Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

কবিতা নিয়ে

Reading Time: 3 minutes
 

আজ ২১ ডিসেম্বর কবি ও কথাসাহিত্যিক পিয়াস মজিদের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 
গানের ভিতর দিয়ে দেখিলে ভুবনখানি যেন সোনার আঁচড়ে বদলে যায় যত তামাটে পরিপ্রেক্ষিত। সুরবিরহিত আমি তবে কবিতার শরণপ্রার্থী; আপাত নিঃসুরে লভি অন্তর্গত কোনো সুরের বিভূতি। জ্ঞানের বিধিবদ্ধ পরিসর চূর্ণ করে কবিতাতো সেই অজ্ঞেয়কে সৃজ্যমান করে তোলে যার তলকূল নেই কোন। কিন্তু আছে ঠিকই; আছে আছে প্রেম ধুলোয় ধুলোয়। ব্যথার মিনারগর্ভেই তো তার পাতালজন্ম। কবিতা তাই বলে রূপকথা না; নয় রোমাঞ্চ গল্প বা পৌরাণিক কাহিনি। কবিতা নয় কেবল স্বপ্নবাসবদত্তা। এই বস্তুপৃথিবীইতো কবিতার শাশ্বত ল্যাবরেটরি। বেঁচে থাকা আর মৃত্যুআসন্নের মধ্যবর্তী চারুসেতুতে কবিতা বাস করে। তবে সেতুর যাত্রীমাত্র তার নাগাল পায় না। কারণ অগ্নিজলের চুমুগোলাপ সবার সয়না। এই মধুর দ-াজ্ঞা সেই গ্রহণক্ষম যে বাস্তবে বসত করে তবে বস্তুর ক্ষুদ্রতাভেদী। কল্পনাস্পর্শী তবে কল্পভাসা নয় শুধু। এক মানুষজীবনে কত শত যুদ্ধ-রক্ত-রিরংসার রোল উঠে। শুনে সবাই কিন্তু কবি যে, সে খাক হয়ে যায়। পুড়ে পুড়ে সাকার করে নতুন অগ্নির মুঞ্জরণ। প্রেমের কবিতা, ঘৃণার কবিতা বলে পৃথক কিছু নেই। প্রেমশীল না হলে তো কবিতাই নয়। তখন হয় শুধু সন্দর্ভের জঞ্জাল। তারা থেকে তৃণের তনু পর্যন্ত বিস্তারিত কবিতার প্রেমডানা। এভাবে কবিতা ছিন্ন করে নিষ্প্রেম দিগন্তের শৃঙ্খল। দৃশ্যকে ধারণ করে কবিতা; তার চেয়ে বেশি দৃশ্যাতীত ব্যঞ্জনা। তাই আকাশের ওপারে আকাশে তার দৃষ্টিপ্রভা। আকাশ ছড়িয়ে আছে যেখানে নীল হয়ে আকাশে আকাশে সেই অমোঘ নীলিমার ছিটমহলে সে তার সীমান্তখুঁটি গাড়ে। এইখানে ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কবির তফাত। এই সেল্ফি-
বাস্তবতায় তবে কবিতা কোথায়! দর্পণে প্রতিফলিত ‘আমি’কে ছাপিয়ে কবিতা তো এক অনশ্বর আয়নামহল।
 
কবিতাফুরোনো পথে আমি পথ হাঁটি। ধুলোবালি-সরণি পেরিয়ে-উড়িয়ে চলি কবিতার দিকে। কবিতা কোথাও নেই কেননা কবিতা কোথাও থাকে না। অনন্ত অনাঘ্রাতার প্রতি আমার এই প্রব্রজ্যাই তো কবিতা। পাখাশীল পৃথিবীতে কবিতা এইমতো হাঁটুরের জীবনদর্শন।
আমার করতল থেকে যা নিঃসৃত হলো তা-ই কবিতা।
হ্যাঁ যদি আমি হই যুগপৎ স্বপ্নগ্রস্ত এবং দুঃস্বপ্নতাড়িত।
যদি আমি হই প্রেমি এবং খুনি।
যদি আমার চোখের জলে ভেসে চলে দাউদাউ অগ্নি; তবে আমার করতল থেকে যা নিঃসৃত হয় তা-ই কবিতা। আমার কাছে কবিতা মানে এক ধরনের আহুতি। সংসারে সবাই এমত আহুতি দান করতে পারে না।
আহুতি।
একটি গোলাপে আহুতি।
যে গোলাপের মৃত্যুগন্ধে মালঞ্চ ভুরভুর।
হোর্হে লুই বোর্হেস বলেন, ‘একটি গোলাপকে ঠিকভাবে চিনলে আমরা নিজেকে এবং এই পৃথিবীর গোটা কার্যকারণকেও চিনতে পারি।’
গোলাপকে চেনা যায় না যদিÑ না তাতে আহুতি দেয়া যায়।
সবাই দিতে পারে না এমন আহুতি।
মৃত্যুগন্ধ আস্বাদের ক্ষমতা যার থাকে সে-ই কবি। তখন তার করতল থেকে যা নিঃসৃত হয় তা-ই কবিতা।
আমি কি গোলাপে আহুতি দিতে পেরেছি? যদি এখনও না দিয়ে থাকি তবে হে গোলাপসুন্দরী দ্বিধা কেন? আমাকে গ্রহণ কর। তোমার মরণসুরভিতে আমার অভিষেক চাই। আমি ভুখা। পিয়াসি আমি। আমার ভেতর নিত্য জায়মান শত শত ক্ষুধিত পাষাণ। তুমি তোমার কোমলগান্ধারের ঘায়ে এ পাষাণ চূর্ণ কর। লক্ষ বছরের বিধুর আত্মা নিয়ে আমি তোমার দরোজায় উপস্থিত। কিন্তু আমার তো জানা নেই আরব্য উপন্যাসের ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র। তবে কি আমি প্রবেশাধিকার-বঞ্চিত! না। গত শীতরাত্রিতে এক অনাথ পরি আমাকে কানে কানে জানিয়ে গেছে সমুদ্রসম্ভোগের গুপ্তিমন্ত্র। আজ ভোরে সমুদ্রসম্ভোগ শেষে দেখি আমার ভেতর এই অভিজ্ঞানের জন্ম হলো যেÑ শিল্পের যে আঙ্গিক ভূমিতে থেকে তারাদের চরণচিহ্ন শনাক্ত করতে সক্ষম তা-ই মূলত কবিতা।
 
কবিতা এক কালোবর্ণ কুহক। বিষয় ও আঙ্গিক জেনে, ভাষার ওপর দখল নিয়েও এ কুহক চূর্ণ করা যায় বলে মনে হয় না। সারা জীবন কবিতা লিখেও এ কুহকের শেষ দেখা যায় না। অধরা মাধুরী যেন। যিনি কবি, তার উপর সেই কবিতাদেবীর জন্ম-জন্মান্তরের দ-াজ্ঞা। এ দ- থেকে, দায় থেকে তার মুক্তি নেই। রক্তাক্ত ও দ-িত হওয়াই তার নিয়তি। আমি কবিতা লিখি; না লিখে পারি না বলে। নিজেকে নিজের কাছে, কাগজের সাদার কাছে প্রকাশের এমন সহজতম, দুরূহতম পদ্ধতি আর নেই। প্রেম-প্রত্যাখ্যান-দেশ-কাল-পুষ্প-বৃক্ষ-বিহঙ্গ সবই আমার কবিতার প্রেক্ষায় থাকে। বলা যায়, এদের প্ররোচনাই জন্ম দেয় এক একটি শব্দের, লাইনের এবং গোটা একটি কবিতার। যেন এক লঘু-ডানা অরণ্যের পরি।
গরলভরা গান গাইতে পারে একমাত্র কবি। বিষ-সুরের স্বত্ব তারই, রক্তাক্ত হবার জন্য যে প্রতীক্ষা করতে জানে। মৃত্যুরে লভে অমৃত করি। কবি। দু’ অক্ষরের শব্দ, এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের মাঝামাঝি ভূমধ্যসাগর, আগ্নেয়গিরি, কুসুম কিংবা কর্দমের ডাঁই। বোবার স্বরে কবি বলে যে অন্ধরাই সঠিক পথ চেনে, শ্রবণ বধির করে সে টের পায় শত শত শূকরের চিৎকার, শত শত শূকরীর প্রসববেদনা, সহস্র সমাধির শ্বাস, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, ছন্দ, ছন্দহীনতাÑ এভাবে পৃথিবীর এই আদিমতম রসায়নে পড়ে পান্না হয় সবুজ। পুরুরবা হয় যযাতি, যযাতি হয় পুররবা। রাত্রি ভোর হয়ে যায় বন্দির বন্দনায়। যীশুর মত গামলায় যুগপৎ জন্ম আর মৃত্যু ঘটে স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের। এদের কাউকে কেঁদেও পাওয়া যায় না বর্ষার অজস্র জলধারে। কবিতা। হেরেমে বন্দি রাজকন্যা, কিন্তু কেমন গেরস্ত-মেয়ের মত কয় ‘কবুল, কবুল’! কবিতা। হলুদ নদীতে চন্দ্রের আলিঙ্গন। বাতাসে কীসের গন্ধ আর ফুলের হাহাকার। সোনালি তারাদের সানন্দ শহীদান। স্বর্গ সহজলভ্য, কিন্তু জীবৎকালে নরকে ঋতু যাপনের অভিজ্ঞতা কেবল কবিরই। উদ্যাপন করে সে এলিজির অনুপম আনন্দ। ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে সে মরে যেতে পারে। কখনোবা সামান্য মাছকে ঈর্ষা করে শুধায় ‘মাছ তুমি চলেছ কোথায়?’ অথচ কবির সমস্ত গন্তব্যে তালা ঝুলছে, তবু হে মাধবী, তবু হে দ্বিধা, ব্যর্থতা জিন্দাবাদ। পেয়ে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল। জলকে ভয় তার, তাই সতত তৃষ্ণা অন্বেষী। কবিতা। ভাঙা দেউল, বাসি বেলপাতা, অসুরের আরাধনা। সারা শীতকালজুড়ে একটিও ঝরাপাতা নেই, শুধু হেমন্তক্বাসিদায় ভরা মাঠ। রাহুর শ্রী জাজ্বল্য, বাকি কিছু ধূসর-বাসর। সমস্ত সিডার বৃক্ষ পতিত হইয়াছে। আমরা আবার তাহা নতুন করিয়া রোপণ করিব। বাইবেল এমত বলিলেও আমাদের রক্তে নিরন্তর পতনের প্ররোচনা। কবিতা। উড়ন্ত বিহঙ্গের পতিত কাকলি, মালঞ্চের শত্রু; কিছু দিকভ্রষ্ট ফুল, তোমরা যে যার সিঁড়ি পেয়ে গেছে, উপরে ওঠার, বাঁয়ে কিংবা ডানে যাবার, একলা কবি বিভ্রান্তির রাজসভায়। এইমাত্র তার অভিজ্ঞান হলো যে কবিতা মূলত সর্বনাশপন্থিদের আখড়া।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>