বিশ্ব কবিতা দিবস: পঁয়ত্রিশ কবির কবিতামালা
ষোল আনাই মিছে
ফুল নেয়া ভাল নয়
জসীম উদ্দীন
বিদায়-বেলায়
কাজী নজরুল ইসলাম
আমাদের ছোট নদী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
শামসুর রাহমান
দূরের পাল্লা
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ছিপখান তিন-দাঁড় –
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল-জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল |
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে|
চুপ চুপ – ওই ডুব
দ্যায় পান্ কৌটি
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বৌটি!
ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো|
তিন-দাঁড় ছিপখান
মন্থর যাচ্ছে,
তিনজন মাল্লায়
কোন গান গাচ্ছে?
রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি|
মুখখানি মিষ্টিরে
চোখদুটি ভোমরা
ভাব-কদমের – ভরা
রূপ দেখ তোমরা !
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী!
ডাক পাখী ওর লাগি’
ডাক ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম|
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে|
দুইতীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে|
আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ|
পান বিনে ঠোঁট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালী-ধান-ভানা
রূপ দেখ তোমরা
* * * *
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো –
সাত সতেরো কোপ কোপানো|
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থমকে গেল|
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল|
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে|
* * * *
আর জোর দেড় ক্রোশ –
জোর দের ঘন্টা,
টান ভাই টান সব –
নেই উত্কণ্ঠা|
চাপ চাপ শ্যাওলার
দ্বীপ সব সার সার,
বৈঠৈর ঘায়ে সেই
দ্বীপ সব নড়ছে,
ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
জল-গায় চড়ছে|
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ! বকশিশ!
খুব জোর ডুব-জল
বয় স্রোত ঝিরঝির,
নেই ঢেউ কল্লোল,
নয় দুর নয় তীর|
নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফুর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফুর্তি|
ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
ঝাউ-গাছ দুলছে,
ঢোল-কলমীর ফুল
তন্দ্রায় ঢুলছে|
লকলক শর-বন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক –
সন্ধ্যার লগ্ন|
চারদিক নিঃসাড়,
ঘোর-ঘোর রাত্রি,
ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
চারজন যাত্রি|
* * * *
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে –
স্বপন পানে পরাণ টানে|
তারায় ভরা আকাশ ওকি
ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
লুটিয়ে পল আচম্বিতে
কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!
* * * *
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি|
কোথায় এল নৌকাখানা
তারার ঝড়ে হই রে কাণা,
পথ ভুলে কি এই তিমিরে
নৌকা চলে আকাশ চিরে!
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা!
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা|
তারায় আজি ঝামর হাওয়া-
ঝামর আজি আঁধার রাতি,
অগুনতি অফুরান তারা
জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি|
কালো নদীর দুই কিনারে
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে?
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে –
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে|
বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;
বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা|
চোখে কেমন লগছে ধাঁধা –
লাগছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হল
কিম্বা জোনাক হল তারা|
নিথর জলে নিজের ছায়া
দেখছে আকাশ ভরা তারায়,
ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
জলে জোনাক দিশে হারায়|
দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!
কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
জোনাক কোথা হয় সুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
চোখ যে আলা রতন উঁছে|
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে’,
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!
আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
একলা ছোটে বন বাদাড়ে
ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, ভাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে|
বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!
শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে|
ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
ধরছে কারা মাছগুলোকে!
চলছে তরী চলছে তরী –
আর কত পথ? আর ক’ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি –
ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
দেখছ আলো? ঐতো কুঠি
ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
রাতের মতন আজকে ছুটি|
ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
গুরগুর মেঘ সব
গায় মেঘ মল্লার,
দূর-পাল্লার শেষ
হাল্লাক্ মাল্লার!
আঠারো বছর বয়স
সুকান্ত ভট্টাচার্য
যাত্রা-ভঙ্গ
নির্মলেন্দু গুণ
ফেরীঅলা
হেলাল হাফিজ
এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে
তসলিমা নাসরিন
আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য
হুমায়ুন আজাদ
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।
গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না
হুমায়ূন আহমেদ
দুজন
জীবনানন্দ দাশ
সেই গল্পটা
পূর্ণেন্দু পত্রী
হঠাৎ নীরার জন্য
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।
দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।
এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।
বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
বাড়িতে আসবেন!’
রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়।
বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই
মহাদেব সাহা
ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
আমার ভিতরে কোথায় নেমেছে ধস,
কোথায় নেমেছে ঘোর কালো!
দেখো আমার ভেতরে এখন প্রবল গ্রীষ্মকাল
খরা আর খাদ্যের অভাব; ভালো করে চেয়ে দেখো
আমার ভিতরে সমস্ত কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন, ভগ্ন ও ব্যথিত
ঠিক যে আঁধার তাও নয় মনে হয় মধ্যাহ্নে অকালসন্ধ্যা
অস্তমিত সকল আলোর উৎস;
ভালো আছি বলি কিন্তু ভিতরে যে লেগেছে হতাশা
লেগেছে কোথাও জং আর এই মরচে-পড়া লোহার নিঃশ্বাস
গোলাপ ফুটতে গিয়ে তাই দেখো হয়েছে ক্রন্দন,
হয়েছে কুয়াশা!
আমি কি অনন্তকাল বসে আছি, কেন তাও তো জানি না
চোখে মুখে উদ্বেগের কালি, থেকে থেকে ধূলিঝড়
আতঙ্কের অন্তহীন থাবা; ভিতরে ভীষণ গোলযোগ
ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
ভিতরে কেমন কোলাহল উদ্যত মিছিল
ঘন ঘন বিক্ষুব্ধ শ্লোগান, ডাক-তার-ব্যাঙ্ক ধর্মঘট
হরতালপ্লাবিত দেখো আমার ভিতরে এই এভেন্যু ও পাড়া,
হঠাৎ থমকে আছে ব্যস্ত পথচারী যেন কারফিউতাড়িত
আমার ভিতরে এই ভাঙাচোরা, দ্বন্দ্ব ও দুর্যোগ;
দেখো অনাহারপীড়িত শিশু
দেখো দলে দলে দুর্ভিক্ষের মুখ
ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
ভিতরে কী অস্থির উন্মাদ, ভিতরে কী নগ্ন ছেঁড়া ফাড়া!
যদি ভালবাসা পাই
রফিক আজাদ
মেঘবালিকার জন্য রূপকথা
জয় গোস্বামী
অবনী বাড়ি আছো
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আদর
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
শঙ্খ ঘোষ
অমলকান্তি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
আলো
মলয় রায়চৌধুর
পরানের গহীন ভিতর-১২
সৈয়দ শামসুল হক
শম্ভু রক্ষিতওখানে বাণিজ্য জাহাজরা নোঙর ফেলে। দরিদ্র এক মানুষ
. ভগ্নস্তূপ দ্যাখে। সর্বপ্রাচীন বাড়ি ধ্বংস হয়ে আসে
. সুস্থ করে গাছের পাতা। অন্ধপ্রথাগুলি
দাবি জানায়। মানুষ জাতি পারিশ্রান্ত স্বপ্নচারী প্রান্তর
. বা জলরাশি অগ্নিময় হৃদয়ের পারে নেমে আসে।
. মেঘের শুকনো আনাগোনা বিদ্যুতের সিরসিরানির
. সঙ্গে অন্তরীক্ষের শেষ খেলা দূরে সরে যায়
. কৃষ্ণবর্ণ অরণ্যের অন্তরালে ঘ্রাণময় হ্রদে
. আমার হৃদয় স্বপ্নে মুগ্ধ হয়
জরা-মৃত্যুর পাশে ভিড় করা গাছের মধ্যে
. উন্মুস্ত উদার সূর্যালোক এসে দাঁড়ায়
. বক্ষের প্রতঙ্গ নড়ে এবং মৃদু হয়ে ভাসে বিষণ্ণতা।
আমার স্মৃতি নেই, আমি বিদ্বেষ কলহের
. অন্তঃসার বুকে নিয়ে বৃদ্ধ হয়ে আছি
আজ দেখি, অসংখ্য হিমাদ্রি-মত্যুভয়গুলি
. একাদিন দুহাত দিয়ে বেঁধেছিল আমায়
আমায় ধরে থাকে অনন্ত সুচিরমৃত শোভন পৃথিবী
আমার একাকী পাখি আমার মধ্যে বিশ্রাম রাখে চিরকাল
মেঘে মাস্তুলে চিহ্নিত একটি সান্ধ্য আকাশ, জলে সূর্যাস্তের আভা
. ত্রিশ কোটি অসহায় ছেলের কাছে বসে ক্ষমা চাই
হে জনচিহ্নহীন, দিশাহীন ছড়ানো যৌগিক পরাজয়
. স্বর্ণধরণীর মধ্যে সবুজের বৈষম্য হয়ে আসা দেখি
মধুর জীবিত শীত নিয়ে যে-লোকটা গুঁড়ি মেরে আসছে
. ও ওখানে দাঁড়িয়ে নেই
. ওকে চিরমুক্ত সৃজনব্রতে নামতে দাও
ভূগর্ভের পাথর খুঁড়ে ও একবার তাপময় নির্জনতা
. গ্রাস করেছিল
অসভ্যদাদাবাবুদেরবাড়ি
মণীন্দ্র গুপ্ত
কসবা-পঞ্চাননতলা থেকে মেয়েরা এসে বাড়ির কাজ করে যায়।
রমণী চাটুজ্যে স্ট্রীটের এই শেষ বাড়িটা হচ্ছে অসভ্য দাদাবাবুদের।
মেয়েরা টিপে টিপে হাসে, চোখ মটকে ইঙ্গিত করে :
অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি।
স্বাধীন চার বাইয়ের ছটা বড় বড় ঘর। মাঝে মাঝে কাজিনরা
এসে রাত কাটিয়ে যায়,
অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি জেন মঠের মতো চুপচাপ।
এ বাড়ি কি মহেশ যোগীর কোনো আর্কিটেক্টের করা?
স্পাইরাল গ্যালাক্সির মতো অচিন্ত্যনীয় সিঁড়ি…
আড়ি পাতার জন্য ছোট ছোট ফোকর আছে দেয়ালে…
সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় গোপন সুড়ঙ্গ থেকে হাওয়া এসে
শাড়ি উতলা করে…
ধ্যানঘরে অন্ধকার— হার্ট লাং ব্রেন সার্জারি টের না পাওয়া
চেতনালুপ্ত অন্ধকার…
রান্নাঘরে অনেক রকমের যন্ত্রপাতি— দাদাবাবুরা
কোনো কথা বলে না, হাতে ধরে রান্না শেখায়।
চার ভাই মিলে অনেক মাইনে দেয়— মেয়েটির
সন্দেহপুলক জন্মে : অসভ্যই যদি না হবে তো এত মাইনে দেবে কেন?
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘটবে ঘটবে করে কিছুই ঘটে না,
তাই আরো ভয় করে : যেন অদৃশ্য স্তম্ভের মাথায়
বাজ চিল ঈগল কণ্ডর বসে আসে— স্তব্ধ,
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে— ঝপ করে মাছটিকে ধরে নিয়ে
নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ বসে বসে খাবেই একদিন।
নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক্ষা, আধ্যাত্মিকতা, আত্মসমর্পণ।
জীবনেও চাই
যে একবার চলে যায়,
সে কি বার বার ফিরে আসে?
পাহাড়ের বুক থেকে তীব্র জলপ্রপাতের
অজস্র ঝর্ঝর,
একঘেয়ে নামতা পড়ার সুরে বৃষ্টি টিপটিপ,
জুঁইফুল ফুটে ওঠবার কান্না,
আর
আমার রক্তের স্রোতে তাকে শুনতে পাই।শব্দে আসে, দৃশ্যে তো আসে না।
আমি তাকে স্পর্শে, গন্ধে, নীলাকাশে, সমীরণে—
জীবনেও চাই।
কবিতা বুঝিনি আমি
বিনয় মজুমদার
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে –
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি-সব ; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।
তোমার ক্ষমায় স্নাত
অমিতাভ দাশগুপ্ত
মেঘের খোঁপায় ফুটেছে আলাের ফুল,
তােমাকে কি দেব অনন্য উপহার ?
কোন ঘাটে পার
হ’তে চেয়েছিলে খুঁজে অনুকুল হাওয়া,
নাবিক বাছাে নি, এ-নৌকো বেয়ে যায় কি সুদূরে যাওয়া
ভাবাে নি, নরম অঞ্জলি মেলে ফুল
ভাসালে জোয়ারে রাজহাঁস বলে – সব ভুল, সব ভুল!
কেবল কথায় বহে গেল বেলা
জল ঝরে গেল মেঘে,
বুকের গভীরে কি শঙ্কা ছিল জেগে
বলে নি বাচাল মুখ,
কথার সাঁকোয় হৃদয়ের আসা-যাওয়া
হয় নি, সমুসুক
অধীরতা প্রাণে এসে ফিরে গেছে পাহাড়তলির হাওয়া।
এখন জেনেছাে, নীরবতা কত ভালাে,
ক্ষীণ সম্বল নিবিড় আঁচলে ঢেকে দিলে, অনুপমা,
বুঝেছ, আমার সকলই চাতুরি, ছল-
জলপ্রপাতে ধাবিত তােমার চোখের তরল ক্ষমা।
যদি স্পর্শ করি
রাজলক্ষ্মী দেবী
অগ্নিবলয়ের মতো,-একে একে পার হবো আগে।
যেন স্পর্শে হৃদয়ের মূল ধ্রুবপদখানি থাকে,
– বিশ্বাস করি না আমি বিবিধ ঝংকার, ঐকতান।
ঋজুচোখে দেখতে যদি পাই হৃদয়ের মেরুদেশ,
অকম্পিত পদে হাঁটি হৃদয়ের বিষুবরেখায়,
যদি না লুণ্ঠিত হই শত বৎসরের পরিখায়,
– যদি ছেড়ে দিতে পারি বিবিধ ভণিতা, ছদ্মবেশ।
ততোদিন মুক্ত তুমি, ততোদিন ফেরো ইচ্ছাসুখে,
ততোদিন প্রৌঢ়া হও বাসনার রসদ কুড়িয়ে ।
স্পর্শগুলি আস্বাদন করতে হয় সস্নেহে জুড়িয়ে,
এমন উত্তাপ আছে প্রত্যেক রোমকূপের মুখে ।
যদি স্পর্শ করি, তবে সহস্র বর্ষের যোগফল
শূন্য হবে । পার হবো স্বর্গ-নরকের মধ্যপথ ।
সূর্য-চন্দ্রে ব্যবধান, সে তো শুধু অংগুলিবিঘত ।
যদি স্পর্শ সত্য হয়,- সোনা হবে লোহার শিকল।।
যেন কেউ মন্ত্রী হয়ে
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যেন কেউ মন্ত্রী হয়ে এইসব মানুষের প্রেম, মানবতা
কিনে নেয়, যেন দুর্ভিক্ষের বাংলা মন্ত্রীদের সোনার থালায়
পায়েস খাওয়াবে ব’লে এই সব খবরের কাগজের বার্তাবহদের
জলশাঘরে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
এরা ভুলে যায়
দু’দিন আগেও অন্য প্রভুদের বাহবায় কীভাবে কেটেছে ভোর থেকে সন্ধ্যা।
ভুলে যায় বিশ বছর জন্মভূমির দিকে পিঠ রেখে অন্ধকার রাত্রির আড়ালে
গুপ্তচর, খুনী, গুণ্ডাদের সঙ্গে খানাপিনা, যখন তখন ককটেল পাটি ;
অতি–ভোজনের শেষে কীভাবে সামলাতে হ’তো ছিড়ে যাওয়া প্যান্টের বোতাম।
এরা খবরের কাগজের সাংবাদিক :
ভুলে যায়, নিরন্নের বাংলাদেশ মন্ত্রীর মুখের শোভা নয়, অন্ন চায়…
ভুলে যায়, বাংলার মানুষ আজ আগুনের পথ হাঁটছে।
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব- প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে- আমি চুপ করে বসে থাকি- অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা- তারপর হঠাৎ
সব মোমবাতি ভোজবাজীর মত নিবে যায় একসঙ্গে- উৎসবের দিন
হাওয়ার মত ছুঁতে যায়, বাঁশির শব্দ
আর কানে আসে না- তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয়- জলের ভেতর- শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিঃশ্বাস নিই সারাক্ষণ- ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মত না, আলো না, স্বপ্ন না- পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশঃ- ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন- আমার ভালো লাগে না- শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব
একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম
জানলার কাছে- চারদিক অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না সেদিন- সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম- চুলে, দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার-
এখন আমি মানুষের মত না- রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার- ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নীচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না- আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি এখন- যে দিক দিয়ে আসি, সে দিকেই দৌড় দি
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব।
তোমার নাগকেশর
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
অনেক খুঁজে ফুটপাতের দোকানে পেয়ে যাই
তোমার ‘নাগকেশর’
জীর্ণ মলাট, উইপোকারা এসে
আমার প্রিয় কবিতাগুলি থেকে
মুছে দিয়েছে দু-তিনটি অক্ষর
ঠাকুর দেখতে গিয়েছে কারা সপ্তমীতে শ্রাবণধারায় ভেসে –
অন্যদিকে কবিরা আজ ব্যস্ত আছে তোমার অনুল্লেখে
একমাত্তর আমিই বুঝি পিছুটানের অাঁজলকাজল মেঘে
তোমার বেঁচে-থাকার পথের স্টেশনগুলো গুনতে-গুনতে চলি;
নদীয়া আর বরানগর, বনহুগলি, হিন্দুস্থান পার্ক
শহর এসে এখানে হলো সময়হীন শ্যামল শহরতলি
আর যখুনি আমার মাথায় তোমার নাগকেশর
ঝরতে থাকে আশ্বিনের শীতে
ছুটতে থাকি নবনীতার সঙ্গে সেটার সিংহভাগ নিতে –
সে আছে ঠিক উল্টোদিকেই
‘ভালোবাসা’-অঙ্কিত বাড়িতে!
ফুল ফুটুক না ফুটুক
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে –
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে –
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত–তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল –
ঠিক সেই সময় চোখের
মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল;
আ মরণ ! পোড়ারমুখ
লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।
