একগুচ্ছ কবিতা
আজ ২০ সেপ্টেম্বর কবি নভেরা হোসেনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
নীরবতা
___________________________________
সন্ধ্যার অন্ধকারে তোমাকে ভীষণ ম্লান মনে হয়। বৃক্ষের শরীরে যত ক্ষত, লোকালয়ে যত লোক
সব কোলাহল হয়ে নীরব।
এই সন্ধ্যা, স্মৃতির শহর একা একা হেঁটে যায় মিনারের পথ ধরে।
লাল লাল বটবৃক্ষ, পুস্তকের সারি। এখানে তুমি নিদারুণ , পড়ে আছো শত শত মলাটের আড়ালে।
একটা অক্ষর, একজন শব্দ গ্রাস করে রাখে। তুমিও হতে চাও অমলিন যেকোন নদীর তলদেশে…
লুসিফার
___________________________________
তোমার জানালায় কৃকলাস ম্রিয়মাণ
জলপাই গাছ, সকালের রোদ, শিশুর চিৎকার
ছিঁড়ে ফেলছে কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের পৃথিবীকে
কবিতা এবং দীর্ঘশ্বাসের বার্তা
কখনও কখনও লোকালয়ে অশ্রু জমিয়ে দেয়
না পাওয়া যত আর্তি
তোমাকে জলে ডোবায়, আগুনে পোড়ায়
পোড়ো বৃষ্টি ও নাস্তিতে
রোদে পুড়ে, জলে ভিজে হও শাণিত
যেন এক তলোয়ার
ছিঁড়ছে কাচের পর্দা
সময়ের বাঁকানো দাঁত—
দাও গেঁথে পোড়া চোখ লুসিফার
ভূতগ্রস্ত অস্থিতে
২.
সে ছিল সবুজ পোশাকে ঢাকা
পায়ে সমতল চপ্পল
এবং সে ছিল না যখন বইয়ের স্তূপ
ভেঙে পড়ছিল হৃদপিণ্ডের অলিন্দে
অলিতে-গলিতে
আহা আমাদের শহরেও ভোর হয়
দুপুরে গন্ধ ছড়িয়ে সাদা ভাত
পড়ে থাকে গোলাপি ডিশে,
পুড়ে পুড়ে চিলের ডানা
ছাই হয়ে আসে—
থাকো তুমি মিনারে, বৃষ্টির ফোঁটায়
স্রোতে ভাসা গাঙচিল নদীর আকাশ
থাকো তুমি মজ্জায়
মরীচিকায়…
সাইকো সাইকো
___________________________________
শহরে অবরোধ
গ্রামে
বন্দরে—
বড় বড় ট্রাক আগুনে পুড়ছে
অস্থি পুড়ছে
মজ্জা পুড়ছে
সিনেপ্লেক্সে গেরিলা ছবির প্রিমিয়ার শো
প্যারিসে শোক মিছিল
বগুড়ায় লাঠি মিছিল
আগুন জ্বলছে কাভার্ড ভ্যানে
ট্রেনের কম্পার্টম্যান্টে
করোটিতে ফুলের মুকুট
জরায়ুতে ডাবল গ্রেনেড
সাইকো সাইকো
আলফ্রেড হিচকক
আমি জেগে আছি
___________________________________
তুমি ঘুমাতে যাচ্ছো
আমি যাচ্ছি না
অনেকে জেগে থাকছে
অনেকে বারুদ পোড়াচ্ছে
কেউ কেউ আগুনে ঘি ঢালছে
ঘিয়ে আগুন—
একজন নিবিড় মনে কেটে চলেছে স্রোতহীন জলধারা
অনেকে ঘুমাতে পারছে না
কেউ কেউ ব্যাংকের ভল্ট ভাঙছে
কবিতা লিখছে কোনও একজন
তুমি ঘুমাচ্ছো
আমি জেগে আছি…
ভোর
________________________________
‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’
রাতের শেষঘন্টা বাজলো প্রহরীরা সব ফিরতে শুরু করেছে
শিউলি বোঁটা ছাড়ছে
কমলাডাঁটার ঠোঁট নিয়ে মাটিতে শরীর বিছালো
কুলকুল স্রোতে নদী বয়ে যায়
পাখিরাও জাগছে
সূর্যের কুসুমচোখ প্রথমে কমলা
ধীরে ধীরে সিঁদুররাঙা হয়ে ফুটতে শুরু করলো
কলপাড়ে বাড়ছে লোকের আনাগোনা
এই হচ্ছে ভোর
মিলের সিটি বেজে যার শুরু
এখন সমস্ত দিন জাগিয়ে তুলবে ভোরকে
বইহাতে ভোর স্কুলে যায়
মোড়ের দোকান হতে ক্রিমরোল
শত শত গাড়ি আর বাসের ভিড়ে
হারিয়ে যেতে থাকবে সকালের নির্মলতা
ধোঁয়া আর হর্নের একটানা শব্দ মনে করিয়ে দেবে আজ সপ্তমী
দুদিন পরেই বিজয়া
সমস্তদিন শাড়ি আর পাঞ্জাবির দোকানে ঘোরাঘুরি
দুপুরে ভাতসিদ্ধ, ড্রাইফিশ
এইসব করেই ভোর শেষ হয়ে গেলো
কারখানায় বিকালের ঘন্টি
দূর দূরান্ত থেকে লোকের দল
পায়ে চাকা লাগিয়ে ছুটছে
কেউ সিনেমাহলে, পার্কে, বাজারে
কেউ বাড়ির পথে
একটু একটু করে ছাইবর্ণ হয়ে এলো সন্ধ্যার আকাশ
পশ্চিম আকাশে গায়ত্রীমন্ত্র, বিজলীর আলো
সারা শহরে আলোর ফুল
কোথাও দীর্ঘশ্বাস, প্রেমিকের অপেক্ষা
মিলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত
সবাই একে একে পোশাক ছাড়ছে
শাড়ি, ব্লাউজ, জামা-পাজামা, প্যান্ট, শার্ট
শরীরে রাতপোশাক
রাত ঘননীল হতেই
বিছানায় কোমল হাত, শিশুর কোলাহল
এভাবে একটু একটু করে রাত নেমে এলো
চোখ থেকে খসে পড়লো চশমা
রাত শিথিল হয়ে এলো
আরেকটি ভোরের অপেক্ষায়
নো-ম্যানসল্যান্ড চিত্র
_____________________________________________
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে
পায়ের আঙুলে এসে ভর করে
শীতের তুহিন হাওয়া,
জ্ঞান হাতড়ে দেখি
অন্ধকার দালানের ফোঁকর
পরিত্যক্ত সিঁড়িঘর।
বহু হাজার বছর ধরে
বিকশিত পৃথিবীর পথে
মিশে গেছে
আমাদের সকল নিঃশ্বাসের ভার
অতিক্রান্ত দিনলিপি,
তারই জারিত রসে সিক্ত হয়ে
খরখরে মাটিতে
এঁকে চলেছি
নো-ম্যানসল্যান্ড চিত্র।
সন্তাপ সে তো আমার নয়
_______________________________________________
জল পতনের তরঙ্গায়নে
উৎকীর্ণ হয়ে উঠি,
কান পাতি ক্ষয়িষ্ণু দেয়ালের ভাঁজে।
নোনাধরা পাঁজরের হাড়
চুন হয়ে গলে পড়ে
ফেনিল সমুদ্রের বুকে।
অবিশ্বাসীর জ্বলজ্বলে চোখে
ক্রূরতার গ্লানি খুঁড়ে, আনি
নির্লোভ, নিষ্কাম সন্তের বাণী।
নৃশংসতার ক্ষুর বুকে চেপে
রক্তাক্ত হয়ে ভাসি
মন্থনহীন দীর্ঘ বালুকায়
সন্তাপ সে তো আমার নয়।
জীবন কড়া নাড়ছে দরজার ঐপারে
____________________________________________________________
আকাশে সাদা মেঘ
জল ঝরছে, মেঘ ডাকছে
উড়ন্ত শ্বেতপায়রা
ছাদে ছাদে নয়নতারা
অনেকেই চলে যাচ্ছে
আজ চলে গেলো দুজন মন্ত্রী
গতকাল দুজন চিকিৎসক
প্রাণবন্ত যুবক
সিরাজগঞ্জে একজন কৃষক
নওগাঁয় অষ্টাদশী তরুণী
এভাবে যেতে যেতে মৃত্যু আজ তোমার দরজায়
হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক
জর্জ ফ্লোয়েডও চলে গেলো
সাদা সাদা গোলাপের পাপড়ি কালো শরীরে
নিঃশ্বাস নিতে পারছো না
একটা শক্ত হাঁটু চেপে বসেছে গলার কাছে
সভ্যতার হিংস্রদাঁত
বিদ্ধ করছে নিরীহ জনপদ
আরবসাগর আজ শান্ত
ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস নেই
তবু কলকাতার ঘরে ঘরে এমফানের বিভীষিকা
প্রকৃতি আজ নৃশংস হয়ে উঠেছে
তারও আগে মানুষ
একজন অন্যজনের উপর চেপে বসেছে
বাঁচা-মরার লড়াই
করোনার দিন একদিন শেষ হবে
ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে
মানুষের ইতিহাসও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে
স্মৃতিতে অমরতা
হৃদয়ে স্পন্দন
জীবন কড়া নাড়ছে দরজার ঐপারে।

জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে।শৈশব হতেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা।তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চবিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা হতে।লিটলম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে।বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন।।প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: হারানো দোকান এলদরাদো (জনান্তিক, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯), একজন আঙুল শুধু হেঁটে বেড়ায় (সংবেদ, ফেব্রুয়ারি, ২০১০) আরকারনেশন ফুটলো থরেথরে ( শুদ্ধস্বর২০১৩), একটু একটু করে বোবা হয়ে যাচ্ছ তুমি (অ্যডর্নপাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। ।. বারুদ লোবানের গন্ধ ,Barudlobanergondho (poetry ), Choitonyo, জলে ডোবা চাঁদ ( ২০২০জানুয়ারী , কলকাতাবইমেলা ) ঐহিক প্রকাশনী।প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:পেন্ডুলাম ও শিশুর দোলনা (শুদ্ধস্বর,ফেব্রুয়ারি২০১১), জৌলুসী বেওয়া ( দেশপাবলিকেশন্স, ২০১৬)। এছাড়া পিয়াস মজিদের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর (অ্যডর্নপাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১০), ২০১৭,তিনি কিছুদিন নৃবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েব ম্যাগাজিন, জার্নাল ও দৈনিক পত্রিকায় লেখেন।
ইমেল : [email protected]
ফোন : 01745370195