আশুতোষ পাল সত্যিকার অর্থেই চল্লিশ দশকের একজন শক্তিমান কবি। প্রাবন্ধিক ও কবি হলেও প্রধানত তিনি তাঁর সনেট লেখার জন্যই পরিচিত। বিচিত্র বিষয়াবলম্বী তাঁর সনেট সমূহে শব্দ ও ছন্দ ব্যবহারে খুবই কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত শব্দের ওপর তার দখল ঈর্ষণীয়। প্রকৃতি, প্রেম, মানবিকবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবই তিনি তাঁর সনেটের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে সনেট যেহেতু সীমাবদ্ধ আঙ্গিকের কবিতা, কবির স্বাধীনতা সেখানে অনেকাংশেই খর্ব। কবির পওে তাই সনেটে আধুনিক বোধের ব্যবহার খুবই কঠিন। আশুতোষ পালও সেটা পারেননি বিধায় তিনি ত্রিশোত্তর কবিতার প্রবল ঢেউয়ের অংশীদার না হয়ে মাইকেল, রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েই থেকেছেন। তবে তাঁর সনেট রচনায় শক্তিমত্তার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকলো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া কবি আশুতোষ পালের কবিতা।
নবায়ন
বনান্তের স্বর্ণশীর্ষে প্রভাতের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি।
সীমাহীন অন্ধকারে ক্লান্তিদীর্ণ কুয়াশা-কর্ষণ
করেছি তো সারারাত-পেলাম কি এ রাতের মন?
বেদনা-বিশীর্ণ জ্বালামাঝে শুধু দিয়েছি আহুতি
দুটি হৃদয়ের স্বপ্ন- যৌবনের আকাঙ্ক্ষা-আকুতি
নিরাশা-নিবিড় মন নিয়ে। কিংবদন্তী-কন্ডূয়ন
যেন এ রাতের স্মৃতি। শিরায় স্বপ্নের শিহরণ
সকালেই শান্তি আনে- ঢেলে দেয় দিগন্তের দূতি।
স্বপ্নস্তব্ধ সকালের দুটি ওষ্ঠ কাঁপানো মায়ায়
সুনিবিড় চুম্বনের প্রগাঢ়তা ঢেলে দাও, আর
হাসি-রাঙা মুহূর্তের পরিপূর্ণ নিবিড় সান্ত্বনা।
রাতের সমুদ্রস্নানে ক্লান্ত মন। কানায় কানায়
পূর্ণ এই হৃদয়ের থমথম আবেগ-বিথার
সঙ্গীত-গম্ভীর হয়ে ঢেকে দিক আমার কামনা।
[রচনাকাল ১৯৫৪]
স্বপ্নশেষ
অনাহত জীবনের বালুচরে স্বপ্ন পলাতক।
দুরন্ত রক্তের ঢেউ সময়ের চঞ্চল শিরায়
পল-অনুপল যতো গোনে, আর অবচেতনায়
আবেগের বন্যা আনে। কানে কানে ছন্দের চাতক
তৃষ্ণার খবর দেয়- তৃষ্ণা তার অনতিব্যাপক।
আমার অতন্দ্র চোখ নীহারিকা-সঞ্চারী তারায়,
নক্ষত্র-বিলাসী মন মুক্ত হল অসীম হাওয়ায়
সে আবেগ, সে খবর তাই নয় স্বপ্ন-নিয়ামক।
দুস্তর এ ব্যবধান। ঘুমে ঘুমে কাহিনী নিঃশেষ
জাগর মনের কোণে এ কাহিনী তরঙ্গ তোলে না
তার সীমা অন্ধকারে, তার সীমা বহু ব্যর্থতায়।
চিহ্ন রাখা দিনক্ষণ অচিহ্নিত সময়ে মিলায়,
অকৃপণ এই মন শূন্য হাতে জীবনের দেনা
শোধ করে দিতে চায়, তবু তার থাকে অবশেষ।
[রচনাকাল ১৯৫৫]
শরৎ
শরতের দীপ্ত মেঘে প্রাণবন্ত আকাশ-মেখলা,
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নীলাঞ্জন ছায়ার সঞ্চার,
স্নিগ্ধনাদ মলয়ের অম্লান অতনু অবতার
চকোরের কলাহ্বানে সচকিতা চকোরী চঞ্চলা।
নদীতীরে কাশবনে মলয়-হিল্লোলে ছলাকলা
সমুজ্জ্বল দিনগুলো পূর্ণ করে প্রীতির সম্ভার,
উচ্ছল আলোর বন্যা মনে আনে আনন্দ উদার
বলাকার পক্ষপুটে প্রাণবন্ত শরৎ উতলা।
হৃদয়-আকাশে ভাসে আমার শারদ মেঘ-মায়া,
অভাবিত প্রশান্তির আদ্যোপান্ত ভরা প্রেমাবেগে,
কাশের আতপ্ত ছোঁয়া বাতাসের আনন্দের মাঝে,
লুব্ধ অনুভূতি দিয়ে স্পর্শ করি বিস্ময়ের ছায়া
পত্র মর্মরের ধ্বনি হৃদয়-তন্ত্রীতে উঠে জেগে,
উদাসীন মধ্যযামে নিরন্তর নীলাভা বিরাজে।
[রচনাকাল১৯৯০]