| 20 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি: প্রভাত চৌধুরী’র একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
‘উত্তরাধুনিক’ বা ‘পোস্টমডার্ন’ (Post Modern) – বিশ্ব সাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ বহুল আলোচিত একটি শব্দবন্ধ। তবে উত্তরাধুনিক সাহিত্য মানে যে শুধুই বিদেশী সাহিত্যের ছায়া অবলম্বন করে চলা নয়, বরং তার একটি নিজস্ব আঞ্চলিক চেহারাও থাকতে পারে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো সাহিত্যিক খুব বেশি জন্মাননি। আর সেইসব সাহিত্যিকদের সামনেই একটা নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলেন কবি প্রভাত চৌধুরী (Prabhat Chowdhury), তাঁর ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার ভিতর দিয়ে। সাহিত্যিকের চেয়েও তাই তাঁর বড়ো পরিচয় একজন সাহিত্য কাণ্ডারি হিসাবে।
 
বাংলা সাহিত্যের জগতকে রিক্ত করে আজ আবারও এক নক্ষত্রের পতন হল। দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেলেন কবি প্রভাত চৌধুরী। গতবছরের মাঝামাঝি থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কিডনি বিকল হয়ে পড়েছিল তাঁর। সপ্তাহে তিনদিন করে চলত ডায়ালিসিস। এর মধ্যেই গত ৯ জানুয়ারি করোনা ভাইরাস বাসা বাঁধে শরীরে। সেই থেকেই চিকিৎসা চলছিল। মাঝে স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় চিকিৎসকদের। ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কবি।
 
১৯৪৪ সালে বাঁকুড়া জেলার হাটকেষ্টনগরে জন্ম প্রভাত চৌধুরীর। ’৬০-এর দশকে কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ভিতর দিয়ে সাহিত্যের জগতে পা রাখেন তিনি। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শুধু প্রেমিকার জন্য’। এই সময়েই বেশ কিছু পত্রিকা সম্পাদনা এবং নতুন নতুন পত্রিকা উদ্যোগও শুরু করেন তিনি। প্রায় ২ দশক নিরলস চর্চার পর হঠাৎই আশির দশকে লেখালিখি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মনে মনে হয়তো তখন থেকেই খুঁজছিলেন একটি নতুন মঞ্চ। প্রায় ১০ বছর সাহিত্যের জগত থেকে দূরে সরে থাকার পর ১৯৯৩ সালে আবার শুরু করলেন নতুন পত্রিকা উদ্যোগ। নাম রাখলেন ‘কবিতা পাক্ষিক’।
পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ। ১৯৯৪ সালে ‘সাদা খাতা’, ১৯৯৭ সালে ‘সাক্ষাৎকার’, ১৯৯৮-এ ‘আবার সাক্ষাৎকার’। এরপর একে একে প্রকাশ পায় ‘নোটবই’, ‘উত্তরপর্বের কবিতা’, ‘এইসব হল্লাগুল্লা’, ‘সুসমাচার’ এবং ‘প্রভৃতি’।
প্রভাত চৌধুরী বলেছিলেন, কবিতা পাক্ষিকের ভিতর দিয়ে তিনি বাংলা কবিতার সামগ্রিক যাত্রার একটা ছবিই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশ তার প্রাণ হয়ে উঠল উত্তরাধুনিক কবিতা। আর তা হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নয়। তবে কবিতা তো শুধুই আঙ্গিকনির্ভর শিল্প নয়। সাহিত্যের ভাষ্যও যে গুরুত্বপূর্ণ, তা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি কবি। তিনি স্পষ্টভাবেই বারবার বলেছেন, কবিতা তাঁর নিজের মত প্রকাশের জায়গা। আর তাঁর বক্তব্যই কবিতার আঙ্গিকও তৈরি করে দেয়। অকপটে স্বীকার করেছেন, বিদেশি উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের লেখা তিনি পড়েননি। পড়ার আকর্ষণও বোধ করেননি। বরং বাংলা সাহিত্যের মধ্যে উত্তরাধুনিক প্রবণতাকেই চিনতে চেয়েছেন বারবার।

বয়স হয়েছিলই। শরীরে বাসা বেঁধেছিল নানা রোগ। আর তার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। অবশ্য চিকিৎসার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন বহু অনুজ সাহিত্যিক। কিন্তু সেই সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। বাংলার সংস্কৃতি জগতের ঝরে যাওয়া মহীরুহদের নামের তালিকায় যুক্ত হল আরেকটি নাম।


 
সপ্তদশ সিরিজ
□ প্রথম
প্রথম থেকে নির্বাচন করলাম ‘ প্র ‘ , প্র আমাকে
পৌঁছে দিয়েছিল একটি প্রবচনে
সেই প্রবচনটি একটি পাঁচ রাস্তার জংশন
এখান থেকে একটি ট্রেন থার্ড ব্রাকেটের দিকে যাচ্ছে
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি ফার্স্ট ব্রাকেটে
□ দ্বিতীয়
আমি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দ্বিতীয় কবিতাটিতে 
কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বকে ঢুকতে দেব না
একটা পার্শ্বিক ধ্বনি ঘোরাফেরা করবে
আমাদের অজানা নয় , আমরা পছন্দ করি
ধনধান্য থেকে পুষ্পভরা এক ভূখণ্ডকে
□ তৃতীয়
তৃতীয়-র সঙ্গে চাঁদের কোনো নিবিড় সম্পর্ক আছে
কিনা জানি না , তবে তৃতীয়ার সঙ্গে আছে
পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার পরের তৃতীয় দিন
তৃতীয়া একটি স্ত্রীবাচক শব্দ, পুংবাচক শব্দটি
দ্বিতীয় এবং চতুর্থ-র মধ্যবর্তীতে বসবাস করে
□ চতুর্থ
চতুর্থজনের পকেটে কোনোদিন তুলোটকাগজে লেখা
পুঁথি-র কোনো অংশ চোখে পড়েনি
কাজেই চতুর্থজন নিয়ামক হতে পারবেন না
এটা ভেবে বসবেন না , দেখবেন এই চতুর্থজন
সন্তরণ প্রতিযোগিতার পদকজয়ী
□ পঞ্চম
পাঁচ একটি শুভ সংখ্যা, এই সংখ্যাটি থেকেই
গঠিত হয় পঞ্চায়েত, এখানে এসেই থেমে যেতে হচ্ছে
কারণ জানানোর অধিকার আমার নেই
আগেই আমি আমার পঞ্চেন্দ্রিয় বা পাঁচটি
ইন্দ্রিয়-কে বন্ধক দিয়েছিলাম ভোটবাক্সে
□ ষষ্ঠ
তখন পালকিবাহকের সংখ্যা ছিল ছয়
পালকি বিলুপ্ত-যান রূপে স্বীকৃত হবার পর
এই ‘ ষষ্ঠ ‘ সংখ্যাটিল বড়ো বিপদ, এমন কী
শহরাঞ্চল থেকে ষষ্ঠীতলাগুলোও উঠে গেল
জন্মনিয়ন্ত্রণের ঠেলায় মা ষষ্ঠীর কৃপাও  তলানিতে
□ সপ্তম
সপ্তম থেকে সপ্তমীতে যেতে সমর্থ হলেই
সপ্তমী-র অনেকগুলি অপসন: ব্যাকরণপথে গেলে
একটি বিভক্তির দ্যাখা পাব , যেখানে ‘ বাঘ আছে আমবনে ‘ , আর 
পুরাণপথে পাবেন সপ্তর্ষি-কে
আর আকাশপথে বিরাজ করেন সপ্তর্ষিমণ্ডল
□ অষ্টম
অষ্টমগর্ভের সন্তানদের সম্পর্কে বলতে শুরু করলে
অন্য বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করা হবে , 
বলা হবে না অষ্টাবক্র মুণিবরের কথা, অষ্টধাতুর গুণাবলির কথা আর 
অষ্টাদশী যে কিশোরীর সঙ্গে আমার অবসরযাপন,গর্জনতেল সহ 
তারা গর্জন করতে শুরু করবে
□ নবম
নবম-এর একদিকে বিক্রমাদিত্যর নবরত্নসভা
অন্যদিকে বটুকদার নবজীবনের গান , তাহলে তো 
মাছরাঙাপাখিদের কোনো কথা-ই জানানো যাবে না বিল্বদণ্ড বা সারস্বত কথাও, 
আসুন 
দরগা রোডের ৯ নম্বর বাড়ির কলিংবেলটি বাজানো যাক
□ দশম
দশচক্রে যখন ভগবান ভূত হয়ে যান , তখন
কবিরাজ-প্রদত্ত দশমূলের পাঁচন ব্যবহার করা যেতে পারে , এ বিষয়ে 
রূপকথার ডালিমকুমার কী নির্দেশ দিয়েছিলেন, জানা নেই ,
জানা আছে ত্রৈলোক্যনাথের
১০টি ভূতের কথা , ভূতের গল্পকথাও
□ একাদশ
একান্নবর্তী পরিবারের সন্ধান করার আগে একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সন্ধান করুন , 
মনে রাখবেন আপনি এন্ট্রান্স পাশ দিয়ে এখানে এসেছেন, আপনার নাক
‘ জবাকুসুম ‘-এর গন্ধ চিনে গেছে 
আলাদা করে প্লেয়ার লিস্টে প্রথম একাদশে আছেন কিনা 
দেখে নিন
□ দ্বাদশ
আমি কোনোদিন দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হইনি , হয় প্রথম একাদশে, 
নচেৎ টিমের বাইরে
অতএব দ্বাদশ ব্যক্তির ভূমিকা আমার অজানা
যেমন অজানা খোদার খাসি কিংবা ধর্মসভার অ্যাজেন্ডা , 
মৃদঙ্গ যে বাদ্যযন্ত্র এটা জেনেই বাদ্যযন্ত্র লিখেছি
□ ত্রয়োদশ
‘ থার্টিন ‘ এই বিশেষ্যটির পূর্বপদে ‘ আনলাকি ‘ বিশেষণটি কীভাবে জুড়ে গিয়েছিল 
সেগল্প আমার জানা নেই , ইংরেজরা আসার আগে 
ত্রয়োদশ একটি ধ্যানগম্ভীর শব্দ ছিল,
তার খুব কাছেই ত্রিলোক
ভাবছি বেশ কয়েকটি ত্রিপদী রচনা করব
□ চতুর্দশ
শিব-চতুর্দশীকে কেউ কেউ ভূত-চতুর্দশী বলে থাকেন
আমি কিন্তু সত্য শিব এবং সুন্দরকে একাসনে বসাই
আর চতুর্দোলায় যিনি কেদারনাথ দর্শন  করে এলেন
সেই পূণ্যের কতভাগ তিনি পাবেন তা গণিতের বিষয়
১৪ বছর বনবাসের গল্প সকলেই জানেন
□ পঞ্চদশ
পঞ্চ + দশ = পঞ্চদশ , আর এই পঞ্চদশের
পাশাপাশি যাঁরা বসবাস করেন ,এঁদের মধ্যে যেমন বিষ্ণুশর্মা-র ‘ পঞ্চতন্ত্র ‘ আছেন , 
তেমনি পঞ্চবটীরও সন্ধান পাবেন , আর 
রোগ নিরাময়ের জন্য যাঁরা পঞ্চকর্ম করান 
তাঁদের সঙ্গে আমার দূরত্ব অনেকটাই
□ ষষ্ঠদশ
আমরা ষষ্ঠদশ বা ষোলো সংখ্যাটিকে অনেকভাবে
যোগ করতে পারি, ৮ + ৮ = ১৬ 
আবার ১০ + ৬ = ১৬ 
যোগফল দিয়ে কিছুই প্রমাণিত নয় , বিয়োগফল দিয়েও , 
একমাত্র ষোলো আনা সম্পত্তি বাটোয়ারার
□ সপ্তদশ 
সপ্তদশ শব্দটি চোখে এলেই দেখতে পাই
সপ্তদশ অশ্বারোহী ,বলে রাখি, 
আমার কোনো ব্যক্তিগত অশ্বশালা নেই , অশ্বারোহণেও আমি দক্ষ নই , তবু 
অশ্বারোহীদের দেখত পাই, 
অশ্বনীকুমারদ্বয়ের কথা পরবর্তী এপিসোডে
 
 
 
 
বালিশ
 
বালিশ দু-রকমের, একটা মাথার, অন্যটি কোলের
কোলেরটিকে কেউ কেউ পাশের বলে থাকে
 
তবে দু-ধরণের বালিশ-ই কিন্তু শিমুলতুলো নির্মিত
 
মাথার বালিশের চারটি কোণ আছে
কোণ চারটি ৯০ডিগ্রি অর্থাৎ একসমকোণ
এর থেকে একটি কথা-ই প্রমাণিত হয় :
প্রতিটি সমকোণ-ই ব্যবহার করে একই স্টাইলের টুপি
স্টাইল এক হলেও কিন্তু রং আলাদা আলাদা
সেসব রং-কথা এখন থাক
 
এখন অপেক্ষা করি ছাতার জন্য
বালিশও অপেক্ষা করুক ছাতার জন্য
 
সামনে বর্ষাকাল
 
 
 
 
 
 
 
 
 
চাদর
 
বিছানার জন্য বেড-শিট এবং বেড-কভার
দু-প্রকার চাদরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে
 
এদের মধ্যে বেড-কভার কিছুটা মোটা এবং বড়ও
আর নরম, কিছুটা মাখনের মতো বেড-শিট
 
এর জন্য় দু-জনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই
দুজনেরই নিজ্স্ব আইডি আছে
আই প্যাড আছে
 
আছে ময়ুরপালক
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
তিনটি কবিতা
 
 
 
১.
তালা-লাগানো এবং তালা-খোলার মধ্যবর্তী সময়ে
যে পাখিটি বসে থাকবে হেমন্তের মগডালে
তার পালকে কোনো মধ্যপদলোপী বহুব্রীহির
দ্যাখা পাওয়া যাবে না
এইসব মন-জোগানো কথা বলে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, দীর্ঘপথ হাঁটার জন্য সংগ্রহ করতে হবে
মনে দাগ কাটার মতো একটি ক্রিয়াবিশেষণ
এই ধরনের চিত্রনাট্য গ্রহণ করার মতো
প্রযোজক পাওয়া যাবে না জেনেও লিখে চলেছি
‘অবাক জলপান’
দ্যাখা যাক যে পাখিটি বসে থাকার কথা হেমন্তের মগডালে, সে জলপাইগাছের দিকে উড়ে গেল কিনা
 
২.
তালা-লাগানো এবং তালা-খোলার মধ্যবর্তী সময়ে
যে ঝাঁকুনি এসে উপস্থিত হবে, সেই ঝাঁকুনির
আদিতে কোনো ঝাঁকা বসে আছে কিনা
তা আবিষ্কারের জন্য গ্যালিলিও কিংবা নিউটনের
কোনো সহায়তা আবশ্যক হবে না নিশ্চয়ই
এই ঘোষণার সঙ্গে ল্যুইস ক্যারলের
কোনো যোগসূত্র নেই, বিয়োগফলও নেই
আছে ণ-ত্ব ষ-তত্ব বিধানের কয়েকটি ব্যবহারবিধি
আর আছে ‘অপরাহ্ণ’ থেকে ‘সায়াহ্ন’-এ যাবার
একটি সিক্স লেনের নিষ্কর হাইওয়ে 
 
৩.
তালা-লাগানো এবং তালা-খোলার মধ্যবর্তী সময়ে
যে শুদ্ধাচারগুলি খাঁচার বাইরে অপেক্ষা করছে
তাদের খাঁচার ভেতরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হোক
ওখান কিছুদিনের জন্য পুষ্প-প্রদর্শনী বন্ধ থাকুক
পুরাতত্ত্ব মিলিয়ে দেখে নিলেই দিগ্ ভ্রান্তি থেকে
নিজেকে আড়াল করা যাবে
এর জন্য নির্বাচন করতে হবে দরদালান
ওই দরদালানে কিছু সময়ের জন্য
তন্ময় হয়ে বসে থাকাটা জরুরি
জেনে রাখতে হবে সব দৈববাণী-ই কিন্তু ছাপাখানার
ঠিকানা জানে না, ওদের চোখে স্থাপন করতে হবে
গুগুলম্যাপ আর হাতের তালুর মতো নিজেকে চেনার কি-বোর্ড
 
 
 
 
 
 
 
নয়াবাদ থেকে বলছি
 
নয়াবাদ থেকে এখন যেসব বাতাসরা আমাকে কিছু শোনাতে চাইছে তাদের সঙ্গে মিশে আছে নিকটবর্তী মেট্রোর শ্রুতিমধুর হুইশল। অথচ আমার চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কথাটা ঠিক নয়। দেখতে পাচ্ছে নিকটবর্তী বাড়িগুলোর ডিজিট্যাল আলো। গ্যারাজের দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি গাড়ি। একটা জানলা থেকে আলো-অন্ধকারে পেয়ারাপাতাদের জেগে থাকা।
 
এক সময় বন কেটে বসত হয়েছিল। এখন জলাভূমি বুজিয়ে বসত হচ্ছে। যেসব জমিতে আবাদ করার কথা ছিল, কথা ছিল সোনা ফলানোর, এখন সেখানে ঝাঁ-চকচকে বিলাস। এবং বিলাসময় ঘুম।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
শীতকাল=ব‌ইকাল
 
তোমাকে আমি যে লেখা বলি, তা তুমি 
এখানে কম্পোজ করো, না? যেগুলো না বলি, 
সেগুলিকে কীভাবে কম্পোজ করবে? 
কম্পোজ করার কথা কম্পোজিটরের। একজন কবি
যখন কম্পোজ করেন, তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে
শীতের রোদ্দুর এবং কমলালেবুর গন্ধ
যারা হাতে দস্তানা পরেন
তাঁদের জানা হয় না কমলালেবুর খোসার সঙ্গে 
শীতের রোদ্দুরের গভীর বন্ধুতার কথা
 
আমি শীতকালের জন্য অপেক্ষা করি
শীতের রোদ্দুরের জন্য অপেক্ষা করি
কমলালেবুর গন্ধের জন্য অপেক্ষা করি
 
আমাকে অপেক্ষা করতেই হয়
 
আমি কখনই ঈশ্বরের জন্য অপেক্ষা করিনি
আমি কোনোদিন কোনো বাজিকরের জন্য অপেক্ষা করিনি
আমি অপেক্ষা করেছি শীতকালের জন্য।
শীতকালকে আমি বইকাল নামে ডাকি
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
বাংলা কবিতার জন্য
 
যারা চোখের জল ফেলেন, কুমিরের চোখের জলের সঙ্গে
তার কোন মিল নেই, ‘চোখর জল’তবু কেন যে
লেখা হলেই উঠে আসে ‘কুম্ভিরাশ্রু’ তার সমাধান গুগুলও জানে না
 
আমি নিজেও কোনদিন বাংলা কবিতার জন্য অশ্রু বিসর্জন করিনি
শরীরের জল বা ঘাম ঝরিয়েছি কয়েক গ্যালন
তার জন্য বাংলা কবিতার কত মিলিমিটার আপডেট হয়েছে
তা জানার জন্য আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে
 
যাঁরা অপেক্ষা করতে রাজি হবেন না, তাঁরা পথপ্রদর্শকের
নির্দেশের জন্য সজাগ থাকুন
ডোর বেলটি ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সে সম্পর্কে অবহিত থাকুন
কাকে কান নিয়ে গেল শুনলে
কাকের পেছনে না ছুটে নিজের কানের পাশে হাত নিয়ে যান
এই লেখাটিতে প্রথমে কুমির, পরে কাক
একটি সরীসৃপ এবং একটি পাখি এসে গেল
 
পরের কবিতায় জলচর, লালতিমি আসার কি কোন সম্ভাবনা
দেখা যাচ্ছে
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
দুটি কবিতা
 
 
১.
 
 
আমি যে কান দিয়ে ‘আকাশভরা ‘ শুনি
ওই কান দিয়েই ‘ কাঞ্চনজঙ্ঘা ‘ দেখি
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখার জন্য আলাদা কোনো কান নেই
আর ঠিক এই কারণেই আমার দ্যাখার মধ্যে
প্রবেশ করে ফুল ফোটার শব্দ
আমি সেই গন্ধ অনুভব করি কান দিয়ে
আর নাক- কে পাঠিয়ে দিই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত
সেমিনারে
 
কাজেই আমার দ্যাখার সঙ্গে অন্য ৫ জনের
দ্যাখার একটা মৌলিক পার্থক্য থেকেই যায়
 
আর দ্যাখার পার্থক্য থাকলে লেখারও
 
 
 
 
 
 
 
 
২.
 
রাত্রির শেষ প্রহরে যেসব পাখি ডেকে ওঠে
তাদের ডাকের স্বরবর্ণগুলির রং হলুদ
এই ধরনের বহুকথা গাঁওবুড়োদের গপ্পে শোনা যায়
কান পাতলে
কান পাতার সঙ্গে মাদুর-পাতার যে সূক্ষ্ম মানঅভিমানগুলি আমাদের জাগিয়ে রাখে
তাতে কেবলমাত্র পাখিদের ডাক-ই শোনা যায়
দ্যাখা যায় না পাখির ঠোঁট কিংবা পালক
তবু পাখি ডাকে , পাখিদের ডাকতেই হয়
আর আমাদের কান জেগে থাকে বলে আমরা শুনি
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আমার কবিতা
 
আমি বর্ষবরণের কবিতা লিখতে চাইলে বর্ষাবরণের কবিতা
উঠে আসতে চায়, এখন চেষ্টা করত
হবে
বর্ষ এবং বর্ষার পালসরেট
একটা আ-কারের জন্য ব্যাঙেদের আচরণে কী কী রাসায়নিক
পরিবর্তন হয় কিংবা প্রস্ফুটিত ফুলের
রং এবং গন্ধের রকমফের হয়ে থাকে তার জন্য
কোন সূর্যোদয়ে যেতে হবে তাও জানা নেই
তবু বর্ষকে তো বরণ করতেই হবে
না হলে বঁধুয়া কীকরে ঘরে ঢুকবে
শাঁখ এবং বরণডালা নিয়ে যাঁরা অপেক্ষা করছেন
তাঁদের কথা না ভাবলে লোকে মন্দ বলবে যে
 
 
 
 
 
 

One thought on “বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি: প্রভাত চৌধুরী’র একগুচ্ছ কবিতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত