| 16 জানুয়ারি 2025
Categories
সাক্ষাৎকার

খুব ভালো ছাত্র হওয়ার ইচ্ছে ছিলঃ পথিক গুহ

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

 

 

ক বাবু : আপনার ছোট থেকেই বিজ্ঞান লেখক হওয়ার ইচ্ছা ছিল?
পথিক গুহ: নাহ্। আমার খুব ভালো ছাত্র হওয়ার ইচ্ছে ছিল। ভালো রেজাল্ট করার ইচ্ছে ছিল! আমার কেরিয়ার গ্রাফটা আমি এরকম ভেবে রেখেছিলাম‌। গবেষণা করবো।
খ বাবু: আপনার জন্ম কলকাতাতেই?
পথিক গুহ : নাহ, আমার জন্ম বাংলাদেশে । কিন্তু আমার যখন একমাস বয়স তখন বাবা-মা আমাকে নিয়ে পালিয়ে আসে স্বাধীন ভারতবর্ষে। আমার দাদা অলরেডি তখনই কলকাতা শহরের কলেজে পড়তেন। আমার দাদার সঙ্গে আমার বয়সের ডিফারেন্স অনেক, প্রায় ২২ বৎসর। আমার দাদার ১০ বছর পরে আমার দিদির জন্ম, তার ১২ বছর পরে আমার জন্ম। তো আমার দাদা তখন কলেজের ছাত্র। দাদা বাবাকে চিঠি লিখেছিল যে, ওকে নিয়ে আমাদের সংসার পথে বেরোলো, তো ওর নাম থাক পথিক। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে যে, আমার নামটা ছদ্মনাম কিনা! আমি বলি, ছদ্মনাম নয়, এটা একেবারেই বাবার দেওয়া – মানে দাদার দেওয়া নাম, বাবার সেটা পছন্দ হয়েছিল। বাংলাদেশের স্মৃতি আমার কিছুই মনে নেই।আমি বড় হয়েছি নর্থ বেঙ্গলের এর গ্রামে । তো গ্রামের যেমন স্কুল হয়, সেই স্কুলে আমি প্রথম হতাম। তখন আমার ধারনা ছিল যে, আমি কেউকেটা একজন।
খ বাবু: নর্থবেঙ্গলের কোথায়?
পথিক গুহ: শৈশবে জেলাটার নাম ছিল পশ্চিম দিনাজপুর, এখন সেটা ভাগ হয়ে আমরা পড়েছি দক্ষিণ দিনাজপুরে। হরিরামপুর নামে একটা গ্রাম, খুব বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখনকার দিনে আর তাকে গ্রাম বলা যায় না, একটা শহরই বটে। কিন্তু আমি বলছি ষাট সত্তরের দশকের কথা, তখন সেটা গ্রাম ছিল। তো গ্রামের স্কুলে আমি প্রথম হতাম। আমার সঙ্গে সেকেন্ড বয়ের এর নম্বরের পার্থক্য হত প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। আমার ধারনা ছিল যে, আমি খুব ভালো রেজাল্ট করবো, তারপর গবেষনা করবো, বিদেশে যাব। এসব আমার প্ল্যান ছিল। তারপর কলকাতায় এসে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি কতটা খারাপ ছাত্র। আরো কিছু এক্সিডেন্ট হল। অনেকেই শুনে অবাক হবে যে, আমি এম.এসসি পড়িনি, আমি বি.এসি. অনার্স এবং খুব খারাপ রেজাল্ট ।
খ বাবু: কলকাতার কোথায় এলেন?
পথিক গুহ: আমার দাদা চাকরি করতেন, বেলেঘাটায় থাকতেন। আমি গ্রাম থেকে এইচ. এস. পাশ করে কলকাতায় আসি, এসে গুরুদাস কলেজে ভর্তি হলাম। দাদা ফুলবাগানে থাকতেন, ফুলবাগানে পাড়ার কলেজ, আমি সেখানেই ফিজিক্স অনার্স না পেয়ে কেমিস্ট্রি অনার্স পড়লাম। তারপর অনার্সে এ খুব খারাপ রেজাল্ট। মাত্র ৪০% পেলাম।
খ: কেমিস্ট্রি পড়তে ভালো লাগতো না?
পথিক: একেবারেই ভালো লাগতো না , একেবারেই না, একেবারেই না ‌।আমার যেটা নিয়ে পড়ার উচিত ছিল সেটা আমি পরে অনুভব করেছি। আমার অঙ্ক নিয়ে পড়া উচিত ছিল।
ক বাবু: আমাদের এটাও একটা কৌতুহল ছিল যে আপনি পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা – এগুলোর ওপর লিখেছেন। কিন্তু কেমিস্ট্রি নিয়ে আপনি খুব একটা লেখেননি, যেটা আপনার নিজের বিষয়!
পথিক গুহ: নাহ, আমি লিখিনি। আমি তখন কেমিস্ট্রি ব্যাপারটা দেখেছিলাম যে, খুবই মুখস্থ করা জিনিস। পরে আমি অনুভব করেছি যে কেমিস্ট্রি অত বেশি মুখস্থ করার জিনিস নয়। এদিকে মুখস্থ করা জিনিস আমার কোনোদিন মনে থাকত না। ফলে বিষন্নতায় ভুগতাম, রেজাল্ট ও খারাপ হত। সব মিলিয়ে খুব দরকচা মেরে গিয়েছিল ! তো যাইহোক আমি এম. এসসি. তে চান্স পেলাম না। তখন আমার সামনে ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। একটা অপশন খোলা ছিল যে, যেহেতু আমাকে স্কুলের মাস্টারমশাইরা ভালোবাসতেন, আমাদের স্কুলে একটা পদ খালি হয়েছিল, অঙ্ক শিক্ষকের, বি. এসসি. পাশ করলেই হয়ে যেত। তো হেডমাস্টারমশাই বললেন যে, “তুই এসে এখানে জয়েন কর”। আমার বাবারও খুব ইচ্ছে ছিল, বাবা তখন গ্রামে থাকতেন। আমার মনে হল যে, চলেই যাব গ্রামে? আচ্ছা আরেকটু চেষ্টা করে দেখি না।
তখন এখানে আমাদের পাড়ায় অরুণ চক্রবর্তী থাকতেন। ওর স্ত্রীর সঙ্গে আমার বৌদি প্রাইভেটে  এম. এ. পরীক্ষা দিচ্ছিল। ওর স্ত্রী আমাদের বাড়িতে আসতেন, আমার বৌদির সঙ্গে একসঙ্গেই পড়াশোনা করতেন। সেসময় অরুণ চক্রবর্তীর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। তখন উনি বলেছিলেন যে, অরুনদাকে তোমার কথা বলেছিলাম, ও খুব Interested, If you can meet him। তো আমি একদিন ওর সঙ্গে দেখা করলাম, উনি আমার সবটা শুনলেন, শুনে বললেন যে, “তোমার লেখার হাত কিরকম?” আমি এক-দু’টো লেখা ওঁকে দেখালাম, স্কুল ম্যাগাজিনের আমি সম্পাদক ছিলাম, স্কুল ম্যাগাজিনের লেখাগুলো নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলো দেখালাম। লেখালেখির প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল।
ক বাবু : স্কুলের সেই লেখালেখিগুলো কি বিজ্ঞানের উপরেই করতেন?
পথিক : না না।একদমই না। একেবারেই না‌। এইকথাটাই আমি আজকালকার ছেলেমেয়েদের বলি, “জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা”, এই কথাটা আমি খুব বিশ্বাস করি। আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশেই ছিল পল্লী পাঠাগার। সেখানে দেব সাহিত্য কুটিরের প্রচুর বই থাকতো। বড়দের বই থাকতো – শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র ঠাসা থাকতো। আর থাকতো প্রচুর দৈনিক সংবাদপত্র। শুকতারা, সন্দেশ, শিশুসাথী – সেসব তো থাকতই। আর কাগজ আসতো – আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, অমৃতবাজার, Statesman – তো আমি সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। ফলে তার কিছু রেশ আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। আমার এখনো মনে হয় এই যে আমি লেখালেখির জগতে এলাম, তাতে এসবের প্রভাব ছিল।
খ বাবু : আচ্ছা।
পথিক: আরেকটা গল্প বলি‌। তখন সত্তরের দশকে ‘ফুটবল’ বলে একটা নাটক করেছিল নান্দীকার, ‘৭৭ সালে। মূল জার্মান নাটকের নাম Zigger Zagger।নাটকের বিষয়বস্তু ছিল ফুটবল পাগলদের নিয়ে। সেই নাটকে দু’ টো চরিত্র ছিল, একজন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, আরেকজন রুদ্রপ্রসাদ ।রুদ্রপ্রসাদ হচ্ছে পাড়ার মস্তান আর অজিতেশ হচ্ছেন – বেশ্যালয়ে যান, বড়লোক মানুষ। সেই বেশ্যার বোনপো হচ্ছে হরি। সে-ই নাটকের হিরো। হিরো-র মা বাবা মারা গেছেন। আমি যখন প্রথম নাটকটা দেখেছিলাম,হরির রোলটা করেছিলেন রঞ্জিত চক্রবর্তী। তখন আমি বসুমতীতে চাকরি করি,সুভাষ মৈত্রের আন্ডারে এ কাজ করতাম। সুভাষদার বন্ধু ছিলেন রঞ্জিত। যখন নাটকটা রিহার্সাল হয় – সুনন্দ দত্ত রায় ছিলেন Statesman এর assisstant editor। তিনি হচ্ছেন, অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ এর বন্ধু। কেয়া চক্রবর্তী বেশ্যা রোলটা করেছিলেন। আমি খুব খেলা পাগল, রাত জেগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এর টিকিটের লাইন দিতাম। রঞ্জিত চক্রবর্তী জানতেন, বললেন, “তোমাদের জন্যই একটা নাটক করছি, তুমি এসো, আমার ভালো লাগবে।” আমার খুউব ভালো লেগেছিল নাটকটা।
তো ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগানের খেলায় হরি হচ্ছে ইস্টবেঙ্গল এর সাপোর্টার। মাসির পকেট মেরে হরি মাঠে যায় ! বিকেল হলেই পাড়ার মস্তান রুদ্রপ্রসাদ হরিকে ডাক দেয়, “হরি চারটে বাজে কিন্তু”, হরির তখনও পয়সা জোগাড় হয়নি। কি করে পয়সা জোগাড় করবে সেই চিন্তায় মগ্ন। আর অজিতেশ হরিকে বলেন, “টাইপ শেখো হরি, টাইপ শেখো।”
তো আমিও বি. এসসি. পাশ করার পরে টাইপ শিখেছিলাম, বেলেঘাটার ‘গোপালদা’স লেক ভিউ টাইপরাইটিং স্কুল’। গোপালদা’স বিখ্যাত লোক ছিলেন। আমার সেই শেখাটা অদ্ভুতভাবে কাজে লেগে গেল।
আমি তারপর ‘বসুমতী’, ‘ আজকাল’ ছেড়ে ‘Telegraph’ -এ গেলাম। সেখানে আমার যে skill টা কাজে লেগেছিল, তা হল এই typewriting – আমি দশআঙ্গুলে ইংরেজিতে টাইপ করতে পারতাম। এটা ১৯৮২ সালের ঘটনা, ১ জুন আমি ‘Telegraph’ -এ জয়েন করি। সেখানে আমার মতো, আমার চেয়ে ইয়াং অনেক বাচ্চা কাচ্চা জয়েন করেছিল, তারা কেউ টাইপ করতে পারতো না। আমার টাইপ তাড়াতাড়ি হয়ে যেত, রিপোর্ট টাইপ করা। তো বাকিদের বলতাম, “দে আমায় দে, আমি তাড়াতাড়ি করে দিচ্ছি।” ফলে আমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। তো আমি দেখলাম, “জীবনের ধন কিছুই যায়না ফেলা”।
খ বাবু: অর্থাৎ বাস্তবে ফলে গেল। আচ্ছা কুসংস্কার জিনিসটায় কতটা বিশ্বাস করেন?
পথিক গুহ: আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার একটা অভিজ্ঞতা শোনো তবে। আমাদের গ্রামের স্কুলে সেন্টার পড়তো না। রায়গঞ্জে সেন্টার পড়তো, আমাদের গ্রামটা হচ্ছে রায়গঞ্জের কাছাকাছি। কিন্তু তখন প্রবল নকশাল আন্দোলন এবং প্রবল টোকাটুকি। পরীক্ষার হলে টেবিলের ওপরেই ছোরা গেঁথে রেখে ছেলেরা পরীক্ষা দিত, যাতে গার্ডরা কোনো কথা বলতে না পারে, বই খুলে লিখতো। এই যুগ ছিল তখন!
খ বাবু: আপনার বন্ধুরাও?
পথিক গুহ: না, আমাদের স্কুলে এসব হত না। কিন্তু রায়গঞ্জের সেন্টারে ওটা হত। আমরা জানতাম, শুনতাম। তো যাইহোক, আমাদের রায়গঞ্জে সেন্টার  পড়লো, সাতটা স্কুলের সেন্টার পড়েছিল রায়গঞ্জে। সাতটা স্কুলের এর ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয়ের জন্য সমস্ত রোল নম্বর ধরে ধরে, ওই গার্লস স্কুলের কর্তৃপক্ষ একটা আলাদা ঘর করেছিল, যাতে এরা আনডিস্টার্ব পরীক্ষা দিতে পারে। প্রত্যেকটা স্কুলের দু’জন, তারমানে সাত-দু’গুনে চোদ্দটা ছেলে আমরা একটা আলাদা ঘরে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
খ বাবু: আপনি তো ফার্স্ট হতেন…
পথিক গুহ: হ্যাঁ, ফার্স্ট হতাম। আমার রোল ছিল, Roll Rai(Sc) -1। মানে রায়গঞ্জ সেন্টারে সায়েন্সে এক’নম্বর রোল আমার। এডমিট কার্ডে লেখা থাকত Roll Rai(sc) 1। বি.এসসি. এর খারাপ রেজাল্ট হওয়ায় যখন ব্যাংকে পিয়ন, ক্লার্ক– এরকম প্রচুর পরীক্ষা দিতাম, ইন্টারভিউ তে আমাকে প্রত্যেক জায়গায় বলতো, “তুমি কি ক্লাসে এ ফার্স্ট হতে?” কেননা, এইচ. এস. এর Roll Rai(Sc) -1 বয়স প্রমাণ করার জন্য দেখাতে হত। তো আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম বলে Sc -1। স্কুল থেকে জেনে নিয়ে ওরা, ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয় কে আলাদা একটা ঘর দিয়েছিল। আমি পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখলাম যে, আমাদের একটা আলাদা ঘর, আমার মনে হল, “হঠাৎ এরকম ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয়ই কেন?” ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমার যে কাকার বাড়িতে আমি উঠেছি, তিনি আমাদের হেডমাস্টার মশাই ছিলেন, তাঁর ছেলে আমার সাথে পরীক্ষা দিচ্ছিল। তাঁর ছেলে বলে তার ছেলের ওই ঘরে সিট পড়েনি। তো ও আমাকে ওই ঘর চেনাতে এসে – আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়ো, আমাকে খুব ভালোবাসতো, “ছোটো ভাই, ছোটো ভাই” করতো, খুব ন্যাওটা ছিলাম তার। আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, – তাদের স্কুলের ফার্স্ট বয়ের সিট  পড়েছে আমার সামনে, আমি সেকেন্ড বেঞ্চে, আর ও ফার্স্ট বেঞ্চে । আমার ডাকনাম হরি, ও আমাকে হরিদাস বলে ডাকতো, ওদের ফ্যামিলির সবাই। আমাকে বললো, “হরিদাস,ওই ছেলেটা সব জানে, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবি না, ও কিন্তু সব ভুলভাল বলবে!” আমি বললাম, “কে ও?” বললো, “আমাদের ক্লাসের এর ফার্স্ট বয়!” জিজ্ঞেস করলাম, “কী নাম?” বললো, “শিবরতন আগরওয়ালা”। মারোয়াড়ি, নর্থ বেঙ্গলে প্রচুর মারোয়াড়ি ফ্যামিলি আছে, যারা মারোয়াড়ি এখন আর নেই, বাঙালি হয়ে গেছে। ওখানেই বিয়েথা করে, সংসার করেছে। কিন্তু ওরা সব বিজনেসম্যান। তাদের একটি ফ্যামিলির ছেলে, ওর ডাকনাম শিবু।
আমাদের সময় একটি কাপড় এসেছিল, জামাকাপড় তৈরি করার, “ডেক্রন” নাম। প্লাস্টিকের মতো কাপড়টা দেখতে, সুতির কাপড় নয়, কেমিক্যালের কাপড়। তো দেখতাম ওই ছেলেটি, শিবরতন আগরওয়ালা ওরফে শিবু, যে আমার সামনে বসতো, সে প্রতিদিন নীলপ্যান্ট আর ডেক্রনের একটা শার্ট পড়ে আসত। আমি Infer করেছিলাম যে, ও নিশ্চয়ই খুব Superstitious, ওই শার্ট এবং প্যান্টটা ওর খুব লাকি, সেজন্য ও সেটা পড়তো। আমাদের সময় স্কুল ড্রেস বলে কিছু ছিল না। আমি ষাটের দশকের শেষে, সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের কথা বলছি। কলকাতার স্কুলে হয়তো ছিল! ওই ধরনের গ্রামের স্কুলে ছিল না, শহরের স্কুলেও ছিল না।আমি তো পায়জামা পরে পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের সময় পায়জামা পরে হরবখত ছেলেরা, সাদা কাপড়ের নয়,পাট্টা কাপড়ের পায়জামা পরে আমরা স্কুলে যেতাম। সেসব easily acceptable ছিল। তো দেখলাম, শিবু রোজ একটা টেরিকটনের নীলপ্যান্ট, টেরিকটন তখন সদ্য এসেছে, আর ডেক্রনের একটা শার্ট পড়ে আসত । আর ওর পেনটা কালির পেন ছিল, ডটপেন আসেনি- ডটপেন এসেছে, কিন্তু ডটপেনে পরীক্ষা দেওয়া যেত না। ওই কালির পেনে পরীক্ষা দিতে হত। ও এতটা Superstitious ছিল বলে আমার ধারনা যে – ওই পেনটা, leak করলে ও ওর পেনটা সমানে জামায় মুছতো। ফলে জামাটা 5th পরীক্ষার দিন দেখলাম পুরোটা হাফ জার্সির মতো হয়ে গেছে, মুছে মুছে – ওই একই পেন আনে ও, leak করে, আঙ্গুলগুলো কালিতে ভরতি হয়ে যায়, আর সমানে মুছে যায় জামাতে। কিন্তু ওর জামা প্যান্ট ও ছাড়ে না।
আর কী দেখলাম? আমাদের স্কুল সেন্টার  থেকে অনেকটা দূর, প্রায় পঞ্চাশ কিমি দূরে রায়গঞ্জ। ফলে আমাদের স্কুলের কোনো টিচার কে গার্ড দিতে ডাকা হত না। রায়গঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের টিচাররা গার্ড দিতেন। তো শিবু যখন পরীক্ষা দিচ্ছে, প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর ওদের স্কুলের সাবজেক্টের টিচার হয়তো, আমার অনুমান, আবার নাও হতে পারেন…. প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর আসছেন, আর ওকে বলছেন, “শিবু, কি লিখলি দেখা।” শিবুকে লেখা থামিয়ে খাতা দেখাতে হচ্ছে। মানে, ওর খাতাটা পুরোপুরি examined হয়ে যাচ্ছে, যখন ও পরীক্ষা দিচ্ছে তখনই। এটা গেল একদিক, উল্টোদিকে আমি এটাও লক্ষ্য করলাম যে, শিবু কিন্তু কোনোকিছুই ভুল লিখছে না। কোনো টিচারই বলছে না যে, “এটা ভুল লিখেছিস, এটা এই কর!”, সেরকম কিন্তু কোনো teacher ই বলতে পারছে না, কিন্তু to be doubly sure, ওরা প্রত্যেকেই এসে চেক করে যাচ্ছে। এটা আমার দেখে খুব খারাপ লাগলো। যাইহোক, পরীক্ষা দিলাম। আমার বাবা চেয়েছিলেন যে, আমি পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় না আসি, ওইদিকে নর্থ বেঙ্গল, রায়গঞ্জ বা মালদা কলেজে ভর্তি হয়ে যাই। আমি বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, মা-র কাছ থেকে কিছু পয়সা জোগাড় করে, ভাড়ার পয়সা পুরোটা হল না, একজন দাদা গরীব হওয়া সত্বেও, আমার ভাড়া দিয়ে দিলেন।কলকাতায় পোঁছে দাদা-বৌদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওঁকে দিয়ে দেব এই শর্ত ছিল। আমি কলকাতা শহরে রেজাল্ট দেখলাম।
আমাদের সময় ‘গেজেট’ বেরতো। মানে যেদিন রেজাল্ট  বেরোতো,ওতে ওই রোল নম্বর, আর পাশে নম্বর লেখা থাকতো। মুড়মুড়কির মত বিক্রি হতো । একটা রেজাল্ট দেখলে, এক’টাকা নিত। সেইসময় এক’টাকার অনেক দাম। পাড়ায় পাড়ায় ‘গেজেট’ নিয়ে দৌড়তো, বেকার ছেলেরা। কেননা, ‘গেজেট’ এর দাম হয়তো পনেরো টাকা, কিন্তু এই ‘গেজেট’ দেখিয়ে অনেক টাকা রোজগার হয়ে যেত। তো এইচ. এস পরীক্ষা দিয়েই, আর ওয়েট না করে – বাবার প্ল্যান আমি জানতাম, কলকাতা শহরে পাড়ি দিলাম। ওই ভদ্রলোক ইন্টারভিউ দিতে এলেন কলকাতায়, ওর সঙ্গে চলে এলাম।
আমি এসে দাদার বাড়িতে থাকলাম। দাদার রেডিও  ছিল না, দাদার বাড়িওয়ালার ঘরে রেডিও ছিল। যেদিন রেজাল্ট বেরোচ্ছে তার আগের দিন রাত্রিবেলা – কাল সকালে হয়তো ‘গেজেট’ প্রকাশিত হবে, ভোরবেলা – রাত্রি তিনটের সময় ‘গেজেট’ বিক্রি হত, যাতে লোকেরা ‘গেজেট’ কিনতে পারে। তার আগের দিন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, যেটা পার্কস্ট্রিটে অফিস, সেখানে প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা করা হত নাম, আর সেইদিনই রাত্রে, স্থানীয় সংবাদে নামগুলো পড়া হত, ঘোষণা করা হত। তখন এইচ. এস মানে ইলেভেনে, তখন ’10+2′ ছিল না, শুধু ইলেভেন ছিল। আমি সেদিন উৎকণ্ঠিত চিত্তে , কত পার্সেন্ট…… আমার তো স্ট্যান্ড করার কোনো চান্স নেই, কিন্তু ওই…. কত পার্সেন্ট পাশ করেছে, কত পার্সেন্ট ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে, সেইসব শোনার জন্য ওদের বাড়িওয়ালার ঘরের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছি ! সেদিন স্থানীয় সংবাদ পড়ছিলেন পীযুষ বন্দোপাধ্যায় “আজ স্থানীয় খবর পড়ছি, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, প্রথম খবর হচ্ছে – আজ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রধান এক সাংবাদিক সম্মেলনে Higher Secondary এর প্রথম দশজনের নাম ঘোষণা করেছেন। প্রথম দশজন হলেন…….”। প্রথম হয়েছিল শঙ্কর দাস শর্মা, হেয়ার স্কুল; সেকেন্ড অভিজিৎ গুহ, South Point School। তৃতীয় হল শিবরতন আগরওয়ালা, রায়গঞ্জ সুদর্শনপুর উচ্চবিদ্যাচক্র!
( ক ও খ বাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন)
খ বাবু: আচ্ছা। আপনি তবে প্রতিভায় কতটা বিশ্বাস করেন?
পথিক: দেখো, আমি নিজে খুব বিশ্বাস করি above average, এই ধরনের মানুষ আর জিনিয়াস, এদের মধ্যে পার্থক্য বেশি নেই।যদিও মার্ক কাক একটা কথা বলেছেন যে, খুবই বিখ্যাত কথা – যারা Brilliant তাদের কাজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ তাদের কাজের দিকে তাকালে আমাদের মনে হতে পারে যে, আমরা আরেকটু বেশি পরিশ্রমী, আরেকটু বেশি বুদ্ধিমান হলে, আরেকটু বেশি focused হলে, ওই কাজগুলো আমরাও করতে পারতাম। কিন্তু Geniuses are magicians, ওদের কাজের ব্যাখ্যা আমরা কোনোদিনই করতে পারবো না, আমাদের পক্ষে পারা সম্ভব না।” কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। Genius বলতে আমি ছোটোখাটো Genius এর কথা বলছি আর কি! আইনস্টাইন বা ওই ধরনের Genius এর কথা আমি বলছি না। Difference কেন সামান্য – আমার এই HSএই একটা ঘটনা ঘটেছিল, তা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম!
খ : কি ঘটনা?
পথিক গুহ ( কিছুক্ষণ থেমে): আমি অঙ্কে ৯৫-১০০ এর কমে কোনোদিন পাইনি! কিন্তু বাংলায় আমি ৩৭ পেয়ে পাশ করেছি অনেক ক্লাসে, 1st হওয়া সত্ত্বেও। আমি অন্য বিষয়ে এত নম্বর পেতাম যে বাংলায় ৩৭,৪২,৪৫ পাওয়া সত্ত্বেও আমার result এ আমার সঙ্গে 2nd Boy এর Difference থাকতো ৩০,৩২,৩৫। তার কারণটা হচ্ছে অন্য subject। ফলে আমার ধারনা ছিল, আমি H. S. -এ আর কোনো বিষয়ে letter পাই বা না পাই, আমি একটা বিষয়ে letter পাবই এবং letter শুধু নয়, ২০০ তে পরীক্ষা হত তখন, 1st paper, 2nd paper, অঙ্কে ২০০ এর মধ্যে আমি ১৯৫ এর মতো পাবো। কিন্তু আমাদের বারে প্রথম ব্যতিক্রম হল, আগের বছর অবধি Science group এর প্রত্যেকটা প্রশ্নই ইংরাজি এবং বাংলায় থাকতো। আমাদের বারই নিয়ম ভেঙে শুধু বাংলায় করা হল। একটা অঙ্ক ছিল….. তোমাদের ওই অঙ্কগুলো মাধ্যমিকে থাকে না টুয়েলভ-এ থাকে – ওই যে equation বানিয়ে solve করতে হয়?
খ বাবু: সমীকরণ গঠন? ওগুলো তো আমাদের ছোটবেলায় থাকে।
পথিক গুহ: ওই একটা x, y দিয়ে থাকে, একটা কথায় থাকে, সেখান থেকে x, y ধরে করতে হয়!
খ বাবু: হ্যাঁ, ওগুলো সেভেন-এইট থেকে শুরু হয়।
পথিক গুহ: আমাদের সময় ওটা H. S. এ থাকতো, একটা x, y দিয়ে, আরেকটা কথায় লেখা থাকতো, সেখান থেকে x, y ধরে নিয়ে equation বানিয়ে করতে হত, নম্বর ৮ এবং ৭। আমাদের বারই ওটাও ব্যতিক্রম হল, একটাই অঙ্ক, শুধু কথা দিয়েই রইলো।
খ বাবু: যেটার বাংলাটা আপনার বুঝতে অসুবিধা হল?
পথিক গুহ: হ্যাঁ, আমার বুঝতে অসুবিধা হল। প্রশ্নটা এখনো আমার মনে আছে……
“একটি ভগ্নাংশের লব ও হরের সমষ্টি ১০,ভগ্নাংশটি হইতে উহার অনোন্যকের তফাৎ ৪০/২১, ভগ্নাংশটি নির্ণয় করো।”
খ বাবু: এখনও এই ধরনের অঙ্ক আসে।
পথিক গুহ: তো এই অঙ্কটা এত বিখ্যাত আরকি! ( সবার হাসি)
আমি ওটা দেখেই লোভে পড়ে গেলাম, “একটা অঙ্ক করলেই পনেরো নম্বর, প্রথমেই ওটা করতে হবে!” আমি ওটা করলাম। অঙ্কটার উত্তর তুমিও জানো, আমিও জানি, ভগ্নাংশটা হচ্ছে – ৩/৭, কিন্তু (৩/৭ – ৭/৩) করলে উত্তর ৪০/২১ হচ্ছে না!

খ বাবু: না, (৭/৩ – ৩/৭) করলে – তাহলে ৪০/২১!

পথিক গুহ: কিন্তু তুমি তো ওটা উল্টে দিলে, ৩/৭ পরে লিখলে, আমি তো ওটা আগে লিখে যাচ্ছি, ফলে আমাকে এখানে ‘ -’ লিখতে হবে। Centre -এর একটি ছেলেও এটা করলো না, একমাত্র ব্যতিক্রম শিবরতন আগরওয়ালা।

ক বাবু: “ভগ্নাংশটি হইতে তার অনোন্যকের তফাৎ”! তো ভগ্নাংশটি তুমি কোনটা ধরবে? তুমি তো উল্টে বিয়োগ করতে পারবে না!
খ : আচ্ছা, ঠিক।
পথিক গুহ: প্রশ্নে ছিল, “ভগ্নাংশটি হইতে তার অনোন্যকের তফাৎ”…….. প্রশ্নটাই তো ভুল ছিল!
তো আমি কেটে যাচ্ছি, করে যাচ্ছি। I lost my sense। আমি বুঝতে পারছি যে এটা ৩/৭ উত্তর হবে। কাটছি-করছি, কাটছি-করছি, এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, সেদিকেও খেয়াল নেই আমার – রোখ চেপে গেছে, কেন হচ্ছে না? আমার বোধহয় calculation এ কিছু ভুল হচ্ছে! x, y দিয়ে করছি তো – কোথাও কিছু ভুল করেছি, এই করতে করতে সময় চলে গেল, অঙ্কটা হল না। ফলে আমি একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম । খুব খারাপ হল। – পরীক্ষা দিয়ে সেই একদিনই আমি শিবুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দাদা আমায় warn করে দেওয়ার জন্য, in fact ওকে প্রশ্ন করার সুযোগও ছিল না – ও এতটাই ব্যস্ত থাকতো, মাঝেমাঝেই তো স্যার এসে ওর খাতা চেক করছে, ফলে ওর সময় নষ্ট হচ্ছে। ও কোনো স্যারকে কিন্তু না করতে পারছে না যে, “স্যার, আমার সময় নষ্ট হচ্ছে।” খুব অনুগত, বাধ্য ছাত্রের মতো ও খাতা খুলে দেখাচ্ছে। যাইহোক, প্রথম আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার উত্তর কত হল?” বললো, “৩/৭”। আমি বললাম, ” কী করে ৩/৭ হল তোমার?” ও বললো, “তুমি কি করেছো, equation টা বানিয়েছো, ওটা কি করেছো, ( x/y – y/x )!” আমি বললাম, “হ্যাঁ, তাইতো বলেছে প্রশ্নে!” ও বললো, “ওটা প্রশ্নে ভুল ছিল, ওটাকে করতে হবে y/x – x/y….”। তখন আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি!
খ বাবু: এটাই তবে genius আর average এর পার্থক্য?
পথিক গুহ: হ্যাঁ। সেই ছেলেই তো H. S. -এ 3rd হবে। তাই না!
শঙ্কর দাস পেয়েছিলো ৯১১,অভিজিৎ গুহ ৯০৮ আর শিবরতন আগরওয়ালা পেয়েছিল ৯০৭।
ক বাবু: আচ্ছা, ধরুন আপনার কাছে যদি আবার কোনো সুযোগ আসে তবে আপনি গবেষণা বেছে নেবেন, নাকি এই লেখালেখি ?
পথিক গুহ: অবশ্যই গবেষণা।
খ বাবু: Physics না অঙ্ক?
পথিক গুহ: সেটা নিয়ে আমি confused। আমি ঠিক জানিনা আরকি, হয়তো অঙ্ক!
খ বাবু : আচ্ছা, এতদিন ধরে লিখে এই বয়সে স্বীকৃতি পেয়ে কি মনে হচ্ছে?
পথিক গুহ: দেখো আমার বয়স এখন ৬৫,আমি মোটামুটিভাবে অবিনয়ী। আমি মনে করি যে, আমি যে ধরনের লেখা লিখেছি, যতদিন ধরে লিখেছি, তাতে একটাআধটা পুরস্কার আমার পাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি জীবনে এই ৬৫ বছর বয়সে প্রথম পুরস্কার পেলাম। সেটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দেওয়া হয়, রবীন্দ্র পুরস্কার। তো আমি এই প্রসঙ্গে বলি যে, আমার একটা অহংকারও ছিল, আমার যিনি গুরু – এই লেখালেখির জগতে, তার নাম সমরজিৎ কর। তিনি কোনও পুরস্কার পাননি এবং আমারও ইচ্ছে ছিল যে আমিও কোনো পুরস্কার পাবো না, এই রেকর্ডটা আমার ভাঙবে না। সেই রেকর্ডটা ভেঙে গেল সম্প্রতি, এবছর আমাকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়ায়। খুশি অখুশি কোনোটাই আমি নই, কারণ ৬৫ বছর বয়সে পুরস্কারের কোনো মূল্যই আমার কাছে নেই, একমাত্র মূল্য হচ্ছে, পঞ্চাশহাজার টাকা দিয়েছিল, সেটার আমার কাছে যথেষ্ট মূল্য আছে। এই বয়সে আমি মনে করি না আমার কাছে পুরস্কারের কোনো incentive আছে।

(পথিক গুহের ছবি কৃতজ্ঞতা-চন্দন বাড়ৈ ও নন্দঘোষ লেন।)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত