palki lokosangit-irabotee-gitaranga-special

গীতরঙ্গ: যান্ত্রিক সভ্যতায় হারিয়ে গিয়েছে পালকি

Reading Time: 3 minutes

বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা, বউ সাজবে কাল কি, চড়বে সোনার পালকি’। রোকনুজ্জামান খানের এই ছড়াটিতে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালকি সংস্কৃতির কথা মরে করিয়ে দেয়। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন হারিয়ে গেছে গ্রামীন জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি। সাথে সাথে হারিয়ে গেছে পালকিবহর পেশার সাথে জড়িত বেহারা পেশা।

আগের মতো এখন আর পালকির ব্যবহার চোখে পড়ে না। এক সময় গ্রামীন জনপদে বসবাসকারি জনগোষ্ঠির বিয়ে অনুষ্ঠানে এবং আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে স্বাচ্ছন্দে বেড়ানোতে পালকির প্রাধান্য ছিল। বিয়েতে পালকি ছাড়া বিকল্প কোন মাধ্যম ছিল না।

বিয়ে অনুষ্ঠানে পালকিতে চড়ে বর তার বরযাত্রীর বহর নিয়ে কনের বাড়িতে যাত্রা করতেন। কনের বাড়িতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও খাওয়া-দাওয়া শেষে আবারো ওই পালকিতে করে নিয়ে আসতেন নববধূকে। কোন কোন পালকিতে বর ও কনেকে একসাথে বহন করে নিয়ে আসতেন বেহারারা।

বিয়েকে সামনে রেখে বরের বাড়িতে কমপক্ষে দুইদিন আগে আনা হত পালকি। পালকিকে রঙ্গীন কাগজের মাধ্যমে সাজ-সজ্জায় সৌন্দর্য্য মণ্ডিত করে রাখা হতো নববধূ আনার জন্য। বাড়ির আঙ্গিনায় কলাগাছ দিয়ে সাজানো হতো গেট । গেটে রং-বেরঙের কাগজ দিয়ে সাজিয়ে ‘বিয়ে বাড়ি’ লিখে রাখা হতো। কোন কোন এলাকায় দুই-একদিন আগ থেকে বিয়ে বাড়িতে মাইক বাজিয়ে জানান দেওয়া হতো। মাইকের আওয়াজ শুনে এলাকার
যুবক-যুবতীসহ সর্বস্তরের লোকজন জড়ো হয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে উঠতো।

কালের পরিবর্তনে পালকির বিপরীতে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক বিভিন্ন যানবাহন। অতীতে গ্রামীন জনপদে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাড়িতেই সম্পন্ন হতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় ৫০ ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান এখন কমিউনিটি সেন্টার ও অভিজাত চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সম্পন্ন হচ্ছে। বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠানে পালকির কদর কমে যাওয়ায় এ পেশার সাথে জড়িত বেহারা শ্রমিকরা অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

এক সময়ে ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি এখন বিলুপ্তির পথে। সেই সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে এ পেশায় জড়িত সহস্রাধিক বেহারা পরিবার।বর্তমান আধুনিক সভ্য জগতে পালকির প্রচলন আর চোখে পড়ে না। সুবর্ণখালী, দশআনী ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গড়ে উঠা উপজেলার জমিদার, তালুকদার, উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী ও অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সদস্যদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিলো এই পালকি। যারা বহন কাজে নিয়োজিত থাকতো তাদের বলা হতো বেহারা।

বাংলাদেশের পালকিগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। এর গঠন শৈলীতেও রয়েছে ভিন্নতা। কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গান কাঠ প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করতো পালকি। পালকির বহন করার দণ্ডটিকে বাঁট বলে। এ বাঁট তৈরি হতো বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। তখন বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দুদিকে দুটি দরজাও থাকতো।

আয়না পালকির বৈশিষ্ট্য হলো এতে আয়না লাগানো থাকতো। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি বসার জায়গা এবং একটি টেবিলে রাখা হতো। তবে আয়তনের দিক থেকে বলতে গেলে ময়ূরপঙ্খি পালকি সবচেয়ে বড়। এ পালকিটি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি তাকও থাকতো।

পালকি এর ইংরেজি নাম: Palanquin, Litter. এই পালকি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামেও পরিচিত। যেমন: ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে। একসময় রাজা বাদশাহদের রাজত্ব আর তাদের বাহাদুরি শেষ হয়ে যায়। তখন এই ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মঝে এই পালকির প্রচলন শুরু এবং স্থায়ী হয়। পালকির সেই প্রচলন অনেক অনেক বছর পর্যন্ত এদেশের গ্রামবাংলার মানুষের সমাজে স্থায়ী ছিল। আর এই চাকাবিহীন পালকি নিয়ে আমাদের দেশের অনেক কবিগণ ছড়া কবিতাও লিখে গেছেন। যা এখনো ছোটেদের পাঠ্যবইতে ওইসব ছড়া কবিতাগুলো প্রচলিত আছে।

তবে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধই হয়ে যায় বলা চলে। বিশেষ করে ১৯৩০ এর পর থেকে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন শুরু হলে পালকির ব্যবহার উঠে যায়। বর্তমানে আমাদের পালকিকে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই ধরা হয়। বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান এখন হয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে। সভ্যতা এবং বাস্তবতার কথা চিন্তা করলে পালকিকে হয়ত আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

এখন আর আমাদের গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দরে দেখা যায় না পালকি বহনের দৃশ্য। পালকি এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য। পালকির সেই ঐতিহ্যময় ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি নানান রংয়ের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গান।তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে পালকির কথা ভুলে না যায় সেদিকে আমাদের সচেষ্ট দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>