মেরি ওলিভার কবিতা
মেরি ওলিভার প্রকৃতির নানা মাত্রা, বিন্যাস ও ধ্যানে ঢোকার জন্য মেরি ওলিভারের কবিতা এক পথদেখানিয়া প্রশ্রয়। অন্যান্য অনেক কবির মতোই ওলিভারের কবিজীবন শুরু হয় প্রকৃতির বন্দনা আর তার সহজ সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ক্রমান্বয়ে তিনি কবিতা ও প্রকৃতির অন্দরমহলে ঢোকেন: তিনি প্রকৃতির অনুকম্পার ভিতর তুলে আনেন ব্যক্তিমানসের আনন্দ, বেদনা ও এক তীব্র স্পর্শকাতরতা। আরেক নিসর্গমগ্ন কবি অ্যাডনা ভিনসেন্ট ম্যালয়-এর সঙ্গে মেরি ওলিভারের সখ্য তাঁর কবিতার মনস্তত্ত্বে একটি প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে। অন্যদিকে ওলিভার যে জলের ধৈর্য বর্ণনা করেন সে জলাধার স্থির কিন্তু তাঁর মনে জাগে সংবেদনশীলতার উতালপাতাল, এভাবে তাকে মনে হয় যেন এক মার্কিনী হাইকু কবি- যিনি হাইকুর আঁটসাঁট বন্ধনের বাইরে এসে মুক্তছন্দে লেখেন।
মেরি ওলিভার জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের মেইপল হাইটসে ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ সনে, ফ্লোরিডার হাব সাউণ্ডে ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮ সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মেরি ওলিভারের কবিতা বাঙলা ভাষান্তর করেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর।
নাচের ইতিহাস
কেবল এ-টুকু বলে দিলেই চলবে না যে-
দুনিয়া ভারি মনকাড়া জায়গা।
এ শুধু তা’ নয়- যেমন মৃদুমন্দ বাতাস একটু
হাওয়া দিয়ে যায়,
তার থেকে বেশি কিছু- অনেক তার প্রস্তুতি-
বলবার ও করবার।
ধাঁই করে বিজলি চমকানোকে মোটের উপর
ভালো বা মন্দ বলে দিলেই শেষ হলো না-
অবিচল বৃক্ষটি পুড়ে ছারখার- বুঝিবা দাঁড়িয়ে থাকে
সোনার পিলার।
নীল বৃষ্টির পরাগ দেখো কেমন লুকিয়ে যায়
গাছেদের নির্মল পায়ের নিচে-
উপরে তার ডালপালার বিস্তার।
বাতাস কী নির্বিকার একদিকে বয়- না ঘুরেঘুরে আসে-
আর গড়ে তোলে অলিখিত নাচের মুদ্রা?
ফুলদের কী আমরা বলবো না- ভিতরেভিতরে
কতোটা পরিযায়ী – যারা এশিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে
কুসুমিত হয়েছে তোমারই বাড়ির পিছনের চত্বরে?
এককথায় বলে দিও না-
জগৎসংসার এক বিবৃতি- কী এক বয়ান মাত্র!
সুফী দরবেশ যে ঘুরেঘুরে নাচে-
তারা কি পাহাড়ের উঁচু শিরের দিকে খোঁজে আলোর গোলক?
না তারা দেখে ব্রহ্মাণ্ডের একান্ত নাভিমূল –
যেখানে আছে অঙ্কুরোদগমের সঙ্কেত, বীজানু পরাগ
একহারা, একান্নবর্তী বিনত প্রেমাকুল তৃষ্ণার কাছে?
ও নাচ, ও নৃত্যকী,
কী যে তুমি ধুলার সংসারে এমন বাগানে ভরসা বারি।
English version: Where does the dance begin, where does it end?
মরণ মম
মৃত্যু দোরগোড়ায় নামে
বুঝি এক ক্ষুধার্ত ভল্লুক পড়ে হেমন্তে নিরালায়
আমাকে কিনবে বলে এক লহমায় তার খতি খুলে বের করে চকচকে সিকি আধুলি;
তাৎক্ষণিক সশব্দ বন্ধ করে তার পেটরা,
মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ে যেন গুটি বসন্ত;
মরণ এসে বসে সটান ঘাড়ের নিচে
ঠাণ্ডা হিম ভারী বরফের চাঁই।
আমার মনে হয় দরজা অবধি যাই, বলি- স্বাগতম:
আমি কী নয়া অভিবাসী ওই কাজলকালো আখড়ায়?
আমি কেমন ভুতগ্রস্তের মতো সবকিছু দেখি
ভাবি জীবন আমার বোন, কাজ আমার ভাই,
আমি সময়কে বোধে আনি প্রবাহের নামে
ভাবি, অসীমতা আমার প্রসন্ন নবায়ন;
চিন্তামনি আমায় কহে জীবন এক ফুলের নিরিখ
খোলা ময়দানে আপনি সই অলকানন্দা ফোটে,
প্রতিটি নাম মুখে মুখে ঘোরে সুরের দারুচিনি
মিলাতে ব্যাকুল উপত্যকায় নীরবতা রূপায়নী।
প্রতিটি দেহঘড়ি- সিংহের ভয়াতীত ঘরবাড়ি
অমূল্য রতন এই দুনিয়ার গিরস্থালির হাটে।
আমার কিসসার বটবৃক্ষ মোড়াবে যেদিন শেষে-
জানবো আমি বিবাহিত ছিলাম উৎসবের সনে
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে তবকের পর তবকে।
সমস্ত মেলার শেষে আমি খুলবো না জমা-খরচের খাতা
মিলাবো না- কী ছিল ভুল, কী বা হলো পাওয়া না পাওয়া।
কক্ষনো আমি এমন অনুযোগ করবো না-
আইলাম আর গেলাম ভবে দাগ তো ফেললাম না!
English version: When death comes
মন্দিরের ইতিহাস
এমন অনেককিছু আছে যেখানে তুমি পৌঁছাতে পারো না
কেবল তার কাছ ঘেঁষে বসতে পারো- চাই কী সারাদিন থাকতেও পারো।
বাতাসে ভর করে পাখি উড়ে চলে যায়
দূর, বহুদূর- তার মাজেজা কেবল উপরওয়ালা জানে।
তুমি নির্ণিমেষ ভাবো, ভাবো আর ধান্ধা খেয়ে রও,
মন করে আন্মন!
সাপ চলে রয়েসয়ে ধীর পায়ে, মাছ লাফিয়ে কাঁপে,
ছোট ভ্যাটের ফুল চমকায় জলের উপর
গোত্তা খেয়ে ডুবে ফের জলের আড়াল,
সোনালি ফিঙে ওই গাছের মাথায় টিকলি-
গান করে আপন সনে।
আমি দেখি- সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখি,
আমার এ-দেখা বিরাম না জানে।
দেখা কেবল চেয়ে থাকা নয়,
কিছু গ্রহণের বান্ছায় প্রসারিত হাত পেতে রাখা।
আর আশা করে থাকা-
কিছু না কিছু তোমার করপুটে এসে জমবে-
হতে পারে বাতাসের প্রাণভরা রাঙতা
বোধি বৃক্ষের গুটি কয় পাতাও হতে পারে বা,
সবাই জমায়েত হয়ে বসেছে এ খেলায়।
এবার আমি তোমাকে আদত কথাটি বলি-
এই জগৎ-সংসারে সবকিছু আসে।
দিব্যি দিয়ে বলি- নিদেনপক্ষে তার কাছাকাছি আসে,
বড়ো মায়া নিয়ে বসে।
যেমন খুঁটেখুঁটে খাওয়া দানাপানি, পিঙ্গলাবৎ মাছের চোখ,
যেভাবে সাপ আলগোছে তার খোলে দলাপ্যাঁচ,
যে-মত গান করে ওঠে ফিঙে- ওগো সোনার পুতুল-
আকাশের কিনারায় পলকা ওড়ে,
এভাবে ঈশ্বর থেকে আসে লীলুয়া বাতাসের নীলাভ লীলা!
English version: Where does the temple begin, where does it end?

কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছিলেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন।
বাংলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত।
প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার প্রতিষ্ঠান- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রকাশিত বই।।
আখ্যান নাট্য: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে।
কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর।
আখ্যান নাট্য: আবের পাঙখা লৈয়া।
প্যারাবল: হৃদপেয়ারার সুবাস।
কবিতা: নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো।
কবিতা : দূরত্বের সুফিয়ানা।
ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।