| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

কবি হিরন্ময়ী চৌধুরীর কথা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

এক

শেরপুর  পরগনার ষোল আনা জমিদারি ‘১১৭৬ বঙ্গাব্দের মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের পরই নয় আনি ও সাত আনি জমিদারী বরাবরের জন্য পৃথক হয়ে যায়।” ১ ভাগটি আগেই ছিল তবে আইন কিংবা  শরিকি বিবাদে নয় বরং পরিবারের একেক ভাইয়ের একেক মহল্লায় থাকার মতো করে একান্নবর্তী বৃহৎ সংসার।

গৃহ ও গৃহস্থালির কায়কারবার এবং জমিদারী ও খাজনা আদায় ইত্যকার শাসন কার্যক্রম  পরিচালিত হতো বাড়ির বড় ছেলের চিন্তা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে। জেষ্ঠ্য কর্তার কথাই শেষ কথা— অনুজ আজ্ঞাবহ কার্য সম্পাদনার নির্বাহী।এমনই বিধি ব্যবস্থা ছিল শেরপুর পরগানার সর্বশেষ মালিক রমানাথ চৌধুরীর নাতি জগজ্জীবন চৌধুরী মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেদের মাঝে শরিকি বন্টন প্রণালী ও জমিদারী ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত হবার প্রাথমিক পর্যায়ের দিনগুলো।

 কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত  সময়ের দাপটে একটি সামন্ত পরিবারের ব্যয়াধিক্যের কারণে বৃহৎ পরিবারের টানাপোড়েন পারস্পরিক রেশারেশি মানসিক ভাঙুনের সুরে একদিকে অার্থিক অনটন ও অন্যদিকে প্রশাসনিক নেতৃত্বের কর্তাগিরি  সংকট — চৌধুরী পরিবারের আর পিছু ছাড়েনি। মামলা মোকাদ্দমা যেমন ছিল তেমনি ছিল সন্তান সন্তুতি না হবার দারুণ উত্তরাধিকারের হাতে নিজস্ব জমিদারী ন্যস্ত করার জন্য দত্তক পুত্র নেবার জন্য লিখিত আদেশনানামা।কিংবা নাবালক পুত্রের ভরণ পোষণ নিয়ে একটি সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের নানা দ্বন্দ্ব ও দেনদরবার আবার কখনো দত্তকপুত্র নাবালক হওয়ার কারনে জমিদারী তখন পরিচালিত হতো  “কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের অধিনে।”২ ১৮২২ সালে রাজচন্দ্র চৌধুরীর দত্তকপুত্র কৃষ্ণকুমার নাবালাক ছিলেন বলে নয় আনী  জমিদারী চার বছর কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের অধিনে পরিচালিত হযেছিল।

 নয় আনীর নেতৃত্ব ঠিক থাকলেও শরিকি বিবাদ বাড়তে বাড়তে হিস্যা আরো বেড়ে সাত আনি ভেঙে  কেউ আড়াই আনা কেউ পৌনে তিন আনা  কেউবা পেলো তিন আনা জমির দখল সত্ত্ব ও আলাদা আলাদা জমিদারী করার পারিবারিক আপোষ রফা।

টাউন শেরপুরে মিউনিসিপালিটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর  এই বিভক্ত জমিদারের কর্তা ব্যক্তিরাই  ঘুরে ফিরে পৌর সভার মেম্বার বা চেয়ারম্যান হয়ে  পরগনার ক্ষমতা কাঠামো ভাবসাম্য বজায় রেখেছে জমিদারী ব্যবস্থা বিলোপের পূর্ব পর্যন্ত।

 উনবিংশ শতকে শেষের দিকে পৌনে তিন আনি জমিদারীর সূচক উর্ধ্বমুখী।সেই সময়েই  আজকের এই পরিত্যক্ত বাড়িটি তৈরি করা হয়। সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরি ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর সময়ে যখন জমিদারি রমরমা– শরিকি হিস্যাও কমে এসেছে তখন বাড়িতে  ছোয়া লাগে গ্রীক স্থাপত্যের আদল– গড়ে ওঠে বিশাল পাঠাগার  অন্যদিকে ঘটে  বিত্তের ও চিত্তের প্রসার। সব কিছুই সত্যেন্দ্র চৌধুরীর বরাতে জমিদারি উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত।

জ্ঞানেন্দ্র ও সতেন্দ্র দুই ভাই নাবালকত্বের কারণে জমিদারী হারাতে বসেছিল– সে সময় হরচন্দ্র চৌধুরী ও গোবিন্দ কুমার চৌধুরী ” একত্রে প্রবেটের বিরুদ্ধে” মামলা মোকাদ্দমা করে “উইল জাল “২ বলে সাবস্থ্য হলে ভ্রাতৃদ্বয় জমিদারী ফিরে পেলেন।

শেরপুর পরগনায় মেধাবী ও সাংস্কতিবান এই দুই ভাই একদিকে যেমন জমিদারী চালিয়েছেন তেমনি জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন এম এ বি এল ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট– স্থানিক জমিদারের মধ্যে প্রথম এম এ পাশ আর সতেন্দ্র মোহন চৌধুরী একজন “নামজাদা সাহিত্যিক।”২

কাজে কাজেই তাদের নির্মিত দালানে সমকালীন ছোঁয়া পাবে এটাই স্বাভাবিক। দক্ষিন পূর্বকোনে রং মহল— একটা সময় কৃষি ইন্সটিটিউটের প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন পরিত্যক্ত;পুরাতন দেয়াল, পরিত্যক্ত কারুকাজ করা ভবন, অলংকৃত স্তম্ভ- প্রশস্ত উঠান, বারান্দা; ছায়া ঘেরা সবুজ। সারি সারি সুপারি গাছ।  ভাঙা ফটক– কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

উত্তর দক্ষিনে প্রসারিত রঙমহলটির পেছনে সিঁড়ি– দোতলায় উঠবার পথ।পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট। মস্তবড় দীঘি। টলটল জলে  শুভ্রমেঘের আকাশের মুখশ্রী ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে সারি সারি নারকেল গাছ।এখানে সেখানে ভেঙে গেছে শান বাঁধানো প্রশস্ত ঘাট। আর ঘাট থেকে থরে থরে সিঁড়ি নেমে গেছে জলের শরীরের কাছে।

কেমন ছিল এই সংস্কৃতবান ভ্রাতৃদ্বয়ের গার্হস্থ জীবন? হরচন্দ্র চৌধুরী দিনলিপিসহ লিখেছেন ‘সেরপুর বিবরণ’ কিংবা” বংশচরিত।” কিন্তু সতেন্দ্রমোহন সাহিত্যিক হলেও পৌন তিন আনি বাড়ির কোন যাপন লিপি লিখে যান নি।যদিও”১৯৪৫ সনে সতেন্দ্র মোহন চৌধুরীর উদ্যোগে যে সাংস্কৃতিক সন্মোলন  এই রাজবাড়ির প্রশস্ত উঠানে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন।”৩

উনিশ শতক থেকেই এই উত্তর জনপদ টাউন শেরপুরে কীর্তিমান মানুষের আর্বিভাব ঘটলেও সেই সময়ের পূর্ব থেকে দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত সামাজিক উপাত্ত সমুহ যথেষ্ট হাজির নেই।যদিও ১৮৮০ সালে এখানে প্রেসের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।

উত্তর পশ্চিম কোনে শীষ মহল– জমিদারদের বসত ঘর। একটি সমন্বিত স্থাপাত্য রীতির নির্দেশন এই শীষ মহল ও রঙ মহল। মেঝেতে দেয়ালে খিলানে জানালায়  রঙিন কাঁচ ভবন দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে।।  শেরপুরের অন্যন্যা  জমিদারের তুলনায় পৌনে তিন আনির সৌখিনতা ও সাংস্কৃতিক রুচি অন্য অংশর জমিদারের চেয়ে বেশি  সাক্ষ্য বহন করছে।

শেরপুরে প্রায় সকল স্থাপনাই কালের দাপটে নষ্ট হয়ে গেছে। নয়ের দশের শুরুতে হারিয়েছি আমরা নয় আনী বাড়ির স্থাপত্য। চমৎকার একটি কাঠের কাজ করা দুতলা বাড়িকে নিমিষেই আমরা হত্যা করে ফেলেছি।

হরচন্দ্র চৌধিরীর নির্মিত নয় আনি জমিদার বাড়ি। গোপা হেমাঙ্গি লিখেছেন ” দুপাশে দীর্ঘ দালানের মাঝখান দিয়ে সরু পথ পেরিয়ে শাল কাঠের মস্ত দরজা। দুপাশে পিতলের গুলি বসানো। দুপাশের ডানদিকের দালানটি ছিল ইটের দোতালা তার একতলায় ছিল মহাফেজ খানা।.. মাটিতে গাঁথা বড় বড় লোহার সিন্দক: বাবুর্চিখানা পাশ দিয়ে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি।দোতলাটি  আমাদের প্রপিতামহ হরচন্দ্র চৌধুরী তৈরি করেন রঙিন কাঁচ দিয়ে।দিনের বেলায় সূর্যালোকে ঘরের ভিতরে এবং রাত্রে ঝাড়বাতির আলোয় তা শোভা হতো অপরূপ।”১

ভাষার ভেতরই দেখে নিলাম অষ্টাদশ শতকে নির্মিত একটি স্থাপত্য শৈলি– আমরা ধরে রাখতে পারি নি। হরচন্দ্র চৌধুরী সংস্কৃতিবান জমিদার। অধ্যাপক মোস্তফা কামাল লিখেছেন, “শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরী সামন্ত হরচন্দ্রকে পরাজিত করে স্বাধীন শৈল্পিক সত্তায় জাগ্রত ও স্পষ্টবাক।” ৪

এখানেই  তিনি গড়ে তুলেন  বিশাল হেমাঙ্গ পাঠগার। ” ইহা অতিশয় প্রাচীন। পূর্ববঙ্গ মধ্যে এই লাইব্রেরি প্রসিদ্ধ ছিল।২”Gazetteer of the Mymensingh  district  থেকে হেমাঙ্গ লাইব্রেরী সম্পর্কে  অধ্যাপক  দেলোয়ার  উদ্ধৃতি  তুলে দিয়েছেন এভাবে,”The 9 ana bari contains a library which boasts of some manuscripts  500 years old.”৬

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

দুই

১৮৬৫  সালেই  এখানে  ‘ বিদ্যোন্নতি সভা” গঠিত হয়ে গেছে ; নিয়মিত সভা চলছে প্রকাশিত হচ্ছে ‘ বিদ্যাোন্নতি সাধিনী’   অন্যদিকে পৌন তিন আনীতে তোড়জোড় চলছে আরেকটি প্রেস প্রতিষ্ঠার– এ হেন   নানামুখী তৎপরতায় সাহিত্য  সাধনার জমিন ক্রমান্বয়ে উর্ব্বর হয়ে উঠবে  এটাই স্বাভাবিক।

উনিশ শতক থেকেই শেরপুরে সাহিত্যচর্চার জমিন তৈরি হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে হরচন্দ্র চৌধুরীই (১৮৩৭–১৯১০) এ জেলায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রথম পথিক।৪ তিনি ছাড়াও পন্ডিত চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার (১৮৩৬–১৯১০), বিজয়কৃষ্ণ নাগ,রাধাবল্লভ চৌধুরী, রামকান্ত, রামনাথ বিদ্যাভূষণ,হরগোবিন্দ লস্কর,হরসুন্দর তর্করত্ন,   পাইকুড়া গ্রামের অধিবাসী পুঁথিলেখক রমজান আলী,কবি ফজলুল রহমান আজনবী,আব্দুল কাদের মুন্সী,একই গ্রামের বিপ্লবী ও লেখক প্রমথ গুপ্ত, কবি কিশোরী মোহন চৌধিরী, মীরগঞ্জ অধিবাসী মুন্সী বছির উদ্দিন, শ্রীবর্দীর গোলাম মোহম্মদ এবং রৌহা গ্রামের অধিবাসী সৈয়দ আবদুস সুলতান ৪শেরপুরের সাহিত্যচর্চার স্মরনীয় বরণীয় অগ্রসৈনিক।

তবে এখানে একটু তথ্য যোগ করা যেতে পারে। দেশভাগের তিন বছর পর টংকপ্রথাবিরোধী যে আন্দোলন ময়মনসিংহের উত্তরে শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে শহীদ হন নারিতাবাড়ি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড শচী রায়। ১৯৫০ সালের ১৬ মে। তিনি দেশভাগ উত্তর প্রথম শহীদ। তাঁর স্মরনে কমিউনিষ্ট পার্টি একটি বুলেটিন প্রকাশ করেন।নাম ছিল ‘রশ্মি” শহীদ স্মরণে  সাইক্লোস্টাইলে ছাপা রস্মিতে ছিল রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও শচী রায় কে উৎসর্গ করে লেখা কবিতা।

১৮৬৯ সালের ১৬ জুন শেরপুর পৌরসভা ঘোষিত হবার চার বছর পূর্বে ‘ বিদ্যোন্নতি সাধিনী” ( ১৮৬৫) নামে একটি মাসিক পত্রিকা যাত্রা শুরু করে জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরির প্রযত্নে চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারে সম্পাদনায়৭।

উক্ত পত্রিকা প্রকাশের আগে  গঠিত হয় ‘ বিদ্যোন্নতি সাহিত্য চক্র। গোপা হেমাঙ্গী রায় তাঁর ‘সোনার খাঁচার দিনগুলি’ বইতে লিখেছেন,” ঘনিষ্ঠ বন্ধু চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার ও ঈশান চন্দ্র বিশ্বাসের উৎসাহে ও প্রেরণায় ১৮৬৫ সালে হরচন্দ্র নিজের বাড়িতে ‘ বিদ্যোন্নতি সভা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন।”১ তখন শেরপুর তো দূরের কথা ময়মনসিংহে কোন প্রেস ছিল না।ছিল না কাছাকাছি ধনবাড়ি কিংবা টাংগাইল জমিদার শাসিত কোন অঞ্চলে।’ বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ ময়মনসিংহ জেলার প্রথম পত্রিকা।এই সভা থেকেই প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক চারুবার্তা। তখনো পৌরসভা গঠিত হয় নি।যে বছর শেরপুরে পৌর সভা হয় সেই একই বছরে আট এপ্রিলে ময়মনসিংহ পৌরসভা গঠিত হয়। শেরপুর পৌরসভা ময়মনসিংহেরর চেয়ে কয়েক মাসের ছোট এবং প্রান্তিক পৌরসভা। নিশ্চয় সেই সময়ে শেরপুর অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ভাবে পরিগঠিত হবার সূচক বৃটিশের বার্ষিক রিপোর্টে উর্ধ্বমুখী ছিল।

১৮৮০ সালে ‘ চারুপ্রেস’২ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রেস থেকেই গিরিশ সেন কৃত পবিত্র কোরআন শরিফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। “১৮৮১  সালের শেষ ভাগে আমি ময়মনসিংহে যাইয়া স্থিতি করি,সেখানে কোরাণ শরিফের কিয়দ্দূর অনুবাদ করিয়া প্রতিমাসে খণ্ডশঃ প্রকাশ করিবার জন্য সমুদ্যত হই।শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়…”

একই প্রেস থেকে ১৮৮৫ সালে মীর মোশারফের বিষাদ সিন্ধু ছাপা হয়। অন্যদিকে শেরপুরে যেহেতু জমিদারদের মাঝে শরিকী ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন ছিল,তেমনি  ছিল কল্যানমূলক কাজের প্রতিযোগিতা ( ভিক্টোরিয়া স্কুল ও জিকে পাইলট স্কুল প্রতিষ্ঠা উল্লেখ্যা)। নয় অানী জমিদারের পাশাপাশি পৌনে তিন আনী জমিদার প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ অগ্নিহোত্রির প্রযত্নে ‘শেরপুর বিজ্ঞাপনী প্রেস'(১৮৯৫)। এই প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী সংবাদ’।শেরপুরের জমিদারবৃন্দ   শুধু মাত্র বাণিজ্যের জন্যই শুধু প্রেস স্থাপন করেন নি,তাদের  ছিল সমাজ সংস্কৃতির প্রতি দায় বদ্ধতার জায়গা থেকে কল্যানমুলক কার্যক্রম চালানো পরিসর নির্মান করা।

এই প্রান্তিকে যে প্রেস ব্যবসা সুবিধে করতে পারবে না তার সম্যক জ্ঞান জমিদার কর্তা ব্যক্তিদের ভালই ছিল। জমিদার বিলাসী হলেও পাকা চুলের নায়েবদের লাভ ক্ষতির হিসাব ছিল নখের ডগায়। নয় আনী জমিদারের অধীনে ব্যবস্থাপকের চাকরি করতে আসা গীতিকবি গোবিন্দ দাসের কয়েক কাব্যগ্রন্থ এই চারু প্রেস থেকেই নয় আনী জমিদারের পৃষ্টপোষকতাই প্রকাশিত হয়।নিয়মিত বিদ্যাোন্নতি সাধিনী প্রকাশিতও হচ্ছে এই প্রেস থেকে। হরচন্দ্রের ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থের অধিকাংশ রচনা এই কাগজেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

কাজে কাজেই এমন একটা আবহে  সাহিত্য চর্চার ঢেউ  অন্তঃপুরেও আছড়ে পড়ে।অন্তঃপুর বাসিনীদের ভেতর প্রথম হেমবতী চৌধুরীই কবিতা রচনায় এগিয়ে আসেন।হৈমবতী  হরচন্দ্রের প্রথমা কন্যা। হরচন্দ্র যে এখানে প্রভাবক হিসেবে সলতের কাঠি হয়ে উস্কে দিয়েছে তার বলবার অবকাশ নেই।  জমিদার বাড়িতে নানামুখী সাংস্কৃতিক তৎপরতা তারই সাক্ষ্য বহন করে। বিশেষ করে নিয়মিত নাট্যচর্চা ও  প্রদর্শন হরচন্দ্রের প্রভাবেই উজ্জ্বল করেছে নয় আনি বাড়ির জমিদারের নানা কৃত্যি।  জমিদার কন্যা হৈমবতীর কবিতা কেদার নাথ মজুমদারের সম্পাদিত পত্রিকা “সৌরভে” প্রকাশিত হত। ” পান্ডুলীপি প্রস্তুত”২ হলেও প্রকাশ হয়নি।

তবে অন্ত:পুরে বেশি উচ্চকিত ছিলেন  হিরন্ময়ী চৌধুরী। হরচন্দ্র চৌধুরীর তৃতীয় সন্তান হেমাঙ্গ চন্দ্র চৌধুরীর সহধর্মিণী।তিনিই এই উত্তর জনপদের প্রথম নারী লিখিয়ে যার লেখা একদিকে যেমন সৌরভে প্রকাশিত হত অন্যদিকে তত্ত্ববোধিনী তেও প্রকাশিত হতো।

অন্তপুরবাসিনী হয়েও সম্ভবত তিনি স্থানিক কল্যানমুখী নানা কাজে  নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার কোন লিখিত সাক্ষ্য তিনি বা অন্য কেউ  লিখে যায়নি। সামন্ততান্ত্রিকতার ভেতর নারীর ভুমিকা কেবলই সেবিকা– আলাদা করে স্বীকৃতি দেবার ক্ষেত্রে সামন্ত জমিদার কুণ্ঠিত। কেননা একমাত্র তারামণি ছাড়া আর কোন অন্তঃপুরবাসিনীর নামে কোন স্থাপনার নামাঙ্কিত করতে দেখা যায়নি কিন্তু ব্যতিক্রম হিরন্ময়ী চৌধুরীর ক্ষেত্রে।

 হিরন্ময়ী  নয় আনী বাড়ির পুত্রবধু —  কিন্তু তাঁর  কাজের স্বীকৃতি বা স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে শুধু নয় আনি বাড়ি নয় আড়াই আনি জমিদারের নানা তৎপরতা চোখে পড়ে। এই তরফের জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী তার পিতার নামে যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে তিনি পাঁচ হাজার বইয়ের সমাবেশ নিয়ে  হিরন্ময়ী লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। এই লাইব্রেরীতে তাল পাতার পুঁথি সংরক্ষিত ছিল বলে জানা যায়।

অন্যদিকে নালিতাবাড়ির আড়াই আনি বাজার শেরপুরের আড়াই আনি জমিদারের   হিস্যার অংশে গোপাল দাস চৌধুরী ১৯১৯ সালে হিরন্ময়ী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে কার্যকর ভুমিকা পালন করে গেছেন।

কবি হিরন্ময়ী এই উত্তর জনপদের প্রথম নারী– যার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।এই গ্রন্থের ভুমিকাও লিখেন জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী।তথ্য হিসেবে আমাকে আনন্দিত করলেও বেদনা এই যে কাব্যগ্রন্থটি কারো কাছেই সংরক্ষিত নাই। এতো এতো প্রাচীন পাঠাগার হাজারো বই পত্র আমরা ধরে রাখতে পারিনি। পারিনি এই  শেরপুর পরগনায়  যে সকল পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং যারা সাহিত্য ধর্ম বিজ্ঞান অনুবাদ এমনি আর্য়ুবেদ শাস্ত্র নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে তাদের কোন গ্রন্থই হাল আমলে কেউ স্বচক্ষে দেখিনি। কালের চক্রে হারিয়ে গেছে। স্থানিক সুশীল গোষ্ঠী কিংবা প্রশাসনের কেউই এই তল্লাটের প্রাত স্মরণীয় কারিগরদের সৃষ্টি সম্ভার সংরক্ষনে কোন ভুমিকাই পালন করেন নি।

তবু রক্ষা– অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে প্রকাশিত কতিপয় বইয়ের নাম ও লেখক তালিকা এখনো সুধীজনদের কাছে আছে হরচন্দ্র চৌধুরীর ‘সেরপুর বিবরণ” (১৮৭৩)ও বিজয় চন্দ্র নাগের ” নাগ বংশের ইতিহাস (১৯২৭)গ্রন্থের বরাতে। যদিও উক্ত বই দুটি প্রথম প্রকাশের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কোন প্রকাশক এগিয়ে আসেন নি পুনমুদ্রনে।

এখন যেটি পাঠকের হাতে ঘুরছে সেটি ফটো কপির ফটো কপি তার ফটো কপি…

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইতিহাস ঐতিহ্য শুধু মৌখিক চর্চা নয়– বকবক করলাম আর হয়ে গেলো– ইতিহাস ঐতিহ্য যাপনে চর্চা ও সংরক্ষনও বটে। সেটি আমরা পারি নি– কী স্থানিক ভাবে কী জাতীয় ভাবে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পাশাপাশি রেখে কিভাবে বর্তমানতার দাবী মেটানো  যায় সেটি আমাদের ভেতর নাই।

শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনপৌনে  তিনআনী জমিদারদের রং মহল ও শীষ মহল–উনিশ শতকের গোড়ার দিকে  জমিদার কিশোরী মোহন চৌধুরীর আমলে এই স্থাপনা, মন্দির ও  শান  বাঁধানো ঘাটসসহ নানা সৌধ নির্মাণ করেন।

ভেতরে অন্নপূর্ণা আর গোপী নাথ মন্দির। সেই কবে  ১৭৮৩ সালে প্রতিষ্টিত।  পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট মন্দির। কার্ণিশে কাজকরা। ফুল ও লতার নকশা। কোথাও ভেঙে গেছে। দেয়ালে জন্মেছে নানা গাছ গাছালি। পাশেই মস্ত দীঘি — আাকাশ ছোয়া নারকেল গাছ।

এখন এখানে কৃষি ইন্সটিটিউট।   এখানেই ছিল একদা “জয়কিশোর লাইব্রেরি”। সতেন্দ্র মোহন ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী পিতা মাতার নামে পাঠাগার এই পাঠাগারটি স্থাপন করে ” সর্ব সসাধারের নিয়মিত সময়ে ইচ্ছা মত সাহিত্যচর্চা করিবার বন্দোবস্ত ও সুব্যবস্থা আছে” ২– যেটি নয় আনি জমিদারী বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হেমাঙ্গ পাঠাগারে ছিল না।

হেমাঙ্গ ছিল পারিবারিক পাঠাগার। জয়কিশোর সকলের জন্য।  জমিদার সতেন্দ্র মোহন বিদ্যানুরাগী শুধু নয়  তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বাইলজি নিয়ে পুস্তকও রচনা করেছেন–এই “লাই্রেরীতে প্রায় ৫৫০০ হাজার গ্রন্থ সংগৃহীত হইয়াছে। বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বিশেষত বাইলজি সম্বন্ধেই বেশী পুস্তক।হইা ব্যতিত ইতিহাস,জীবন, অর্থর্নীতি সংস্কৃত বাঙ্হালা ইংরাজি প্রভৃতি নানা বিধ গ্রন্থ সংগৃহীত হইয়াছে।”২

দেশ ভাগের পর সরকার জমি  অধিগ্রহণ করে ১৯৫৭ সালে কৃষি ইন্সটিটিউ করা হলে  পুরাতন পাঠাগার ভেঙে শ্রেণি কক্ষ করা হয়।  তখনই পাঠাগার রক্ষিত বইয়ের বাস্তুচুত্য ঘটে।বই গুলো আর তাদের ঠিকানা খোঁজে পায় নাই। এমনতিতেই আমরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে সকল বই আউটের বই— এমন একটা প্রবনতা মানসিক ভাবে আমাদের মাঝে বিদ্যমান।

যথেষ্ট বই বান্ধব মানুষ না হলে ক্ষয়ে যাওয়া বিগত শতাক্দীর বইয়ের প্রতি  এমনি এমনি মমত্ব জাগে না। শ্রেনি কক্ষ  প্রয়োজনে  নির্মিত হবার পর কিভাবে বইগুলো নতুন ব্যবস্থাৃয অভিযোজিত হতে পারে সেই ছোট্ট কাণ্ডজ্ঞান টুকু আমাদের আধখেচড়া সমাজ কাঠামোয় গড়ে উঠেনি।

দুখ এখানেই– নইলে শেরপুর পরগনায় এতো পুরাতন পাঠাগারে এতো এতো বই সবগুলোই কি উঁই আর ইদুরের করালে দাঁতে ধ্বংশ পেলে?  কোন বই-ই কি পেলো না নতুন বাস্তু?

বলছিলাম কবি হিরন্ময়ী চৌধুরীর কথা।বইটি দেখব দুরস্ত– প্রচ্ছদও দেখতে পাইনি। কেমন ছিল বইটির? কী ছিল তার ভেতর উঠান– ইত্যকার প্রশ্নের উত্তরের জন্য একমাত্র একটিই উৎস।

সেটি হলো শেরপুর মহাবিদ্যালয়ের ১৯৬৯– ১৯৭০ শিক্ষা বর্ষের বার্ষিকীতে প্রকাশিত বইটির রিভিউ।চার পৃষ্ঠা জুড়ে বইটির সমালোচনা করেছিলেন তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রভাষক মুহাম্মদ আব্দুর রসিদ খান। তৎকালীন ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও বিতর্ক সম্পাদক মুহাম্মদ আখতারুজ্জামানের প্রযত্নে প্রকাশিত বার্ষিকী।

রসিদ খানের সমালোচনাই কবি হিরন্ময়ী কবিতা সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস। ধন্যবাদ জনাব খান।তিনিই অতীতের সাথে একটি ব্রিজ নির্মান করে রেখেছিলেন বলেই হিরন্ময়ী সৃষ্টি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত আমরা জানতে পাচ্ছি।

মুহম্মদ আব্দুর রসিদ খান লিখেছেন,”  আর্ট পেপারে ক্রাউন ১/৮ সাইজের ৮*৬  ইঞ্চি পরিসরের রেক্সিন কভার ষ্ট্যাম্প বাধাই স্বর্ণ রঙে মোড়া “প্রকাশকাল ২০ শে পৌষ,১৩২৮. মোতাবেক১৯২১।৬

জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী “পুষ্পাধার রচয়িত্রীর একমাত্র কন্যা ও প্রথম সন্তান অমিয়াদেবী গত ১৩২৬ সনের ৯ই বৈশাখ সুখ দু:খের অতীতপুরে প্রস্থান করিয়াছেন।  মাতৃরচিত কবিতার মাধুর্য্যে মুগ্ধ হইয়া এবং সন্তানোচিত স্বাভাবিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির বশবর্তী হইয়া স্নেহময়ী  অমিয়া মাতার রটিত কবিতা কানন হইতে কতকগুলি অম্লান কুসুম স্বহস্তে চয়ন করিয়া ” পুষ্পাধারে”সাজাইয়া আত্মীয় বর্গের তৃপ্তি বর্ধন করিতে চাহিয়া ছিলেন।…. পুষ্পাধার সাধারনের মধ্যে প্রচারের জন্য প্রকাশিত হইল না কেবল আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই বিতরণের জন্য।”

হিরন্ময়ীর কবিতা সুললিত কবিতা।গত শতকের কবিতার ধরন ধারনের দিকে তিনি তাকাবার অবসর হয়তো পাননি। হৃদয়ের আবেগ মথিত ভালোবাসার রঙে তিনি এঁকেছেন  একেকটি  কবিতা। শৈল্পিকতার নিরীখে নয় বরং আব্দুর রসিদ খান  লিখেছেন,” প্রাণাধিক কন্যার নিমিত্ত শোক বিহ্বল মনের আকুতি ও তৎসংক্রান্ত কাব্যিক উদ্ভাস নৈরাশ্য ও বেদনার কোন কোন কবিতা মাত্রাতিরিক্ত ভারাক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত,এই কারনে যে,তা থেকে চিরন্তন কোন কবিতার অপারগ, এই মহিলা কেবল প্রাসবিক যন্ত্রনায় সংক্ষুদ্ধ। অভিজ্ঞতা কাব্যের অন্যতম নিয়ামক,তবে পরিণতির প্রতীক্ষার স্থির উপলব্ধিতে তা প্রশান্ত হয়ে না এলে সংহত বাণীমূর্তি লাভ করতে পারে না। এই জন্য কতকগুলি কবিতা ব্যর্থ রোদনের পর্যবসিত। “

রসিদ খানের তলোয়ার ধার দুইধারে। কবিকে আক্রমন করতে ছাড়নি। তিনি লিখেছেন,”১৯২১ এর আগে কবিতাগুলো লেখা– সেদিক থেকে সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক নিগ্রহ বর্তমান মহিলাকে কম বেশী উচ্চকিত করার কথা–যা অন্য সব কবিদের করেছে।” রশিদের উত্থিপিত প্রশ্ন জরুরি বটে। সামন্ততন্ত্রের ভেতর বেড়ে ওঠা  হিরন্ময়ীর প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের চাপ তাপ ভাপ লাগেনি।

এই প্রান্তিকে অন্তপুরে থাকা একজন নারীর পরিসর পুরুষতন্ত্রের নানা সীমা পরিসীমা দিয়ে ঘাট বাঁধা। তাঁর স্থানিক ও কালিক অবস্থানের ভেতরই যাপন লীলা সম্পন্ন করতে হয়েছিল।সুখের সংবাদ এই যে খুব ক্ষীন হলেও অাত্মজার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে একজন মায়ের হৃদয় নিঙড়ানোর শব্দমালাই ” পুষ্পাধার।”

এ মধুর হাসি তুই                পাইলি কোথায়?

                 টুকটুকে রাঙ্গা ঠোঁটে

               আহা মরি ফুটে উঠে

আঁধার গৃহেতে যেন আলোকের ভিয়।

                  মেঘ শেষে নীলাকাশে

                  চাঁদ যেন উঠে হেসে

নিরমল রূপ ছটা করি বিতরণ

                 পূরব গগন গায়

                  উষা যেন হেসে যায়

        ( শিশুর হাসি)

সেই সুখ দিন হায় গিয়াছে চলিয়া

বসন্তের উষাকালে

সুনীল অম্বর ভালে

উঠেছিল সুমধুর যে আভা ফুটিয়া

শারদ জোজনা নিশি

গিয়াছিল প্রাণে মিশি

বয়েছিল হৃদিমাঝে সুখের মলয়।

  ( মৃত সঞ্জীবনী)

গ।

উচ্চ শৃঙ্গ হিমাদ্রির

অভ্রভেদী শিরে

আশার কলিকা মোর

ফুটাইয়া ধীরে,

চকিতে ফেলিলে তাহা

ছিন্ন করি তায়,

কোন অপরাধে দিলে

এ দণ্ড আমায়।

    ( দণ্ড)

আব্দুর রসিদ আরো লিখেছেন,” এই মহিলার কাব্য নবিশির আরম্ভ ও পরিসমাপ্তি ‘ পুষ্পাধারে” সীমাবদ্ধ। হয়তো প্রকাশনা শৈথিল্যে অথবা কাব্যালোচনার পরিবেশ অভাবে আরও কবিতা ফুলদানির বাইরে অজ্ঞােতে ঝরে গেছে কিংবা কলিমুখ ফুটতে পায়নি। কিন্তু এই একটি সংকলনে যথেষ্ট শক্তির পরিচয় স্বাক্ষরিত। …সাহিত্যাকাশের সূর্য নয় চন্দ্র নয় এমন কি তারকাও নয়;স্রেফ গৃহাঙ্গনের একটি তৈলপ্রদীপ। চিত্তের প্রসন্নতা হৃদয়ের অপার স্নেহ ভক্তি ভালবাসা দিয়ে গৃহকোণ আলোকিত করেছে মাত্র– যতটুকু করেছে তার মূল্য কম নয়। “৬

কবি কন্যা অমিয়া (১৩০৬–১৩২৬)কে উৎসর্গিত “পুষ্পাধার” ঢাকার ৫ নং নয়াবাজার শ্রীনাথ প্রেস থেকে শ্রী প্রাণবল্লভ চক্রবতী দ্বারা মুদ্রিত হয়েছিল। আরেকটু তথ্য সংযোজিত করা যেতেই পারে ” ১৯২৫সালে পুষ্পাধার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার সময় কথা সাহিত্যিক শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবির বাড়িতে গিয়েছিলেন।তিনি এই বইটির প্রথম সংস্করণ তাদের বাড়িতে বসেই পড়েন এবং বইটিতে কবিতার ক্রমবিন্যাস সম্বন্ধে ত্রুটি সংশোধন করার অনুরোধ করেন,দ্বিতীয় সংস্করণে।সেই সময়েতাঁর বন্ধু সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্যোপাধ্যায় কবিতার ক্রমনির্ণয়ের কাজটি সমাধা করে দেন।৭

১৯২৫ সালের এই দ্বিতীয় সংস্করনে শ্রী হেমাঙ্গচন্দ্র চৌধুরী তার স্ত্রীর বইটি সম্পর্কে লেখেন,” মানুষের মন সতত চিন্তারত। অসংখ্যা চিন্তা মনে উদয় হইয়া অপরের অগোচরে মনে বিলীন হইয়া যায়।কতক চিন্তা বাক্যে প্রকাশ পাইয়া বায়ুতে বিলীন হয়।কিন্তু এমন অনেকচিন্তা প্রত্যেক মানুষের কাছেই প্রিয় বোধ হয় যাহাদের ঐরূপে ক্ষনিকতার মধ্যে  নষ্ট হইতে দিতে ইচ্ছা করে না;তাহাদের রূপ দিয়া স্থায়ী করিয়া ধরিয়া রাখিবার সাধ মানুষের মনে জাগে।এই জন্য কবি নিজের চিন্তাকে ছন্দের শৃঙ্খল পরাইয়া লেখায় বাঁধিয়া রাখিতে চেষ্টে করেন;রূপ দক্ষ শিল্পী নিজের চিন্তাকে কাঠ ককাটিয়া বা ইট গাঁথিয়া বা পটে রং লেপিয়া ধরিয়া রাখিতে চেষ্টে করেন… আমার পত্নীর রচিত কবিতাগুলিবে আমাদের জেষ্ঠ সন্তান ও একমাত্র কন্যা অমিয়ে সোদরার ন্যায় স্নেহের চক্ষেই দেখিত।তাই তাহার বিশেষ বাসনা ছিল এইগুলোকে অপরের সমক্ষেও প্রকাশ করিবে। সে তাহার মাতার মানসোদ্যানের পুষ্পগুলিকে পুষ্পাধারে সজ্জিত করিয়া লোকসমক্ষে প্রকাশ করিবে ইচ্ছা করিয়াছিল। কিন্তু বিধাতা তাহাকে অকালে আমাদের ক্রোড় হতে নিজের ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন।তাহার অভাবে এই কবিতাগুলির সঙ্গে একটি মর্ম্মন্ত্দ শোকের স্মৃতি জড়িত হইয়া গেল।”

সম্প্রতি  ‘ মিলনসাগর ওয়েবে’ কবি হিরন্ময়ী দেবীর ১৪টি কবিতা পুনপ্রকাশ করে সম্পাদক  লিখেছেন ,”…. তাঁর কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয়েছে যে  এই কবি যদি কলকাতা কেন্দ্রিক হতেন এবং তাঁর কাব্যগ্রন্ধটি যদি সর্বসাধারনের জন্য প্রকাশিত হতো তাহলে হয়তো জনপ্রিয় হতে পাতেন।”৭

শত বছর আগে এই আমার উত্তর জনপদ  শেরপুর পরগনায় সাহিত্য চর্চার যে চাতাল সামন্ততন্ত্রের ভেতরে থেকে গড়ে উঠেছিল তার ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। প্রাগ্রসরতার  কর্ষিত ভুমি   কী জানি কী কারণে ব্রহ্মপুত্রের বালরাশির চাপে পড়ে রইল। সজীবতায় উন্মুখ হলো না।আবাদী জমিন অনাবাদী হয়ে পড়ল।

সামন্ততন্ত্রের বেড়া ডিঙিয়ে গনতন্ত্রের বুলি চর্চা করতে করতে আমরা শত বছর পাড় করে দিলাম। সামন্তের গর্ভে জন্মে নেয়া অনেক কিছুই আমরা ফেলে এসেছি।ফেলে দিতেই হয়– নইলে বোঝা ভারী হয়ে ওঠে।বর্তমান হয়ে পড়ে স্মৃতিকাতরতামুখর। কালের যাত্রা পুরাতনকে পেছনে ফেলে  নতুনকে নিয়ে সামনে চলে দৃঢ় পদক্ষেপে। এটাই ইতিহাসের চলার গতি।তবু নতুনের ভেতর পুরাতন যুগের যা সার তা ঠিক ঠিক থেকে যায়। নতুন রূপে নতুন অাঙ্গিকে।এই প্রান্তিকে সাহিত্য সাংস্কৃতিক চর্চার  ভিত্তিভুমি যে  কারিগরেরা নির্মাণ করেছেন তাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ইতিহাস ঐতিহ্য প্রাত্যহিক চর্চা ও অবিনির্মানের বিষয়– শুধু শুধু বাতচিতের বাগাড়ম্বর নয়।

উৎস

১।সোনার খাঁচার দিনগুলো।গোপা হেমাঙ্গি রায়।চন্দনগর সাহিত্য পরিষদ।২০০৪

২।নাগ বংশের ইতিবৃত্ত।বিজয়চন্দ্র নাগ।১৯২৭

৩।শেরপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। শফি উদ্দিন।ব্রহ্মপুত্র।সংখ্যা১।২০১৬

৪।শেরপুরে সাহিত্য প্রসঙ্গে।অধ্যাপক মোস্তফা কামলা।প্রয়াস প্রথম সংখ্যা।১৯৮৫

৫।শেরপুরের ইতিকথা। অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন।১৯৬৯

৬।একজন মহিলা: একটি কাব্য। আব্দুর রসিদ খান। কলেজ বার্ষিকী।১৯৬৯-৭০.

৭। www.milandagar.com শ্রী মিলন সেনগুপ্ত।

৮। শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা। মৎ প্রণিত।

One thought on “কবি হিরন্ময়ী চৌধুরীর কথা

  1. সত্যিই তাই ইতিহাস ঐতিহ্য প্রাত্যহিক চর্চা ও অবিনির্মানের বিষয়। শুধু শুধু বাতচিতের বিষয় নয়।
    অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় লেখক জ্যোতি পোদ্দার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত