আর যদি নাই আসো
……………………………
আর যদি নাই আসো,ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে ।
ফিরে এসো, চাকা-৫৫
………………………………..
হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়—
এদের কখনো আরো সরব সংগীত শোনাবো না।
বধির স্বস্থানে আছে; অথবা নিজের রূপে ভুলে
প্রেমিকের তৃষ্ণা দ্যাখে, পৃথিবীর বিপণিতে থেকে।
কবিতা লিখেছি কবে, দু-জনে চকিত চেতনায়।
অবশেষে ফুল ঝ’রে, অশ্রু ঝ’রে আছে শুধু সুর।
কবিতা বা গান… ভাবি, পাখিরা— কোকিল গান গায়
নিজের নিষ্কৃতি পেয়ে, পৃথিবীর কথা সে ভাবে না।
অনেক কিছুই তবু
………………………..
অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয়
লিখিত বিশ্লিষ্ট রূপ গণিতের অআকখময়
হয় না, সে সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতসূত্রের
নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ ক’রেই বিশ্লেষণ
করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয়।
সেহেতু ঈশ্বরী, দ্যাখো গণিতের ইউনিট
পাউন্ড সেকেন্ড ফুট থেমে থাকে চুপে,
এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনস্তত্ত্বে বর্তমান ইউনিট রূপে
আলোকিত ক’রে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী, চিন্তনীয় বিষয়গুলিকে
সিরিজের কতিপয় টার্মের চরিত্র ফুটে চরিত্র নির্দিষ্ট করে
আগামীর দিকে।
কবিতা বুঝিনি আমি
……………………………….
কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে—
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি—সব ; লম্বিত গভীরহয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্না ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।
একটি উজ্জ্বল মাছ
…………………………….
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা |
আমার বাড়ির থেকে
…………………………….
আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি অগণিত যুবতী চলেছে।
এইসব বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা যুবতীদিগের প্রত্যেকের
অন্তরে জয়পতাকা কিভাবে থাকে আমি সু ন্দর নিখুঁতভাবে দেখি
তাকিয়ে তাকিয়ে ওরা যখন হাঁটে বা বসে থাকে।
প্রত্যেকটি যুবতীর অন্তরে জয়পতাকা প্রবেশ করেছে বহুবার,
নিজের অন্তরে ঢোকা জয়পতাকাকে খুব ভালবাসে যে কোনো যুবতী।
অনেক জয়পতাকা অন্তরে প্রবেশ করে তার মধ্যে যে জয়পতাকা
অন্তরে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ
তাকেই বিবাহ করে অনূড়া যুবতীগণ। আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে
প্রতিদিন আমি দেখি অগণিত যুবতী চলেছে।
ভালোবাসা দিতে পারি
……………………………….
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান — শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচুড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।
কুঁড়ি
…………
পদ্মপাতার প’রে জল টলমল করে; কাছেকোনো ফুল তো দেখিনা,
সাধ জাগে, – বড়ো সাধ জাগে –
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
আকাশের অভিমুখী উন্মুখ কুঁড়ি আছে কিনা।
হয়তো সে কুঁড়ি
ফোটবার ইচ্ছায় থেকে থেকে – থেকে থেকে
কোন কালে হয়ে গেছে বুড়ি;
কোন কালে তার সব রূপ গেছে প’চে;
হয়তো বা তার আর নেই কোন লেশ।
সাধ জাগে, বড়ো সাধ জাগে-
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
এখনো রয়েছে কিনা কোন অবশেষ।
ফিরে এসো চাকা- ১৮
……………………
বেশ কিছুকাল হলো চ’লে গেছো, প্লাবনের মতো
একবার এসো ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি
জীবন যাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরানো
দেওয়ালে তাকালে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো মানসির আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কুজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো; তুমি পুনরায় চ’লে গেছো।
১৯ জুলাই’১৯৬১