পাওলো কোয়েলহোর অণুগল্প

Reading Time: 3 minutes

ভাঙা কলসি আর বুড়ো হবার গল্প

এক দেশে এক লোক ছিল। সে প্রতিদিন কাঁধে ঝোলানো একটা বাঁশের দু’মাথায় দুটো কলসিতে করে তার গ্রামে পানি নিয়ে আসতো।

কলসি দুটোর একটা ছিল খুব পুরনো, গায়ের কয়েক জায়গায় ফুটো। এই কলসির অর্ধেক পানিই বাড়ি আনতে আনতে রাস্তায় পড়ে যেত।

যে কলসিটা ভাল ছিল, সে নিজের কাজ ঠিকঠাক মত করতে পেরে তো দারুণ খুশি! কিন্তু অন্য কলসিটার সবসময় লজ্জায় মুখ ভার হয়ে থাকতো।

একদিন লোকটা যখন পানি আনতে যাবে, বুড়ো কলসি তখন লজ্জার মাথা খেয়ে বলে উঠলো, “আমাকে দিয়ে তো তোমার কোন কাজই হয় না। এত কষ্ট করে যে পানিটা নিয়ে আসো, তার অর্ধেকটাই তো পড়ে যেয়ে নষ্ট হয়। বাকিটা কাজে লাগে কেবল।”

লোকটা হেসে বললো, “আজ বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তার দিকে একটু খেয়াল কোরো।”

আসার সময় পুরনো ভাঙা কলসিটা অনেক ফুল আর গাছপালা দেখতে পেলো পথে। লোকটা তাকে বললো, “দেখেছো তোমার দিকের রাস্তাটা কত সুন্দর? এমনটা কী করে হয়েছে জানো? বলছি শোনো।

তোমাদের নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তোমার অর্ধেকটা পানি পড়ে যাতে নষ্ট না হয়, এজন্য আমি পথের ধারে গাছের চারা লাগিয়েছি। তোমার হারানো পানিটা ওদের খুব কাজে লাগে, আর আমারো! আমি আমার বাচ্চাদের ভালো ভালো শাকসবজি খাওয়াতে পারি, গোলাপ দিয়ে ঘর সাজাতে পারি; তোমার কারণেই তো!

আমরা ভাবি বুড়ো হলে আমাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়, কিন্তু তা কেন হবে? আমরা আগের গুণগুলো হারিয়ে নতুন কিছু যোগ্যতা অর্জন করি কেবল। সেগুলো ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলেই বুড়িয়ে যাওয়াটা সার্থক।”

 

.

ছোট বোনটির প্রশ্ন

চার বছরের ছোট্ট তনুর ভাইটা যেদিন হল, সেদিন থেকেই ও বাবা-মার কাছে খুব করে বায়না ধরত। ওকে যেন বাবুটার সাথে একদিন একা থাকতে দেয়া হয়, অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও। কিন্তু বেচারীর আশা পূরণ হল না।

বাবা-মার মনে হল, ওর বয়সী বাচ্চাদের মত তনুও যদি ঈর্ষা না সামলাতে পেরে ভাইটার কোন ক্ষতি করে ফেলে!

তনু কিন্তু ভাইকে অনেক আদর করত।

এই দেখে শেষ পর্যন্ত তারা ভাবলেন, ছোট মানুষ, একটা সুযোগ দিয়েই দেখা যাক না! তারা তনুকে ভাইয়ের সাথে একা এক ঘরে থাকতে দিলেন, তবে দরজা খোলা রাখলেন, যাতে বাইরে থেকে দেখতে পারেন ভেতরে কি হচ্ছে।

তনু একলা হওয়ামাত্রই পা টিপে টিপে ভাইয়ের পাশে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“লক্ষী ভাই আমার!
আমাকে বলতে পারবে স্রষ্টা দেখতে কেমন?
আমি যে ভুলতে বসেছি!”

.

নার্সিসাস আর সেই হ্রদ

নার্সিসাস নামের এক তরুণ প্রতিদিন এক হ্রদের পারে বসে পানিতে নিজের প্রতিচ্ছায়া দেখতো।

একদিন সকালে এমনি বিভোর হয়ে নিজেকে দেখার সময় হ্রদের পানিতে পড়ে ডুবে মরে নার্সিসাস। সে যেখানে পড়ে যায়, সেই জায়গাতে একটা ফুল ফোটে। সেই ফুলের নাম রাখা হয় নার্সিসাস।

হ্রদটা ছিল একটা বনের পাশে। একদিন বনের দেবীরা এসে দেখলেন, হ্রদের আগেকার মিষ্টি পানি বদলে সব চোখের নোনা পানিতে ভরে গেছে।

তারা হ্রদটাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছো কেন?
হ্রদ উত্তর দিল, আমি নার্সিসাসের জন্য কাঁদছি।

দেবীরা বললেন, কাঁদাটাই স্বাভাবিক। বনের ভেতর আমরা নার্সিসাসকে কত চেয়েছি, কিন্তু কেবল তুমিই তো সবচেয়ে কাছ থেকে ওর সৌন্দর্য দেখতে পেতে।
হ্রদ তখন প্রশ্ন করলো, তাই? নার্সিসাস সুন্দর ছিল?

দেবীরা অবাক হয়ে বললেন, বলো কী? এটা তো তোমারই সবচেয়ে ভাল জানার কথা। ও তোমার পানিতেই তো প্রতিদিন নিজেকে দেখতে আসতো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হ্রদ বললো, আমি নার্সিসাসের জন্য কাঁদছি ঠিক, কিন্তু আমি আসলে কখনো খেয়াল করি নি যে ও সুন্দর ছিল। আমি কাঁদছি কারণ ও যখন আমার তীরে বসে থাকতো, তখন ওর চোখের গভীরে আমি আমার নিজের সৌন্দর্য প্রতিফলিত হতে দেখতাম।

 

.
ছায়া

ঈশ্বর একবার এক লোকের কাছে একজন দেবদূতকে পাঠালেন। লোকটির কিছু অসাধারণ গুণ ছিল – তিনি তাঁর চারপাশের সবাইকে ভালবাসতে আর অবলীলায় ক্ষমা করে দিতে পারতেন।

দেবদূত তাঁকে এসে বললেন, “ঈশ্বর আপনার ভাল কাজের পুরস্কার দিতে আমাকে পাঠিয়েছেন। বলুন আপনি কী চান? আপনার যা ইচ্ছে তাই আপনি চাইতে পারেন। আপনি কি মানুষকে রোগমুক্ত করার ক্ষমতা চান?”

“মোটেই না। এ দায়িত্ব ঈশ্বরের কাঁধে থাকলেই বরং আমি খুশি,” লোকটির উত্তর।

“তাহলে? পাপীদের সৎপথে ফিরিয়ে আনতে চান?”

“সে তো আপনার মতো দেবদূতদের কাজ। আমি কারো শ্রদ্ধার পাত্র হতে চাই না, কোন ভাল কাজের দৃষ্টান্ত হয়েও থাকতে চাই না।”

“দেখুন, আপনি নিজে যদি কিছু বেছে না নেন, তাহলে আমাকেই আমার ইচ্ছামত কোন না কোন ক্ষমতা আপনাকে দিতে হবে। তা না করে স্বর্গে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

এক মুহুর্ত ভেবে লোকটি বললেন, “আচ্ছা, তাহলে আমি চাই আমাকে দিয়ে ভাল কিছু হোক; কিন্তু তা যেন কেউ বুঝতে না পারে, এমনকি আমি নিজেও না। তা না হলে আমার মনে নিজেকে নিয়ে অহংকার জন্মাতে পারে।”

এরপর থেকে লোকটি যেখানেই যেতেন, সেখানেই রুগ্ন মানুষ স্বাস্থ্য ফিরে পেতো, কৃষকের জমি ফসলে ভরে উঠতো, আর দুখী মানুষদের জীবনে সুখের দেখা মিলতো। এমন করেই তিনি অনেক বছর পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন।

দেবদূত তাঁকে কী পুরস্কার দিয়েছিলেন জানেন? তিনি তাঁর ছায়াকে রোগমুক্তির ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা শুধু তখনই কাজ করতো যখন তিনি সূর্যের দিকে ফিরে থাকতেন। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে যেহেতু তাঁর ছায়া থাকতো তাঁর পেছনে, তাই তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনোই জানতে পারেননি কী অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়েছিল।

 

 

 

.

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>