ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম বাণিজ্য করতে আসে পর্তুগিজগণ। বাংলায়ও পড়েছিল তাদের বাণিজ্য ছাউনী। তবে বাণিজ্য দিয়ে নয় বরং বাংলার মানুষের মনে তারা ছিল ত্রাস হয়ে। চলুন জনে আসা যাক কেমন ছিল বাংলায় তাদের প্রভাব।
ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে হালকা ও দ্রুতগামী জাহাজের তৈরী ও ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে অক্ষাংশ নির্ণয়ে কৌণিক উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহারে পর্তুগিজদের দক্ষতা তাদের সমুদ্রযাত্রায় যথেষ্ট সহায়তা করে। ভাস্কো দা গামা প্রথম পর্তুগীজ যার নেতৃত্বে পর্তুগিজরা কালিকট বন্দরে জাহাজ নোঙর করাতে সমর্থ হয়। ভাস্কো দা গামার এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রিন্স অঁরি দ্য নেভিগেটর। তখন থেকেই উপমহাদেশে পর্তুগিজ প্রভাবের শুরু।
ভাস্কো দা গামার ভারতবর্ষে আগমনের কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে। প্রথম পরোক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৫১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে। ধারণা করা হয় বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে সুলতান হুসেন শাহের শাসনামলে। ফ্লোরেন্সের বণিক গিওভান্নি ডি এম্পলি কর্তৃক প্রেরিত পর্তুগিজ বণিক যোয়াও কোয়েলহো ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে গঙ্গায় এসে পৌঁছেন। এটিকেই বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের সূচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।
ব্যবসা ও জীবনযাপন
পর্তুগিজদের বাংলায় আগমনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। শান্তিপূর্ণ নাহয় জোরজবরদস্তি ,যেভাবেই হোক না কেন ব্যবসার প্রসারই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। বলা হয়ে থাকে রোমান মেয়েদের নিকট ঢাকাই মসলিন ছিল এক বহু আকাঙ্খিত বস্তু। এছাড়া সুজলাসুফলা বাংলায় মসলাসহ নানা পণ্যের উৎপাদন ছিল প্রচুর । আরব বণিকরা এসব পণ্যের চালান দিত ভেনিস জেনোয়া ইত্যাদি বন্দরে। তাদের ব্যবসায় ভাগ বসানোই ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলায় উৎপন্ন পণ্যের বিপ ণনের জন্য পূর্বে ও পশ্চিমে গড়ে উঠেছিল দুটি প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। পূর্বে ছিল চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে সপ্তগ্রাম । পর্তুগিজরা মূলত এ দুটি কেন্দ্র থেকেই ব্যবসা করত।
চট্টগ্রামের নাম তারা দিয়েছিল ‘পোর্ট-গ্রান্ডী’,যার অর্থ বড় স্বর্গ । সপ্তগ্রামের নাম তারা দিয়েছিল ‘পোর্ট-পিকানো’,যার অর্থ ছোট স্বর্গ । তখনকার বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়।
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হুগলী নদীর তীরে বসতি স্থাপনের জন্য পর্তুগিজদের অনুমতি প্রদান করেন। পর্তুগিজরা তাদের বসতিকে বলত Porto Pequeno। ষোড়শ শতকে জায়গাটি প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
প্রথম প্রথম পর্তুগিজদের ব্যবসার মূল সময়কাল ছিল বর্ষাকাল। বর্ষা শেষে তারা চলে যেত তাদের প্রধান আস্তানা পশ্চিম ভারতের গোয়ায়।
তৎকালীন ঐতিহাসিক বর্ণনামতে জানা যায় পর্তুগিজরা বিলাসী জীবনযাপন করত। তারা নবাবদের মত পোশাক-আশাক পরিধান করত, তাদের বাড়িতে দাস-দাসী থাকত প্রচুর। তাদের মূল কাজ ছিল আম, কমলা-লেবু থেকে মিষ্টান্ন তৈরী করা। পর্তুগিজ ময়রারা কেক পেস্ত্রি ইত্যাদি পদ তৈরী করত। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে দুধ থেকে ছানা তৈরীর প্রক্রিয়াটি পর্তুগিজদের কাছ থেকে আয়ত্ত করা।
তাছাড়া আমাদের দৈনন্দিন খাবারের অনেক উপকরণ পর্তুগিজদের অবদান। আনারস (পর্তুগীজ ভাষায় আনানাস),গোল-আলু, মরিচ, ঢেঁড়স, কামড়াঙা, কাজু বাদাম পর্তুগিজরাই প্রথম এনে চাষ করেছিল। বাঙালীর তামাক খাওয়াও শুরু হয় তাদের দেখাদেখি। এ নিয়ে পুঁথিও রচিত হয়েছে (তামাকু মাহাত্ম)।
১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পর্তুগীজ বংশোদ্ভুত ছিল প্রায় ২০হাজার ,যদিও এর মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের মত ছিল বিশুদ্ধ। এর কারণ হিসেবে বলা চলে পর্তুগিজরা শুরু থেকেই স্থানীয় মহিলাদের বিয়ের ব্যপারে আপত্তি করেনি।
বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পর্তুগীজ প্রভাব
পর্তুগিজদের বাংলা আগমনকালে এখানকার শাসকরা ছিল মুসলিম। প্রধানত দুই ধর্মের মানুষের বাস ছিল ,হিন্দু এবং মুসলিম । পর্তুগিজরাই প্রথম বাংলার মাটিতে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার করে। তারা বিশ্বাস করত খ্রিষ্টধর্মের প্রচারে সহযগীতা করলে তাদের পূণ্য হবে পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাও পাওয়া যাবে। তারা চট্টগ্রাম,বরিশাল,হুগলী,আরাকান সহ সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার দরিদ্র মানুষদেরকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করত। এমনকি মোগল রাজদরবারেও ছিল তাদের প্রবেশাধিকার। সম্রাট আকবর পর্তুগিজ পাদ্রীদের নিকট থেকে খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপারে জানতেন। সমুদ্র তীরবর্তী স্থান থেকে শত মাইল দূরেও তারা ধর্ম প্রচারে চলে যেতেন। এমনকি তারা কয়েকজন জমিদারকেও খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন বলে জানা যায়।
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দ পাওয়া যায়। যেমন–আলমারি,চাবি,বালতি,বোতল,বারান্দা ইত্যাদি। পর্তুগিজ ভাষা এদেশে এতটা প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে লর্ড ক্লাইভ পর্যন্ত অনর্গল পর্তুগিজ বলতে পারতেন।
বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ লিখেছেন পর্তুগিজ পাদ্রী মনোএল দ্য আসসম্পুসাঁউ ।
১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে তিনটি বাংলা বই বের হয়। ব্রাহ্মন-রোমান ক্যাথোলিক সংবাদ,কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ,বাংলা ও পর্তুগিজ ভাষার শব্দ ও ব্যাকরণ।
পর্তুগিজ সাধুরা অনেকেই এদেশের মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন। তেমনই একজন সেইন্ট জেভিয়ার্স(১৫০৬-১৫৫২)।মহৎপ্রাণ এই সাধুর জীবনের আদর্শ ছিল ধর্ম।কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজ তাঁর প্রতি সম্মানের নিদর্শন ।
আরেক পর্তুগিজের কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন এন্টনি ফিরিঙ্গি(১৭৮৬-১৮৩৬) ।তাঁর আসল নাম হ্যান্সম্যান এন্থনি। তিনি ছিলেন কবিয়াল,বাংলা ভাষার প্রথম ইউরোপীয়ান কবিয়াল।সৌদামিনি নামে একজন বাঙালি ব্রাহ্মন মহিলাকে সতীদাহের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিয়ে করে তিনি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন।তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় গানটি হল-‘সাধন ভজন জানিনে মা,জেতে তো ফিরিংগি’।
বণিক থেকে দস্যু
আগমনকাল থেকেই পর্তুগিজরা ছিল আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন। পর্তুগিজ নাবিক যোয়াও ডি সিলভেরিয়া চারটি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমনকালে সেখানে অবস্থানরত বাংলার জাহাজগুলি আক্রমন এবং লুট করেন। চট্টোগ্রামের মুসলিম শাসনকর্তার সাথে কখনো শান্তি কখনো যুদ্ধাবস্থা চলতে থাকে। পর্তুগিজরা চাইত তাদের একচেটিয়া বাণিজ্য।তাই তারা তাদের প্রতিপক্ষের জাহাজ লুট করত। তারা চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে বহু আরবীয় বণিকদের জাহাজ লুণ্ঠন করে এবং সমুদ্রের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। নদ-নদীবিধৌত এ অঞ্চলের মানুষ ছিল অনেকটাই নিরীহ এবং যুদ্ধবিমুখ। এই সুযোগে পর্তুগিজরা অবাধে গ্রামগুলোতে ঢুকে লুটতরাজ করত এবং নারী,শিশু ও সমর্থ যুবকদের দাস হিসেবে নিয়ে যেত। তাদের এই দাস ব্যবসার কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম ,বরিশাল,নোয়াখালি এলাকা। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গ’গ্রন্থে বলেন-‘মগদস্যুরা পর্তুগীজদিগের সঙ্গে যোগ দিয়া দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা অতি ভয়াবহ। তাহাদের স্পর্শদোষে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার এখনও পতিত হইয়া আছেন। বিক্রমপুরের মগ-ব্রাহ্মণদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। মগ ও পর্তুগীজদের ঔরসজাত অনেক সন্তানে এখনও বঙ্গদেশ পরিপূর্ণ। ফিরিঙ্গিদের সংখ্যা চট্টগ্রাম, খুলনা ও ২৪ পরগনার উপকূলে, নোয়াখালীতে, হাতিয়া ও সন্দ্বীপে, বরিশালে, গুণসাখালি, চাপলি, নিশানবাড়ী, মউধোবি, খাপড়াভাঙ্গা, মগপাড়া প্রভৃতি স্থানে অগণিত। ঢাকায় ফিরিঙ্গিবাজারে, তাহা ছাড়া কক্সবাজারে ও সুন্দরবনের হরিণঘাটার মোহনায় অনেক দুঃস্থ ফিরিঙ্গি বাস করিতেছে।’
মধ্যযুগে বাংলায় ইউরোপীয়দের ফিরিঙ্গি বলা হত। আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের বলা হত হার্মাদ। ফিরিঙ্গি শব্দটি এসেছে ‘ফ্রাঙ্ক’ হতে । ক্রুসেডের সময় আরবরা ইউরোপীয়দের বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করত । হার্মাদ শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ “আর্মাডা”হতে ,যা কিনা নৌবহর বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী তৎকালীন হার্মাদ আক্রমনে হিন্দু নারীদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন।তিনি বলেন-“বস্তুত সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার উপকূলীয় এলাকায় মগ-ফিরিঙ্গিদের অব্যাহত দৌরাত্ম্য সমাজ জীবনে এক অভিশাপরূপে আবির্ভূত হয়। বিশেষ করে হিন্দু সমাজে নারীদের অবস্থা করুণ পর্যায়ে উপনীত হয়। যে সকল স্ত্রীলোক কোনো না কোনোভাবে মগ-ফিরিঙ্গির সংস্পর্শে আসত, তারা সমাজে চরম লাঞ্ছনা ভোগ করত”।
অনেক ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের সহযোগিতা করতেন ভদ্রবেশী পাদ্রীরা।
পর্তুগিজদের দাস ব্যবসার ক্রেতারাও অবশ্য এদেশীয় ছিল। শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার বলেন-“পর্তুগীজ হার্মাদ, মগ জলদস্যুরা শত্গঙ [চাটিগাঁও, চিটাগাং], বাকলা [বরিশাল, বাকরগঞ্জ], সন্দীপ, নোয়াখালীর নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ হিন্দু-মুসলিম লোকেদের ধরে বিক্রি করে। এই কেনা-বেচায় দেশীয় বণিকরাও অংশ নেয়। বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর-নবদ্বীপের সম্পন্ন পরিবারের লোকেরা অবিবাহিত পুরুষের জন্য চন্দননগরের বিবিরহাট থেকে অপহূত দাসীদের কিনে আনে”। বাংলা বিশেষত পূর্ববাংলায় পর্তুগিজরা অপরাধকর্ম করে বেড়াত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাথে মিলে। তারা এসব সন্ত্রাসীদের জোগাড় করত ‘বুলখক খানা’ থেকে। সম্রাট আকবর সপ্তগ্রামকে বলতেন বুলখক খানা বা বিদ্রোহীদের আড্ডা। মোগল সাম্রাজ্যের বিদ্রোহীরা সব জমায়েত হতেন সপ্তগ্রামে। তাদের সাথে আরো যোগ দিতো আরাকানি মগরা । মগ জলদস্যুরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ১৬০২ সালে ডোমিঙ্গো কার্ভালহো সন্দ্বীপে আসেন তার বাহিনী নিয়ে। সেবাস্তিয়াও গঞ্জালেস তিবাউ ও তার অনুসারী নাবিকেরা ১৬০৫ সালে পর্তুগাল হতে ভারতের মাটিতে পা রাখে। সেই সময় থেকেই তাদের চোরাগোপ্তা হামলায় বাংলার জনজীবন বিপর্যস্ত হতে থাকে। পর্তুগীজ পাদ্রী ম্যান্যরিক ১৬৯২ সালে বাংলা ভ্রমণকালে তার ভ্রমণকাহীনিতে পর্তুগিজদের অরাজকতার উল্লেখ করেন। সেসময় লুণ্ঠন ও আক্রমণে নেতৃত্ব দিতেন দিয়েগো দ্য সা । দিয়েগোর নেতৃত্বে হার্মাদরা ঢাকায় পর্যন্ত আক্রমণ চালায়।বলা হয়ে থাকে ঢাকার অভিজাত বাড়িগুলোও মগ-হার্মাদদের কামানের নিশানা থেকে স্বস্তিতে ছিলনা। ডাকাতির হাত থেকে রক্ষার জন্য সেসময় ঢাকার বাড়িগুলোতে দরজাগুলো সরু বানানো হত। পর্তুগিজ জলদস্যুরা চট্টগ্রামের অংগারখালিতে(ধারণা করা হয় বর্তমানে শহরটি সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে) বন্দর নির্মাণ করেন। ম্যানরিকের বিবরণীতে পাওয়া যায়-“লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ ও বন্দিদের নিয়ে দস্যুরা বীরদর্পে বিজয়ীর বেশে অংগারখালীতে প্রবেশ করে। এ উপলক্ষে বন্দর ও জাহাজগুলোকে সজ্জিত করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করে কামান ও অস্ত্রের গোলা বর্ষণের মাধ্যমে উল্লাসও প্রকাশ করা হয়।
বস্তুতপক্ষে, দস্যুরা এরূপ আনুষ্ঠানিক ও উৎসবমুখর পরিবেশে গর্বিতভাবে নিজ বন্দরে প্রবেশ করতো এই জন্য যে, যাতে পথিমধ্যে মানুষ তাদের শক্তি ও সফলতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং জনমনে তাদের ব্যাপারে ভয় বজায় থাকে। তারা কখনো কোনো অভিজাত নাগরিক বা সুন্দরী নারী লুট করে আনলে সেগুলো প্রদর্শন করে নিজেদের শক্তিমত্তাকে আরো বড় করে প্রদর্শন করতো। বন্দরে প্রবেশ করে দস্যুরা আনন্দ-উল্লাস ও হৈচৈ আরম্ভ করতো এবং নিজেরা একপাশে দাঁড়িয়ে অন্য পাশে বন্দিদের দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন শুরু করতো। পর্তুগিজ দস্যুদের উন্মত্ততা এবং বন্দিদের আহাজারি মিলে সেখানে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, যা মদ-মাংস ও গান-বাজনা সহযোগে হার্মাদ-পাষণ্ডরা উপভোগ করতো”।
দমন ও প্রস্থান
সম্রাট আকবরের জীবদ্দশায় পর্তুগিজদের সাথে মোগল সেনাবাহিনীর সরাসরি সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মোগলদের সাথে পর্তুগিজ জলদস্যুদের বৈরিতা শুরু হয় এবং এই বৈরিতাই পর্তুগিজ জলদস্যুদের বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহ যখন দ্বিতীয়বারের মত বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে বাংলায় আসেন তখন রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌ সেনাপতি হিসেবে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ফ্রান্সিস কার্ভালো,রডা গঞ্জালেস প্রমুখ পর্তুগিজগণ। একই সাথে তারা হুগলী তে হামলাও অব্যাহত রেখেছিল। পর্তুগীজ জলদস্যু ও তাদের দোসর কর্তৃক মেঘনা ও কর্ণফুলিতে বাণিজ্যতরী আক্রমণ করে কর আদায়,মক্কাগামী হজযাত্রীদের জাহাজে লুটপাট,হিন্দু দেবমুর্তি ভাঙা ইত্যাদি অভিযোগ সম্রাট জাহাঙ্গীরের কানে পৌঁছলে তিনি পর্তুগিজ দমনের আদেশ দেন। সেইসাথে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।ঢাকার নতুন নাম দেন ‘জাহাঙ্গীর নগর’।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে শুরু হওয়া পর্তুগিজবিরোধী অভিযান সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬)শাসনামলে আরো তীব্র হয়।সম্রাট শাহজাহানের সাথে পর্তুগিজদের শত্রুতা বেশ আগের। সম্রাট শাহজাহান যখন বিদ্রোহী হয়ে বাংলায় অবস্থান করছিলেন তখন তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ বেগমের একজন দাসীকে মগ-হার্মাদ জলদস্যুরা অপহরণ করে। এছাড়াও আরেকটি লজ্জাজনক ঘটনাও এর পেছনে রয়েছে। এক অভিজাত ‘মির্জা’পদমর্যাদার দুই হাজারি মনসবদার, সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাহ শিকোর নির্দেশে দিল্লী যান ,স্ত্রীকে নিজস্ব জায়গীরে পাহারায় রেখে।কিন্তু পর্তুগীজ জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে ।এই আপত্তিকর ঘটনা জানাজানি হলে স্বাভাবিক কারণেই দিল্লি ও বাংলার মুঘল শাসক শ্রেণি চরমভাবে ক্রোধান্বিত হয়। সম্রাট শাহজাহান তাৎক্ষণিক এক নির্দেশে বাংলার সুবাদারকে হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করার নির্দেশ দেন।বাংলার সুবাদার তখন কাসেম খান জুয়ুনি।বাদশা কাসেম খাঁ কে বলেন-“আমার প্রজার সুখই আমার সুখ।আপনি পর্তুগিজদের ধ্বংস করুন”।এরপর মোগল সেনাবাহিনীর সাথে পর্তুগিজদের ভয়ানক যুদ্ধ বেঁধে যায়।এই যুদ্ধ তিন মাস চলে।ব্যাণ্ডেলে মোগল সৈন্যরা সুড়ঙ্গ কেটে সেই সুড়ঙ্গে বারুদ ভর্তি করে পুরো দুর্গ উড়িয়ে দেয়।১৬৬৬ সালে মোগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদখান চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করেন এবং চট্টগ্রাম দখল করেন।সেসময় বাংলার সুবাদার ছিলেন শায়েস্তা খান।বুজুর্গ উমেদ খান ছিলেন তাঁর পুত্র।এ অভিযানে শায়েস্তা খান ২৮৮ টি রণতরী প্রেরণ করেছিলেন।মগ ও হার্মাদদের নির্মূলের জন্য বাংলার দক্ষ নৌবাহিনী তিনিই তৈরী করেছিলেন।এর মাধ্যমেই বাংলায় পর্তুগিজদের ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।
ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সাথে ব্যবসায় টিকতে না পেরে পর্তুগিজ বণিকেরা ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে চলে যান।১৭৩৩ সালে ইংরেজরা পর্তুগিজদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক না রাখার জন্য তাদের কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়।তারপরও হুগলীতে ১৭৪০ সালে পর্তুগিজ বাণিজ্যিক জাহাজ আগমনের নথিপত্র পাওয়া যায়,যা থেকে মনে করা হয়ে থাকে পর্তুগিজরা বাংলায় আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাণিজ্য করে গেছে।
পর্তুগিজরা চলে গেছে আজ অনেকদিন।কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যে ও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে আজও রয়ে গেছে তাদের বিভৎসতার ইতিহাস।প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের সাথে বাংলার মানুষের স্মৃতি বিভীষিকার এবং ঘৃণার।