| 16 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস এই দিনে

পালকি পালকি দিন

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আজ ১০ ডিসেম্বর কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাসের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


প্রাচীন রোমে পালকিকে বলা হয়,Lectica ev Sella. সেই সময় সম্ভ্রান্ত পরিবার, উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, ধর্মসংঘের ব্যক্তিবর্গ পালকি ব্যবহার করতেন। তবে ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের পর সেখানে ধর্মশহীদের শোকযাত্রা বা শবযাত্রায় পালকি ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার পরিবর্তে শোক বা শবযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সাদা পোশাকে হেঁটে চার্চ বা গির্জায় প্রবেশ করত।
ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ডে পালকি বাহকদের বলা হয়, চেয়ারম্যান। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরিকে তার পালকিতে বহন করত চারজন শক্ত-সমর্থ চেয়ারম্যান। রানি চেরিওট্টির জন্য ১৭৭৫ বাকিংহাম প্যালেসে নির্মিত হয় বিশেষ পালকি, যার ডিজাইনার ছিলেন রবার্ট এডাম। রানি চেরিওট্টি (Chariotti) রাজা তৃতীয় জর্জের পরিণীতা এবং ডাচ রাজকন্যা ছিলেন। উনিশ শতকের গ্রেট ব্রিটেনে পালকি বা Sedanchair সাধারণ মানুষের জন্য একেবারে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
এদিকে পর্তুগিজ শব্দ palanquim এসেছে মালে বা জাভা Palangki থেকে যার মূল নিহিত রয়েছে ইন্দো-আর্য শব্দের মধ্যে। সংস্কৃত শব্দটির অর্থ হলো বিছানা বা খাটিয়া, যা বাংলায় হয়েছে পালকি। ধারণা করা হয় যে, এর সাথে মানুষের প্রথম পরিচয় ঘটে পনেরো শতকের গোড়ার দিকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে যুদ্ধক্ষেত্রে ডোল নামে ব্যবহৃত হতো পালকি। ক্রমে এটি ভারতে অভিজাত শ্রেণীর আভিজাত্যের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
তবে এ কথা সত্যি যে, আর্থিক সঙ্গতি আর অভিজাত্যের অংশ হিসেবে এক সময় পালকির গুরুত্ব ছিল। পালকি এখনও তাই আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ও সংরক্ষিত- মিউজিয়াম অথবা জমিদারদের বিশেষ কক্ষে। আর বেহারাদের খবর কেউ রাখেনি। না রাখুক, তবে আভিজাত্যের ছাপ অঙ্গে নিয়ে অভিজাত নারীকে বিশেষ মর্যাদায় বহন করত যে পালকি, তার বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে জানান, ‘কেশব সেনের ইদিলপুর-লিপিতে দেখিতেছি একটু প্রচ্ছন্নভাবে হস্তদন্ত নির্মিত বাহদ যুক্ত পালকির উল্লেখ। বল্লাল সেন নাকি তাঁহার শত্রুদের রাজলক্ষ্মীদিগকে বন্দী করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন। এই ধরনের পালকি চড়াইয়া।’
সমসাময়িক স্মৃতি বা পুরাণে ডোলবাহী বা দুলিয়া নামের শ্রমিক সেবকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং ঐতরেয় পুরাণে ডোলবাহী বা দুলিয়াদের অসৎশূদ্রের নিম্নস্তরে গণনা করা হয়েছে। এর অর্থই হলো, সেই সময়কার গ্রামীণ সমাজে পালকি বাহক বা দুলিয়াদের প্রয়োজন ছিল পালকি বহন করার জন্য। তবে পালকি আর ডোলের মধ্যে পার্থক্য আছে। পালকি ডোলেরই আধুনিক সংস্করণ। তার আগে আহত সৈন্য কিংবা অসুস্থ ব্যক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য পালকিসদৃশ খোলা ডোল ব্যবহার করা হতো।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আর্যপূর্ব যুগে অর্থাৎ মহাভারতের যুগেও পশুচালিত রথের দেখা মেলে, সেও তো খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছর আগে। আর্যিকরণের পর আর্যকর্তৃক বিজিত ভূমিজরা (যাদের তারা- দস্যু অসুর বল) নিয়োজিত হলো তাদের সেবাদাসে। এসব সেবাদাসের মধ্যে ডোলবাহী বা দুলিয়ারা অন্যতম। ভারতের অস্ট্রিকভাষী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন ডোলের উপস্থিতি ছিল যাকে তারা ডুলি বলে। ডুলি হলো বাঁশে ঝোলানো আদিম খাটিয়া পালকি।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই এখানে রাজতন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাষ্ট্র বা নগরায়নের মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটে নানা ধরনের স্থলযান- অশ্ব, হস্তি ও গো-যান এমনকি পালকি। পালকি ছাড়া রাজমহিষী ও রাজমাতার আভিজাত্য কল্পনা করা যায় না। বাৎসায়ন রচনায় অভিজাত পরিবারের নারীদের পর্দাপ্রথা মানার কথা জানা যায় এতে অনুমান করা যায় যে, সে সময় নারীদের বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পালকি বা ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সরকারি কর্মচারীদের যে তালিকা আছে তার ১১তম ধাপে আছে- ‘চতুষ্পদ প্রাণীর পরিচারক, মানুষ বা পাখি প্রভৃতি দ্বিপদ প্রাণীর পরিচারক, প্রসাধন ব্যাপারে নিযুক্ত ভৃত্য, শরীর পরিচায়ক, সেবারত পুরুষ, গবাদি পশুর পালক ও মজুর সংগ্রাহকদের তালিকা যারা বছরে ৬০ পণ করে বেতন পেত। আর কুমারমাতা এবং অন্যান্য রাজমহিষীগণ ৩য় ধাপে বেতন পেতেন।’ অতএব দেখা যাচ্ছে যে, রাজপরিবারের নারীরাও সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে ধর্মানুষ্ঠানেই হোক কিংবা অন্য যে কোনো উপলক্ষেই হোক, একটা যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব কারও না কারও ওপর বর্তাতো আর সে দায়িত্ব পালন করত ১১তম ধাপের কর্মচারীরা।
পালকি ও পালকি বাহকদের প্রাচীনত্ব প্রামাণের জন্য ‘বিক্রমাদিত্যের কালিদাস আবিষ্কার’ গল্পটির অবতারণা অযৌক্তিক হবে না। এ গল্পটি আমি শুনেছি ড. রণজিৎ বিশ্বাসের কাছ থেকে। গল্পটির অবতারণা করেছিলেন তিনি- কালিদাসের পাণ্ডিত্য এবং পণ্ডিত ব্যক্তির প্রতি রাজার শ্রদ্ধা ও বিনয় সম্পর্কে তৎকালীন সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনামূলক চিত্র বোঝানোর জন্য। আর এখন এ প্রসঙ্গটি পালকির উপস্থিতি বা পালকির কাল নির্ণয়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। গল্পটি এরূপ- “একটি গাছতলায় এক লোক বসে ছিল। কৌপিন বা নেংটি পরা লোকটির ধূলিমাখা মলিন শরীর। ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য। তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল ষোলো বেহারার পালকি। রাজকীয় পালকিতে চড়ে যাচ্ছেন রাজা বিক্রমাদিত্য। হঠাৎ বেহারাদের একজন কৌপিন পরা লোকটিকে দেখে বলল- ‘এই ব্যাটা কাঁধ লাগা’।
কৌপিন পরা লোকটি ভাবল- রাজার পালকি, কাঁধ না লাগিয়ে উপায় কী!
সে কাঁধ লাগাল। কিন্তু কাঁধ লাগাতে গিয়ে পালকিখানা একটু নড়ে উঠল- এটাই স্বাভাবিক। তখন পালকির মধ্য থেকে রাজা বললেন-
‘ক্ষণং বিশ্রাম্যতাং জাল্ম যদিতে বাধতি স্কন্ধে।’
এ কথা শুনে কৌপিন পরা লোকটি বলল-
“নঃ বাধতে স্কন্ধে তথা যথা ‘বাধতি’ বাধতে”
অর্থাৎ আমার কাঁধে তত লাগছে না যত লাগছে ‘বাধতি’ শব্দটি। এ কথা শুনে রাজা পালকি থেকে নেমে কালিদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাজার কথার ভুল ধরার পরেও রাজার জ্ঞানীর প্রতি এই বিনয়- এখন আর দেখা যায় না।
এই গল্পের চরিত্র দুটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। তাই এদের আবির্ভাবকাল শনাক্ত করলে- পালকির অস্তিত্বের সময় নির্ণয় সম্ভব হয়।
গল্পের দুটি বিখ্যাত চরিত্র রাজা বিক্রমাদিত্য ও কালিদাসের কাল নির্ণয় নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ইতিহাসের বিক্রমাদিত্য গুপ্ত যুগের রাজা। গুপ্ত যুগের সময়কাল ৩০০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ। অন্যদিকে ভবিষ্যপুরাণের বিক্রমাদিত্য হলেন গান্ধর্বসেনার পুত্র। ইনি উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন। বলা হয় যে, তার জন্মের সময় দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন। এই রাজার রাজদরবার যে নয়জন পণ্ডিত অলঙ্কৃত করেছিলেন, তাদের মধ্যে- ধন্বন্তরি, অমরসিংহ, বেতালভট্ট, ভারুচি, বরাহমিহির প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে কালিদাসের নামও উচ্চারিত হয়।
ভবিষ্যপুরাণকে আদর্শ ধরলে বিক্রমাদিত্যের সময় দাঁড়ায় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৩৫০ এর মধ্যে। এ সময়ই নানা রকম পুরাণ এমন কি রামায়ণের সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিক্রমাদিত্য বা কালিদাসের গল্পের পালকির উপস্থিতি আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ, ভারত উপমহাদেশে পালকি নামক বাহনটির ইতিহাস অনেক বেশি পুরনো। পুরাণে ডোলবাহী বা দুলেদের উপস্থিতিও সেই সত্যের প্রমাণ দেয়।
প্রাচীন বাংলার শাসন কাজের গুরুত্বের কারণেই স্থাপিত হয় নগর ও নগর প্রশাসন। রাজা, মহারাজা, সামন্তগণ ছিলেন নগরবাসী, এ ছাড়া ধমর্ ও শিক্ষাগুরু, আচার্য পুরোহিত, ছাত্র, শিষ্যও ছিলেন নগরবাসী; কিন্তু নগরের বাইরে যেসব ম্লেচ্ছ ও অন্ত্যজ পর্যায়ের সমাজসেবক যেমন : ডোম, চণ্ডাল, ডোলবাহী চর্মকার, মাংসছেদক ইত্যাদি- এরা নাগরিক হিসেবে গণ্য হতো না।
নগর সভ্যতার উন্মেষের সময় থেকেই পালকির অল্পবিস্তর চল শুরু হয়েছিল। প্রাচীন পুরাণকে প্রমাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনায় আনলে এর কাল নির্দেশিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১০০০ অব্দ। এরপর ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের আভিজাত্যের অংশ হিসেবে পালকি তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নিজে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।
সংস্কৃত শব্দ ‘পল্যঙ্কিকা’ থেকে পালকি শব্দটি এসেছে বলে গবেষকগণ মনে করেন।
পল্যঙ্কিকা>পাল্যাস্ককা>পল্যঙ>পালকি।
এ প্রসঙ্গে ড. প্রবালকান্তি হাজরা বলেন, “শব্দবিজ্ঞানীদের মতে সংস্কৃত ‘পল্যঙ্কিকা’ থেকে পালকি কথাটি এসেছে। কারও মতে পাল্যাঙ্ককা বা পাল্যঙ্ক থেকে এই শব্দটি পেয়েছি। পালকির সমগোত্রীয় মানুষ্য বহনের যান হলো আঞ্জাম, কান্তি, ডান্ডি।” সাঁওতালী ভাষার সাথে বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠতা যাচাই করতে গিয়ে পালকি শব্দটিকে সরাসরি সাঁওতালী শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন ক্ষুদিরাম দাশ তার সাঁওতালী বাংলা সমশব্দ অভিধানে। নৃতাত্তি্বক অনুসন্ধানে জানা যায়, বাঁশে ঝোলানো কাপড় দিয়ে ঘেরা বাহনকে সাঁওতালী ভাষায় ডুলি বলে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বাহনটি আর্যপূর্ব যুগ থেকেই এদেশে ছিল।
অবস্থা এবং আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে পালকিও তৈরি করা হতো নানা রকমভাবে। এগুলো আবার নানা নামে পরিচিত ছিল- রাজপঙ্খী, ময়ূরপঙ্খী, আয়নাপালকি ইত্যাদি। বাংলাপিডিয়ায় তিন প্রকার পালকির উল্লেখ আছে- সাধারণ পালকি, আয়ন পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি। ‘সাধারণ পালকি আয়তকার চারদিক কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছন্দ ঢালু। এর দু’দিকে দুটি দরজার থাকে। কোনো কোনোটিতে জানালাও থাকে। পালকির বাইরের দিকে আলপনা আঁকা থাকে।’৪ সাধারণ পালকি মূলত- সাধারণ মানুষের জন্য নির্ধারিত।
‘আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। ভিতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে।’ আয়না পালকির আয়নাই প্রধান অনুষঙ্গ।
‘ময়ূরপঙ্খী’ পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়। এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়, ভেতরের দুটি চেয়ার। একটি টেবিল ও তাক থাকে। এ পালকির বাঁটটি বাঁকানো এবং এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল, তালপাতার নকশা থাকে।’ সাধারণত জমিদারগণ এই ধরনের পালকি ব্যবহার করতেন।
ময়ূরপঙ্খীর মতো রাজপঙ্খীর আকৃতি বড়। ভেতরে দুটি সুদৃশ্য চেয়ার, একটি কারুকার্যময় টেবিল ও তাক থাকে। এর বাঁট বা ডাফ এ ধাতু, পাথর ও মণিমুক্তার কারুকাজ, সিলিংয়ে নকশা, দেয়ালেও খোদাই করা বিচিত্র নকশার সমাহার। মূলত রাজপরিবারেই এই পালকি ব্যবহৃত হতো।
এ ছাড়া ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে স্টেজ পালকি নামে একধরনের পালকির প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ডাক বিভাগ- ডাক ও যাত্রী বহনের জন্য স্টেজ পালকি চালু করে। দূরের যাত্রীরা ডাকঘর থেকে স্টেজ পালকির টিকিট সংগ্রহ করত।”
পালকিবাহক হতো চারজন। আট ও ষোল বেহারার পালকিও ছিল। রানী রাসমণির পালকি ছিল আট বেহারার জানান লোহাগড়ার বেহারাপাড়ার বেহারারা। আবার রানী রাসমণির খাজনা আদায়কারী চৌধুরীদের পালকি ছিল চার বেহারার। ড. প্রবালকান্তি হাজরা বলেন- “পালকিতে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যেতে তখন দশ পনেরো ক্রোশ (২৫-৩০ কি.মি.) বা তারও বেশি পথ চলতে হতো। এতটা পথ চলায় যথেষ্ট কষ্ট ছিল। তাই পথের কষ্ট লাঘবের জন্য বেহারারা (পালকিবাহক) মুখে মুখে একরকম ছড়া কেটে আনন্দে পথ চলতো। এগুলোকে পালকির গান বলা হতো। এগুলি একধরনের শ্রম-সঙ্গীত। চার পালকি বাহকের মধ্যে একজনই (প্রথমজন) গানের কথা ও সুর ধরে। অন্যেরা কেবল ধুয়ো ধরে গানের সুরকে ধরে রাখে। গান শুরু হয় ধীর তালে। ক্রমে তার তাল বা লয় বাড়ে। বাড়ে চলার গতি। এক সময় গানের লয় বাড়তে বাড়তে আবার ধীরগতিতে নেমে আসে। চলায় গতি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে গানের গতিও কমে বাড়ে। এসব গান মুখে মুখে বা তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হয়। কথায় থাকে- প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনা, পথের ধারে দেখা ক্ষণিক দৃশ্য, পথের প্রতিবন্ধকতা সুখ-দুঃখের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা- কখনো বা আদি রসাত্মক কথা। কথায় ও শব্দের মধ্যে পারম্পার্য থাকবে, এমন কথা নেই। কখনও তা অসংলগ্ন, কখনও বা কথার খেই ধরে রাখার জন্য মনে যা আসে তা বলা হয়। তাই পালকির গান শুনতে গেলে কথার যথার্থ মানে বা ভাব খোঁজা নিরর্থক।”
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘পাঁচজন ঠিকা বেহারার একদিনের ভাড়া ছিল এক টাকা। আর অর্ধদিবসের জন্য আট আনা। কলকাতার বাইরে পাঁচ মাইল পর্যন্ত যেতে পালকি ভাড়া হতো চার আনা হিসেবে। এক ঘণ্টার কম সময়ের জন্য যাত্রীরা এক আনা হিসেবে ভাড়া দিত। এ প্রসঙ্গে ড. হাজরা জানান, “… পাঁচজন ঠিকা বেয়ারার একদিনের ভাড়া ছিল এক টাকা (১৭৯৪ খ্রি.) অর্ধদিবসের জন্য আট আনা। কলকাতার বাইরে পাঁচ মাইল যেতে পালকির ভাড়া গুনতে হতো চার আনা হিসেবে। এক ঘণ্টার কম সময়ের জন্য যাত্রীদের এক আনা হিসেবে ভাড়া দিতে হতো।” এই ভাড়া সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হতো না। ফলে পালকিতে চড়ার অধিকার কেবল বিত্তবানদেরই ছিল।
বেহারাদের সেই সময় রমরমা অবস্থা। তারা রীতিমতো যাত্রীদের সাথে দরদাম কষে লাভের হিসাব বুঝে নিয়েই পালকি বইতো। ইংরেজদের বিষয়টা ভালো লাগেনি। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, পালকিবাহকদের ক্ষেত্রেও দর দামটা বেঁধে দেওয়া যাক। আইন হলো। আইন জারি করে জানানো হলো যে, প্রত্যেক বেহারাকে পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে আর মজুরি নিতে হবে ঘণ্টানুযায়ী। প্রত্যেক বেহারাকে পরতে হবে সংখ্যা জ্ঞাপক চাকতি। এই নিয়মে দেখা গেল বেহারাদের মজুরি আগের তুলনায় কমে গেছে। শুরু হলো আন্দোলন। পালকিবাহকদের ধর্মঘট। নিম্নশ্রেণীর নিম্ন আয়ের এই শ্রমিকদের বড় অংশ একত্রে জড়ো হয়ে সভা ডাকল। সেই সভায় পালকিবাহক পাঁচু সুর ছিলেন সভাপতি, আর প্রধান বক্তা ছিলেন গঙ্গাহরি। গঙ্গাহরির বক্তব্য ছিল- তারা ইংরেজ সরকারের এই আইন কিছুতেই মানবেন না। সভায় ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান, নৌকার মাঝিদের মধ্য থেকেও দু’জন করে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন যে, ইংরেজ সরকার তাদের ভাড়ায়ও হস্তক্ষেপ করতে পারে তাই তারা বেহারাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন। ড. হাজরা জানান, ‘১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ মে সরকার এক আইকার করে জানায়, প্রত্যেক পাল্কী বেহারাকে পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে; প্রত্যেককে সংখ্যা নির্দেশক চাকতি পরতে হবে। আর ঘণ্টা অনুযায়ী মজুরি নিতে হবে। আইনের অন্য বিষয় মানায় বেহারাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু মজুরি কমে যাওয়ায় শুরু হলো আন্দোলন। পাল্কী বেহারাদের বেশির ভাগই ছিলো গরিব উড়িয়া। তাঁদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে সরকারি আইন তাদের ক্ষুব্ধ করে তুললো।”
বেহারাগণ ইংরেজ সরকারকে লিখিতভাবে আবেদন জানাল, কিন্তু এতে কোনো ফল হলো না। ইংরেজরা তাদের আবেদন উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল রইল। ফলে কয়েক হাজার বেহারা রাস্তায় নেমে এলো, মিছিল নিয়ে তারা লাল বাজারের পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করল। বিক্ষোভ হলো সুপ্রিম কোর্টের সামনে। এই ঘটনা তখন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল।
সংবাদপত্রে বলা হয়েছিল-
“Yesterday [21st instant] all the Theeka Bearers of Calcatta had formed themselves into a body and unanimously swore that they would not bear palan keens untill the new Regulaiton Promulgaled for licensing then, be abolished and that those who would disregard this agreement should be excommunicalted from the community forfeiting their caste.
পালকিবাহকের ধর্মঘট প্রায় ১ মাস স্থায়ী হয়েছিল। এই ধর্মঘট ইংরেজ প্রশাসন ও অভিজাত লোকেরা বেশ বিপাকে পড়েছিল। অবশেষে পালকিবাহকদের দাবির কাছে ইংরেজ সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়। এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ‘সমাচার দর্পণ’ একটি রম্য সংবাদ প্রকাশ করেছিল- “সে যে হউক বেয়ারারা ‘চলিয়া’ গিয়াছে হইতে পারে যে তাহারা শ্রীক্ষেত্র দর্শনে গিয়াছে। সম্প্রতি রথযাত্রা উপস্থিত ভরসা হয় যে একবার রথ টানিয়া পুনর্বার পাল্কী বহিবেন। ইতোমধ্যে কলিকাতা নগরের ঘোড়া সকল পাল্কী বেয়ারা হইয়াছে এবং বোধ হয় যে দুই তিন হ্নার মধ্যে ঘোড়াদের সভা হইয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত হইবেক।”
ড. হাজরা জানান- “পাল্কী বেহারাদের আকস্মিক ধর্মঘট ইংরেজ প্রশাসনসহ শহরের অভিজাত লোকেরাও বিপদে পড়েছিল। প্রায় একমাস চলেছিল এই ধর্মঘট। শেষে বাধ্য হয়ে সরকার পাল্কী বেহারাদের দাবি মেনে নিলে ধর্মঘটের অবসান ঘটে। এটি শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত ধর্মঘট হলেও, এটিকে ভাঙার জন্য ইংরেজ সরকার নানা হীন কৌশল গ্রহণ করেছিল- যা তাদের শয়তানি বুদ্ধির ঐতিহ্যকে মনে করায়।”
আর এভাবে নিম্নশ্রেণীর পালকিবাহকেরা ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় বটে কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে ওঠে না। ফলে কাঠের তৈরি একটি পালকি মিউজিয়ামে ঠাঁই পেলেও পালকি বহনকারী মানুষগুলোর কোথাও ঠাঁই নেই- না ইতিহাসে_না সমাজে! পালকি নিয়ে- বেহারাদের ধর্মঘট এবং ইংরেজদের বাড়াবাড়ি যেমন হয়েছিল তেমনি পালকির ব্যবহারের আধিক্যের কারণে ইংরেজ বণিকদের অবৈধ আয় ঠেকাতে সরকারকে প্রণয়ন করতে হয়েছিল বিশেষ আইন। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম জানান- “বাংলার সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় বণিকরা হাটে বাজারে যাতায়াত এবং তাদের মালপত্র বহনের জন্য পাল্কী ব্যবহার করত। তারা পাল্কী ব্যবহারের এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে, কোম্পানির একজন স্বল্প বেতনের সাধারণ কর্মচারীও এদেশে যাতায়াতের জন্য একটি পাল্কী রাখত ও তার ব্যয়ভার বহন করত। কিন্তু পাল্কীর ব্যয় বহন করতে গিয়ে কর্মচারীরা অবৈধ আয়ের নানাবিধ খারাপ পন্থা অবলম্বন করতে থাকে। ফলে কোর্ট অব ডিরেক্টরস ১৭৫৮ সালে সাধারণ কর্মচারীদের পাল্কী ক্রয় ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।” এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একসময় পালকি ও পালকিবাহকদের ওপর এদেশে প্রচুর প্রভাব ছিল। যদিও বেহারাদের সেই প্রভাব স্থায়ী হয়নি। তবু পালকি ঠিকই তার আভিজাত্য নিয়ে জাদুঘরের মর্যাদা ও শোভা বাড়াচ্ছে এখনও।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত