সামান্য ভিক্ষুক থেকে যাত্রাভিনেতা হিসাবে নাম করেছিলেন প্যারীমোহন

Reading Time: 3 minutes

প্যারীমোহনের বেহালার সুরে মজে গেলেন সেই রূপোপজীবিনী। বললেন, যাত্রা করবে ঠাকুর? লিখেছেন সন্দীপন বিশ্বাস।

এক টা কথা বলতেই হয়, গোপাল উড়ে এসে বিদ্যাসুন্দরকে জনপ্রিয় করার অনেক আগেই সখের দলে বিদ্যাসুন্দর অভিনয়ের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মতো আর কেউই বিদ্যাসুন্দরকে এই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই বিদ্যাসুন্দরের অভিনয় শুরু হয়েছিল বলে অনুমান। কেননা এই সময়ের মধ্যেই কলকাতা এবং শহরের আশপাশে কয়েকটি দল বিদ্যাসুন্দর পালার অভিনয় করেছিল বলে জানা যায়।
মঞ্চে, পালাগানে, খেউড় গানে বিদ্যাসুন্দরের উপস্থাপনই শুধু নয়, বিদ্যাসুন্দর নিয়ে তখন বই ছাপানোরও ধুম পড়েছিল। বটতলা ছিল তার প্রাণকেন্দ্র। বটতলা তখন হয়ে উঠেছিল নিম্নরুচির অল্পশিক্ষিত পাঠকের রুচিবিনোদনের খোলা বাজার। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনটি ছাপাখানা একসঙ্গে বের করল তিনটি বিদ্যাসুন্দর। রামকৃষ্ণ মল্লিকের প্রেস, মথুরানাথ মিত্রের প্রেস এবং পীতাম্বর সেনের প্রেস থেকে প্রকাশিত হল এই বইগুলি। আর একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মীবিলাস প্রেস থেকে বের হয় আরও একটি বিদ্যাসুন্দর। ছাপার সঙ্গে সঙ্গে সেটির প্রায় চার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। এই বছরেই দুটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। একটি সিপাহী বিদ্রোহ এবং অন্যটি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা।
বিদ্যাসুন্দর পালাভিনয়ের ব্যাপারে যাঁকে পথিকৃৎ হিসাবে মনে করা হয়, তিনি হলেন ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়। বরানগরে তিনি ১৮২২ সালে গড়ে তোলেন সখের বিদ্যাসুন্দর যাত্রার দল। তাঁর দলে সুন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করতেন রাধামোহন চট্টোপাধ্যায়। বিদ্যা সাজতেন ঈশানচন্দ্র।
সেই সময়ের কাছাকাছি বিদ্যাসুন্দর পালার দল গড়েন হাওড়ার ব্যাঁটরার ঠাকুরদাস দত্ত। ঠাকুরদাসের অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল। তাঁর দলের বিদ্যাসুন্দর পালা দেখে কয়েকজন এসে তাঁকে ধরলেন। তাঁদের দলের জন্যও বিদ্যাসুন্দর পালা লিখে দিতে হবে। এরকম চারটি দলের পক্ষ থেকে অনুরোধ এল বিদ্যাসুন্দর পালা লেখার। ঠাকুরদাস প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বিদ্যাসুন্দর পালা লিখে দিলেন। তার সংলাপ আলাদা, গানও আলাদা। নিজের দল ছাড়াও তাঁর লেখা বিদ্যাসুন্দর পালার অভিনয় করত গজা চিত্রশালাপুরের জমিদারের দল, কালী হালদারের দল, কৈলাস বারুইয়ের দল এবং টাকীর মুনসীদের দল।
এই সময়ের পালাগানে অভিনয় ছাড়াও মানুষ তারিফ করত বাদ্যযন্ত্রকারদেরও। যেমন বরানগরের ঠাকুরদাসের দলে ঢোল বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন রামধন মিস্ত্রি। বেহালা বাজিয়ে মানুষের তারিফ কুড়িয়েছিলেন নারায়ণ দাস। বেহালার কথাই যখন উঠল, তখন অনিবার্যভাবেই আসবে প্যারীমোহনের নাম। তিনি ছিলেন একজন বেহালাবাদক। অসাধারণ সুর খেলত তাঁর হাতে। তাঁর বাড়ি ছিল বরানগরে। সকালে তিনি কাঁধে বেহালা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। সারাদিন মানুষের দ্বারে দ্বারে বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষা করতেন। এমনই একটা দিন। সেদিন তিনি বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষা করতে করতে চলে গিয়েছেন ভবানীপুরের বেলতলা অঞ্চলে। সেখানে থাকতেন এক বারাঙ্গনা। প্যারীমোহনের বেহালার সুর শুনে তাঁর হৃদয় টলোমলো হল। বুকের গভীরে কেউ যেন দোলা দিল। তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখলেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক সুদর্শন যুবক বেহালা বাজাচ্ছেন। প্যারীমোহনকে তিনি ঘরে ডেকে এনে বসতে দিলেন। একটা রেকাবে কিছু মিষ্টি ও জল খেতে দিলেন। সেই বারাঙ্গনা ছিলেন নাচ ও গানে বেশ দড়। প্যারীমোহনকে দেখে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তিনি প্যারীমোহনকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘ঠাকুর তুমি এমন গুণী মানুষ হয়ে কেন মানষের দজ্জায় দজ্জায় ব্যায়লা বাজিয়ে ভিক্ষে করে ফিরছো?’ চুপ করে বসে থাকেন প্যারীমোহন। কীই বা উত্তর দেবেন! নিজের অদৃষ্টকেই দোষারোপ করতে থাকেন। সেই মহিলা বলতে থাকেন, ‘ঠাকুর, তুমি একটা দল গড়বে? যাত্রার দল? তুমি সেখানে পালায় অভিনয় করবে। এমন করে ব্যায়লা বাজিয়ে মানষের মন জয় করবে! আমি নাচব। সক্কলে একেবারে ধন্যি ধন্যি করতে থাকবে!’ প্রস্তাব শুনে প্যারীমোহনের চোখে জল এল। সেই বারাঙ্গনার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, এ কোন দেবী নেমে এল স্বর্গ থেকে!
প্যারীমোহন রাজি হলেন। সেই ‘দেবী’ বারাঙ্গনার সাহায্যে তৈরি করলেন বিদ্যাসুন্দরের দল। সেই দলকে লোকে বলত বেলতলার দল। প্রতিভা এবং পরিশ্রমের কারণে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিল বেলতলার দলের বিদ্যাসুন্দর। প্যারীমোহনের গানে দর্শকরা উল্লসিত হয়ে হইহই করতেন। বেলতলার দলের সকলের গলায় সেকী জোর! তাঁরা নাকি খালি গলাতেই পালাগানে ৬-৭ হাজার লোকের মন জয় করে নিতেন। সেই পালার একটি গান খুব বিখ্যাত হয়েছিল। ‘আমি আর যাব না তোমার সনে, তুমি ফচকে মেয়ে, / পুরুষ দেখলে অম্‌঩নি থাকো তার পানেতে চেয়ে।’ বিদ্যাসুন্দরের পর প্যারীমোহন ‘নল দময়ন্তী’ পালার অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সে পালা তেমন চলেনি। প্যারীমোহন যাত্রাপালার এবং অভিনয়ের আঙ্গিকে বেশ কিছু নতুনত্ব এনেছিলেন। এর পিছনে নাম না জানা সেই বারাঙ্গনার অবদান অনেকখানি। তিনি পাকা জহুরীর মতো রতন হিসাবে চিনেছিলেন প্যারীমোহনকে।
বিদ্যাসুন্দরের অভিনয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আর এক বারাঙ্গনা। রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের রক্ষিতা ছিলেন তিনি। তিনিও একটি বিদ্যাসুন্দর দলের পরিচালনা করতেন। সেটাই প্রথম মহিলা পরিচালিত কোনও যাত্রাদল। সেই সময় শহর ছাডিয়ে গ্রামের সংস্কৃতির মধ্যে ক্রমে ঢুকে যাচ্ছিল বিদ্যাসুন্দরের প্রভাব। ধনেখালির নিরক্ষর বাগদি নামে একজন সেখানে বিদ্যাসুন্দরের অভিনয় আরম্ভ করেন। সেও কিছুদিন চলেছিল।
প্যারীমোহনের দলের খ্যাতির কথা কানে গেল শ্যামবাজারের ধনপতি নবীন বসুর। তিনি প্যারীমোহনের দলকে নিজের বাড়িতে এনে অভিনয় করালেন। পালা দেখে মজে গেলেন নবীন বসু। মনস্থ করলেন নিজেই বাড়িতে মঞ্চস্থাপন করে বিদ্যাসুন্দর পালা নতুনভাবে অভিনয় করাবেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর গড়েছেন হিন্দু থিয়েটার, দ্বারকানাথও চৌরঙ্গি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করলেন রঙ্গমঞ্চ। এখন যেখানে শ্যামবাজার ট্রামডিপো, সেখানেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছিল নবীনচন্দ্র বসুর বাড়ি। সেখানে নাট্যশালায় ১৮৩৫ সালের ৬ অক্টোবর অভিনয় হল বিদ্যাসুন্দর নাটকের। এক একটি দৃশ্য অভিনীত হতো এক একটি স্থানে। সুতরাং একটি দৃশ্য যখন শেষ হতো। তখন অন্য দৃশ্য যেখানে অভিনীত হবে, সেখানে দর্শকদের যেতে হতো। প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা ধরে এর অভিনয় হতো। রাত বারোটায় অভিনয় শুরু হতো। এবং শেষ হতে সকাল সাড়ে ৬টা বেজে যেত। এই নাটকে সুন্দর সেজেছিলেন শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যয়। বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রাধামণি নামে একটি ১৬ বছরের কিশোরী। রানি এবং মালিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়দুর্গা নামের এক অভিনেত্রী। বিভিন্ন পতিতালয় থেকে এনে তাঁদের দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছিল। নাটকে দৃশ্যসজ্জা এবং ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুতের এফেক্ট দারুণভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যাত্রাগানকে ভালোবাসতে গিয়ে লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছিলেন তিনি।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>