আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
আশির দশক। আমাদের তখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কাল, কবিতা পড়ার কাল, কবিতা শোনার কাল। তখন তিনি, নবারুণ ভট্টাচার্য, কী ভীষণ আবেগ ও প্রতিজ্ঞার জন্ম দিয়েছিলেন ‘এই মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না’ লেখার মধ্য দিয়ে। ‘যে পিতা তার সন্তানের লাশকে শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি’- বলার মধ্য দিয়ে তিনি আসলে আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিলেন ঘৃণার চেয়েও অবর্ণনীয় দুঃসহ একসময়ের দরজা- যে সময় এত অবরুদ্ধ, এত দুঃশাসনীয় যে পিতা পর্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন তাঁর সন্তানকে শনাক্ত করতে। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা সে কবিতা আমাদের বাংলাদেশে হয়ে উঠেছিল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে পঠিত অন্যতম প্রতিবাদী কবিতা। নবারুণ আমাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তাঁর সশব্দ পঙ্ক্তিমালার মধ্য দিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে যেন আন্দোলনের জনস্রোতে উচ্চারণের জন্যই লেখা তাঁর কবিতা, কিন্তু তার পরও তাতে রয়েছে স্তব্ধতার মধ্যে ঠোঁট নড়ে ওঠার আবেগ, বেদনা ও নির্লিপ্তি। হয়তো নবারুণের নাম জানেন না, কিন্তু তাঁর কবিতা শোনেননি, আশির দশকের এমন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী কমই আছেন। এ কথা ভাবা আমাদের জন্য বেদনার যে চোখজুড়ে তারুণ্য ও প্রতিজ্ঞা ছড়িয়ে থাকা এমন মানুষটির সঙ্গে আমাদের আর মুখোমুখি কথা হবে না।
নিজের লেখা সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণা খুবই স্পষ্ট : ‘কেউ চাইলে এবার একটি সসীম মুদ্রিত পরিসরে আমার আখ্যান, তার ব্যর্থতা ও সফলতা, একাধিক ধাঁচের বাচনের মধ্যে আমার অস্থির সন্ধান, কোনো মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে না নেই, জটিল ও ধস নামার সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা আমি করতে পেরেছি কি না, আমার বিশ্ববীক্ষা, প্রাণমণ্ডলের সঙ্গে একটা সক্রিয় অঙ্গীকার- সবটাই যাচাই করে নিতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে যে তাগিদ থেকে আমি লিখি, তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রদবদলের যে বিচিত্র ও ট্র্যাজিক সময়ের আমি সাক্ষী তার অনুরণন আমার আখ্যানে রয়েছে- কখনো আমি অংশীদার এবং সব সময়ই ভিক্টিম। তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখক হিসেবে সেটাই আমার উপলব্ধি। বিচ্ছিন্নতার কষ্টকর একাকিত্ব থেকে কোনো একটা অন্বয়ে আমার যাওয়ার চেষ্টা আশা করি পাঠকের চোখ এড়াবে না।’ নিজের উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকা লিখতে গিয়ে ২০১০ সালে নিজেকে তিনি এভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন। নিজের বিচ্ছিন্নতার আদলকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন, বুঝেছিলেন তার শক্তিকেও এবং সেই শক্তিকে অতিক্রম করে একটা অন্বয়ে যাওয়ার ধাবমান সংগ্রাম তাঁর লেখাকে আর সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সেই অর্থে তিনিও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন গতানুগতিক সাহিত্যের স্রোত থেকে এবং নিজেকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর নিজস্ব বিচ্ছিন্নতার শক্তি দিয়ে। সাহিত্যের বাজারকে যে তিনি কী তীব্রভাবে এড়িয়ে চলতেন, সেই সত্য আমরা উচ্চকিত হতে দেখি তাঁর এই কবিতাটিতেও, যেটিতে তিনি লিখেছেন যে ‘আমি একটি ইতরের দেশে থাকি/এখানে বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে/এবং লেখকেরা উদ্ভাবিত হয়।/…আমার ভাগ্য আমি নিজেই ভেঙেছি/তাই বাতিল স্টিমরোলারে/কাছে বসে থাকি আর/রাস্তা বানাবার গল্প শুনি।’ চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে, তার ওপর বাজারের আগ্রাসী ছোবল সম্পর্কে তাঁর কী যে স্পষ্ট ধারণা ছিল, তার ছাপ তিনি মেরে দিয়ে গেছেন তাঁর লেখা উপন্যাস-আখ্যানগুলোর প্রতি বাক্যে।
কথাসাহিত্যে নবারুণ আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে আসেন ১৯৯৩ সালের প্রথমদিকে ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর। ১৯৯৬ সালের দিকে নবারুণের উপন্যাস ‘হারবার্ট’ সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর এক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। অন্যদিকে দেবেশ রায় লিখেছিলেন, এই একটা উপন্যাসেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে নবারুণ একজন জাত-ঔপন্যাসিক। এমনকি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক পর্যন্ত ছিলেন তাঁর এই উপন্যাসের মুগ্ধ পড়ুয়া। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন ও ভাঙনের ক্রান্তিকালে নকশাল আন্দোলন, তারুণ্য ও সামাজিক উদ্দেশ্যহীনতার প্রেক্ষাপটে লেখা ‘হারবার্ট’ তাঁকে অমর করে রাখবে অনন্তকাল। ‘হারবার্ট’-এর লেখনরীতিই এমন যে তা বোধহয় অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ হওয়া সম্ভব নয়। অনুবাদকদেরও তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। কবিতা ও ছোটগল্পের জন্য নবারুণ অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন পড়ুয়াদের কাছে; কিন্তু ‘হারবার্ট’ ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। কলেবর তত বড় নয়, কিন্তু এর আবেদন ছিল সুদূরস্পর্শী। বাজারের প্রত্যাশা না করেই তিনি লিখতেন, কিন্তু আঙুলের ডগায় ঝলসে ওঠা নবারুণের ক্ষমতার গুণে বাজারই ছুটে এসেছিল তাঁর কাছে। ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন না, কেননা তিনি মনে করতেন মানুষের প্রতিটি প্রজন্মই তার সময়ে তার হরাইজোনে যেসব প্রশ্ন উঠে আসে, আসতে থাকে, সেসবের প্রতিটিরই সমাধান করতে করতে এগিয়ে চলে। ‘নিজেকে বেশি স্মার্ট মনে করার কোনো কারণ নেই’- এ রকমই বলতেন তিনি; তার পরও বলতে হয়, লেখনরীতিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের যে স্মার্টনেস রয়েছে সেটির প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করাতে গিয়ে দুর্বলকণ্ঠে কেবল হয়তো বলা চলে সন্দীপণের কথা। ‘দুর্বলকণ্ঠে’ বলছি এ কারণেই যে বাজার থেকে দূরে থাকতে চাইলেও সন্দীপণের ভাষার ঋজুতা আসলে মধ্যবিত্তের পলায়নপরতা লুকিয়ে রাখার শক্তিশালী কৌশল। কিন্তু নবারুণ তাঁর ভাষার ঋজুতার পাশাপাশি মুখোমুখি হন সেই পলায়নপরতার ও তাতে কমিটমেন্টও থাকে। সে কমিটমেন্ট নিঃসঙ্গ হলেও তার আবেদন এখানেই যে তা একদিকে যেমন বাস্তবতাকে অতিক্রম করে না, অন্যদিকে সে কমিটমেন্টকে নবারুণ লুকিয়ে রাখতে পারেন কাহিনীর অতলে, অদৃশ্য করে ফেলতে পারেন বহুস্তরগামী ও বহুস্তরস্পর্শী আবহের মধ্য দিয়ে। ফলে তাঁর গল্প ও আখ্যান আর শেষ পর্যন্ত কথিত ‘সামাজিক বাস্তবতাবাদের’ ঘেরাটোপে আটকে থাকে না। যেমন ‘হারবার্টে’র কথাই ধরুন, ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির লেখা কবিতাকে ব্যবহার করে তিনি আসলে বেসিক এনিগমাস অব লাইফকে ইতিহাসগতভাবে দেখতে চেষ্টা করেছেন। আধুনিকতার চিরকালীন দিক আছে বলে মনে করতেন তিনি। তাই তিনি অতীতকে তার চলমান সময়ের মধ্যেও খুঁজে নিয়েছেন। এভাবে লেখার মধ্য দিয়ে তিনি আসলে রাজনৈতিক প্রতিবাদ করেছেন।
এত কিছু বলেও আসলে নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে একটি স্থিরচিত্র তুলে ধরা অসম্ভব। খানিকটা হলেও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও মুগ্ধতা সেই অসম্ভাব্যতাকেই বরং আরো স্থিরতা দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সম্ভবত ১৯৯৭ সালে- তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে এলে। পল্টনের একটি হোটেলে মুখোমুখি কেবল আমরা দুজন ঘণ্টাদেড়েক কথা বলেছিলাম। তার পরও তিনি যে আমাকে মনে রেখেছেন, সেটি টের পেতাম তাঁর সূত্রে মাঝেমধ্যে কেউ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যোগাযোগ করলে। সেই মনে রাখাটা যে কেবল ‘ব্যক্তিগত’ সেটি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি ২০০৭ সালের প্রথম দিকে, একটি সংকলনের জন্য তিনি ছোটগল্প চেয়ে ই-মেইল করলে। তখন তিনি সক্রিয় ‘ভাষাবন্ধন’ নিয়ে। ই-মেইলে লিখেছিলেন, বাংলা ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদের একটি সংকলন বের হবে। লিখেছিলেন, আমার কোনো গল্পের ইংরেজি অনুবাদ থাকলে সেটি তাঁর বরাবর পাঠাতে। কোনো গল্পের ইংরেজি অনুবাদ নেই বলে তাঁকে আশাহত করতে হয়েছিল, পরে যোগাযোগও আর অব্যাহত থাকেনি।
নবারুণের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে তারুণ্যের ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টি- ঠিক কি বেঠিক, সেটি তো পরের ব্যাপার, কিন্তু তারুণ্যে এই যে একটি ব্যাপার আছে, ঝুঁকি নেওয়ার ও আবেগমথিত হওয়ার, স্পর্ধিত হওয়ার ও ধ্বংস হওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার- এসব বিষয় তাঁকে বারবার আকৃষ্ট করেছে। লেখক হিসেবে তিনি আসলে রেসপন্স করেছেন সত্তর দশকের, তাঁর চোখের সামনে দেখা নকশাল আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। তাঁর সেই রেসপন্স আবার প্রভাবিত করেছে আশি ও নব্বইয়ের দশকের পাঠক ও সংস্কৃতিকর্মীদের। সন্দীপণ নিজেকে এত বেশি অসামাজিক ভাবতেন যে মৃত্যুর পর খাটিয়া বইবার জন্য চারজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না বলে ডায়েরিতে উদ্বেগ লিখেছিলেন। নবারুণও তাঁর লেখার বিষয়-আশয় ও ঋজুতার কল্যাণে পাঠক ও বাজারব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যদিও কেউ খাটিয়া টানবে কি না, তা নিয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ ছিল না। কিন্তু মায়ের জীবদ্দশাতেই তাঁর এই মৃত্যু যেন শোকের আবহকে আরো তীব্র করে তুলেছে। ‘হাজার চুরাশির মা’ লিখে যিনি কল্যাণময়তার উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন, সেই মা মহাশ্বেতা দেবীকে আর আমাদের এই মৃত্যুউপত্যকায় রেখে তিনি একা-একা চলে গেলেন, কিন্তু স্মৃতিউপত্যকায় তিনি বাস করবেন অনন্তকাল।
