ইরাবতীর স্মরণ: আমাদের দাদামনি । জিললুর রহমান
কবি অরুণ দাশগুপ্ত আজ ১০ জুলাই ২০২১ দুপুর দেড়টা নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এই যাওয়া তাঁর স্বভাব যাত্রা, অতিক্রান্ত সময়ের যাওয়া——তবু মন বলে, আরও কিছু দিন থেকে গেলে কী এমন সমস্যা হতো? আমি কিছুদিন আগে কথাশিল্পী রবিন ঘোষ দাদার কাছ থেকে জেনেছি অরুণ দা মানে আমাদের সকলের প্রিয় দা’ মনি বা দাদামনি বেশ কিছুদিন হলো ধলঘাটে পিতৃপুরুষের ভিটায় নিঃসঙ্গ সময় যাপন করছেন। বল যায় তিনি শেষ সময়ের প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর এই একা গ্রামজীবনে শেষ সময় পার করার সংবাদে আমি চমকে উঠেছিলাম। নিজেকেও বেশ কিছুটা অপরাধী ভেবেছি, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর বহুবার আহবানে সাড়া দিয়ে অন্তত একবার তাঁর বাসায় যাওয়া হয়নি। নিজে জড়িয়ে থেকেছি আপন জীবনযুদ্ধে। অথচ যখন যে স্থানেই আমাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন, আমি প্রণতি জানাবার আগেই তাঁর স্নেহার্দ্র আহ্বান এবং আমার যাবতীয় খবর নিজেই আগ বাড়িতে জেনে নিয়েছেন। অথচ তাঁর শেষদিকের এই ধলঘাটবাসের সংবাদ পেয়েছি মাত্র ক’সপ্তাহ আগে। এই মহান বটবৃক্ষতুল্য মহীরূহটিকে নিয়ে আজ সারা দেশ জুড়ে অনেকেই অনেক সারগর্ভ লেখা লিখবেন, জানি। আমি তেমন কিছু লিখতে অপারগ। আমি শুধু বারবার নিজেকেই মনে করিয়ে দিতে চাই——এই কবি অরুণ দাশগুপ্ত হলেন সেই একমাত্র সম্পাদক যাঁর সরাসরি প্রশ্রয় ও আশ্রয় না হলে হয়তো আমি লেখার জগত থেকে পেশার জগতে হারিয়ে যেতাম। আমাকে লেখক হওয়ার এবং কবি হওয়ার পথ করে দিয়েছেন দাদামনি নামে সর্বজনে পরিচিত সকল সৃজনশীল মানুষের আশ্রয়ের ঠিকানা এই অরুণ দাশগুপ্ত।
অরুণ দা’কে চিনতাম না আমি। এখনও কি চিনি? তবে পরিচয় ঘটেছিল, এবং তার অসীম গভীরতা এখনও টের পাই। ১৯৮৮ সালে সবে কবিতার ভাঁজপত্র প্রকাশ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে অনেক লেখক কবি শিল্পীর সাথে আলাপ পরিচয় হতে থাকে। একসময় কলেজ জীবনের বন্ধু তখন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ব্যাতিক্রম সম্পাদক সুদীপ্ত দেবের আহ্বানে বোস ব্রাদার্সের শুক্রবারের সান্ধ্য আড্ডায় গেঁড়ে বসি। সখ্য হয় কবি হোসাইন কবির সহ অনেকের সাথে। হোসাইন কবির তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনের ছাত্র; বাসা দেওয়ান বাজার সিএন্ডবি কলোনীতে। আমাদের পাশের গলিতে বাসা হওয়ায় সময়ে অসময়ে আড্ডায় মেতে উঠতাম। কবিতা লিখছি, আলোচনা সমালোচনায় মেতে থাকতে থাকতে একসময় আজাদীর ঠিকানায় কবিতা পাঠাই। কবিতা ছাপাও হয়ে গেল। ১৯৮৩তে দৈনিক পূর্বদেশের পরে এই প্রথম কোনো দৈনিকে কবিতা ছাপা হলো। তখনও লিটল ম্যাগাজিন বুঝি না, তাই কবিতা প্রকাশের আনন্দে উদ্বেল হতেও দেরি হয়নি। তখনও জানি না, আজাদীর সাহিত্য সম্পাদকের নাম।
সম্ভবত কবি হোসাইন কবিরের সাথেই প্রথম শহরের রাস্তাগুলোয় হাঁটতে হাঁটতে পিপাসার্ত হয়ে পড়ি, এবং তাঁর সাথে ঢুকে পড়ি বৌদ্ধমন্দিরের মোড়ে এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের পাশে একটি পুরনো বনেদী ঘরের ভেতরে। সামনের ঘরে চেয়ার সোফা তো আছেই, কিন্তু আমরা আরো একটু এগিয়ে পরের ঘরটিতে প্রশস্ত বিছানায় শায়িত বর্ষীয়ান ব্যক্তিটির কাছে পৌঁছে যাই। তিনি বৈঠকখানায় বসার ইঙ্গিত দিলে চেয়ার দখলে প্রবৃত্ত হই। কিছুক্ষণ পরে রাবীন্দ্রিক ভঙ্গিমায় দাদামনি বৈঠকঘরে এসে এমনভাবে কুশল জিজ্ঞেস করলেন যেন আমি তাঁর শত জন্মের পরিচিত। পরবর্তীতে কবির ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি আমার লেখা পড়েছেন বলে জানান, এবং আমার সম্ভাবনা ভাল বলেও অভিমত প্রকাশ করেন। এক মধ্যে আরও কয়েকজন সাহিত্য সংস্কৃতিকর্মী এসে গেলেন, আড্ডা জমে উঠল। বাড়ির পাশে মোড়ে রয়েছে রেঁস্তোরা বা চা-দোকান। চা আসতে লাগলো, সাথে জিলিপি আর নিমকি। কতো কথাই না উড়ে উড়ে আড্ডায় এসে বসতে লেগেছে। মনটা এই আড্ডায় মজে গেল। অরুণ দা বলে খুব কম লোকই ডাকে। প্রায় সকলেরই এক সম্বোধন——দাদামনি। আমিও এই ডাকে সাবলীল হয়ে গেলাম। তারপর থেকে সময় অসময় ভাবিনি, দাদামনি বিশ্রামে নাকি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত —— এসব দেখার বোধ বা ফুরসত কিছুই ঘটেনি। খোলা দিন কিংবা ছুটির দিনে দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় কবিতা রচিত হলেই ছুটে গিয়েছি দাদামনি সকাশে। তাঁর যে প্রশ্রয় আমি পেয়েছি তা অনুজতুল্য না সন্তানতুল্য তা অনুমান করা দুরূহ। ১৯৮৯ সাল থেকে ৯১/৯২ পর্যন্ত সময়টায় প্রায়শ একসপ্তাহ অন্তর অন্তর আজাদীতে আমার কবিতা ছাপা হতো। এর মধ্যে দৈনিক পূর্বকোণেও কবিতা ছাপা হওয়ার সুবাদে এমনও দিন ছিল যেদিন একই দিনে চট্টগ্রাম শহরের সবেধন দুটিমাত্র কাগজেই আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমার অগ্রজ শুভানুধ্যায়ী কারও কারও কাছে দাদামনি আমার প্রশংসা করেছেন বলে জেনেছিলাম।
দাদামনির সাথে আড্ডা দেবার লোভে অনেকসময় আজাদী অফিসেই হামলা করেছি। সেখানেও চা সিঙাড়া সহযোগে আড্ডা জমে উঠেছিল অনেক অনেক দিন। সুখেন্দু দা’র সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দাদামনি। পরে সুখেন্দু দা আমাকে এত ভালবাসতেন যে আমাকে কয়েকদিন না দেখলে আমার বাসায় চলে আসতেন। সুখেন্দু দার পক্ককেশ শ্মশ্রুগুম্ফ—— আমার পিতৃদেব কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়তেন তার পুত্রের বয়স্ক বন্ধুকে দেখে। কিন্তু আমাদের আড্ডায় সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতির নানা বিষয় এমন খরস্রোতা ঝরনার বেগে এগিয়ে আসতো যে সময়ের দিকে নজরই থাকতো না। দাদামনি ও সুখেন্দু দা উভয়কেই দেখতাম প্রচুর পান খেতেন। পান চিবাতে চিবাতে মুখ রসে টইটুম্বুর হয়ে যেত। সেই পানের পিক ফেলার পরও অনেক সময় মুখের আশেপাশে লেগে থাকতো। পানের পিক মোছার জন্যে রুমাল থাকতো পাঞ্জাবীর পকেটে। তবে সেই পকেট ভরা থাকতো আমাদের মতো তরুণ কবিতাকর্মী ও কবি যশোপ্রার্থীদের অনেক দরদ ভরা হস্তাক্ষরে লেখা কবিতায়। আর থাকতো কাগজে মোড়ানো খিলি পান। মুখ মোছার জন্যে সবসময় হাতে রুমাল উঠে আসতো না দাদামনি। মাঝে মাঝে রুমাল বাসায় রেখে এলে পকেটের কোনো একটা কাগজ হয়তো চলে যেতো খরচের খাতায়। মাঝে মাঝে ভাবতাম, হায়, কার কবিতা চলে গেল পানের পিকের সাথে পথে প্রান্তরে অথবা নর্দমায়। তবে, কেন যেন মনে হতো, এসব কাজে তিনি সেই কাগজগুলোই বেছে নিতেন, যেসব মনোনীত হবে না বা হয়নি। আমার লেখা যেমন কোনোদিন বাদ পড়েনি, আমার পরিচিত কবিদের লেখাও বাদ পড়েছে বলে শুনিনি।
এদিকে একসময় কবি আবুল হাসান আমার মাথার ভেতরে এমন জেঁকে বসলো যে, আমি তার ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। এমন সময় বোস ব্রাদার্সের আড্ডা থেকে স্বনন প্রকাশিত হবে, কিন্তু কবিতা গল্প পেলেও প্রবন্ধ মেলেনি। অগত্যা আমি লিখে ফেললাম একটি ছোটগদ্য। স্বনন বেরিয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু আমার মন বলছিলো, আবুল হাসান নিয়ে লেখাটা অসম্পূর্ণতায় ডুবে আছে। তাই আমি আবার লিখতে বসি আবুল হাসান নিয়ে। আবুল হাসান আবেগ সঞ্চারী কবি। আমাদের বয়সটাও আবেগাপ্লুত হবার। যদিও বোসের আড্ডা এবং অচিরা পাঠচক্রে বারবার শিক্ষিত হচ্ছিলাম, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করায়। কবিতা থেকে মেদ ঝরিয়ে ফেলার মুনসিয়ানা অর্জনে প্রাণান্ত চেষ্টা চলমান। অথচ এমন এক সময়ে আমি কিনা আবেগে টলমল এক বিশাল গদ্য লিখে ফেলি কবি আবুল হাসানের তিন তিনটি কবিতার বই নিয়ে। গদ্যটি লিখেই দৌড়ে ছুটে গিয়েছিলাম বৌদ্ধমন্দির মোড়ে দাদামনির ঘরে। দাদামনি বললেন “রেখে যাও, পড়ে জানাবো। আমি ফিরে গিয়ে আর দাদামনির বাড়ির দিকে যাবার সাহস পাই না, যদি মন্দ বলেন! তাই বেশ ক’দিন আর ও মুখো হইনি। এদিকে আমি তো বটেই চাটগাঁর বিদ্ব্যৎসমাজকে বিস্মিত করে এক সপ্তাহ পরে আজাদীর সাহিত্য পাতার অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হলো আমার গদ্যের প্রথমাংশ। নীচে আবার লেখা রয়েছে ‘চলবে’। প্রথম সপ্তায় অগ্রজদের কেউ কেউ আমার পিঠ চাপড়ে দিলেও পরে দাদামনির সকন্ঠেই শুনেছি ২য় ও ৩য় কিস্তি ছাপানো অনেকেই হজম করতে পারেননি। তাঁরা দাদামনিকে অভিযোগ করেছিলেন একটা ছোকরার লেখা এভাবে ধারাবাহিক ছাপানোর কোনো যৌক্তিকত নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ এ বয়সে এসে টের পাই সে সকল দুর্মুখ সত্যি কথাই বলেছিলেন। তবে, দাদামনি করেছিলেন উদ্বুদ্ধ। তাঁর এই অনুপ্রেরণা পরবর্তীতে আমাকে গদ্য লেখায় সাহসী ও আগ্রহী করে তোলে। এমন উৎসাহ তিনি শত শত তরুণকে দিয়েছেন, আমাকে একা নয়। আর সকলেই মনে করে তাকে দাদামনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। আমি এই সজ্জন ব্যক্তিটির এই নিপাট ভদ্রতা এবং শিষ্টাচারে কখনোই ঊনতা দেখিনি, কেবল একবার ব্যতীত। একদিন আমি সকালে দাদামনির ডেরায় বসে আছি, চা আসার অপেক্ষায়। এরই মধ্যে আমার একটি কবিতাও দাদামনির পকেটে সঞ্চালিত হয়েছে। এমন সময় আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় একজন কবি যশোপ্রার্থী সেখানে এলেন। সৌজন্য দাদামনির যথা নিয়মেই ছিল। তাঁকেও বসতে বললেন চা পানের আহ্বান জানিয়ে। কিন্তু তিনি বসতে অপারগতা জানিয়ে বলেছিলেন তাঁর ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে। তাঁকে ব্যবসার কাজে যেতে হবে। কেন জানি না, অকস্মাৎ দাদামনি তাঁকে বললেন, সেই ভাল, ব্যবসাই করো, কবিতা টবিতা লেখে কিছু হবে টবে না। তুমি বরং মন দিয়ে ব্যবসাটাই করো। তখন সেই অগ্রজ খোঁচাটা টের পেয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওর ক্ষেত্রে তবে কি বলবেন? দাদামনি খুব সাবলীলভাব বললেন, ওকেও বলবো, ডাক্তারিটা মন দিয়ে করতে। আমিও কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে যাই। কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে অগ্রজ কবি যশোপ্রার্থী বেরিয়ে গেলেন। এর মধ্যে চা এসে গেল। দাদামনি চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, সবাইকে দিয়ে তো আর কবিতা হয় না। আমিও মিনমিন করে বললাম, আমারও হবে না বলছেন? তখন দাদামনি তাঁর সেই বিখ্যাত প্রশান্ত হাসির ঔজ্জ্বল্য বিকিরণ করে বলেন, তোমার সম্পর্কে ওকে বলতে হলো, হঠাৎ তোমাকে ইঙ্গিত করায়। তুমি তো ভালই লিখছো, লেগে থাকো। এমনভাবে তিনি আড্ডা দিতেন যেন আমার সমান বয়সী, কিন্তু ধীরে বিকিরণ করে যেতেন তাঁর আজীবন অধীত বিস্তীর্ণ জ্ঞানের ভাণ্ডার। বুধবার দাদামনির বাসায় বিশেষ দিন। বলা হতো বুধ সন্ধ্যার আড্ডা। সন্ধ্যা হতে হতেই দাদামনির বৈঠকখানা আলোকিত করে ঘরে প্রবেশ করতেন আরেক জ্ঞানতাপস ড. অনুপম সেন। তারপর একে একে নানা কোণ থেকে নানা চিন্তার আধার বিভিন্ন সাহিত্যিক কবি ও সংস্কৃতিকর্মীতে ঘর গমগম করতো। চা জিলিপি নিমকি পান পাশের দোকান থেকে আসতেই থাকতো। কতো জ্ঞানগভীর আলাপে ঢুকে পড়তেন দাদামনি ও ড. অনুপম সেন। অন্যরাও সে আলাপে সুযোগ বুঝে নিজের অধীত জ্ঞান জুড়ে দিতো; আড্ডা তো আর একতরফা চলে না। তবে বুধসন্ধ্যার আড্ডায় আমি প্রায় পুরোটা সময়ই চুপচাপ নীরব শ্রোতা থাকতাম। তবে খাবারে ভাগ বসাতাম ঠিকই। কবি আহমেদ খালেদ কায়সার আসতেন মাঝে মধ্যে। মাঝে মাঝে আসতেন কবি ময়ুখ চৌধুরী। উনি এলে অবশ্য আর কেউ তেমন বকতে পারতেন না। তিনিই হয়ে যেতেন মূখ্য বক্তা। আমি দাদামনির সাথে কথা বলতাম অন্যদিনে কিংবা অন্য সময়ে, এমনকি আজাদীর আড্ডায়। দাদামনি বিভিন্নরকম উপদেশ পরামর্শ দিতেন, সব মান্য করার মতো বয়স বা ধৈর্য্য হয়তো আমার তেমনটা ছিল না। তাঁকে কাজী আবদুল ওদুদের কথা অনেকবার বলতে শুনেছি। ওনার মতো মনীষীদের সান্নিধ্য পাওয়া লোক——ভাবতেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেতো। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কথা বলতে শুনেছি বেশ কয়েকবার। শিক্ষাজীবনের এবং যৌবনের সূচনাকাল কোলকাতা শহরে কাটানো সে যুগে পরম সৌভাগ্য, যা কবি অরুণ দাশগুপ্তের ছিল। তবে, যার রক্তে বহমান ছিল প্রীতিলতার উত্তরাধিকার, ধলঘাটের সেই জমিদার নন্দন দেশের টানে মাটির প্রেমে ফিরে এলেন চট্টগ্রামে, যুক্ত হলেন শিক্ষকতার পেশায়। পরবর্তীতে আজীবন দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক হয়ে কেবল কবিতা বা লেখা ছাপানোর কাজ করেননি, বরং চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে ওঠা সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মীদের শিক্ষিত মার্জিত রুচিবান এবং সত্যিকার সংস্কৃতিমুখী করে গড়ে তোলার দায়িত্বটি তুলে নিয়েছিলেন নিজ কাঁধে। নিজের সৃষ্টিশীলতার কথা ভুলে গিয়ে তরুণদের মানসগঠনে অনেক বেশি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।
১৯৯৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে ঢাকা যাত্রার পর থেকে দাদামনির বাসার আড্ডার অভাব হৃদয়ের গহীন গভীরে নিয়ত অনুভব করেছি। ফিরে এসে সংসারপর্ব ও পেশায় থিতু হবার সংগ্রামে ধীরে ধীরে কমতে কমতে একসময় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল সে আড্ডায়। পরে একদিন কে একজন জানালো দাদামনি আমার খবর জানতে চেয়েছেন। সে খবর পেয়ে বৌদ্ধমন্দির মোড়ে ছুটে যাই। দেখি, সে ঘর সে বাড়ি ভেঙে বহুতল ভবনের রূপ নিচ্ছে। অনেক খোঁজ করে ছুটে গিয়েছিলাম রহমতগঞ্জের যোগেশ ভবনে। সেখানেও তাঁর দেখা মেলেনি। পরে অবশ্য বেশ ঘন ঘন কয়েকবার দেখা ও আলাপ হয়েছিল। কিন্তু প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে বেশ জমিয়ে আড্ডাবাজি আমার কপালে আর ছিল না। সর্বশেষ দেখা মিলেছিল একুশে বইমেলার মঞ্চে। আমার কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত স্বরে বাহ্ বাহ্ করে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন এবং পাশে বসে থাকা কবি আসাদ চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন পরম মমতায়। তাঁর ভালবাসার এই ঋণ আজীবন বুকে আগলে রাখা ছাড়া আজ আর কোন গত্যন্তর নেই।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)