আজ ০৪ মার্চ কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
এক অক্ষরের একটা শব্দ–মা, কিন্তু কি অনন্ত ব্যাপ্তি শব্দটার! গর্ভধারিনী জননী,দেশ মাতৃকা, ঈশ্বর। আমাদের পরম স্নেহের আশ্রয় মা। বিশ্বের তাবৎ অভিধানে একই অর্থ এই একটিমাত্র অক্ষরের শব্দ মা’র।মায়ের কথা, মা কে নিয়ে কথার কোন শেষ নেই। আমি তিন মায়ের কথা বলব। তিন ‘মা’ই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকার জগৎ থেকে এসেছিলেন, তারপর আপন নিষ্ঠা আর তন্ময় সাধনায় মহিয়সী নারীর মর্যাদা আদায় করতে পেরেছিলেন। সুকুমারী দত্ত বা গোলাপসুন্দরী প্রথম মহিলা নাট্যাভিনেত্রী থেকে বাংলার প্রথম মহিলা নাট্যকার , নটী বিনোদিনী তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেত্রী এবং ইন্দুবালা সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী। এই তিন মায়ের গল্পে আছে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার কথা,অবহেলার অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করে আপন প্রতীভায় মাথা-উঁচু করা প্রতিষ্ঠার কথা।
১৮৭৩ নগর কলকাতা থিয়েটারের শহর হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে, এক বছর আগে ধনি জমিদার বাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে মুক্তি পেয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে থিয়েটারের দরজা। ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশানাল থিয়েটার ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।বাংলা থিয়েটারের সেই শৈশবে ধনকুবের ছাতুবাবু বা আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎকুমার ঘোষ খুললেন বেঙ্গল থিয়েটার। শরৎকুমার মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নাটক লিখে দেবার জন্য। মাইকেল নাটক লিখেদিতে সম্মত হলেন একটি শর্তে, তা হল তাঁর নাটকে স্ত্রী চরিত্রের অভিনয় নারী অভিনেত্রীকে দিয়েই করাতে হবে। বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্যোক্তারা বারাঙ্গনাপল্লী চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন তাদেরই একজন ছিলেন গোলাপসুন্দরী। মাইকেল তখন মৃত্যুসশয্যায় তবু মাইকেল বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য নাটক লিখে দিলেন ‘মায়া কানন’। থিয়েটার উদবোধনের আগেই মধুসূদনের মৃত্যু হওয়ার কারণে তারা মায়াকানন দিয়ে থিয়েটারের উদবোধন করলেন না। ৮৭৭৩এর ১৬ই অগস্ট বেঙ্গল থিয়েটারের উদবোধন হল মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে। অভিনয় করলেন বারাঙ্গনাকন্যা গোলাপসুন্দরী। বাংলা থিয়েটারের প্রথম নারী অভিনেত্রী। শেষ হল নাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার।এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। মাইকেল মধুসূদন এই ঘটনা দেখে যেতে পারেননি।
বারাঙ্গনাকন্যা গোলাপসুন্দরীর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম বিস্ময়কর।সাহায্য পেয়েছিলেন এক মহতী হৃদয় মানুষের, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস। উপেন্দ্রনাথ গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তর সঙ্গে। এই ঘটনা তখনকার সমাজে প্রবল নিন্দাবাদ হয়েছিল। উপেন্দ্রনাথকে নিজের পিতৃসম্পর্কও ত্যাগ করতে হয়েছিল। গোষ্ঠবিহারী–সুকুমারীর মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের ব্যবস্থা উপেন্দ্রনাথ করেছিলেন। তারা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন। এই সময় উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্পর্ক পুণস্থাপিত হয়। তিনি উপেন্দ্রনাথকে বিলাতে পাঠিয়ে দেন। উপেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে গোষ্ঠবিহারীও জাহাজের খালাশি হয়ে বিলাত চলে যান। সুকুমারী স্বামী পরিত্যক্তা হন, তখন সে এক কন্যাসন্তানের জননী।
স্বামী পরিত্যক্তা সুকুমারী থেমে থাকেননি। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশানাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন। ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক। নাটকটি অভিনীতও হয়েছিল। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে।
একমাত্র কন্যার শিক্ষার বিষয়ে কোন অবহেলা করেননি সুকুমারী। কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু একটা দুঃখ বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে। মেয়ের শশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার অধিকার ছিল না সুকুমারীর।
১৮৯০-৯১ পর্যন্ত গোলাপ নানান থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। তারপর কবে চলে গেলেন তা জানা যায় না। অন্ধকার জগত থেকে আলোয় ফেরা গোলাপদের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ তখনকার সমাজ মনে রাখেনি। গোলাপ তার কন্যাকে পিতৃ ও মাতৃ পরিচয় দিতে পেরেছিলেন কিন্তু আর এক জননী বিনোদিনী তাও পারেননি।
বিনোদিনীর সঠিক জন্মতারিখ জানা যায় না, জানা যায় না তাঁর পিতৃপরিচয়ও। আনুমানিক ১৮৬৩তে তাঁর জন্ম। বিনোদিনীর জন্মবৃত্তান্তে নিশ্চিত ভাবেই আমাদের আগ্রহ নেই। তিনি তাঁর আত্মকথায় বারবার নিজেকে হীন বারাঙ্গনা বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলা থিয়েটারের সেই আদিপর্বে, সহায়সম্বলহীনা এক বালিকা সমাজের অন্ধকার স্তর থেকে ঊঠে এসে অসামান্য প্রতিভা ও মেধায়, থিয়েটারকে ভালোবেসে, আপন তন্ময় সাধনায় এক মহিয়সী নারীর মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চেয়েছিলেন।
আরো পড়ুন: রবীন্দ্রনাট্য এখনো বাঙালির অন্তরের আত্মীয় হয়ে উঠল না
থিয়েটারের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন বিনোদিনী–নিজেকেও। মারোয়াড়ি যুবক গুর্মুখ রায় একটা স্থায়ী থিয়েটার নির্মাণ করে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। বিনিময়ে বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে। এবং সেই থিয়েটারের নাম হবে বিনোদিনীর নামে ‘বি থিয়েটার’। সমস্ত আত্মগ্লানি দূরে সরিয়ে রেখে বিনোদিনী সম্মত হলেন। তাঁর নাট্যশিক্ষক গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীকে এক অর্থে বিক্রি করে দিলেন গুর্মুখ রায়ের কাছে। থিয়েটার নির্মিত হ’ল , কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতো ‘বি থিয়েটার নয় – বিনোদিনীকে বঞ্চনা করে গিরিশ বাবুদের কৌশলে সেই থিয়েটারের নামকরণ হল ‘ষ্টার থিয়েটার’ , ১৮৮৩’র ২১শে জুলাই। কারণ , এক বারাঙ্গনার নামে থিয়েটার নাকি সেকালের সমাজপতি ও ভদ্রসমাজের অনুমোদন পেতো না। বিনোদিনী গুর্মুখ রায়ের সঙ্গে ছিলেন মাত্র ছ মাস। গুর্মুখ চেয়েছিলেন যার নামে থিয়েটার করেছেন তাকেই অর্থাৎ বিনোদিনীকে ষ্টার থিয়েটার’এর মালিকানা দিয়ে যাবেন , অন্তত ৫০ভাগ অংশ তাঁকে দেবেন। এ ক্ষেত্রেও গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল মিত্ররা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন, বিনোদিনী তাঁর অংশ পেলেন না। মাত্র ১১হাজার টাকায় ষ্টার থিয়েটারের মালিকানা হস্তান্তরিত হ’ল অমৃতলাল মিত্র সহ চার জনের নামে।
বিনোদিনী শুধু নিজেই অভিনয় খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন তা নয় তাঁর অসামান্য অভিনয় সেকালের বাংলা থিয়েটারকেই মর্যাদামন্ডিত করেছিল। সে যুগে সম্ভ্রান্ত মানুষের চোখে নাট্যাভিনয় হীন কাজ বলেই বিবেচিত হতো। বিনোদিনীর অভিনয় দেখতে থিয়েটারে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর ‘মৃণালিনী’ নাটকে মনোরমার চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেম “আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ করিব আমন আশা করিনাই। আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল”। ১৮৮৪র ২রা আগস্ট গিরিশচন্দ্রের চৈতন্যলীলা মঞ্চস্থ হল স্টার থিয়েটারে। চৈতন্যের ভুমিকায় বিনোদিনী। রামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন নাটক দেখতে। শ্রীচৈতন্যের চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয়ে পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেব ভাববিহ্বল হয়ে বিনোদিনীকে আশির্বাদ করেন। বলেন “আসল নকল এক দেখলাম”। পঙ্ক থেকে পঙ্কজা হয়ে ওঠার মত বিনোদিনী শ্রীচৈতন্যের চরিত্রের সার্থক রুপায়নের মধ্য দিয়ে বারাঙ্গনা জীবনের আত্মগ্লানি মুছে ফলতে চেয়েছিলেন। শ্রীরমকৃষ্ণের স্পর্শে বারাঙ্গনা নটী বিনোদিনী কলুষমুক্তির আস্বাদ পেলেন, তেমনই রঙ্গালয়েরও অস্পৃষ্যতা মুক্তি ঘটলো, থিয়েটারকে মর্যাদার আসনে স্থাপন করলেন বিনোদিনী।
১৮৮৬তে মঞ্চ ত্যাগের ২৬ বছর পরে বিনোদিনী তাঁর আত্মকথা ‘আমার কথা’ লিখতে শুরু করেন। আমাদের নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে বিনোদিনীর উল্লেখ নিতান্ত দায়সারা ভাবে একজন অভিনেত্রী রূপে উল্লেখ হয়। আত্মকথার ভুমিকায় বিনোদিনী লিখেছেন “ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয়-জ্বালার ছায়া ! পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা,শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরতা! কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই–কেননা আমি জগত মাঝে কলঙ্কিনী, পতিতা। আমার আত্মীয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই”। সেকালের সমাজের কাছে বিনোদিনীর জিজ্ঞাসা ছিল “… বারাঙ্গনার জীবন কলঙ্কিত বটে! কিন্তু সে কলঙ্কিত ঘৃণিত কোথা হইতে হয়? জননী জঠর হইতে তো একেবারে ঘৃণিত হয় নাই। …অনেকেই পুরুষের ছলনায় ভুলিয়া তাহাদের বিশ্বাস করিয়া চির কলঙ্কের বোঝা মাথায় লইয়া অনন্ত নরকযাতনা সহ্য করে। সে সকল পুরুষ কাহারা? যাহারা সমাজ মধ্যে পূজিত আদৃত তাহাদের মধ্যে কেহ নন কি”?
অথচ কি হিমালয়প্রমাণ বঞ্চনা, প্রতারনা আর উপেক্ষার স্বীকার হয়েছিলেন পঙ্কজা থেকে মহিয়সী হয়ে ওঠা এই রমনী। মঞ্চ ও অভিনয় ত্যাগের পরও বিনোদিনী বেঁচে ছিলেন আরো পঞ্চান্ন বছর তার মধ্যে সাহিত্যচর্চা করেছেন চল্লিশ বছর। দুটি পর্বে তাঁর আত্মকথা ছাড়াও রচনা করেছিলেন ‘বাসনা’ ও ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু লেখিকা রূপে বিনোদিনীর অবদান এখনো গ্রাহ্য হয় নি। যদিও তিনিই ছিলেন বাংলার ২য় মহিলা আত্মচরিত লেখিকা। বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য ইতিহাস তন্নতন্ন করে খুঁজলেও সেকালের মহিলা লেখিকা রূপে বিনোদিনীর বিন্দুমাত্র উল্লেখ পাওয়া যাবে না।
১৮৮৬’তে থিয়েটার থেকে বিদায় নেবার পর বিনোদিনী উত্তর কলকায় এক উদার হৃদয় ব্যক্তির আশ্রয়ে বধু জীবন যাপন করেন। সেখানেই তাঁর এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে, নাম দেন শকুন্তলা। কন্যাকে আশ্রয় করে বিনোদিনী পূর্বের অনেক ক্লেদাক্ত স্মৃতি ভুলে যান। বিনোদিনীর বাসনা ছিল কন্যা শকুন্তলাকে শিক্ষাদান করে সমাজের মুলস্রোতে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেকালের রক্ষণশীল সমাজ শকুন্তলার বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অথকথায় বিনোদিনী তীব্র ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন “… আবার এই বিপন্নাদের পদে পদে দলিত করিবারজন্য ঐ অবলা-প্রতারকেরাই সমাজপতি হইয়া নীতি পরিচালক হন। যেমন ভাগ্যহীনাদের সর্বনাস করিয়াছেন, তাহারা যদি তাহাদের সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের সত১১পথে রাখিবার জন্য কোন বিদ্যালয়ে বা কোন কার্য শিক্ষার জন্য প্রেরণ করে, তখন ঐ সমাজপতিরাই শত চেষ্টা দ্বারা তাহাদেরসেই স্থান হইতে দূর করিতে যত্নবান হন”। … শত দোষ করিলে ক্ষতি নাই ; কিন্তু ‘নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ’। কন্যাকে আশ্রয় করে বিনোদিনী তাঁর বারাঙ্গনা জীবনের গ্লানি ভুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৮৯১এ সেই কন্যার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন বিনোদিনী। এর দুবছর পর তাঁর শেষ আশ্রয়দাতারও মৃত্যু হয় , বিনোদিনী ফিরে যান তার ১৪৫ নম্বর কর্নোয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িতে। সেখানেই সবার অলক্ষ্যে অনাদরে অবহেলায় একদা পঙ্কজা থেকে বাংলা থিয়েটারের রাজেশ্বরী হয়ে ওঠা বিনোদিনীর মৃত্যু হয় ১৯৪১এ। না কোন শোক সভা হয়েছিল কিনা, কোন সংবাদ পত্র প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল কিনা তাও জানা যায়না।
তিন মায়ের গল্পের তৃতীয় যে মায়ের কথা বলব তিনি সুকুমারী ও বিনোদিনীর চেয়ে আরো চল্লিশ বছর পরে জন্মেছিলেন। এদের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক প্রতিষ্ঠাও তিনি পেয়েছিলেন । কিন্তু নিষিদ্ধপল্লী রামবাগানের বাস ছেড়ে কোন সম্ভ্রান্ত অঞ্চলে চলে আসতে চাননি। বলতেন ‘রামবাগান আমাকে যশ, খ্যাতি, অর্থ সব দিয়েছে। আমি রামবাগান ছেরে যাব কেন? আমি রামবাগানের ইন্দু’। তিনি সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা যাকে চিত্র-মঞ্চ- যাত্রা- সাংস্কৃতিক জগতের শিল্পী কলাকুশলীরা আজও ‘ইন্দুমা’ বলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন।
এই লেখার অন্য দুই মায়ের মত ইদুবালা পিতৃপরিচয়হীনা ছিলেন না, বরং পিতা ছিলেন নামকরা মানুষ। মায়ের নাম রাজবালা। রাজবালার মা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা, স্বামীর অকালমৃত্যুর পরে অবস্থার বিপাকে এক ধনীর রক্ষিতার জীবন পান এবং আশ্রয় হয় রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতে। মায়ের মৃত্যুর পরে অন্য দুই বোনের সঙ্গে রাজবালারও আশ্রয় হয় নিষিদ্ধপল্লীতে। নিতান্ত বালিকা রাজবালা নিষিদ্ধপল্লীর ভবিতব্য মানতে চাননি। সেখান থেকে মুক্তির জন্য সুযোগ পান সার্কাশের দলে যোগ দেবার। সাত বছরের বালিকা যোগ দেন প্রফেশর বোসের সার্কাসে। মালিক ছিলেন মতিলাল বোস– সেকালের প্রসিদ্ধ নাট্যকার মনমোহন বোসের পুত্র। ছয় বছর পরে মতিলাল বিবাহ করের রাজবালাকে। ইন্দুবালার জন্ম হয় অমৃতশরে।
মতিলাল চেয়েছিলেন মেয়ে ইন্দুকে নিয়ে রাজবালা সার্কাশেই থাকুন আর রাজবালা চেয়েছিলেন কলকাতায় স্বামী কন্যাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে। রাজবালা আর সার্কাশে ফিরে যাননি। তিনবছরের মেয়ে ইন্দুকে নিয়ে রামবাগানেই বাসা বাঁধেন। সেকালে থিয়েটার ছিল বারাঙ্গনা কন্যাদের মুক্তির আশ্রয়। রাজবালা থিয়েটারে যোগ দিলেন, খ্যাতিও পেলেন যথেষ্ঠ।
রাজবালা ইন্দুর লেখাপড়ার আয়োজন করেছিলেন, তাকে ভর্তি করেছিলেন স্কুলে। কিন্তু মায়ের অসুস্থ্যতার কারনে ইন্দুর স্কুলশিক্ষায় ছেদ পড়ে। জনৈক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় ইন্দু নার্সিং ট্রেনিং নিতে শুরু করেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। কিন্তু সেখান থেকেও পালিয়ে আসেন। এরপর শুরু হল গান শেখা। ওস্তাদ গৌরীশঙ্কর মিশ্রের কাছে তালিম নিতে শুরু করলেন। সেকালের বিখ্যাত গায়িকা গহরজানের সান্নিধ্য লাভ করলেন। ক্রমে ইন্দু সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন। বিভিন্ন দেশীয় রাজার দরবারে দরবার গায়িকা রূপে ক্যাতি ও প্রতিপত্তি পেলেন।
ইন্দুর সঙ্গীত প্রতিভাকে ব্যবহার করতে দেরি করেনি সেকালের বাংলা থিয়েটার। সবকটি পেশাদারী থিয়েটার স্টার, মিনার্ভা মনমোহনে ইন্দু অভিনেত্রী ও গায়িকা রূপে খ্যাতি অর্জন করলেন। এই সময়ে ইন্দু কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। ইন্দুবালা থিয়েটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু গানেই ডুব দিলেন। ১৯১৬তে প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান করেন আর তারপরেই ক্রমে প্রবল জনপ্রিয়তায় হয়ে ওঠেন ‘সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী’। একদিকে খেয়াল, দাদর্ ঠুমরি কিংবা ভজন, অন্যদিকে নজরুলের গান, ভক্তিগীতি, নাটক ও সিনেমার গান – ইন্দুবালার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হল। ১৯৭৫এ পেলেন সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা, পরের বছর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর সম্মানে প্রকাশ করলো গোল্ডেন ডিস্ক। কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে বসে উদবোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা। খ্যাতির শীর্ষ স্পর্শ করেও ইন্দুবালা কোনদিন মাটি থেকে পা সরিয়ে নেননি। দেশজোড়া খ্যাতি সত্তেও ইন্দুবালা রামবাগানের বাসা ছেড়ে যাননি । একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার। এই দিয়ের মাঝে সুরের আকাশে উজ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা – সকলের শ্রদ্ধার ইন্দু মা।
সাহিত্যিক সমরেশ বসুর স্ত্রী গৌরী বসু, যিনি ইন্দুবালার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে তাঁর কাছে সঙ্গীতশিক্কা করকে, তাঁকে লেখা এক পত্রে ইন্দুবালা লিখেছিলেন ” কেন আমি ভদ্র ঘর থেকে ইন্দুবালা হতে পারিনি। কিসের জন্য এই পল্লীর মেয়ে আম ! জানো মা গৌরী। দুনিয়াসুদ্ধ সকলে বলে আপনি ভদ্র পল্লীতে যান, স্কুল করুন, আপনার জিনিস সব দান করুন, শেখান ইত্যাদি ইত্যাদি। তা কি হয় নাকি? দিদিমা বনবিষ্ণুপুর থেকে এসেছিলেন, চাটুজ্জে বাড়ির মেয়ে মুখুজ্জে বাড়ির বৌ হয়ে। পরে বিধবা হয়ে এই পাড়ায়। তিন পুরুষের বাস কি ভাঙতে পারি! পারবো না। কারণ ভগবান যে শাস্তি দিয়েছেন মাথা পেতে নিয়েছি…কিছু তো লুকুই নি মা।… মানা অর্থাৎ প্রণব(ইন্দুমার পালিত পুত্র)সেও জানে যে তার জীবনে সে যখন অভিজাত পাড়ায় বাড়ি করবে তখন তার এই মা কোনদিন যাবে না”। এই রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতেই সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী – সকলের ইন্দুমা’র মৃত্যু হয় ১৯৮৪র ৩০শে নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে।
তিন মায়ের অন্ধকার থেকে লড়াই যেন একাকার হয়ে গেছে। এই লেখা শুধু তিন মায়ের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার কথা নয়, সেই সময়ের অনেক মায়ের কথাই ধরা আছে এই লেখায়।
তথ্যসূত্র
(১) ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’/ অমিত মৈত্র
(২)’আমার কথা’ / বিনোদিনী দাসী
(৩) ‘সুকুমারী দত্ত ও অপূর্বসতী নাটক’/সম্পাদনা বিজিতকুমার দত্ত, নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২
(৪)’ইন্দুবালা – স্মৃতি ও প্রণতি’ / বাঁধন সেনগুপ্ত ।