পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান

Reading Time: 3 minutes

বাড়িতে ঢোকার মুখেই লেটারবক্সের দিকে একবার চোখ পড়ে গেল। আজকাল সেখানে মাসের শুরুতে একটা ইলেকট্রিক বিল এসে চুপটি করে শুয়ে থাকে। ব্যস। নেহাত অনলাইনে বিল এলে সময়মতো দেখা হয়না। বিল জমা দেওয়া হয়নি বলে দু’একবার সমস্যা হয়েছিল, তাই ওই বিলের জন্য পুরনো নিয়ম এখনও বহাল রয়েছে। তাছাড়া ওই কাঠের বাক্সটার আর তেমন কোনও ভূমিকা নেই আজ।

কালো কাঠের বাক্স। কালো রঙের ওপর সাদা দিয়ে বড় করে লেখা ‘আচার্য’। তলায় বাড়ির নম্বর। তার মানে এটা ৩৯৮-এ অশোক রোডের আচার্যদের বাড়ি। ভরদুপুরে রোদ মাথায় নিয়ে কোনও আধবুড়ো ডাকপিয়ন তার হাতে ধরা চিঠির গোছা থেকে নাম-ঠিকানা মিলিয়ে ফেলে দিয়ে যাবেন চৌকো গর্তের মধ্যে। বাক্সটায় এখন আর কোনও তালা নেই। আগে তালা ঝোলানো থাকত। পুঁচকে একটা তালা। টিপতালা। কুট করে চেপে দিলেই বন্ধ। তার চাবি জুতোর তাকের সামনে দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো। এখন তালার দরকার হয় না। বাক্সের একটিমাত্র ছিটকিনি ভাঙা। দরজাটারও একটা কবজা নড়বড়ে। কেউ ফিরেও তাকায় না লেটারবক্সটার দিকে।

আমার চোখ চলে যায় ওই কালো বাক্সটার দিকে। যেদিন অফিসফেরত ক্লান্ত শরীর বাড়ি অবধি টেনে আনতে ইচ্ছে করে না, সেদিন দেখি ওকে। আমার মতোই অপ্রয়োজনীয়, নিরুত্তাপ।

ওই বাক্সটায় এককালে রোজ জুঁইফুলের গন্ধ লেগে থাকত। আমার প্রিয় ফুল। জুঁই। চিঠির খাম কোনওদিন ফিরোজা, কোনওদিন সিঁদুরে লাল। শ্লেট রঙের মেঘ জমলে জানতাম নীল রঙের খাম আসবে, অথবা কচি সবুজ। স্নিগ্ধ, নরম পেলব। খামের ভেতরে শুয়ে আছে অনেক অক্ষর। ভালবাসার অক্ষর। উষ্ণ বর্ণমালা। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পাই স্পষ্ট। কেউ কি দেখতে পেলো? আসছে কি কেউ কোনও দিক থেকে? খুব দ্রুত লুকিয়ে ফেলতে হবে বায়োকেমিস্ট্রি নোটস খাতার মধ্যে। উত্তেজনায় সিঁড়ির ধাপ এলোমেলো। দু’এক ধাপ লাফিয়ে উঠি। আবার পরপর তিন-চারটে ধাপ ধীরেসুস্থে। কলিংবেলে আঙুল রাখতে গিয়ে দেখি ঘামে ভিজে উঠেছে হাতের কোল। গ্রিলের দরজা খুলতে খুলতে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা। মায়ের কাছে, বাবার কাছে। খামের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে আমারই নাম। কিন্তু সেই খাম এখন থাকবে বায়োকেমিস্ট্রি ফরমুলার পাশে জড়াজড়ি করে। আমি জানি খামের ভিতরের সাদা কগজে আমার চেনা জামরঙা কালিতে লেখা থাকবে… আমার নাম। ঝিনুক। আমাকে লেখা।

ইতি

তোর…।

সপ্তাহে তখন দুটো চিঠি বরাদ্দ। কখনও কখনও তিনটে। কিন্তু সেই খাম খোলা হবে গভীর রাতে। সবার অলক্ষ্যে। পড়ার বইয়ের আড়ালে, খাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকবে অনেক দূরের শব্দ। সমস্ত শব্দে কোমলতা, প্রতিটি অক্ষরে আঙুলের ছোঁয়া। চিঠিতে লেখা শব্দে আঙুল বুলিয়ে গেলে গাঢ় নিঃশ্বাসের ওঠাপড়া স্পষ্ট শোনা যায়।
‘জানিস ঝিনুক, কাল রাতে তোকে স্বপ্নে দেখেছি বহুক্ষণ।

প্রায়ই দেখি তোকে। জেগে, ঘুমিয়ে। কিন্তু কালকের স্বপ্নটা আলাদা। দেখলাম, তুই এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস আমার পড়ার ঘরের দরজার ঠিক বাইরে। তোর মেরুন রঙের ওড়নার একটা কোনা হাতের মুঠোয়। নাকের ছোট্ট হীরের কুচিতে খুশির ঝিলিক। ওই টুকরোটা ঝিকিয়ে উঠলেই বুঝতে পারি, আজ তুই ঝগড়া করবি না। আজ শরতের ঝলমলে রোদেলা আকাশ। আজ চোখের মধ্যে রামধনু ভেসে উঠবে। আজ আমরা ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে পায়রাগুলোর গল্প শুনব। কাঁচের অ্যাকোয়ারিয়মে লাল-নীল পাথরের আড়ালে লুকোচুরি খেলবে গোল্ড ফিশ আর ব্ল্যাক মলির দল। একটা গোল্ড ফিশকে তুই ভারি পছন্দ করিস দেখেছি, সে আসলে তোর মতোই শান্ত, চুপচাপ। একটা বড় পাথরের ধার ঘেঁষে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে অন্যদের ব্যস্ততা। তুইও ঘরের পাশে ওভাবেই এসে দাঁড়িয়েছিস। বুঝতেই পারছি, মা বাড়িতে নেই। মা থাকলে সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ হত। নীচ থেকেই গলা তুলে প্রশ্ন করতিস, কাকিমা প্রত্যয় বাড়ি আছে? ভীষণ ব্যস্তসমস্ত হাবভাব। যেন কত কিছু পড়া বুঝে নিতে হবে, কত ক্লাস নোটস টুকে নেওয়া বাকি। আমাদের কত আড়াল, কত রেখেঢেকে চলা, তাই না রে? আচ্ছা, তুই কি ভাবিস, মা কিছু বোঝে না? আমার মা সব বোঝে। এই যে তুই হুটহাট চলে আসিস, এসেই বলিস, চটপট জিবি’র ক্লাস নোটসটা বের কর তো। নীরবে দৃষ্টি বিনিময়, আর সেই ফাঁকে হাতবদল হয় আমাদের না বলা কথা। বইয়ের আড়ালে গুছিয়ে রাখি তোর দিয়ে যাওয়া ভাঁজ করা কাগজের একটা নরম চিঠি। তুই চলে গেলেই পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে চিঠি খুলে বসি। চার-পাঁচ লাইনের বেশি কখনও লিখিস না তুই, আর তার মধ্যে কেবল অনুযোগ আর অভিমান। তোর গালের পাশে ঘামেভেজা চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে দিয়েছিলাম শুধু। এটা কি অসভ্যতা? তোর পাতলা গোলাপি ঠোঁটে কেঁপে ওঠা শব্দগুলো সরে সরে যায় আমার চোখের পাতায়। আমি উত্তর লিখতে বসে পড়ি। তোর জ্বালায় আমি এবার এম এসসির ফার্স্ট ক্লাস মিস করব, দেখিস’।

প্রত্যয় আর ঝিনুক এইরকম অসংখ্য চিঠি লিখত। একই ক্লাসের সমবয়সী দুটি প্রাণী প্রেমের গহন টানে ভেসে পড়েছিল মাঝদরিয়ায়। চিঠিতেই তাদের ঝগড়া, চিঠিতেই তাদের ভালবাসাবাসি। চিঠিতেই তাদের মন দেওয়া-নেওয়া আবার চিঠিতেই শরীর বিনিময়ের তীব্র কামনা।

প্রত্যয় বিদেশে থাকে। গবেষণা করেছে প্রচুর, কাজকর্মে বহু নামডাক হয়েছে শুনেছি। প্রবাসের প্রথম বছরে আমাদের কালো লেটারবক্সে ঝাঁপিয়ে পড়ত জুঁইফুলের গন্ধ। এখন সব ‘নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে’। আমি, ঝিনুক এখন বেসরকারি অফিসের কর্মচারী মাত্র। অফিস ফেরত অন্ধকারে একলা একলা হাতড়ে বেড়াই আমার গোপন সিন্দুকের হারিয়ে যাওয়া চাবি।

 

 

 

 

 

One thought on “পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>