একদিন বাউলের আখড়ায়

Reading Time: 4 minutes

 

 

নাতন সিদ্ধাশ্রম যাবো। পথে যাকেই ঠিকানা জিজ্ঞাসা করি উত্তর আসে ঠিক জানিনা দাদা। ‘বলতে পারবো না’- বার কয়েক এই উত্তর পেয়ে বাধ্য হয়েই মোবাইলে ডায়াল করলাম পার্বতীদি’র নাম্বারে আর কেন জানিনা প্রত্যাশা মতোই কয়েকবার বেজে কেটে গেল ফোনটা। এমন সময় উদয় হলো এক যুবক ছোঁকড়া অটোচালক সে এসে বলল ‘দাদা গুগল ম্যাপ এ একটু লোকেশনটা দেখুন না, আমি নিয়ে যাবো। মনে মনে একটু তারিফ করলাম ছোঁকড়ার।

কিছুক্ষণ পর লোকেশন দেখে রফা হলো ৩০০ টাকায়। বোলপুর পেরিয়ে শান্তি নিকেতনের গন্ডি পার করার পর একটু চিন্তাতেই পরলাম কারন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার এর কল্যাণে মোবাইলে ৪জি কানেকশন সহজলভ্য থাকলেও রাস্তায় ল্যাম্পপোষ্ট চোখে পড়ছিল না। প্রায় আধঘন্টা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যাবার পর জনাকয়েক লোককে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কামারডাঙ্গাটা কোনদিকে? উত্তর এলো ‘কুথায় যাবেন?’ সোনাতন আশ্রম? একেবারে বিশুদ্ধ বীরভূমের টোন এ। বললাম হ্যাঁ। অটোচালক রাজাকে পথ বাতলালেন দুজন। আরও মিনিট পনের যাবার পর কিছু আলো জ্বলছে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করাতে জানলাম পৌঁছে গেছি সনাতন সিদ্ধাশ্রম বা পার্বতী বাউলের আখড়ায়।

পরিচয় দিয়ে বললাম আমার আসার কথা পার্বতীদি জানেন। শুনে সামনের মহিলাটি জানালেন ‘মা এখন সন্ধ্যা পূজায় বসেছেন কলারিতে ’ এবং জানতে চাইলেন আমি ওখানে যাব কি না? সম্মতি জানাতেই সেখানে নিয়ে গেলেন। দেখলাম। দিন দশেক আগে কলকাতায় হয়ে যাওয়া ‘তান্ত্রী ধাত্রী’ অনুষ্ঠানের কল্যানে এবং ইন্টারনেট ঘেঁটে যাওয়ায় চিনতে অসুবিধা হলো না।


জনাদশেক বাউল ও বাউল অনুরাগীকে নিয়ে একযোগে গান গাইছেন পার্বতীদি। ছবিঃলেখক

গান শেষে প্রথম প্রশ্নটি করলেন ‘সৌম্যজিৎ আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?’ আমি জানি তুমি ফোন করেছিলে কিন্তু আমি পূজায় ছিলাম বলে ধরতে পারিনি। এরপর একে একে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন ‘ও আমার পরিবারের লোক’ । কুচবিহারে বাড়ি। ছবি তোলে। তাই কালকের অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তুলতে ডেকেছি। কথা বলার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম।

সন্ধ্যায় গানের পালা সাঙ্গ করে সিঙ্গারা, মুড়ি সেবা করতে করতে লক্ষ্য করলাম উপস্থিত সবাই। পার্বতী দির প্রতি মুগ্ধতায় বাঁধা। রাতের খাবার আয়োজন সাঙ্গ হলে দ্বিধা নিয়েই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম রাতের থাকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কি না? কিছুক্ষন পর একজন মহিলা সেবক এসে জানালেন আমাকে মা ডাকছেন। একটা অর্ধেক তৈরি হওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকতেই পার্বতীদি বললেন ‘সৌমজিৎ এসো। এটা আমার খিঁচুড়ি মার্কা ঘর।’ ২ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে সামনে বসে থাকা দু’জন বিদেশীকে কিছু বোঝালেন সারেঙ্গা নামক বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে। ওরা বিদায় নিতেই বললেন ‘তুমি আজ আমার ঘরেই থাকবে’ বার বার আপত্তি সত্ত্বেও নিজের হাতে বিছানার চাদর, বালিশের কভার পাল্টিয়ে মশারি টাঙ্গিয়ে দিলেন। সাথে টিপসও দিলেন মশারীটা ভাল করে গুঁজে নিতে। আর ডাবল মশারী ব্যবহার করে কি করে মশাদের কনফিউজস করা যায় সে কথাও জানালেন।


পাবর্তীদির গুরু শ্রী সনাতন দাস ঠাকুর বাউল এবং শ্রী শশাঙ্ক গোঁসাই বাবা হলেও আসল আরাধ্য সাধারণ মানুষ বা নর নারায়ণ। ছবিঃ লেখক

 

কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম ‘কলারি’ কথাটার মানে কি? বললেন ‘আখড়া’ । জানালেন অনেকদিন দক্ষিণ ভারতে থাকার দরুণ বেশকিছু এমন শব্দ জুড়ে আছে পুরো আশ্রমেই। যেমন সমস্ত প্রার্থনা/চর্চা হয় ‘কলারি’তে; খাবার ব্যবস্থা হয় ‘গোলবারা’তে ইত্যাদি।

নিজের জিনিসপত্র নিয়ে পার্বতী’দি অন্য ঘরে চলে যেতে ভালো করে চোখ বোলালাম ঘরটার চারপাশে। আধো অন্ধকারেও বুঝলাম পরম যত্নে সহাবস্থান করে গোপাল এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। পূর্বদিকে অবস্থিত গোপাল বাদ্যযন্ত্রটি এবং বিভিন্ন বই যে পূজনীয় তা সহজেই বোঝা যায়। দুর থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক , ধামসা মাদলের আওয়াজ আর মশার কনসার্ট উপভোগ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না।

পরদিন ভোরবেলা উঠে আশ্রমের চারদিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম প্রায় সারারাত ধরেই চলেছে এক বড় ধরনের কর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি। কথায় কথায় জানতে পারলাম এই যজ্ঞের আরাধ্য বকলমে পাবর্তীদির গুরু শ্রী সনাতন দাস ঠাকুর বাউল এবং শ্রী শশাঙ্ক গোঁসাই বাবা হলেও আসল আরাধ্য সাধারণ মানুষ/নর নারায়ণ।


গ্রামবাসীর প্রসাদ গ্রহন। ছবিঃ লেখক


ক্রমে ক্রমে শুরু হলো নাম সংর্কীতন, বাউল গুরুদেব বন্দনা আরতি সহযোগে বাউল গানের চর্চা চলে।এর প্রধান পুরোহিত পার্বতী বাউল নিজে। প্রায় ৩০০০ গ্রামবাসীকে নিজের হাতে প্রসাদ বিতরণ করে তারপর খিঁচুড়ি, তরকারি, পায়েস, চাটনী সহযোগে পেটপুরে খাওয়ানোর আদ্যপান্ত তদারকির পরেও এতটুকু ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেলাম না পার্বতীদি ও তাঁর সহযোগীদের মুখে। অভ্যাসবশত ক্যামেরা বন্দী করছিলাম এই পুরো অনুষ্ঠানের বিভিন্ন মূহুর্ত। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন অভিব্যক্তি আর তথাকথিত শহুরে চোখে প্রত্যক্ষ করছিলাম ভারতের সাধারণ গ্রামবাসীদের। মানুষের মধ্যকার অব্যাক্ত বিশ্বাস যেটাকে আধুনিকতা এখনো গ্রাস করতে পারেনি। গ্রামের লোকদের সাথে পার্বতীদির কথোপকথনের ধরণ দেখে বোঝায় উপায় নেই যে এই ভদ্র মহিলাই সাবলীলভাবে প্রায় সারা পৃথিবী চষে বেড়ান আর অগণিত মানুষকে মুগ্ধ করেন সহজ সরল কিন্তু গভীর বাউল তত্ত্ব ও সুরের গুনে।



গ্রামের লোকদের সাথে কথোপকথনে পার্বতীদি। ছবিঃ লেখক

সদ্য ভারত বর্ষের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম বাউল শিল্পীর শিকড় যে কেন গরীব সাধারণ মানুষের মনে তা তাঁর বহুবিধ জনকল্যানমূলক কাজকর্ম আর আন্তরিকতাই বলে দেয়।
গোবরডাঙ্গার স্কুল টিচার থেকে শুরু করে আমেরিকার ছাত্রী বা ফ্রেঞ্চ দম্পতি বা মুর্শিদাবাদের সহজ সরল বাউল সাধিকা প্রত্যোকের চোখে যে ভালবাসা আর শ্রদ্ধা পাবর্তী মা এর জন্য প্রথমদিন লক্ষ্য করেছিলাম তার প্রকৃত কারনটা স্পষ্ট হয়ে গেল এই ‘অন্নদান’ উৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে।
বিকেল বেলা বেরোনোর সময় অজান্তেই প্রথমবার প্রণাম করে ফেললাম পাবর্তীদি বা সবার প্রিয় পাবর্তী মা’কে। আর ফিরে এলাম সবার নিখাদ আন্তরিকতা আর মানুষের প্রতি ভালবাসার নির্দশনকে মনের ক্যামেরায় বন্দি করে।

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>