| 12 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
এই দিনে সাক্ষাৎকার

আমার কোনও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিশ্বাসও নেইঃ ওরহান পামুক

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আজ ৭ জুন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

।।ভাষান্তর এমদাদ রহমান।।

ওরহান পামুক ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ‘মাই নেইম ইজ রেড’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ডাবলিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পদক। তার কাজগুলি ষাটটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ইস্তানবুলে বসবাস করেন।

ওরহান পামুকের জন্ম ১৯৫২ সালে, তুরস্কে। তিনি তুরস্কের অন্যতম প্রধান লেখক। ‘দ্য হোয়াইট ক্যাসল’, ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’, ;’দ্য নিউ লাইফ’, ‘মাই নেইম ইজ রেড’, ‘স্নো’, ‘দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’ ইত্যাদি তার প্রখ্যাত উপন্যাস। তার স্মৃতিকথা ‘ইস্তানবুল : মেমোরিস অব অ্যা সিটি’ বইটিকে সমালোচকেরা ইতালো কালভিনো’র ‘অলক্ষ্য জনপদ’ বইটির সঙ্গে তুলনা করেন। সাক্ষাৎকারটি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর। ভাষান্তর : এমদাদ রহমান।

——————————————
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
রাতে পড়ার জন্য টেবিলে কোন বইগুলি গুছিয়ে রেখেছেন?

ওরহান পামুক :
ফেরদৌসী’র ‘শাহনামা’র ডিক ডেভিস কর্তৃক অনূদিত একটি সংকলনের একটি প্যাঙ্গুইন ক্ল্যাসিক এডিশন, যার উপশিরোনাম- ‘দ্য পার্সিয়ান বুক অব কিংস’। রুমি’র ‘মসনবি’ কিংবা ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র মতো ‘শাহনামা’ হচ্ছে গল্পের মহাসমুদ্র। বইটির বেশ কয়েকটি তুর্কি ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে সে মহাসমুদ্র মন্থন করে প্রাচীন গল্পগুলি থেকে রসদ নিয়ে নিয়ে আমি ‘মাই নেইম ইজ রেড’ এবং ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ বই দুটি লিখেছি। প্রাচীন এই মহাকাব্যের মর্মে নিহিত হয়ে আছে বীর সোহরাবের পিতাকে অনুসন্ধান; যার পিতা মহাবীর রুস্তম; যুদ্ধে সোহরাবকে তার পিতাই হত্যা করে ফেলে এটা না জেনেই যে সোহারাব তারই পুত্র!
পার্সিয়ান-অটোম্যান-মুঘল সাহিত্যের এই গভীর ট্র্যাজিক কাহিনীর ধারাপ্রবাহ ওয়েস্টার্ন সাহিত্য ধারার ওডিপাসের কিংবদন্তির সঙ্গে বহুলাংশে মিল পাওয়া যায়। এই গল্পগুলি এখন যেন একজন পশিমা ফ্রয়েডের অপেক্ষা করছে যিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্যের মিল এবং মৌলিক ভিন্নতাগুলি খুঁড়ে খুঁড়ে তার মতো ব্যাখ্যা করবেন! তুলনামুলক সাহিত্য ‘সভ্যতার দ্বন্দ’ এই বিশেষ কথাটির মাধ্যমেই যেন পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কে আমাদেরকে জ্ঞান দান করছে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন?

ওরহান পামুক :
সত্যিকার অর্থেই শ্রেষ্ঠ বই বলতে সব সময়ই উপন্যাস- ‘আনা কারেনিনা’, ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজোভ’, ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’… আর এখন ফেরদৌসী’র ‘শাহনামা’; জীবনের বিভিন্ন সময়পর্বে আমি এই বইগুলিকে উল্টেপাল্টে দেখে বারবার উপলব্ধি করতে চাই- কীভাবে একটি মহৎ সাহিত্যকর্ম আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়াতে গেলেও বইগুলিকে বারবার পড়তে হয়।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
এপর্যন্ত পঠিত সবচেয়ে জঘন্য বই কোনটি?

ওরহান পামুক :
বাজে উপন্যাসগুলিই আসলে নিকৃষ্ট বই। যেভাবে ভাল উপন্যাসগুলি বেঁচে থাকার আনন্দ দিতে পারে ঠিক একইভাবে বাজে উপন্যাসগুলি কেমন জানি বিষাদগ্রস্ত করে ফেলে; আর বিষাদজনিত অনুভূতিটি প্রকট হয়ে ওঠে ঠিক যে পৃষ্ঠাটিতে গিয়ে পড়াটা থেমে যায়- সেখান থেকে। সিনেমা বাজে হবে বুঝতে পারলে আমি হল থেকে সোজা বের হয়ে পড়ি। আমাদের জীবনটা খুব ছোট। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
কোন ধরণের বই পাঠে আপনার ভেতর অপরাধবোধ জেগে ওঠে?

ওরহান পামুক :
দীর্ঘদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছে যে থ্রিলার এবং ডিটেক্টিভ উপন্যাস পড়া সময়ের করুণ অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, আর ঠিক কারণেই প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথের উপন্যাস পড়তে গেলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। পরে অবশ্য এটা উপলব্ধি করেছি যে, নিজেকে অপরাধী মনে করার অনুভবটা আসলে থ্রিলার পড়া থেকে আসেনি, এসেছে খুনির সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবার লেখিকার এক বিশেষ উদ্ভাবনকুশল থেকে। প্যাট্রিসিয়া দস্তইয়েভস্কি-ঘরানার বড় লেখক। জন লী ক্যারে’র বহু লেখা আছে পড়বার মতো, সেগুলি একটু একটু করে পড়ে ফেলব। নেটে খুব বেশি পরিমাণ ‘বুক-চ্যাট’ করলেও নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
শেষ কোন বইটি খুব হাসিয়েছে?

ওরহান পামুক :
ওয়াইল্ড সব সময়ই আমাকে হাসিয়ে মারেন- শ্রদ্ধা ও বিস্ময় প্রকাশ করেই বলছি। তার ছোটোগল্পগুলি প্রমাণ করে যে- লেখা ও লেখক উভয়েই শ্লেষাত্মক, এমনকি নৈরাশ্যবাদীও; কিন্তু অত্যন্ত গভীর এক মায়া যেন! বুকশপে ওয়াইল্ডের কোনও একটি বইয়ের কভার দেখেই আমার হাসি পেয়েছিল। জুলিয়ান বার্নের লেখায় কিছু নিষ্ঠুর আর কোমল ব্যাপার আছে। আমি বার্নের ‘দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং’ উপন্যাসখানি পছন্দ করি।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
শেষ কোন বইটি আপনাকে ক্রুদ্ধ করেছিল?

ওরহান পামুক :
অ্যাডাম হসচাইল্ডের ‘কিং লিওপোল্ড’স ঘোস্ট’ বইটি হচ্ছে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড-এর সংগঠিত নৃশংসতার বয়ান; দাসত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে লিওপোল্ডের আর্মি ও তার লোকজন ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কঙ্গো-কে লুটপাট। আজ আমরা সকলেই জানি- ‘সিভিলাইজেশন’, ‘মর্ডানাইজেশন’ শব্দগুলি গণহত্যার দায় থেকে অব্যাহতির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ। এই মহৎ বইখানি যে কাউকেই ক্রুদ্ধ করবে, বিশেষকরে সেই পাঠকদেরকে যারা ইউরোপ সম্পর্কে খুব ভাল জানে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
আমেরিকার প্রেসিডেন্টেকে একটি যেকোনও একটি বই পড়ার জন্য বলতে হলে কোন বইটির নাম বলবেন? তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর জন্য?

ওরহান পামুক :
প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বেশ আগে থেকেই বারাক ওবামাকে ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’ বইটির লেখক হিসেবে জানতাম। বইটি খুবই ভাল। এখন তাঁকে কিংবা আমেরিকার আর কোনও প্রেসিডেন্টকে আমি যে-বইটি পড়ার জন্য বলব সে-বইটি আমি আমার বন্ধুদেরকেও উপহার দিয়েছি; আশা করছি প্রেসিডেন্টও বইটি পড়বেন, তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করবেন- ‘এই বইটি কেন পড়তে দিলে, ওরহান?’ ‘জেন এন্ড দ্য আর্ট অব মোটরসাইকেল মেইন্টেনেন্স : অ্যান ইঙ্কুয়ারি ইনটু ভ্যালুজ’ হচ্ছে আমেরিকার একটি শ্রেষ্ঠ বই যা আসলে- আমেরিকার বিশাল বিস্তৃতি, জীবন ও মূল্যবোধের এক গভীর অনুসন্ধান। রোম্যান্টিক এই বইটি উপন্যাস নয় কিন্তু এমন কিছু ব্যাপার বইটিতে এসে গেছে যা কেবলমাত্র উপন্যাসেই সম্ভব, এবং বহু মহৎ উপন্যাসের চেয়েও এই বইটি উৎকৃষ্ট; দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটির ভেতর থেকে জীবন-দর্শনের অনুসন্ধান।
রাজনীতি থেকে আর্মিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, তাদেরকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর পলিসিকে আমি সম্মান করি, যদিও তার সময়কালে, আমার মতো অনেকের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কারণে আদালতে হাজিরা দেওয়ার ব্যাপারটি আমাকে আনন্দিত করতে পারে না। তাঁকে বিড়ালের মতো করে আঁকার কারণে এক কার্টুনিস্টকে তিনি অভিযুক্ত করেছেন। যারা ইস্তানবুল-এ আসেন, তারা সকলেই জানেন যে- ইস্তানবুলে আমরা বিড়াল পছন্দ করি। আমি নিশ্চিত ‘এরদোগান’ জাপানের মহান লেখক নাতসুমে সোসেকি’র ‘আমি একটি বিড়াল’ বইটি উপভোগ করবেন, বিদ্রূপাত্মক এই উপন্যাসটিতে অতিমাত্রার পশ্চিমীকরণের বিপদগুলিকে বিড়ালের মুখ দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে!

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
কুর্দি আর আর্মেনিয়দের গণহত্যার ব্যাপারে কথা বলা এবং তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হওয়া নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবার জন্য আপনাকে বিভিন্ন সময়েই অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি কি একজন সাধারণ নাগরিক হয়েই জীবন কাটাবেন, না কি- লেখক হিসেবে ‘সোস্যাল এক্টিভিজম’-কে আপনার দায়িত্ব বলে মনে করছেন?

ওরহান পামুক :
জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আমি নানাধরণের কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষ, অর্থাৎ- নাগরিক। আমার কোনও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিশ্বাসও নেই কিংবা আমি একজন স্ব-সচেতন রাজনৈতিক লেখকও নই। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত আমার উপন্যাসগুলিকে হয়ত রাজনৈতিক বলা যায়, কারণ- আমার চরিত্ররা অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়ে আছে। আমি আমার পাঠকদের দেখাতে পছন্দ করি- নিজেদের জন্য যা ভাল তাই যেন তারা বেছে নেয়; আর এটাই ‘ফিকশনে’ রাজনীতি সম্পর্কে আমার একমাত্র সাহিত্যিক পন্থা।
আমি কখনোই ‘পলিটিক্যাল আইডিয়া’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হইনি। আমি আগ্রহী থেকেছি মানুষ যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে এবং তাদের মজাদার সব অভিজ্ঞতার প্রতি, গল্পের প্রতি। তুরস্কে আমি যেসব রাজনৈতিক সমস্যায় পড়েছি সেগুলির সব কিন্তু উপন্যাসের জন্য নয়, দেশের বাইরে আমি যে সাক্ষাৎকারগুলি দিয়েছি সেগুলির জন্যে। বিদেশে আমি যা কিছু বলেছি দেশে সেই কথাগুলিকে প্যাঁচিয়ে ভিন্ন অর্থ করা হয়েছে; কথাগুলিকে ঘুরিয়ে এমনভাবে বদলানো হয়েছে যে আমি নিজেই তা দেখে বোকা হয়ে গেছি। আমাকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়েছে, বদলে দেওয়ার ফলে সবকিছুই আমার বিশ্বাসের চেয়েও অনেক বেশি ‘পলিটিক্যাল’ হয়ে গেছে!
তরুণ লেখক পল ওস্টারকে–যার লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি–ওসলো’য় তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেখানে সে তার একটি বইয়ের প্রচারণার কাজে গিয়েছিল; পল সেখানে সাক্ষাতকারীর মুখোমুখি হয়, আমার মতো; তাকে আমার সমস্যার কথা বলেছিলাম। কথা শুনে সে জানায়- সাক্ষাৎকারীরা সব সময়ই তাকে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করেন। তবে আমেরিকান লেখক হবার কারণে পলের কাছে ব্যাপারটা এতোটা জটিল নয়। সে বলেছিল সাক্ষাতকারীরা ‘উপসাগরীয় যুদ্ধ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে সবচে বেশি। সেই প্রথম ‘উপসাগরীয় যুদ্ধ! এর মধ্যে বিশটি বছর কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এখান থেকেই আমি সম্ভবত শিখেছিলাম- লেখকদের ভাগ্যই হচ্ছে রাজনৈতিক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া।
এই পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তির পথ হলো- কিছুটা রাজনীতি ঘনিষ্ঠ হওয়া–কূটনীতিকদের মতো–আর কেবল সাহিত্য সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া। কিন্তু আমি তো কোনোভাবেই সফল কূটনীতিক চরিত্রের লোক না। সাক্ষাৎকার প্রদানকালে আমি মেজাজের দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলি, যা শেষ হয় আদালতের কাঠগড়ায়; তুরস্কের ডানপন্থী-সংবাদমাধ্যমের প্রচার প্রোপ্যাগান্ডার মুখোমুখি হয়ে। উপন্যাসও রাজনৈতিক কিন্তু তা লেখকের পার্টির পরিচয়পত্র থাকার কারণে নয়, পরিচয়পত্র কারও থাকে আবার কারও থাকে না; উপন্যাস রাজনৈতিক হওয়ার কারণ আসলে- মানুষকে বোঝা, মানুষের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করা যারা ঠিক আমাদের মতো নয়। সমস্ত শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক কারণ সে যে অন্যদেরকে আইডেন্টিফাই করছে সেটা রাজনৈতিক। সমস্ত ‘আর্ট অব দ্য নভেল’-এর মর্মকথাটি অন্যের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে পারার মতো সক্ষমতার ভেতরেই নিহিত। ঔপন্যাসিকদের মহত্বের প্রধানতম নেপথ্য শক্তি হল সহমর্মিতা।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
বিচ্ছিন্ন মরুভূমিতে নির্বাসিত হলে কোন তিনটি বই নিয়ে যাবেন?

ওরহান পামুক :
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র ১৯১১ সালের সংস্করণটি, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম (১৯১৩-১৯৩৬)-এর প্রথম সংস্করণ, এবং- রিসাত একরাম কোকু’র ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইস্তানবুল’ (১৯৫৮-১৯৭১); আমার ‘ইস্তানবুল’-এ আমি এই বইয়ের কথা বলেছি; এই বইটি নিয়ে আমি আগামী ১০টি বছর ব্যস্ত থাকতে চাই। আমার নির্বাসিত জীবন ইতিহাসের ঘটনাবলীর দ্বারা ঋদ্ধ হবে যখন সবকিছুই কিছু তারিখের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। নির্বাসন শেষ হলে, ১০ বছর পর- কেউ আমাকে মরুভূমি থেকে ফিরিয়ে নিতে এলে এখানে লিখিত আমার উপন্যাসটি প্রকাশিত হবে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
আপনি আমেরিকায় বহুদিন ছিলেন, আবার চলেও গিয়েছিলেন। আমেরিকার কোন লেখককে আপনি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করেন?

ওরহান পামুক :
‘মৃত’ জন আপডাইক একবার বলেছিলেন ‘সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের’ লেখক ফকনার দ্বারা প্রভাবিত। আমিও তাদের একজন। ফকনার দেখিয়েছেন- আমাদের বিষয় হয়তো প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক, পশ্চিমের কেন্দ্র থেকে দূরে, এবং রাজনৈতিকভাবেও সংকটাপন্ন, তা সত্ত্বেও একজন লেখক সেই বিষয়েই লিখবেন অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও উন্মোচনের পদ্ধতিতে, এবং সেই লেখা বিশ্ব জুড়ে পড়া হবে।
আমি ফকনার এবং হেমিংওয়ে এবং ফিটজিরাল্ডের প্রায় সমস্ত লেখাই পড়েছি, পড়েছি নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত আপডাইকের লিটারারি রিভিউগুলিও। আপডাইকের কাছ থেকে আমরা শিখেছি অনেক কিছু, এবং আমার বই সম্পর্কে তার করা রিভিউ থেকেও ঋদ্ধ হয়েছি। যখন থেকে আমি ইস্তানবুলে অবস্থিত আমেরিকান সেক্যুলার রবার্ট কলেজে গিয়েছি, সেখানকার সিলেবাসে ছিল বলে আমাকে ‘টম সয়্যার’ পড়তে হয়েছে, ‘এ সেপারেট পিস’ এবং ‘টু কিল অ্যা মকিংবার্ড’ পড়তে হয়েছে; আমি এই বইগুলির গণতান্ত্রিক এবং সমতাবাদী স্পিরিটটাকে উপভোগ করতে করতে পড়েছি। তখন স্কুলগুলোয় সালিঙ্গার পড়ানো হতো না বলে আমাকে ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ পড়তে হয়েছিল স্কুলজীবনকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়ে। তাছাড়া আমি থমাস পিনশনের উপন্যাসগুলিকে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, নিকলসন বে’কার-এর প্রখর বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়েছি, এখনও হই; শ্রদ্ধা করি ডেভ এগারকেও।
কিন্তু, কেউ যখন আমাকে আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, মুহূর্তেই মাথায় হথর্ন, মেলভিল এবং পো’র নাম চলে আসে। আমার মনে হয়েছে- আমেরিকার সত্যিকার স্পিরিটটাকে যেকোনও লেখকের চেয়ে এই তিনজন সবচে বেশি তুলে ধরেছেন। আমেরিকানদের অদম্য বুনো কল্পনাশক্তি, তাদের প্রাদেশিকতার উদ্বেগ কিংবা দুশ্চিন্তার সঙ্গে এই লেখকদের সময়কালে হাতেগোনা অল্পক’জন পাঠক, তাদের লেখার শক্তি এবং আশাবাদ, তাদের সফলতা এবং তাদের লক্ষণীয় ব্যর্থতার দ্বারাই আমার পক্ষে তাদেরকে বুঝে ওঠা সমজতর হয়। স্বপ্নে ও জাগরণে এবং কল্পনায়- পো, মেলভিল, হথর্নের সঙ্গে আমার যোগসূত্র তৈরি হয় কিছু রহস্যময়তা দিয়ে, ঠিক যেভাবে আমার সঙ্গে জার্মান রোম্যান্টিক চিত্রশিল্পী ও তাদের ল্যান্ডস্কেপগুলির সম্মেলন ঘটে অজ্ঞেয় কিছু কারণে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
ভেতরের সেই চিত্রকর কীভাবে আপনাকে লেখার প্রেরণা দেয়?

ওরহান পামুক :
ঠিক যেভাবে আমি আমার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ইস্তানবুল’ এবং এখন ‘দ্য ইনোসেন্স অব অবজেক্টস’ লিখেছি, ঠিক এই আমিই একদিন শিল্পী হতে চেয়েছিলাম। ২৩ বছর বয়সে মাথার ভেতরের একটি রহস্যময় প্যাঁচ শিথিল হয়ে গিয়েছিল, তখন ছবি আঁকবার চিন্তা বাদ দিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম।
কিন্তু রঙের কাজ আমি এখনও ছাড়িনি। ছাড়তে পারিনি। যখনই কিছু আঁকতে যাই তখন নিজেকে খুব সুখী মানুষ ভাবতে পারি। কিন্তু এই অনুভবটিও আমাকে বিস্মিত করে- যখন লিখতে বসি তখন আমি যেন পুরো পৃথিবীর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি! হ্যাঁ, চিত্রকলা আর সাহিত্য হচ্ছে শিল্পের দুই বোন। কলাম্বিয়ায় ছাত্রদেরও আমি এই কথাটা বলেছিলাম। ছাত্রদেরকে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে বলতাম। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করতাম- ভাবনাটি কোনও বিশেষ শব্দ কিংবা ছবির সঙ্গে সম্পর্কিত কি না। তাদের উত্তর ছিল- দুটোই! উপন্যাস আমাদের কাছে মৌখিক (দস্তইয়েভস্কি) এবং দৃষ্টিনির্ভর (প্রুস্ত, নবোকভ) কল্পনাশক্তিকে বিশিষ্ট করে তুলে ধরে। দস্তইয়েভস্কি’র উপন্যাসগুলোয় বহু অবিস্মরণীয় দৃশ্য আছে, হ্যাঁ, দৃশ্যগুলিকে হয়তো ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিন্তু সেসব দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড, ল্যান্ডস্ক্যাপ কিংবা অবজেক্ট-কে আমরা খুব কমই মনে রাখতে পারি।

অবশ্য এমন কিছু ঔপন্যাসিকও আছেন যারা স্মরণীয় দৃশ্যগুলি গড়ে তোলেন আমাদের মনের ভেতরে নানারকমের ছবি তৈরি করে। ফ্লবেয়ার কথিত সেই ‘পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড’ গড়ে উঠবার পূর্বে, লেখকের কল্পনায় সম্পূর্ণ নিখুঁত ছবিগুলি থাকতে হয়। একজন পাঠক মাঝেমাঝেই তার পড়তে থাকা উপন্যাসটি মাঝেমাঝে বন্ধ করে ছাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন; কল্পনায় তিনি বাক্যে কিংবা অনুচ্ছেদে লেখক যে-ছবিগুলি তৈরি করেছেন সেগুলি স্পষ্ট দেখতে পান। আমরা, লেখকরা এইসব কল্পনার অধিকারী পাঠকের জন্যই তো লিখব।

বছরের পর বছর ধরে, সেই যে এক চিত্রকর আমার ভেতরে নিত্য বিরাজমান, সেই চিত্রকর ‘লেখক’ হিসেবে আমাকে এই পাঁচটি কথা শিখিয়েছে-
১. লিখতে বসার আগে সম্পূর্ণ লেখাটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা না নিয়ে লেখাটি শুরু করবে না, তা না হলে তুমি লিখে ফেলবে একটি লিরিক্যাল টেক্সট কিংবা কবিতা।
২. পরিপূর্ণ শুদ্ধতা এবং নিখুঁত সামঞ্জস্যের সন্ধান করবে না- এই বিষয়গুলি কাজের প্রাণকে হত্যা করে।
৩. যে-দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে চাও এবং তার পরিপ্রেক্ষিত, বিষয়বস্তুর গভীরতা, দৈর্ঘ্য, অবস্থান ইতাদির নিয়মকে অগ্রাহ্য করো না, এবং- তোমার চরিত্রের চোখ দিয়ে বিশ্বটাকে দেখো।
৪. ভ্যান গগ কিংবা নিও-এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো তুমিও তোমার তুলির চমৎকারত্ব দেখাও! পাঠক তোমার উপন্যাসের লিখনশৈলীটাকে পছন্দ করবে গল্পের গৌণ অংশটি পড়েই।

৫. লেখায় আকস্মিক সৌন্দর্যকে সনাক্ত করার চেষ্টা করবে, যে-আকস্মিকতার জন্য তোমার না কোনও ধারণা ছিল, না ছিল অভিপ্রায়।

আমার ভেতরকার সেই চিত্রকর আর সেই লেখকের মধ্যে প্রতিদিনই বন্ধুত্ব হয় আর সে কারণেই আমি এখন বিভিন্ন রকমের ছবি এবং ছবির বই-এর সঙ্গে ট্যাক্স আর গল্পকে একাকার করে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করি।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস :
গত পঞ্চাশ বছরে ইস্তানবুল অনেক বদলে গেছে। এই পরিবর্তনটা সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?

ওরহান পামুক :
১৯৫০-এ যখন ইস্তানবুলের জনসংখ্যা ১মিলিয়ন থেকে ১৪মিলিয়নে বেড়ে যায় তখন তুরস্কের আগের প্রজন্মের লেখকরা সোচ্চার ছিলেন অ্যানাতোলিয়া’র গ্রামগুলোর জীবনসংগ্রাম ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে। এখানকার শহরতলী, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের গ্রাম, পশ্চিমা-জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত-হয়ে-পড়া উচ্চশ্রেণি, কলকারখানা আর শ্রমিক-শ্রেণির কোয়ার্টারগুলি, তার সঙ্গে বিক্ষুব্ধ রাগী তরুণদের কথা, জাতীয়তাবাদীদের কথা, মৌলবাদী এবং উদারপন্থিদের কথা এবং তাদের রাজনৈতিক সমস্যাবলীই হচ্ছে আজকের এই মহানগরীর জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেসব কথা আমি ‘সাইলেন্ট হাউজ’-এ বর্ণনা করেছিলাম।

একেবারে ভেতর থেকে ইস্তানবুলের অতিকায় নির্মিতিটা দেখতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান বলে মনে করি। ব্যাপকমাত্রার এই পরিবর্তনটা গত প্রায় ১৫ বছর ধরেই সংগঠিত হচ্ছিল যাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠাটাও সহজ নয়। ‘সাইলেন্ট হাউজ’ বইটি লিখবার সময় আমি সেই চেষ্টাটি করছিলাম, এখনও আমি ইস্তানবুলের জনবসতিগুলি দেখবার জন্য পায়ে হেঁটে বহুদূর পর্যন্ত চলে যাই, দেখতে থাকি সে কীভাবে আকারে আয়তনে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। যা কিছু দেখি, সেসব উপভোগ করি। শহরের বস্তিএলাকাগুলি কীভাবে বহুতল ভবনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, ‘ওল্ড সামার সিনেমা গার্ডেন’ ভেঙে গড়ে উঠছে বর্ণাঢ্য বিপনিবিতান। নতুন নতুন দোকান আর স্থানীয় ফাস্ট ফুড চেইনশপগুলি যেন সারা দুনিয়ার বহুবর্ণিল মানুষ আর অবিরাম জন-কোলাহলকে তুলে ধরছে।

 

কৃতজ্ঞতাঃ গল্পপাঠ

 

 

 

 

 

 

 

.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত