| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: আমতার বিখ্যাত পান্তুয়া । পলাশ পোড়েল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

হাওড়া জেলার মিষ্টির মানচিত্র খুবই বিখ্যাত।এক সময় খইচূড় (মাজু) থেকে শুরু করে মিল্কিমজা,বোঁদে,মতিচূড়, কারাকাণ্ড ইত্যাদি ছিল খুবই বিখ্যাত।আমরা এই নিবন্ধটিতে আমতার পান্তুয়ার কথা বলবো l হ্যাঁ, এই আমতার পান্তুয়া ভারতবর্ষের বাইরে ইংল্যান্ড, জাম্বিয়া(২০০৪) পর্যন্ত গিয়েছে বহুবার l নানান ভাবে অনেক খবর মুদ্রিত হয়েছে দৈনিক কাগজেও l এই পান্তুয়া খেয়েছেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং মহানায়ক উত্তম কুমারও l… নামের তালিকা দীর্ঘ l ইংল্যান্ড ( লণ্ডন)…দূর দেশে পাড়ি যেত আমতার পান্তুয়া, শালপাতায় মোড়া হত একটুকরো অমৃত!

আমতার পান্তুয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদনে শুভদীপ চক্রবর্তী( ডেইলিহান্ট ওয়েব) লিখেছেন—
‘আর মশাই আর দুটো নিন, এই তো সময় খান খান।’ বিয়েবাড়ি থেকে অন্নপ্রাশন বা কোনো অনুষ্ঠান মিষ্টিতে বড়ই রসিক এই ঘুম ভাত বাঙালি। পাতের শেষে একটু মিষ্টি না হলে খাবার হজম হতে চায়না। এবার সেই মিষ্টি যদি প্রিয় দোকানের প্রিয় মিষ্টি হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ঠিক এমনই এক জায়গা হল আমতা। এমনকি সেখানকার পান্তুয়ায় মজে ছিল স্বয়ং উত্তম কুমারও। পান্তুয়া আর কাঁচা গোল্লার জাদুতে সারা বিশ্বের নজর এসে পড়েছিল হাওড়ার এই জায়গায়। মূলত সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বহু মিষ্টিখ্যাত জায়গা রয়েছে তবে হাওড়ার আমতায় ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট। পান্তুয়ায় যবুথবু বাংলা থেকে শুরু করে সারা ভারতবর্ষ। তবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত এই মিষ্টি। কিন্তু বাংলার পান্তুয়ার স্বাদ যে বলে বোঝানো যায়না তা আপনি না খেলে অনুভব করতে পারবেন না। আর সে যদি হয় আমতার পান্তুয়া। মোটামুটি ছোটো বড় মিলিয়ে ৩০ টারও বেশি মিষ্টির দোকান রয়েছে এই জায়াগায়। দোকানের আগন্তুকেরা এলে তাদের মুখমণ্ডলে ছেয়ে যায় এক তৃপ্তির বাসনা যা হয়তো এইখানেই মিটবে। মিষ্টিপ্রেমীদের আটকানো যায় কি করে বলুন! একটা সময় ছিল ভারতের বাইরেও পারি দিতো এই জায়গার মিষ্টি। সাহেব থেকে মালি সবার প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছিল আমতার পান্তুয়া। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গেছে বহু কিছু। আজকাল কাঁচের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে আর কালের নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে এই সমস্ত পুরোনো দোকান। আমতা রেল স্টেশন থেকে/ কলাতলা মোড় থেকে CTC বাস স্ট্যান্ড আসতে হবে। ওখান থেকে আমতা বাজার, মেলাই চন্ডী মন্দির ঢোকার রাস্তার বাম দিকে চারিতের মিষ্টির দোকান। বনমালী চরিত।ভূপতি ময়রার দোকান। চরিতের দোকানের ইতিহাস( পলাশ পোড়েল) দিকে তাকালে দেখা যায়- ১৮৭৭ সালে আমতায় মুড়ি মুড়কির দোকানে কাজ করতে আসেন ভূপতি চরিত। মালিকেরা পরে কলকাতা চলে যাবার সময় ভূপতি বাবুকে দোকান দিয়ে যান। তিনি পশুপতি ও শ্রীপতি এই দুইভাইকে নিয়ে মিষ্টির দোকান করেন। কাঁচাগোল্লা ও পান্তুয়া তৈরি করতে থাকেন। মার্টিন রেলের কামরায় এবং অন্যান্য জায়গার খুব নামকরে। তারপর তো শুধু উন্নতি। মিষ্টির গুণমান উন্নত হলেও দোকানটি কিন্তু প্রাচীনত্ব বজায় রেখেছে আজও… বক্তব্য বর্তমানে মালিক নারায়ণ চরিতের। তবে দোকানের মালিক দের বক্তব্য, দোকানে নয় মানুষ মজবে মিষ্টির রসেই। তা অবশ্য খাঁটি কথা স্বাদের দিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে আমতার এইসব দোকানের মিষ্টি। বলছে স্থানীয় মানুষেরাই। তাদের এই পান্তুয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট আছে। এই পান্তুয়া বাজার চলতি পান্তুয়ার মতো থ্যাসথ্যাসে নয়। এর মোটা ছালের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে এলাচ দানা মেশানো মিষ্টি রস। যা আপনাকে আহ বলতে বাধ্য করবে। তবে আর কি! ঘুরতে ঘুরতে চলেই আসুন একদিন আমতার পান্তুয়া খেতে। আমতায় এসে বললেই সবাই আপনাদের ঠিকানা দেখিয়ে দেবে। এছাড়াও আমতা বেতাই বন্দরে শীতলা মিষ্টান্ন ভান্ডার এর পানতুয়া জগৎ বিখ্যাত ।এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা – বেচু রাম দেন অনেকবার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে । এছাড়াও আমতার বিখ্যাত পান্তুয়ার দোকান গোবিন্দ চরিত, দিলীপ রানা এদের মিষ্টির দোকান। প্রদীপ রঞ্জন রীত মহাশয় এক জায়গায় লিখেছেন-” কলকাতা শহরে একটা ক্যুইজের আসর।আমি দর্শক।ক্যুইজ মাস্টার বোধহয় বেশ ভোজনপ্রিয় মানুষ।একটা রাউন্ড দেখলাম কেবল খাদ্যকেন্দ্রিক।প্রশ্নের কিছু নমুনা- রসগোল্লার আবিষ্কারক কে? ল্যাংচার জন্য কোন জায়গা বিখ্যাত? প্রভৃতি।সেই রাউন্ডেই প্রশ্ন হল- কোন জায়গার পান্তুয়া নামকরা?উত্তরও এসে গেল সঠিক– আমতার।আমতার মানুষ হিসাবে একটা অন্যরকম গর্ব অনুভব করলাম।সত্যিকথা বলতে কি –আমতার পানতুয়ার একটা নাম আছে জানতাম,কিন্তু খ্যাতিটা যে এতদূর বিস্তৃত সে ধারণা ছিলনা।অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মুখেও একবার আমতার পান্তুয়ার গুণগান শুনেছিলাম।প্রশ্ন হল,কতদিন আগে থেকে এবং কিভাবে এই সুনাম তৈরী হল?

প্রায় ১৬৬ বছর আগের কথা।আমতায় ভূপতি চরিতদের তখন বড় ও নামকরা মিষ্টির দোকান ছিল। এক বড় রাজাতুল্য জমিদারকন্যার বিবাহ।ভূপতি চরিতদের দোকান মিষ্টির অর্ডার পেল। তাঁদেরকে বলা হল — এমন মিষ্টি করতে হবে যেন ধন্য ধন্য পড়ে যায় চতুর্দিকে। চিন্তিত চরিতরা মাথা খাটিয়ে দৈত্যাকৃতির পান্তুয়া তৈরী করলেন। একএকটির ওজন আড়াইশো।স্বাদেও অতুলনীয়।সাড়া ফেলে দিল এই পান্তুয়া।খ্যাতি ও ঐতিহ্যের সেই শুরু।পূর্ণচন্দ্র চরিত আমতার পান্তুয়ার খ্যাতিকে সুদূর প্রসারিত করেন। দীপক দাসের লেখায় পাই- হাওড়ারই আমতায় পাওয়া যায় ভাল পান্তুয়া। বেশ নাম। খেতেও অন্যরকম। মোটেও বাজার চলতি পান্তুয়ার মতো থ্যাসথেসে নয়। ছালটা মোটা। সেই বর্মের গর্ভে এলাচদানা রসে ডুবে ঘাপটি মেরে বসে। এলাকার পুরনো এবং নামী দোকান চরিতদের। নারায়ণ চরিত এবং বিকাশ চরিত জানিয়েছিলেন, তাঁরা পয়সা বাঁচানোর জন্য লোক ঠকান না। অন্য জায়গার পান্তুয়ার মতো নিভু নিভু আঁচে পান্তুয়া ভাজলে তাড়াতাড়ি লাল রং আসে বটে। কিন্তু পান্তুয়া নরম থাকে। একটু কাঁচা কাঁচা ধরনের। আর গনগনে আগুনে ভাজলে চামড়া মোটা হয়। কিন্তু ভেতরটা থাকে সাদা। প্রচলিত আছে, অনেককাল আগের পুরনো কারিগরদের হাতে তৈরি পান্তুয়া কানের কাছে নিয়ে নাড়ালে ভিতরে রসের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন সেখানে অনেক নতুন দোকান হয়েছে। কিন্তু আমতার বাজারের চরিত বা বন্দর এলাকার দেনেদের  দোকান থেকে কিনলেই ভাল জিনিসটা মেলে। ও হ্যাঁ, কিনতে গেলে সকালের দিকে যাওয়াই ভাল। পুরনো দোকানগুলোর পান্তুয়া দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

১৩৬৬তে বন্যাত্রাণে আমতায় এসেছিলেন উত্তমকুমার।সঙ্গে ছিলেন বিকাশ রায়, পাহাড়ী সান্যাল প্রমুখ।আমতার পান্তুয়ায় তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।প্রশংসায় তাঁরা পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। আমতার প্রাক্তন বিধায়ক আফতাব মন্ডল রাজীব গান্ধীকে পান্তুয়া উপহার পাঠিয়েছিলেন।

নবকল্লোল পত্রিকায় কার্টুন এও উঠে এসেছে এই মিষ্টির জনপ্রিয়তার কথা।আর মার্টিন রেল বিষয়ে বিভিন্ন বইয়ে পাতায় আছে পান্তুয়ার কথা।দোকানে ৩, ৫,১০ টাকার ছাড়াও স্পেশাল অর্ডারে ২০ টাকার “বাম্পার পান্তুয়া” তৈরি করা হয়।ইয়া বড় তার সাইজ।যেন টেনিস বল।আর খেতে?কি বলবো? চেখেই দেখুন…..!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত