পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতাগুচ্ছ
কবি প্রার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল কলকাতার দমদম সিঁথির মোড় এলাকায় থাকতেন। তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। নির্জন ও আত্মমগ্ন কবি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে মননশীল পাঠকসমাজে আদৃত ছিলেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। তার প্রথম বই ‘দেবী’ প্রকাশ পায় ১৯৭০ সালে। স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির জন্য প্রকাশের পরপরই তৎকালীন পাঠকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয় কাব্যগ্রন্থটি। এছাড়া তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘আকাশ (১৯৬৬)’ ও ‘অন্ধযুগ (১৯৭৩-৭৪)’। কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ‘দেবী ( ১৯৭০)’, ‘রাত্রি চতুর্দশী ( ৮৩)’, ‘টেবিল’, ‘দূরের সন্ধ্যা ( ৮৪)’, ‘পাঠকের সঙ্গে’, ‘ব্যক্তিগত ( ২০০১)’, ‘ধর্মপুত্র’, ‘এখানে আসুন (২০০৭)’, ‘বর্ণজীবের সনেট (২০১৩)’, ‘বহিরাগত (২০০৮)’, সাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ (২০১৫)’, এবং ‘নবান্ন (২০১৯)’।
তার বাবা নরেন্দ্রনাথ কাঞ্জিলাল। মা জ্যোঁৎস্না কাঞ্জিলাল। জীবনানন্দ-পরবর্তী পরম্পরায় অগ্রগণ্য এ কবি এবং একদা-নিরলস সাহিত্যকর্মীর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে, ‘ইমন’ পত্রিকায়। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতাসংগ্রহ স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রাবস্থায় তার উদ্যোগে প্রকাশিত একটি স্বল্পায়ু সাহিত্যপত্রিকার নাম ‘আকাশ’। সাতের দশকের প্রথমার্ধে সম্পাদিত ‘অন্ধযুগও’ স্বল্পায়ু— কেবল দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হতে পেরেছিল— কিন্তু অভিঘাতের দিক থেকে প্রভাবশালী। অন্ধযুগের লেখকরা অনেকেই পরবর্তীকালে তাদের নিজস্বতার ছাপ রাখতে পেরেছেন। অধুনালুপ্ত বাণিজ্যিক সাহিত্য-সাপ্তাহিক ‘অমৃত’-র সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠরূপে যুক্ত ছিলেন। তার কবিতার বই ও পুস্তিকাগুলো প্রকাশিত কবিতাসংগ্রহে সংরক্ষিত হলেও খ্যাতিমান ও অখ্যাত, মৃত ও জীবিত পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত তার বহু কবিতা আজও রোদে পুড়ছে, জলঝড়ে ভিজছে; কবিতা-বিষয়ক অসংখ্য গদ্যরচনা এবং অন্তত দুটি উপন্যাসের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত।
ট্রেন
যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখন
অন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?
যখের গহনা আগলায় আজ এই
উত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়ো
অপারগ আচার্যের আঙুলের উন্মন
উপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।
শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সতত
শৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা…
যত্নে স্বচ্ছ হলো আজ, তবু পথ-ক্ষত
যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতা
আমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশে
আর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুল
অতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূল
অন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।
মহাদশমী অথবা মহালয়া
[আবহমান থেকে নেয়া]
মহাদশমী। বামপন্থীদের পুজোপ্যাণ্ডেলে যেতেন মাসীমা, কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা কঁল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ শাড়িজামা, অলংকারও বিশেষ পরতেন না,কখনও চা খেতেন একটু, কখনও একটা সিঙাড়া, কথা বলতেন, স্টলের বইপত্র উল্টোতেন; সমস্ত অবয়ব থেকে সোনাঝুরি ঝরে পড়ত, অবশ্য তাহা তো প্রসন্ন রোদ্দুরের জন্য, যে রোদ্দুর আজ উঠেছিল। আজই একটি বামপন্থী পত্রিকা ‘নতুন পথ এই সময়’ – এর কপি পেলাম। তখন আঙুলে প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে খেতে বসেছি। হ্যাঁ, মানুষের জলধিবদল হয়, আমারও হয়েছে। আমি এখন বামপন্থীদের পাঠক, সমর্থক, পারলে লেখক হতে চাই। পাঠক অবশ্য বরাবরই ছিলাম। মনে হচ্ছে, ওখানেই আমার মুক্তি আছে।
আত্মকথন
চলিত ক্রিয়াপদের বাংলা আর লিখিতে ইচ্ছা হয় না। এই বাংলা বড়ো সাহিত্যিক। যদিও আমার বয়স ত্রিশ বৎসর ও ২মাস পূর্ণ হইয়াছে এবং এক্ষণে আমি রবিবারের মধ্যাহ্নে, ত্রিতলে, খাটে বসিয়া আছি, চারিদিক বেশ শান্ত, একটি কাক ডাকিতেছে—কেমন ধারণা হইতেছে যে ইহার মধ্যেই মিশিয়া আছে আমারই মরণোন্মুখতা। কোনো-না কোনো একটি সত্য বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আমার ব্যক্তিগত সত্য। জীবন এপর্যন্ত যতোটা যাপিত হইয়াছে, তাহার তথ্য ও চিত্রের ভিত্তিতে কিন্তু এই সত্য প্রস্তুত নয়। কেবলি মনে হইতেছে আঁটপুর বা ঐরকম কোনো একটা গ্রামের বাড়িতে বসিয়া থাকিতে পারিলে বিলক্ষণ শান্তি হইত। না, যে থাকিত সে কোনো ত্রিশবয়সী লোক নয়। তাহার বয়স কোনোমতেই সতেরোর বেশি হইবে না। সে ধুতি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিবে। এখন নির্জন দুপুর, কলাঝাড় পার হইয়া সে জামের বনে যাইতেছে। সেখানে কি একটি বালিকা থাকিবে না, যে তাহাকে আঁকাবাঁকা হরফে বহু সাধ্যসাধনায় একটি চিঠি দিয়াছে কিছুদিন আগে—‘কেমন আছ। আমার প্রণাম নিবে।’ তাহার মুখ ও হাবভাবের বর্ণনা, আমি, ওই সতেরো বছরের হাতকাটা গেঞ্জি ও ধুতি পরা যুবা, দিতে মনস্থ করিতেছি না; শুধু পাঠকের সঙ্গে কথা বলিতে ভাল লাগে তাই বলিব, তাহার নাম পূর্ণশশী। কতবার ভাবিয়াছি—ঐ তো সে এখনো ভাবিতেছে আজ হয়তো তাহার হাত তাহার বশ মানিবে না, আলিঙ্গন করিবে; আজ হয়তো তাহার মুখ চুম্বনে চুম্বনে পূর্ণশশীকে জানাইয়া দিবে সে ডাগর হইয়াছে, সে শহরে গিয়া জানিয়াছে; কিন্তু ঐ তাহাকে দেখা যায়, পূর্ণশশীর হাত হইতে জাম খাইতেছে যেভাবে পোষা ঘোড়ায় মানুষের নিকট হইতে দানা খায়, শুধু একটি করতল পূর্ণশশীর পদমূলে। জামবনে হাওয়া অতি ধীরে বহিতেছে। পাঠক, আপনাকে ভগবান জানিয়া বলিতেছি, আমি এ-ই।