মোহাম্মদ হোসাইনের তিনটি কবিতা
ভালবাসার জেরক্স কপি
ভালবাসার জেরক্স কপি রেখে দিয়েছি
বৃক্ষদের মাঝে
টলটলে দিঘির গরিমায়
একদিন টাঙ্গিয়ে দেব নিরালায়
কিংবা
যে ঢেউ এসে বালিতটে চুমু খেয়ে ফিরে যায় বারবার, আর
যে পাখি ভোরের নীলিমা ছেড়ে জানলায় খুঁটে খায় দেহের উত্তাপ,
উঁকি দিয়ে দেখে নেয় পরাবাস্তব ঘুম, চোখ থেকে তুলে নেয় ঈপ্সিত কান্নার কলরোল
থোকা থোকা শব্দমঞ্জরি, থোকা থোকা বিহবলতা কিংবা সবুজ পায়রার গান, অভয় বুটিকদানার, কিংবা
হেলেঞ্চা বনে লুকোনো সাপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা কোনো গুপ্তমানব
সাদাকালো দিনের মাহাত্ম্য বুঝে ওঠতে পারি নি আজও, বুঝে ওঠতে পারি নি
করতোয়া পাড়ের স্নেহমাখা রোদ, কাশফুলবিস্ময়
তাই
সবই রেখে দিয়েছি জিনোম সিকোয়েন্সের মহিমায়
পূর্বপুরুষের জীবাস্ম থেকে খোঁজে নিতে হবে অতীতের জেরক্স সিনোম
মাটির দানা থেকে, বিন্দুবিন্দু জল থেকে বুঝে নিতে হবে হাওয়ার অনুবাদ
আকাশের ফুলস্ক্যাপ ফটোশুট ধরে রেখেছি বুকে, ধরে রেখেছি
নক্ষত্রের নিবিড় সখ্যতা, অনূদিত রাতের পঙক্তিমালা
ঝরনা ও জীবন, পাহাড় ও প্রতিধ্বনির মাঝে জুড়ে দিতে হবে সারস্বত প্রতিবিম্ব
প্রকৃতির
সমস্ত সৃষ্টিকে একই সূত্রে, একই বিন্দুতে এনে বলে দিতে হবে
আদি ও অনন্তের পরমতত্ত্ব, প্রকৃতিবাদ
ভয় এবং শংকা, সহস্র শিখা হয়ে উচ্চারিত হবে বিনির্মিত সহজ পাঠে
ভালবাসার জেরক্স কপি রেখে দিয়েছি তাই
রেখে দিয়েছি বুকের ভেতর
একদিন টাঙ্গিয়ে দেব পথে পথে পৃথিবীর পাঠশালায়…
নদী
নদীকে ভালবেসে একদিন
নদী হতে চেয়েছিলাম
নদী নেয় নি।
সেই থেকে নদী পাড়ে বসতি আমার
নদীকে অঙ্গে অঙ্গে নিয়েছি বেঁধে
তার ঢেউ, তার ভাঙনই নিয়তি আমার
দু’চোখ ভরে দেখি, তার জল গায়ে মাখি তৃষ্ণা মেটাই
হয়ত, সেও আমাকে নিয়েছে চিনে, হয়ত সেও আমাকে ভালবেসেছে ততদিনে!
তার কাছে কাছে রাখে। যতদূর যায়, তার দেহের পরতে লুকায়
নদী প্রেম আমার
প্রতিদিন
নদীকে তর্জমা করি…
শুধু মানুষেরা চলে যায়
শুধু মানুষেরা চলে যায়
রাত নেমে আসে
অকারণে জল বয়ে নিয়ে আসে কালো চাঁদ
বন্দরে হাজারো জাহাজ, হাজারো মানুষের ভীড়, পদচিহ্ন
খালাসিরা রাত ফেরি করে ফেরে
কষ্ট নিয়ে চলে যায় দূরের নোঙর
মানুষের মুখগুলো অচেনা গিটার
বেজে ওঠে শিশির, চোরাস্রোত
যাকিছু অজ্ঞাত, যাকিছু অধরা
সবই ফিরে ফিরে আসে মৌসুমী জলের ছায়ায়
হয়ত, স্নেহপরবশে জড়িয়ে ধরে গলা
কখনও কখনও চুমু খায় ঠোঁটে, নাভিমূলে
রাত নেমে এলে বাজায় টুংটাং দেহের সেতার
ছুটে আসে মৃতঘোড়ারা দিকবিদিক,
তখন পিতামহদের হাড়গোড়
লাল ঝাণ্ডা নিয়ে আসে
নীলিমা থেকে আসে স্বীকার্য পঙক্তিপুরুষ চিরচেনা তরবারি ফিদা হোসেন
হারিয়ে যাওয়া নোলক, দ্বিধাহীন আঁচল
সবুজ শস্য হয়ে,প্রেম হয়ে ফিরে ফিরে আসে
অবজ্ঞা মুছে ফেলে আসে স্নেহের কোলাজ
শুধু মানুষেরাই সয়ে যায়
শুধু মানুষেরাই নিরলে ভেদবমি করে
চোখ দিয়ে, বুক দিয়ে ঢেকে রাখে অয়োময়কাল
ঠোঁটে বিষের থলি, রক্তবীজ উপড়ে ফেলে
মানুষেরাই অনায়াসে চলে যেতে পারে
চলে যায়…

কবি
জন্ম ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর, সুনামগঞ্জে। লেখালেখি শুরু ছোটবেলাতেই। নানা পত্রিকায়, নানা মাধ্যমে চল্লিশ বছর ধরে নিরন্তর যাত্রা। কবিতাই তাঁর ধ্যান, নিমগ্ন আরাধনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে পেশা হিসেবে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে।