আজ ১৮ আগষ্ট কবি ও ফ্যাশন ডিজাইনার প্রগতি বৈরাগী একতারা’র জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
মা,তোমাকে
মাঝরাতে কাঁটাতার পেরিয়ে এসেছিলো বছর উনিশের রোগা মেয়েটা, মিলিটারি কালি মাখা গর্ভিনী একটা দেশ, ভাঙা প্রেম, টুকরো খোয়াব আর অস্থির একাত্তর পেছনে ফেলে। টিনের বাক্সে ছিল দাঙ্গার আগুনে একরাতে সর্বস্বান্ত বাবার বোবা অসহায়তা,মায়ের ভেজা আঁচলে লুকোনো ভীতু চাউনি,ভাইবোনেদের অবুঝ ক্ষিদে আর ভাঙলেও না মচকানো শিরদাড়া ভরা জেদ।
তারপর এঘাটা,ওঘাটা,কুমির কামটের হা এড়িয়ে দিশেহারা ভাসতে ভাসতে মেয়ে বোঝে দেশ হারালেও,পায়ের তলার মাটি হারানো চলবেনা। চেনা মুখ অচেনা হয়, আত্মীয়জন আবছায়া। মেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে,নখে মাটি আঁকড়ে লড়াই করে। পায়ের নীচের বসুমতী,মাথার উপরের সুয্যিঠাকুর আর “একলা চলো” বোলে রবীন্দ্রনাথ তাকে সঙ্গ দেন। ছোট্ট একটা চাকরি পায় মেয়ে, সাধে আর আলহাদে, ঘামে আর ভালবাসায় ছেনে একটুকরো ঘর বাঁধে।পুরোনো প্রেম ফিরে আসে সিঁদুর রঙ হয়ে। কিন্তু জীবন তো আর রূপকথা নয়, কিছু স্বপ্ন সত্যি হয় আর বেশিরভাগটাই অলীক সিলাইবুনাই। মেয়ে ঠিকভুল যাপন করে, তার বয়স বাড়ে, চোখের কোনে আলতো ভাঁজ, রগ ঘেষে রুপোলি ঝলক, কিন্ত মেয়ে লড়াই ছাড়েনা।
মা,…আমার কিছুতেই হার না মানা মা, আজ চারপাশটা যখন খুব দ্রুত বুড়ো আর ধূসর হয়ে যাচ্ছে, তোমার পয়ষট্টি বছরের চোখের ভাঁজে আজও ঝলসায় সেই উনিশের জেদ। আমার সব কবিতা, সব গল্পের নায়িকা তুমি। আমার নায়িকা, সে তোমার মতই, ঠিক যেন এক যোদ্ধা রাজকুমারী, যে রাঁধে, চুল বাঁধে, অফিস যায়, খরচা বাঁচাতে নিজে ঘুঁটে দেয় আর সন্ধেবেলা তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে মেয়েকে গোর্কির “মা”-এর গল্প শোনায়, কখনো “কচদেবযানী” আবৃত্তি করে।
আজ আমি তো্মার থেকে হাজার মাইল দূ্রের শহরে। আমার বয়সও প্রায় তিরিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু তোমার “আমি তো আছি”-এর নরম ওম আজও আমায় আদরে মুড়ে দেয়। আমি জানি মা, তুমি সবসময় থাকবে না, শীতের দুপুরের রোদও তো একসময় আবছা হয়। কিন্তু যাবার আগে,আমায় তোমার ভেতরের ওই রোদটা দিয়ে যেও মা আর তোমার ওই হাজার ঝড়ঝাপটেও না নুয়ে পড়া শিরদাড়াটা।
”সেসবই অলীক পরনকথা”
ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠেই সে লেপের মধ্যে একটা গুহা বানিয়ে ফেলতো, মুখটা শুধু বের করে দেখে নেওয়া, মা এতক্ষণে অফিস, দিদি স্কুলে, বাপী কোথায় কে জানে! বাইরে চড়াই শালিকের কিচিরকিচ, রান্নাঘরে দিদিমাসী পাশের বাড়ির বেড়ালটাকে বকাবকি করে মাছ কাটতে বসেছে। এসময় দিদিমাসীর হাতের আঙুল উপেন্দ্রকিশোরের মেছোভূতের মতো ঠাণ্ডা থাকে, ভিজে ন্যাকড়ার মতো আর আঁশ আঁশ গন্ধ। সাড়া পেয়ে কোলে নিতে আসার আগেই সে লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে,
মোজা আর উলিকটের পাজামা পরে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
বারান্দা ভাসিয়ে দিচ্ছে কমলালেবুর কোয়া ফেটে যাওয়া রঙের রোদ্দুর।
দিদিমাসী গরমজল আর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়, হাতে ধরিয়ে দেয় দুধের গ্লাস আর বানরুটি। অর্ধেক খেয়ে গ্লাস সরিয়ে রাখে সে, রুটি থেকে খুঁটে খুঁটে তোলে লাল সবুজ কিশমিশের টুকরো। রুটির লোভে উড়ে আসা ঘাড়কাত কাকেদের জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি দ্রিঘাংচু? তুমি? তুমি?”।
তারপর এদিকওদিক দেখে গ্রীলের দরজা খোলা। এত সকালে বাগানের মাঝখানে কুয়াশা ঢিবি হয়ে থাকে, তার সোয়েটারের গলা দিয়ে শীত ঢুকে পড়ছে। চকচকে লেবুপাতায় দানা দানা শিশির, যেন সোনার গাছে হীরের পাতা আর মুক্তোর ফল।
সে রুটির টুকরো ফেলতে ফেলতে এগোয়, এই জঙ্গলেই কোথাও আছে ডাইনি বাবা ইয়াগার পিঠে আর চকোলেটের বাড়ি। কাঠঠোকরা গাছ খুঁড়ছে ‘কটোরকটোর’ করে, শুকনো পাতায় এলোমেলো, ভাঙাচোরা শব্দ, এইমাত্র তার মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল একটা সাদা ছোট্ট পাখি, জঙ্গলের ভিতর থেকে আওয়াজ আসে, ‘উঁউঁ’, বুড়োমানুষের গানের মতো, সে নিঃশ্বাস চেপে একটু একটু এগোয়…
‘উঁ উঁ উঁ উঁ” পাম্পের একটানা আওয়াজে ঘুম ছিঁড়ে যায়, দূরে কোথাও মাইকে শিবস্তোত্র বাজছে। নীচের তলায় বাচ্চা মেয়েদুটি আজ আবার কিছু নিয়ে গলা তুলে ঝগড়া করছে। তার দরজা জানালা আঁটসাঁট ঘরে সকালের আলো ঢোকেনা, টিউবের ফ্যাটফেটে সাদায় জমাট বেঁধে থাকে রুমহিটারে সেঁকা গতরাতের বোঁদা বাতাস। আধবোজা চোখে মোবাইলে সময় দেখে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামতে যায়, চটি খুঁজে পায়না, ঠাণ্ডা মেঝে ‘ছ্যাৎ’ করে ওঠে পায়ের পাতায়, কুঁকড়ে যাওয়া আঙুলে।
অবিদ্যা
তোমাদের লেখা হোক কোমলগান্ধারে
তোমাদের ঝিলপাড়ে, আলো দিক উড়ন্ত হাউই প্রাকমধুকাল ঘেঁষে ডানা মেলে তোমাদের বাড়ি
মফঃস্বল, এ শিলাটি জায়মান মেঘ
প্রেমিকের ভ্রমজাত বিষাদঈশ্বরী
আলাপে ধারালো দিও
চাষ আবাদের দেশে ফলপ্রসূ আত্মপরিচয়
উঁবু হও প্রান্ত ছুঁয়ে… যেরকম বেতাব ঈশ্বর
তবে আর যাই করো…
মৃতশষ্প, কবুল ছুঁড়ো না
ডাহুক পরবর্তী উপকথা
সেসব ডাহুক পরবর্তী উপকথা
আজকাল আর লিখি না আমি
বেকুবের মত এক কলম কালি নিয়ে
লিখতে বসেছিলাম নিডর কিষাণির উপাখ্যান
জোয়ানমদ্দ স্বামী, ভরা পোয়াতি ক্ষেত,
গাইবকনা, ডগমগ সংসার ফেলে
কোমরে ভিস্তী আর নুনমরিচ চুলে বেগুনী প্যাঞ্জি গুঁজে
সে মরুভূমি পেরোতে চেয়েছিল,
শুকিয়ে ওঠা মরুদ্যানের বিষন্ন ছোকরা গাছটির
গোড়া নিকিয়ে দেবে বলে
শেষটা কি যে হল…
গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়লো মরুঝড়, পুরনো কাঁটাঝোপ
ছেঁড়া কলিজা আর কি ভীষণ রক্তারক্তি !!
সে সব থেকে কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছি আমি
আজকাল শুধু বিধিসম্মত মৌলিক গল্প লিখি
কচি গাছেদের সাথে যেমন আরো কচি ফুলেল লতার প্রেম
তারপর, সেলাই করা বাঁদিক ঘেঁষে
হাত বুলিয়ে বলি “ঘুমোও উপকথা, ঘুমোও”
নির্লিপ্তি এবং
যেহেতু মিলিত ফসলকথা নিয়ত অসম্ভব ছিল –
আকুল বর্ষণ শেষে, বহনীয় ভাঙনেরা এলে
আমরা নিজস্ব মাটি আঁকড়ে ধরলাম
কেন শুধু রক্তপাত, মরা নদীখাতে –
তার থেকে সহনীয়
নিরাসক্ত চৌকাঠ, ধানদূর্বা, আগ্নেয়মাস
একহাতে অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট, অন্যহাতে জন্মনিরোধক
চাপ দিয়ে দেখে নিই, কে বেশি আপন
তোমার শব্দে মুখ ডুবিয়েছে স্রোতস্বিনীরা
নিশিপাওয়া কথাবার্তা শুনে ইদানীং
আলো হচ্ছ, নেচে উঠছে নাবালক ভুরু
আহা, তারা বেঁচে থাক, সুখী হোক খুনসুটিসম অর্গাজমে।
আমি সেই ভাঙনের, আরো ঘোর ভাঙনের মুখে
পতন সামলে নিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিই,
শীতার্ত ঠোঁটে, উদাসীন ধার মেখে রাখি
তবু মৃদু কথাকথি হলে, নিষেধ পাথরখানি এখনও গড়িয়ে যায়
ঋতুরক্ত দ্বিতীয়ার প্লাবন আছড়ে আসে, সর্বনাশের ঘ্রাণে
ভরপুর লীলায়িত নদী, আকাঠ নাবিক আমি
ভেবে নিচ্ছি অনিষ্ট হবে না
দাঁড়খানি ফেলে রেখে উঠে দাঁড়িয়েছি
ফেরার উপায় নেই, হলে হোক এই শেষ ঝাপ
সোহাগী জলের মত গাঢ় হয়ে থেকো…
জীবন হে, যতখন পারো ধরে রাখো!