/poetry-daughters-of-afghanistan-literary-voices

আফগান নারীদের প্রতিরোধের কবিতা: অদিতি ফাল্গুনী

Reading Time: 4 minutes

(ভূমিকা: আফগানিস্তান আবার সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রের শিরোনাম। কাবুল থেকে কান্দাহার, হেরাত থেকে গজনী সবার মুখে মুখে আলোচনায় ফিরছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তালিবান ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে আফগান নারীর জীবনের সম্ভাব্য বদলের বিষয়টি। রক্ষণশীল আফগানিস্তানে নারীর জীবন কি আরো দূর্বিষহ হয়ে উঠবে? এই প্রেক্ষাপটে সাত জন আফগান নারী কবির কবিতার অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো):

 

 

আফগানিস্তানের কন্যারা

নাদিয়া আঞ্জুমান

আমার নিজের মুখ খোলার কোন বাসনা নেই। আমি কি আবৃত্তি করব?

যে আমি আমার বয়সের জন্য ধিক্কৃত হব, সে আমি আবৃত্তি করি আর নাই করি!

আমি কিভাবে গাইব মধুর গান? এই গান আমার জিহ্বায় পরিণত হয়েছে বিষে-

পৃথিবীর সেরা স্বৈরাচারীর প্রতি রইলো অভিশাপ যিনি আমার মুখ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।

এই পৃথিবীকে আশীর্ব্বাদ করো যেখানে আমার

বিষাদ ভাগাভাগি করার কেউ নেই

সে আমি হাসি বা কাঁদি, বাঁচি বা মরি

আমি এবং এই কারাগার: আমার বাসনাকে

কোণে ঠেলতে ঠেলতে নাই করে দেয়া হয়েছে।

আমি জন্মেছি ব্যর্থতা থেকে, জন্মেছি শুধুই নি:শব্দকৃত হতে।

হৃদয়! আমি জানি বসন্ত চলে গেছে, এবং তার আনন্দও

কিন্তু কিভাবেই বা আমি উড়তাম আমার ছিঁড়ে যাওয়া দুই ডানায়?

যদিও সবটা সময় নীরব, আমি ঘনিষ্ঠভাবে শুনেছি:

আমার হৃদয় আজো ফিসফিস করে গায় তার গান,

আর নিজের জন্ম প্রতি মূহুর্তে জন্ম দেয় নতুন কাউকে না কাউকে।

একদিন আমি ভেঙ্গে ফেলব এই খাঁচা, এর নিজস্ব নৈ:শব্দ্য

আমি পান করব আনন্দের মদিরা, গাইব গান যেভাবে একটি পাখি

গায় তার বসন্তদিনে।

একটি কোমল তরু হয়েও, আমি কাঁপব না প্রতিটি বাতাসের শিহরণে

আমি এক আফগান কন্যা- আমি বাজাব আমার ফাগান, বুনব তাকে চিরায়থ অনন্তে।


*ফাঘাম হলো এক ধরণের আর্তনাদ, পরিতাপ ও বেদনার এক ধরণের প্রকাশ, এই আফগান শব্দটি ইংরেজি অনুবাদে যথাযথ অবিকৃত রাখা হয়েছে যাতে মূল কবিতার শব্দের খেলা খানিকটা হলেও প্রতিফলিত হয়।




 

সূর্যের মৃত্যু

পারউইন পাজওয়াক

 

এবং

ঠিক সেখানেই,

সূর্য শীতল হয়ে গেছিল

নক্ষত্ররা পতিত হয়েছিল, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন

পৃথিবীর উপরে তারা পতিত হয়েছিল

অতল সব গহ্বর পোড়াতে পোড়াতে

অতল সেই যত গহ্বর প্রতিধ্বনিত করেছে

শুন্যতা

তার ক্ষুব্ধ ক্রন্দনধ্বনি।

এবং এখন:

অন্ধকার।

আশার পাতাগুলো সব ঝরে পড়েছে।

বাতাসের সাথে সাথে মেধাও হারিয়ে গ্যাছে

অপূরিত

পাখিগুলোকে জবাই করা হয়েছে

তারপর গিলে খাওয়া হয়েছে তাদের

অসংখ্য বইয়ের স্তÍপ ধোঁয়া আর ছাইয়ে

পরিণত হয়েছে

শুধু যাতে ঘরগুলো আর একটু গরম রাখা যায়।

এখানে, শান্ত গাছগুলো শেকড়সুদ্ধ উপড়ানো হয়েছে,

তাদের ক্ষীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিশুদের পেটানোর লাঠিতে

বদলে গেছে,

এখানে, চিন্তাগুলো মনের নির্বাসিত কুঠুরী

পরিত্যাগ করার কথা ভাবার সাহসও করেনি।


তোমরা যারা আশা বৃক্ষ থেকে একটিও পাতা ছেঁড়োনি:

তোমরা কি কখনোই অন্ধকারের সমুদ্র থেকে

আলোর একটি সেতু বানাবে?

ওহ, তোমরা যারা তোমাদের সত্ত্বার ভুববেন বন্দী,

তোমরা কি কখনো, কখনোই ছুটবে আলোর দিকে?

 



‘পার্থিব পংক্তিমাল‘ থেকে, ফরুঘ ফারোখজাদ (১৯৩৫-১৯৬৭)।




সন্ধ্যা পাঁচটায়

খালেদা ফরুঘ

আমাদের সময়

সবসময়ই হয়েছে সন্ধ্যা পাঁচটা

কখনোই ভোর পাঁচটা নয়।

আমার স্মৃতির পরিষ্কার জলরাশি

কখনোই ভুলবেনা:

নারীর চলা-ফেরাই আমাদের সময়ের

সবচেয়ে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

গোধূলির ঘ্রাণ, বিষাদ-গন্ধ মাখা।

একটি পাহাড়ের বাঁক

আমার ভেতরে রূপ নেয়

এবং আমি প্রচন্ড জোরে কাঁদি,

আর যেহেতু আমিরাত জুড়ে দীর্ঘ ক্রন্দন করি

প্রতিটি রাতই যেন ভেঙ্গে যায়

আমার কান্নার শব্দে।

এই নগরী যেন এক বিবর্ণ কান্না

ক্লান্ত

আমাদের নলখাগড়ার বাড়িগুলো

এর শব্দরা নিজেদের মধ্যে ভাঁজ হয়,

আর দেয়ালগুলোকে খুঁচিয়ে জাগ্রত করে

যদিও তারা, নিজেরাই,

ঘুমের ভেতর ডুবে যাচ্ছে।

এবার, বৃষ্টি বইছে ঘূর্ণিব্যত্যায়

এবং ভাবনা-চিন্তাহীন

গাছের শাখা-প্রশাখাকে খাওয়াচ্ছে দোল।

নলখাগড়া,

কাউকে না কাউকে নিশ্চিত

বাজাতে হবে একাকী নলখাগড়ার বাঁশী।

 




 

পাখিদের নৈ:শব্দ্য

নাদিয়া ফজল

আহ!

তুমি কি অনুভব করছো পাখিদের নৈ:শব্দ্য?

তুমি কি দেখছো তাদের দৃষ্টি?

জেলের গরাদের ভেতর থেকে চালানো গুলি

রাতের অন্ধকারে

যেন বা খোদ রাত্রির হৃদয়ে

ছোঁড়া একটির পর একটি তির

 





আরো পড়ুন: অনুবাদ কবিতা: আফগানিস্তানের নারী কবির কবিতা


 

কাবুলের জন্য

ফায়েঘে জাওয়াদ মোহাজের

হে আমার তপ্ত, আকাশহীন শহর

আমি প্রেমে পরিপূর্ণ,

আর ভরা চাঁদের আলোয়

এই রাত পূর্ণ করুক

তোমার শান্ত স্থিরতার পোড়ো জমি

এবং তোমার রাত পূর্ণ করুক

অনন্তের সবটুকু

তোমার জানুদ্বয়

শৌর্যরহিত

তোমার ক্ষোভ, পুড়ছে

আর পোড়াচ্ছে আমাকে

হে আমার মহিমান্বিত প্রেম,

আমি তোমাকে চিনি-

তুমি আমার সর্বস্ব সুন্দর।

আমাকে দাও তোমার শক্ত, কড়া পড়া হাত,

আমাকে দাও তোমার হাত, হে আমার প্রেম

এখন এসো, এসো

জেগে ওঠো!




 

পর্দা

বাহার সাঈদ

এই অবগুণ্ঠন আমাকে লুকোতে পারে না, যেহেতু আমার চুল-

তার সামান্য আভাস- আমাকে নগ্ন হিসেবে চিত্রিত করবে না।

আমিই সূর্য। পর্দার কাপড়ের ভেতর দিয়ে আমি ঝলমল করি।

বোরখার নেকাব আমার আলো লুকাতে পারে না,

পারে না পৃথিবীর অন্ধকারতম আঁধার আমাকে লুকোতে।

সত্যিকারের পূণ্যবান পুরুষ আমাকে পর্দা করতে বলবে না

যদি না সে বড্ড বেশি ধার্মিক আর দূর্বল, নাজুক না হয়!

হে আমার দেশের পথবাসী!

আমাকে বলো, কিভাবে আমার চুল তোমাদের

অধ:পাতে নিয়ে যায়?

আমি তোমাদের বিক্রি করা জ্ঞানে কোন কান্ডজ্ঞান খুঁজে পাই না:

তোমরা যারা আমার সাথে অন্যায় করেছো,

তাহলে আমি কেন নরকের আগুনে পুড়ে মরবো?

আমার সতী হবার কোন শখ নেই, তোমাদের দূর্বল পদযুগলের জন্য

হে পুরুষেরা, আমার মাথা নত করতে আমি রাজি নই।

হে খোদার চর পুরুষেরা! আমার মুখে থেকে তোমাদের দৃষ্টি ফেরাও।

যাও আমার সামনে থেকে আর লুকাও তোমাদের সত্ত্বার দূর্বলতা-

পর্দা দিয়ে ঢাকো তোমাদের দূর্বল ঈমানকে।




 

শাশ্বতের চিহ্ন

লেয়লা সেরাহাত রোশানী

আমার ভেতরে

তুমি যেন একটি আয়না

অস্তিত্বের মতই প্রসারিত,

সজীব ও বসন্তের মতই নির্মল।

আয়নায় আমি আমার চোখ দু‘টো বপন করিযেন একটি ছোট্ট এবং

সবুজ কিছু দেখা দেয়,

যে কিনা ঘোষণা করবে

বসন্তের শাশ্বতী তনু।

গণিকার বিষাদে

ফারাংগিজ সৌগান্দ

সে শুধুমাত্র নিজের কাছে এক ঘন্টা ধরে হাসে

কোন গণিকার রেখে যাওয়া নি:শ্বাসে।

তারপর, কাঁপতে কাঁপতে, সে জোরে চেঁচায়

যেন কোন পতিতার ভয়ার্ত বিষাদ।

একটি মূহুর্তের জন্য সে আয়নার দিকে তাকায়:

সেখানে সে নেই। এবং সেখানে সে রয়েছে ধূলোর ভেতরে

একজন পতিতার পৃথিবীর ধূলো।

প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা

বলিষ্ঠ বাহুতে ধৃত

সে তবু কাঁদে এক গণিকার কান্না।

সে বদলে যায় এক বৃশ্চিকে,

নিজেই নিজেকে দংশন করে, কাঁদে

আর তারপর এক পতিতার জন্য

ভাবে প্রতিকারের কথা।

মৃত্যু, নগরীর অন্য কোথাও

খেলায় ব্যস্ত

সে হাসে এক রূপোপজীবীনীর ভেজা চোখে।

শরতের বিদায় নেবার সাথে সাথে, আর একটি

গল্প থেকে যাচ্ছে অকথিত:

আমি আমার জন্মদিন কাটিয়েছি

কাটিয়েছি এক গণিকার বিষাদে।

 



Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>