| 4 অক্টোবর 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

ইরাবতী স্মরণ: নবারুণের চলে যাওয়া । টোকন ঠাকুর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
সাহিত্যিক-কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের পরলোক যাত্রার পর আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস লিখি- ‘গোল পার্কের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিকী থেকে, সেই মে মাসের পোড়া পোড়া দুপুরে ট্যাক্সিতে গেলাম গলফ গ্রিন, তখনকার সময়ে মহাশ্বেতা দেবীর বাসায়। আমি আর শাহনাজ মুন্নী। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আকাদেমীর আরুণি দা এবং বাপ্পা দা। অবশ্য ট্যাক্সিতে তিনি বলেননি যে, তিনি নবারুণ ভট্টাচার্য।’ মৃত্যু উপত্যকাকে যিনি নিজের দেশ বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তো মহাশ্বেতা দেবীর সামনেই তিনি সিগারেট ধরালেন এবং সিগারেটের প্যাকেটটা তিনি আমার দিকে বাড়ালেন। আমি জড়তা ফিল করছিলাম, ২০০২ সালে, মহাশ্বেতা দেবীর সামনে, তারই বাসার ড্রইংরুমে কীভাবে সিগারেট টানি! হাজার চুরাশির মা তা টের পেয়ে বললেন, ‘শোনো, তুমি তো আমার নাতির বয়সী। বাপ্পা যদি টানে, ও তো আমার ছেলে, তুমিও টানো।’ বাপ্পা দা বলতে নবারুণ ভট্টাচার্য। বললাম, ‘নবারুণ দা, বাংলাদেশের বিপ্লবী স্বপ্নের বারান্দায় বসা ছেলেমেয়েদের সম্ভবত সব্বারই মুখস্থ, এই জল্লাদের ভূমি আমার দেশ না…’
মাঝে-মধ্যে আমি সিদ্ধেশ্বরীতে, প্রতীতি দেবীর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাই। ভবির বয়স এখন ৮৯। ভবি, ভবার যমজ। ভবা হচ্ছেন ঋত্বিক ঘটক। সঙ্গত কারণেই কথা হয় খুকু ওরফে মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে, তিনি প্রতীতি দেবীর তিন মাসের ছোট। ঋত্বিক-প্রতীতির বড় ভাই মনীশ ঘটকের মেয়ে খুকু। খুকুর ছেলেই, বিজন (ভট্টাচার্য)-পুত্র নবারুণ। নবারুণ ভট্টাচার্য চলে গেলেন। কয়েক মাস আগে, প্রতীতি দি’ই একদিন বাপ্পা দার চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে আমাকে ফোন করে এমনভাবে বললেন, যেন এ ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল! দিদি বললেন, ‘শোনো, খোকনকে মুম্বাই না নিয়ে দিল্লি নেয়া কি ভালো হলো?’
চলে গেলেন। তো গেলেনই। তবু মৃত্যু উপত্যকায়, জল্লাদভূমিতে, হার্বাট-এর হারু… নবারুণ দা, এত সহজে আপনার মৃত্যু হয় না।
দুই বাংলার কাগজেই বেশ লেখালেখি হচ্ছে তাকে নিয়ে। পড়ছি। এই রচনায় আমি কলকাতার দুটো কাগজের নবারুণ মূল্যায়ন তুলে ধরলাম। সঙ্গে উইকিপিডিয়ার রিপোর্ট। লক্ষ করার বিষয়, কলকাতার একটি কাগজ তাদের চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গিতে নবারুণের জীবন সত্তার মূল্যায়নে বলেছে ‘দ্রোহাভ্যাস’। দাদা আনন্দবাজার। এই দাদারা বলছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে এক সময়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রবল কৌলীন্য ছিল। প্রকৃত সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠানবিরোধীই হইতে হইবে- এই বাধ্যতায় অনেকে বিশ্বাস করিতেন। যে লেখকগণ কোনো প্রতিষ্ঠানের মদদে খ্যাত বা ধনী হইতেন, সাধারণ মানুষ তাহাদের লইয়া উত্তেজিত ও আপ্লুত থাকিলেও, চর্চাবান মহলে তাহাদের নিতান্ত মেরুদণ্ডহীন, লোভী ও আত্মবিক্রয়কারী জীব হিসেবে ধরা হইত। পাশাপাশি ইহাও ধরিয়া লওয়া হইত : তাহারা লেখক হিসাবেও ব্যর্থ। বিশ্বাস করা হইত, লেখকের কাম্য কেবল নিজ সাধনায় সিদ্ধি। ‘সিদ্ধাই’য়ের দাপটে বিচ্যুত হইলে, বাড়ি-গাড়ির ফাঁদে জড়াইয়া পড়িলে, নিষ্কলুষ সংস্কৃতিযাপন সম্ভব নহে, আজ নহিলে কাল এই বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্যের খাজনা দিতে হইবে, আপন কাজটিকে তরল ও সরল করিয়া। জনপ্রিয়তার দায় ও সম্পদের আমোদ, লেখককে উৎকর্ষ ও স্বাতন্ত্র্যের পথ হইতে ছিন্ন করিয়া বাজার-বশ্যতার দরবারে আনিয়া ফেলিবে। রাজাকে তুষ্ট করিতে অভ্যস্ত ও ব্যস্ত সভাকবি, নিজের মতানুযায়ী কবিতা না লিখিয়া, রাজার রুচিমাফিক কাব্যরচনায় অভ্যস্ত হইয়া যাইবেন। জনপ্রিয়তায় প্রকৃত শিল্পের ক্ষতি হয়, জ্যা শিথিল হইয়া পড়ে, ইহাও অনেকেরই মতো ছিল। যদিও এই মতামতের নেপথ্যে বহু সময় কাজ করিত ঈর্ষা, দ্বেষ, নিজে প্রতিষ্ঠানসিদ্ধ হইয়া উঠিতে না পারিবার আক্ষেপ, কিন্তু অনেক লেখকই এই উগ্র মতাবলম্বনের অগ্নি হইতে নিজ উত্তাপ ও অস্ত্র খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। সহজ প্রতিষ্ঠার পথে, স্থূল জনপ্রিয়তার পথে কিছুতে হাঁটিব না- এই প্রতিজ্ঞা বাংলা সাহিত্যের কিছু লেখককে অতি মৌলিক ও স্পর্ধিত সাহিত্য রচনায় প্রণোদিত করিয়াছে। বৈপ্লবিক ভাবনা ও আশ্চর্য আঙ্গিক লইয়া ইহারা সাহিত্য প্রয়াস লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। কেহ ‘কাল্ট’ হইয়াছেন, কেহ হন নাই, কিন্তু এই প্রকল্পগুলোই একটি ভাষা ও সংস্কৃতিকে আগাইয়া লইয়া যায়, কিছু লোক পাঁচিল ভাঙিতে গিয়া আহত হয় বলিয়াই বহু লোক উন্মুক্ত প্রান্তরে পদচারণার স্বাদ পাইয়া থাকে। সদ্যপ্রয়াত নবারুণ ভট্টাচার্য তাহার ঘোরতর প্রতিষ্ঠানবিরোধী স্বকীয়তায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন।
নবারুণের মতো শক্তিশালী লেখকের প্রয়াণ বাংলার দ্রোহসংস্কৃতিকে আরও স্তিমিত করিবে।’
আরেকটি কাগজ, আজকাল লিখেছে, ‘ফ্যাতাড়ু’র স ষ্টা, স্বতন্ত্র ভাবনার সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য প্রয়াত। বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। বেশ কিছু দিন ধরেই অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে অসুস্থ ছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিট নাগাদ ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এদিন তার মরদেহ রাখা হয় পিস হাভেনে। আজ, শুক্রবার সকাল ৯টায় তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ক্রিক রো-তে গণসংস্কৃতি পরিষদের দফতরে। এখান থেকে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া ঘুরে শোকযাত্রা তার গলফ গ্রিনের বাসভবন হয়ে যাবে কেওড়াতলা শ্মশানে। ওখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। তার বাবা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব প্রয়াত বিজন ভট্টাচার্য, মা মহাশ্বেতা দেবী। নবারুণ ভট্টাচার্য রেখে গেলেন মা, স্ত্রী প্রণতি ভট্টাচার্য, পুত্র তথাগত ও অসংখ্য অনুরাগীকে। তার মৃত্যুতে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে শোকের ছায়া। ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন বহরমপুরে তার জন্ম। ছোট থেকেই নাটক, সিনেমা, সাহিত্যের প্রতি তার টান ছিল তীব্র। ছোটবেলায় ঋত্বিক ঘটকের শুটিংয়ে একবার যে রিফ্লে’র ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন, এ কথা বলতে তিনি গর্ব অনুভব করতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। কলেজ স্ট্রিটের স্টুডেন্টস হলে অঙ্গন নাট্যে একসময় অভিনয় করেছেন নিয়মিত। ’৭৩ থেকে ’৯১ পর্যন্ত ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন। কবিতা দিয়েই তার সাহিত্যজীবন শুরু। পরবর্তীকালে গদ্যেই তার মনোযোগ ছিল বেশি। তার সৃষ্ট ‘ফ্যাতাড়ু’র তুল্য নজির বাংলা সাহিত্যে নেই। ‘হারবার্ট’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যার জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৯৭ সালে। এই উপন্যাসের জন্যই পেয়েছেন বঙ্কিম ও নরসিংহ দাস পুরস্কারও। তার কবিতা লেখার ভাষাও ছিল স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ তার বিখ্যাত কবিতার বই। তার গদ্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’, ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক’, ‘হারবার্ট’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘হালালঝাণ্ডা ও অন্যান্য’ উল্লেখযোগ্য। এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার নতুন গল্পগ্রন্থ ‘আংশিক চন্দ্রগ্রহণ’। তার প্রবন্ধের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আনাড়ির নাড়িজ্ঞান’ ও ‘অ্যাকোয়ারিয়াম’। তার ফ্যাতাড়ু প্রথম মঞ্চে আসে সংস্কৃতির প্রযোজনায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ২০০৪ সালে। তার পর সুমন মুখোপাধ্যায় তার ‘কাঙাল মালসাট’কে মঞ্চস্থ করেন। এই কাহিনী নিয়ে সুমন চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। ‘হারবার্ট’ও চলচ্চিত্রায়িত করেছেন সুমন। তারই পরিচালনায় সদ্য মঞ্চে এসেছে নবারুণ ভট্টাচার্যের নাটক ‘যারা আগুন লাগায়’। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকা। দশ বছর মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশের পর কিছু দিন আগে ‘ভাষাবন্ধন’কে তিনি ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রকাশ করা শুরু করেন। তার লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিনেই। প্রধানত তিনি লিটল ম্যাগাজিনেরই লেখক ছিলেন। সব সময়েই অন্য ভাষার সন্ধান করেছেন। বিকল্প লেখালেখিকে জায়গা করে দিতেই তার ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকার সূচনা। পাঠক-ভোলানো ফর্মুলার লেখা থেকে সততই শতহস্ত দূরে থেকেছেন তিনি। নিজস্ব ভাবনা এবং ভাষাই তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, যা থেকে তিনি কখনও নিজেকে সরিয়ে নেননি।
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত