| 19 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

শংকর লাহিড়ীর গুচ্ছকবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

আজ ১৯ সেপ্টেম্বর কবি ও তথ্য চিত্র নির্মাতা শংকর লাহিড়ীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

অনন্ত সূত্রধর

তারপর  অনন্ত,   তুমি সাথে সাথে এতদূর এসে 

অস্ফুটে   আমারই সম্মুখে    

দাঁড়িয়েছ !    -যখন সম্মুখ ব’লে কিছু নেই 

ঊর্দ্ধ অধঃ নেই,    শুধু পূর্বাপর –

আলো-জ্যামিতির  গায়ে  তমিস্রা  নাম্নী  এক নদী

রয়েছে জড়িয়ে

স্মৃতির কুহক     নাকি  উদ্ভ্রান্ত অবিরল কণা     

এতদূর চলে আসে   বিকিরণ  ভস্মদল

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে প্রত্যেক গহ্বরে

বালিয়াড়ি শস্য মরুভূমি    জলের প্রত্যাশে কেঁপে ওঠে ।    

তুমি সেই আদিম সারস

দীর্ঘ ডানার পাখি, 

শবদেহ জাগাতে এসেছিলে ;  

পরিত্যক্ত রানওয়ে…    উড়ে যাচ্ছে লাল মাইক্রোলাইট,

নাকি এক লাল অন্তর্বাস ? 

আমরা তো কবিতাকে জলোচ্ছ্বাসের মতো অন্তর্বাসের মতো

বাজুকার মতো

কর্তৃত্বময় দেখতে চেয়েছি ;      অনন্ত নক্ষত্রলোক 

আমাদের শস্যবীমা আছে ।  

তবুও অনন্ত,  তুমি

এতদূর এসেও জানালে না    -উত্তাল সমুদ্র     

না কি ভাসমান দ্বীপপুঞ্জ       তুমি

কোথায় অধিক তেরিয়ান

রৌদ্র-ফসফরাস জানে   তপ্ত বালু   কচ্ছপের ডিম

ভাঙ্গা নৌকায় শব

ঘর্মাক্ত সানট্যান্ড বিকিনি তরুণী

পদচিহ্ন মুছে মুছে চলে গেছে অজস্র জীবন।

আমি সেই দৃশ্যপট নির্মিত দেখেছি

ভিটে বদলের দৃশ্য,   গেরামথান পার হয়ে চলে যাওয়া 

ভাঙ্গা আর্শি    ময়ূর পালক

কাজলের দাগ ছিল মাটির দেওয়ালে – 

লবণাক্ত জল নামে ধীরে ধীরে মাটির গভীরে

পান্ডুলিপি  রৌপ্যমুদ্রা      কাদামাখা তোরঙ্গ    চাবুক

দড়ি ও হারপুন

হ্রদের অতলে ঘোরে অন্ধ মাছেরা ।  

তুমিও অন্ধ ছিলে,    নিজ বর্ণমালার আশ্রয়ে

অন্ধ   অশরীরী

ক্রমে  ব্যবহৃত  ব্যবহৃত    বহু ব্যবহৃত   

ব্যবহৃত হয়ে  

অনন্ত কাল,     তুমি সত্যিই    এমনই 

চিহ্নবোধহীন?  

ছবি ভাসমান    ছিন্নভিন্ন,     বহুমাত্রিক 

সমুদ্রপৃষ্ঠাগুলো-  

নীলাকাশ ভেসে যায়       সৌরমূর্ছনায়

দিনের কলড্রন ভরে ওঠে    

শবদেহ  মেঘ  বাস্প   রডোডেনড্রন   

আহ্নিক গতিও ক্রমে ক্ষীণ ;     ক্রমশঃ স্তিমিত আলো  

গোলাপী আলোরা –  

শব্দহীন বৃষ্টিবন

টুপ টুপ শিশির পড়েছে

ঘূর্ণি হাওয়ায় ঘোরে   ঝরাপাতা    মাটি উড়ছে  

পত্রমোচী বন –

এই  বৃত্তপরিধির  মাঝে

কে তবে জাগিয়ে রাখে সারারাত তোমাকে আমাকে ?

তোমারই হাতের নম্রতা
   

ঝিঁঝিঁর শব্দ ওঠে বনে বনে        

– অনন্ত,  এই রাত এত শব্দহীন ।       

অনন্ত, কোথায় গেলে সেই মানুষের স্পর্শ পাবো 

সৌরপৃথিবীর কোন শাঁসের গভীরে  

এতদিন অরণ্যবাসী     এত দূর অরণ্যবিনাশী     

ইরেক্টাস, স্যাপিয়েন স্যাপিয়েন,

নিয়ান্ডারথাল

ঘনজ্যামিতির মতো ঘাসে

যৌনচেতনায়  নাকি মৃত্যুভয়ে    কেঁপে উঠে ছিলো

রান্নাঘর সরু চাল     নিকোনো উঠোনে কলরোল

ভিয়েন বসেছে

খেজুর রসের মতো রক্ত ঝরছে নিঃশব্দ প্রাণে 

নিঃশব্দ রক্ত ঝরে    আক্রান্ত  বাতাসে

দৃষ্টিহীন হয়ে আছি

ক্রমে ওঠে ক্লান্ত হিম পাতাপোড়া রাতের হিল্লোল। 

অনন্ত বৃত্তের মাঝে   রয়েছে  অনন্ত

দুটি রেখা ;

সাগর ও সৈকতের মতো

সমান্তরাল

আলো     অন্ধকার   

উলম্ব বাতিস্তম্ভ,   যে আলোতে সঞ্চিত জলের

দেখা যায়   পূর্বাপর  

এই পথ দিয়ে যেতে যেতে   আমরা তো

কতবার

অনন্ত   অনন্ত   অনন্ত   ব’লে 

চেঁচিয়ে ডেকেছি

আমাদের হাত ছিলো   পিছমোড়া,   

চোখ বাঁধা ছিলো,     কষে

শুকনো রক্তের দাগ 

তপ্ত সৈকতবালি      পদচিহ্ন ছিলো কি আমাদের ?

শংখচিলের ডাক   

সমুদ্র গর্জন

-কতবার  অনন্ত  অনন্ত  ব’লে চেঁচিয়ে উঠেছি।  

৬*

অনন্ত শ্যাম বলছে      কথা বলো, হে অনন্ত শ্যাম

অমূলসম্ভব রাত্রি

পাড় ভাঙ্গছে   গভীর  অচেতনে

ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে   ঘুমিয়ে আছে চেতন-ভ্রমর । 

হে বনমর্মর,   জলপ্রপাত,   হে সন্তানসম্ভবা –

হে একটি সম্বোধন   তোমাকেই 

কথা বলো, হে অনন্ত শ্যাম 

কথা পুরুষম    বলো,   

বলো কী কী আবিষ্কার পেরিয়ে এসেছো এতদূর  

একমাত্র নোঙর জানে নাবিক জন্মের ভবিষ্য –   

গাছে গাছে বিষফল পেকেছে এখন ।

বিরল গন্ধ থেকে উঠে এসে ধীরে

নিজের আয়ুর মতো শ্যামবর্ণ একজন কবি –

সৈকত বালুতে তার পদচিহ্ন

দেখেছে কখনো 

রঞ্জনরশ্মি  জানে    শরীরের অন্তর্বর্তী

চিহ্ন   ভাষা    ইয়েরোগ্লিফিক

কবি জানে     শুয়ে আছি ঝর্ণার পাশে

সমুদ্রশৃগাল জানে  হাঁসের মাংস সুস্বাদু 

সুনামির এক বছর পরে  যারা ফিরে এসে ছিল

নামানো রুকস্যাক,          চোখে    

আলোর হাঁসুয়া –

নিখিলের নীল গ্রামোফোনে    ছররা গুলির শব্দ

বনে আজ কনচের্তো বেজেছে ।

সুখের কালক্রম ও সমুজ্জ্বল দুঃখ পার ক’রে 

ঐসব ছায়ানৌকোগুলো –

ক্রমে বিস্মরণ তাকে নিয়ে যাবে পরম আদরে  

চিতাবাঘ শহরের    চিত্ররূপময়    এক

অন্য ব্যাপারে ।    

মাটিতে প্রোথিত আছে    প্রিয় কবিতার বইগুলো –      

আকর্ষণ বল আছে,  

রক্তে আছে আদিম লবণ। 

[ *এই লেখাটির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে কয়েকটি কবিতার বইয়ের নাম। কবিদের কাছে আমার ঋণ স্বীকার। ]  

অনন্তের পাশে ব’সে   নির্বিকার  আমিও দেখেছি

কিভাবে আলোর বেগে  ছুটে যেতে যেতে 

প্রতি ক্ষণে

বর্তমান ঝ’রে পড়ে    অতীতের  অনন্ত  গহ্বরে 

পিয়ানো অর্গান থেকে সুর ওঠে

থির থির কাঁপে        -কুয়াশা জড়ানো রাত     

শত খন্ড   টুকরো টুকরো  

পয়ার ছন্দে লেখা   আবহমান  রাত্রিযামিনী ।  

একদিন অনন্ত রায়     টিনশেডে ভূতগ্রস্ত সেলাই মেশিনে – 

তখন গ্রীষ্মের ফল ;   

একদিন অনন্ত মুর্মু     ইটের ভাটির পাশে হোগলার আধো অন্ধকারে – 

তখন বসন্ত পাখি ;   

সেগুন অরণ্যজুড়ে  সন্ত্রাসে ভয়ে সারারাত       সেই 

পাখি ডেকেছিল  

শহরের রাজপথে ঘর্ঘর শব্দ তুলেছিল

অনন্ত হাঁসদা-র   হাওয়াগাড়ি।   

অনন্তের কথা আমি কবিদের কাছেই শুনেছি

এবং গঞ্জের ঘাটে মাঝিদের কাছেও ।  

আলিপুর দায়রা আদালতে

মহামান্য আদালতও সখেদে  জানতে চেয়েছিলেন     

অনন্তকাল কেন    এইসব  মামলা  চলেছে    

দৃশ্যতঃ  গতিহীন       

রাতের আকাশে ছিল স্বাতী তারা  -অবিচল নক্ষত্রমন্ডলী !      

   

একদিন কবিতার আনন্দবাসরে   গ্রীনরুমে,      

নাকি এক টাট্টুর বাজারে  

দেখেছি দেওয়ালে লেখা : 

‘মাত্রাহীন অসীম আবার কিসের বিষয়’  

-এই প্রশ্নের মুখে  একাকী বিস্ময়ে আমি বালকের মতো 

কতো রাত  ঝিঁক চোখে কাটিয়ে দিয়েছি ।  

একান্ত বালক জানে অক্ষরে মাত্রা দেওয়া ভালো ; 

একান্তে বালিকা জানে মাত্রাহীনতার রাত  কিরকম

সঙ্গোপনে বেড়ে

           

ঢ’লে পড়ে  অনন্তের দিকে ।       

নাম অনন্ত হেমব্রম,   গ্রাম তুইলাডুংরী,  জিলা  

পূর্বী সিংভূম,   -ঝাড়খন্ড ।  

কদ্‌ পাঁচফুট দুইঞ্চি,     বাঁ-পকেটে গেটপাশ ছিল

রঙ গেহুঁয়া,     উমর পঁচাশ,  

খৈনির ডিব্বা ছিল,  বিড়ির বান্ডিল

সাইকিল বিল্লা ছিল চাবির গোছায়

ফুটন্ত লোহার নদী  অনন্ত অনন্ত ব’লে ডাক দিয়েছিল – 

আংরা হ’য়ে পড়ে ছিল,

শোনা গেল  -থার্ড ডিগ্রি বার্ন ।  

লাল মাটি, পাহাড়ি ডুলুং 

ব্রাজিলের জার্সি পরা সর্ষেক্ষেত  

উঠোনে দোলনা বাঁধা,   হাঁড়িতে কিছুটা মদ ছিল 

মাটির দেওয়ালে আঁকা ছিল

মালা হাতে সীতা,  পাশে অতিকায় ধনুর্ধারী রাম ।  

১০

সমস্তই নির্ধারিত হয়ে আছে !  – আজ জঙ্গলের

মধ্য দিয়ে যেতে যেতে জিঞ্জিরাম নদীর কিনারে 

গাছের মগডাল থেকে ক্রেস্টেড ঈগল দেখেছিল

আমাকে,     আমিও তাকে ।       অর্থাৎ এই দেখাশোনা

এই উত্তরের হাওয়া নির্ধারিত ছিল নাকি

আমার জন্মেরও আগে,        অনন্ত সময়-গভীরে !  

অনন্ত, সত্যি তুমি শক্তিমান এত  -নাকি এক গভীর দুষ্টুমি ?     

কাল জঙ্গলের  

মধ্য দিয়ে যেতে যেতে  জিঞ্জিরাম নদীর কিনারে

গাছের মগডালে সেই ঈগল কি থাকবে আবারও ?

যদিও উত্তরে হাওয়া বয়ে যাবে

আন্দোলিত হবে সেই গাছ 

তবু সে থাকবে না, আমি জেনে গেছি একান্ত অনুভবে-

আমারও ভেতরে আছে অনন্তের একটি প্রতিভূ। 

১১

কংসাবতী নদীটির মধ্যে আমি তাকেই খুঁজেছি

‘পরাণকথা’ শব্দটির ছিলকার ভেতরে

যেখানে মৃদঙ্গ বাজে অনন্তের মতো দ্রিম দ্রিম

আমারও চোখের মধ্যে   তার দুচোখের স্পষ্ট নীল     

ছায়া পড়ে

এই হাত  এই আঙুল     এই শুকনো ত্বকের খশখশ –

জমিজরীপের কাজে বেলা হয়

সবুজ টিয়ার ঝাঁকে উতরোল ওঁরাও যুবতী

কংসাবতী বয়ে যায় অনন্তের দিকে ঢাল বেয়ে ।

১২

সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি,   পায়ে গামবুট

মাথার টুপিতে আলো-      শ্বাসরোধকারী অন্ধকারে

তির তির জল পড়ে পাথরের গভীর ফাটলে 

যেখানে দুপুর কালো, রাত্রি কালো, চিন্তা যুক্তি বিবেচনা কালো 

-শুধু কফনের রঙ সাদা ।  

আমি সেই  সাদা কালো ছবির ক্যানভাসে

আমি তার অনন্ত রতির আশ্লেষে 

আমি তার পাতায় পাতায় ফের জেগে ওঠা আলোর সংশ্লেষে 

আমি  লাল পিঁপড়ে  ও  পিরানহা মাছের সন্ত্রাসে-  

স্ট্রেচার বাহিত হয়ে চলে যাচ্ছি     সবুজ অ্যাপ্রন ।

গ্যালারীর সবুজ আঁধারে,             

অনন্ত সূত্রধর      – ব্ল্যাক বোর্ডে পাই-য়ের মান  

লিখে চলে একা নির্বিকার :   

তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ

আট নয় সাত নয় তিন দুই তিন আট চার ছয় দুই ছয় চার…

 

 

সেই বাড়িটার রঙ

( উৎস : গদারের চলচ্চিত্র – ‘টু অর থ্রি থিংগ্‌স আই নো অ্যাবাউট হার’ )

সেই স্বপ্নটা আমি অনেকদিন দেখি না যেন ষোলোতলার
খোলা জানালা দিয়ে পড়ে যাচ্ছি গাছে গাছে
এত অজস্র স্যালাড-পাতা
সবুজ হলুদ মভ্‌ শিরাকাটা রক্তাক্ত খয়েরী

আর তুমুল আছড়ে পড়তেই ঝনঝনিয়ে ফুটপাথ টুকরোগুলো
সারা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে শববাহীরা আমি একা
কুড়িয়ে তুলছি ফটোফ্রেম বোন-চায়না
আমি নিশ্চিত জানি এখানে এইঘরেই কোথাও একটু নীল
রয়ে গেছে ওয়ার্ডরোবে স্বপ্নহীন
কন্ডোম লিপস্টিক

টীশার্টগুলোর অন্ধকার ভাঁজে ভাঁজে আমারই নামের
আদ্য অক্ষর আর তোমার শেষটা যদি
এমন হয় নীল রঙকে আসলে ওরা
সবুজ বলে, কোনও দিন খুঁজে পাবো না
চিনতেও পারবো না তোমার আঘাতগুলো

কেননা শব্দই আমাদের ধারণ করেছে সেই
প্রবাহিত শব্দমালা
অর্থ যতি আর্তি ব্যাঞ্জনা, ঝুলে আছে মহাশূন্যে

আমাদের একক আশ্রয় সেই বাড়িটার স্পর্শ ঘুম রঙ
হিমায়িত শবদেহ বিজ্ঞাপিত ধাতু ও বুরুশ
শ্বাসরোধকারী এক রন্ধনপ্রণালী।

বিপন্ন মহিষগুলো ডাকছে

❑❑

সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে বিপন্ন মহিষগুলো ডাকছে।

আরব সাগর থেকে জল এসে লাগছে তাদের বাঁটে
আর নুনে ভরে উঠছে দুধ;
গায়ে আটকে যাচ্ছে ছোট ছোট ঝিনুক ও জেলিফিশ।

একটা উল্কাপিণ্ড এসে পড়ছে খড়ের গাদায়,
চাঁদের প্রান্তবর্তী টুকরোগুলো এসে পড়ছে মহিষের খাবারে
আর প্রধান রাস্তা দিয়ে দুধ বয়ে যাচ্ছে।
এই দৃশ্যে শহরের উদ্ভ্রান্ত সমস্ত রাখাল,

তারা বেহালা বাজাতে জানে না,
ভয়ে জড়িয়ে ধরছে আপন মেয়েমানুষদের;
মেয়েমানুষের লাল আলোয়ানে মুখ লুকিয়ে কাঁপছে তারা
আর অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে সন্ধ্যায়।

মেয়েরা, মকাইয়ের গন্ধ যাদের সমস্ত শরীরে,
হাতে নিয়ে দেখছে ঐ উল্কাপিণ্ড ও ছোট ছোট ঝিনুক,
জল এসে লাগছে তাদের স্তনেও।

একটা কাঁপন এসে লাগছে জরায়ুতে; হিম গুঞ্জনময় জলে
গর্ভ ভরিয়ে তুলবে এই সম্ভাবনায়
আবেগে শিহরনে তারা দুলে উঠছে।

বিদ্যুতের আলোয় চমকে উঠছে মহিষ ও দূরগামী রাজপুরুষেরা।

 

 

সস্‌প্যান

❑❑

সাদা সস্‌প্যানটি ক্রমে কালো হয়ে উঠছে
বিন্দু বিন্দু জলে মুখ ভিজে যায়, কাঁপে
ঐ কালির মধ্যে আছে কার্বন ও রন্ধনপ্রণালি

আর এক রুদ্ধশ্বাস    আবেগ    গহ্বর।

কত সস্‌প্যান ও ব্রেকফাস্ট টেবিল ঘটে গেছে
চাকা ও দড়ির কারুকার্য

কত রকমের চাবুক ও সসেজ

ভালো স্ট্রবেরির জন্যে আয়োজিত ঈষদুষ্ণ জীবন
উষ্ণতার জন্য কত সস্‌প্যান ক্রমশ কালো।

 

 

কফি

❑❑

আমায় টেবিলে ডাকো,    দাও কাপ,    দাও প্রস্তাবনা
বাতাসে অনেক দুধ,     আলোয় অশেষ চিনি আছে
যেতে চাই কোনও দূরে      স্পষ্ট কোনও মাইলমিটারে
দেখো ডানা সংকুচিত কিনা

সম্পূর্ণ মেপে ভেঙে প্যাক খুলে দাও
                                                                     যেন গলে যেতে পারি
এবার কাপের মধ্যে;    —জেগে আছে উজ্জ্বল চামচ
আর কফিটুকু তৈরি হয়ে যাক।

আমি টেবিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য পাশে ঘুরে
এসেছি তোমার কাপে,    সেই মাপে তুমিও ঢালো কী
তোমার সকল দুধ             তোমার সমস্তটুকু চিনি

তুমিও কি লিপিবদ্ধ রন্ধনপ্রণালি ভালোবাসো

কাপের গহ্বর ছেড়ে উঠে এসে কফি থেকে ক্রমে
তীব্র এক ঘ্রাণ এসে ঢুকে    পড়ে ভ্রূণের ভেতরে,
                                                                        —ক্রমে চঞ্চলতা আসে

ঠোঁটে    গর্ভে    অজস্র ডানায়।

 

 

 

গান এসেছিল কাল

❑❑

গান এসেছিল কাল ফলের আকার নিয়ে আমার টেবিলে
তাতে আমি দু-কামড় দিয়ে
দেখেছি, ভরেছে মুখ ফলের অপূর্ব পীত রসে।

জেনেছি, এমন ফল এ বাজারে সহজে মেলে না
বহুদূর অরণ্যপ্রদেশে
কুয়াশা অধ্যুষিত দুর্গম পাথর পেরিয়ে
এই ফল এসেছিল আমার টেবিলে, আমি
কিনেছি অনেক দামে তাকে।

আমাকে বাগানে আজ মুখার্জীরা ডেকে বলে গেছে
ও-গানের নাম নাকি সিন্ধুভৈরবী, আর
ঐ ফল তারা নাকি প্রতিদিনই খায়।
একথাও বলেছে যে আগামী আশ্বিন থেকে
এ-ফলের স্বাদ আমি কোথাও পাব না—

শুধু মুখার্জীরা পাবে, কেননা তাদের আছে
                                                 জেলি বানাবার পদ্ধতি।

 

 

 

মুখার্জী, তোমার আছে

❑❑

মুখার্জী, তোমার আছে
লাবণ্য, চেতনা, নুন, আত্মবিশ্বাস,
ক্রিমের প্রচুর তুমি, প্রচুরের ক্রিমের মতন—
তোমাকে সকলে চায়, কবিতাও চেয়েছে তোমাকে।
এই যে তোমার কাল, একালের অদ্ভুত ব্যাটারি,
আপামর চার্জড্‌ হয়ে আছে—
এই যে তোমার জেলি, সুরাসার, দ্রাক্ষারিষ্ট, ক্ষীর,
সামগ্রিক পরিক্রমা, ডাবলিউ এবং ডাবলিউ,
এই বৃংহণ, এই সফিস্টিকেটেড হ্রেষা ধ্বনি—
এ কি তাৎক্ষণিক গুঁতো, এ শুধুই অসার রোয়াবি?

আমি তো দেখেছি ভেবে, ভেবে কেন, স্পষ্টই দেখেছি,
কিভাবে লাফাও তুমি, হঠাৎ কিভাবে ঝুঁকি নাও ।
কত অনায়াসভাবে ফল থেকে জেলি তৈরি করো
সহসা বিপুল জলাভূমি রূপান্তরিত করো অদ্ভুত রঙিন সুরাসারে ।
ঘোর অবিশ্বাস হয়, তবু ভাবি স্পষ্টত দেখেছি,
প্রায় দেড় লক্ষাধিক লেখা হলো বিপুল কবিতা
              মুখার্জী তোমারই মাপে।

—সকলে আমাকে বলে, আমিও আমাকে ডেকে বলি,
                             হতে হবে মুখার্জীর মতো।

 

 

কবিতা, ঘুমোও তুমি

❑❑

কবিতা, ঘুমোও তুমি, মুখার্জীও ঘুমিয়ে পড়েছে
তোমার দক্ষিণ পাশে, তোমারই স্তনের দিকে ফিরে;
—গাঙ্গেয় বাতাস আসে, প্রান্তরে নগরে হাই ওঠে।

যা তুমি বলেছ কাল, গত রাতে, আগের সপ্তাহে,
যেখানে রেখেছ তুমি অন্তর্বাস, অধিক কাঁচুলি,
শব্দ সংযোজন করে, সমাসবদ্ধ হয়ে, ভেঙে
—সেখানে তোমারই বেদি, নিত্যপূজা, মাল্যদান হলো।

কবিতা কি সহসাই নগর বন্দর থেকে, ঘর থেকে, ক্রমে
বিবাহ জীবন থেকে, ফলবাগানের থেকে অন্তর্হিত হবে?
—ভাবি আমি, দেখি ভেবে রাত্রি হয়ে নেমেছে আঁধার।

মুখার্জী ঘুমিয়ে আছে, কবিতাও ঘুমে মগ্ন, তার বাম হাত
এলিয়ে রয়েছে পড়ে, কামচিহ্ন আঁকা আছে হাতে;

ফুটেছে শীতের রেখা ; শীতের স্পষ্ট দাঁত
                                            প্রতি ছত্রে,                  প্রত্যেকের ঠোঁটে।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত