| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

পাবলো নেরুদার প্রাচ্যবাসের অভিজ্ঞতা । রাজু আলাউদ্দিন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভারতবর্ষে চাকরিসূত্রে এসেছিলেন। কেউ কেউ নিছক ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতি কৌতূহল থেকেও এসেছিলেন। আমাদের মনে পড়বে ওক্তাবিও পাসের নাম, মনে পড়বে পাবলো নেরুদার নাম। এসেছিলেন হুলিও কোর্তাসারও ১৯৫৯ সালের দিকে। কলকাতা শহরের সাধারণ রাস্তাঘাটের দৃশ্যাবলীর বর্ণনাসহ রয়েছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ লেখাও।

নেরুদা ভারতে এসেছিলেন তিনবার। কেউ কেউ মনে করেন তিনবার এসেছিলেন। প্রথমবার এসেছিলেন রেঙ্গুনে চিলির কনসালের চাকরি নিয়ে। ১৯২৭ সালের অক্টোবরে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৯২৯ সালের শুরু পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাটান। ফুন্দাসিওন পাবলো নেরুদার দেয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি শ্রীলংকা থেকে মাত্র অল্প কয়েক দিনের জন্য ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। জানুয়ারির শুরুর দিকেই তিনি কলকাতা থেকে আবার শ্রীলংকা ফেরেন। এ সফরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘ভারতীয় মহাসভা’র জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে এসে দেখা হয়েছিল মতিলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। দেখেছিলেন সদ্য বিলেত ফেরত জওহরলাল নেহেরুকে। তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘স্বীকার করি বেঁচেছিলাম’ (Confieso Que he vivido : memorias) এ তিনি এর বর্ণনা দিয়েছেন যা ভবানীপ্রসাদ দত্ত অনুদিত ‘অনুসৃতি’ গ্রন্থে বাঙালি পাঠকরা খুঁজে পাবেন। এরপর তিনি আরও একবার ভারতে আসেন ১৯৫০ সালে। প্যারিস থেকে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নেহেরুকে দেয়া জোলিও ক্যুরির একটি চিঠি বয়ে আনার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। অক্টোবরের দিকে তিনি দিল্লিতে এসে নেহেরুর সঙ্গে দেখা করে তাকে সেই চিঠি হস্তান্তর করেন। এ যাত্রার তিনি ১০ দিনের মতো ছিলেন স্বাধীন ভারতে। আরও একবার তিনি ভারতে এসেছিলেন ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে। এই সফরের কথা কোথাও খুব শুনা যায় না। রেুদা নিজেও তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থে এ নিয়ে কিছুই বলেননি। তবে মাহমুদ আল জামান এবং বিষ্ণু দের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায় তিনি কলকাতা এসেছিলেন। ফুন্দাসিওন পালো নেরুদা-এর সঙ্গেও তথ্য মিলে যায়। এ যাত্রায় তার সঙ্গে ছিলেন ব্রাজিলের বিখ্যাত বামপন্থী লেখক জোর্জে আমাদো। এ তৃতীয় সফরে তিনি ভারতের কোন কোন জায়গায় কার কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ অন্য কোথাও- ইংরেজি বা স্প্যানিশে পাওয়া যায় না।

প্রথমবার চাকরিসূত্রে যে- উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল নিয়ে তিনি প্রাচ্যে এসেছিলেন তা দ্রুতই লুপ্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আবহের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে। আত্মজীবনীতে তিনি ‘সিংহল’ অধ্যায়ে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, ‘সাহেব আর হিন্দুদের মাঝখানে পড়ে আমার জীবন হয়ে উঠল দুঃসহ। না পারতাম প্রতি সন্ধ্যায় ডিনার-জ্যাকেট চড়িয়ে ক্লাব আর নাচের আসরে যোগ দিতে, না সইতো হিন্দুদের জাতিভেদের নিয়ম-কানুন। ভয়ানক একাকিত্ব তখন গ্রাস করেছে আমাকে (অনুস্মৃতি, পাবলো নেরুদা, অনু:ভবানীপ্রসাদ দত্ত, একুশে, ঢাকা চতুর্থ সংস্করণ ১৪১১, পৃ. ৯৫)’।

চাকরিসূত্রে যে-ক’টা দিন তিনি এ অঞ্চলে ছিলেন তার বেশিরভাগ সময়ই ছিল একাকিত্বের। এর বর্ণনা ওই অধ্যায়ের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়েই দেখা যাবে। কলোম্বোর ওয়েলাওয়াতিতে থাকার সময়কার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তা বর্ণিত হয়েছে এভাবে : ‘একাকিত্বের যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা- ওয়েলাওয়াতির ওই ক’টা বছরের জীবনেই আমি তা উপলব্ধি করেছিলাম। সঙ্গি বলতে ছিল একটি খাট, একটি টেবিল, দুটি চেয়ার আর আমার কুকুর ও বেজিটি। আর ছিল একজন ভৃত্য- যার নাম ছিল ভ্রাম্পি।

এই নিঃসঙ্গতা আমার কিন্তু কবিতা লেখার কোনো উপাদানই দেয়নি- বরং দিয়েছে বন্দীশালার অসহ্য যন্ত্রণা।’ (H. c„. 96-97)। তিনি যদিও বলেছেন, এ নিঃসঙ্গতা তাকে লেখার কোনো উপাদান দেয়নি। কিন্তু তার লেখার ইতিহাসের ক্রমপঞ্জি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ঘটনা ঠিক উল্টো। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত তার Residencia eu la tierra কাব্যগ্রন্থের বেশকিছু কবিতা লেখা হয়েছিল এই প্রাচ্যবাসের সময়। এটা ঠিক যে প্রাচ্যবাস তার জন্য যত একাকিত্ব ও দুঃসহ যন্ত্রণাই নিয়ে আসুক না কেন, এমনকি নেহেরুর সঙ্গে তার শীতল সাক্ষাৎ, দিল্লীর বিমানবন্দরে পুলিশ ও শুল্ক বিভাগের লোকদের অপমান ও অমর্যাদাকর আচরণ সত্ত্বেও এ সময়ই তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা জন্ম হয়েছিল রেঙ্গুন, শ্রীলংকা এবং কলকাতায়। এছাড়া তার প্রাচ্যদেশীয় রোমান্সের ঘটনা তো আছেই। বার্মিজ রমণী জোসি ব্লিস যাকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, আর আছে ডাচ সেই নারী- মারিয়া আন্তোনিয়েতা হাগেনার- যার সঙ্গে ১৯৩০ সালে বিয়ে হয়, তার সঙ্গেও তিনি পরিচিত হন এই শ্রীলংকার কলোম্বোয়। সুতরাং দুঃসহ একাকিত্বের যন্ত্রণার সঙ্গেই জমজ ভাই-বোনের মতো সৃষ্টিশীলতা ও রোমান্সের উষ্ণ ধারা প্রবহমান ছিলো। সত্য বটে, নেরুদা এ অঞ্চল সম্পর্কে ওক্তাবিত্ত পাসের মতো কৌতূহলী ছিলেন না। পাসের মতো তিনি প্রাচ্যকে আবিষ্কার করতে চাননি। পাসের জীবনে ভারত এনে দিয়েছিল ‘পরিপক্বতা’, অন্যদিকে নেরুদার জীবনে এ পর্বটি ছিল -এরপর ১৩ পাতায়

জানুয়ারির শুরুর দিকেই তিনি কলকাতা থেকে আবার শ্রীলংকা ফেরেন। এ সফরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘ভারতীয় মহাসভা’র জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে এসে দেখা হয়েছিল মতিলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। দেখেছিলেন সদ্য বিলেত ফেরত জওহরলাল নেহেরুকে। তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘স্বীকার করি বেঁচেছিলাম’ (Confieso Que he vivido : memorias) এ তিনি এর বর্ণনা দিয়েছেন যা ভবানীপ্রসাদ দত্ত অনুদিত ‘অনুসৃতি’ গ্রন্থে বাঙালি পাঠকরা খুঁজে পাবেন। এরপর তিনি আরও একবার ভারতে আসেন ১৯৫০ সালে বন্দীত্বের। কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এ বন্দীত্বের মধ্যেই জš§ নিয়েছে কয়েকটি কবিতা, ছোট ছোট কয়েকটি গদ্য, আর আর্হেন্তিনীয় লেখক ও বন্ধু এক্তর এয়ান্দিকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠিগুলো। এছাড়া রয়েছে চিলির লেখক বন্ধু হোসে সান্তোষ গণছালেস বেরা ও মাকে লেখা চিঠিপত্র। ‘অনুস্মৃতি’র বাইরে, উপরোক্ত এসব লেখায় নেরুদার নিঃসঙ্গতার পাশাপাশি দেখতে পাব তার অন্তরঙ্গ উন্মোচন।

১৯২৮ সালের ১১ মে’তে নেরুদা এয়ান্দিকে রেঙ্গুন থেকে এক চিঠিতে তার নিঃসঙ্গতার কথা জানান। রেঙ্গুনে লেখা আরও একটি জার্নাল ধরনের টুকরো গদ্য রয়েছে যার শিরোনাম La nocha del soldado (সৈনিকের রাত), এটি পরে ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘মর্তের বাসিন্দা’ বা Residencia ea la tierra-এর প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যেখানে তার নিঃসঙ্গ অবস্থার পাশাপাশি রয়েছে সেখানকার জীবনশৈলী ও সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর তার পর্যবেক্ষণ।

এর পরের মাসে (জুলাই ১৯২৮) লেখেন তিনি Juntos nosotros (আমরা এক সঙ্গে) শিরোনামে রেঙ্গুনে তার প্রথম কবিতাটি। একই বছরের জুলাই-আগস্টে লেখেন, (Sonata Y Desctrucciones) সোনাটা ও ধ্বংস কবিতাটি।

৬ আগস্ট রেঙ্গুন থেকে চিলির লেখক বন্ধু হোসে সান্তোস গনছালেস বেরাকে লেখেন এক চিঠি যাতে তিনি এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক ধর্মীয় বিশ্বাসের বর্ণনার পাশাপাশি জানাচ্ছেন তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের সম্ভাব্য শিরোনাম- মর্ত্যরে বাসিন্দা।

আগস্ট মাসেই তিনি লেখেন El joven monarca (তরুণ রাজা) নামে একটি কাব্যধর্মী টুকরো গদ্য বা গদ্য কবিতা। এটিও পরে ‘মর্ত্যরে বাসিন্দা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়।

৮ সেপ্টেম্বর এয়ান্দিকে আরেকটি চিঠি লেখেন যেখানে তার ‘মর্ত্যরে বাসিন্দা’ শেষ করে এনেছেন বলে জানিয়েছেন। রেঙ্গুনে পরের মাসেই (অক্টোবর ১৯২৮) লেখেন Diurno Doliente (যন্ত্রণার দিন) নামে একটি কবিতা।সম্ভবত নভেম্বর ডিসেম্বর- দুটো মাসই তিনি কলকাতায় কাটান। কারণ এখানে লেখা তার দুটো বিখ্যাত কবিতার রচনাকাল এবং রচনাস্থান সেই সাক্ষ্যই দেয়। নভেম্বরে লেখেন তিনি Tango del viudo (বিপত্নীকের তাঙ্গো) নামক সেই বিখ্যাত কবিতাটি। যা তার খ্যাতি ও কাব্যকৃতির এক আশ্চর্য নমুনা। এরই ধারাবাহিকতায় লেখেন আরও একটি অসাধারণ কবিতা Arte poetica (শিল্পতত্ত বা কাব্যতত্ত্ব)- যা তার কাব্যকৃতির মূল দর্শনকে তুলে ধরে।

দুটো কবিতাই তার ‘মর্ত্যরে বাসিন্দা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সম্ভবত ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন শ্রীলংকার রাজধানী কলোম্বোয়। এখান থেকে ১৪ মার্চ মাকে এক চিঠিতে তার নিঃসঙ্গ জীবনের কথা জানান। একই সঙ্গে জানান এখানকার পরিবেশ ও জীবনে তার অনুভূতির কথা। প্রাচ্যজীবনের সঙ্গে নেরুদা খাপ খাওয়াতে না পেরে নিঃসঙ্গ ছিলেন বটে, কিন্তু তার সৃষ্টিশীল সত্তা স্তব্ধ ছিল না। একাকিত্ব ও যন্ত্রণা, তার সৃষ্টিশীল সত্তাকে যে গভীরতা ও মুখরতা এনে দিয়েছিল তা নেরুদার কাব্যজীবনের উজ্জল অধ্যায়গুলোর একটি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত