| 19 মার্চ 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

বিশ্ব কবিতা দিবস: পঁয়ত্রিশ কবির কবিতামালা

আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট

 

ষোল আনাই মিছে

সুকুমার রায়

 

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে, 
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে? 
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?” 
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে। 
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি, 
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।” 
 
খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে 
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে? 
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?” 
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?” 
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি 
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!” 
 
আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো, 
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো? 
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?” 
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?” 
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,- 
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।” 
 
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে, 
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে! 
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি, 
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?” 
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু, 
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু? 
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, 
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”

ফুল নেয়া ভাল নয়

জসীম উদ্‌দীন

ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে।
ফুল নিলে ফুল দিতে হয়, –
ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়।
যারা ফুল নিয়ে যায়,
যারা ফুল দিয়ে যায়,
তারা ভুল দিয়ে যায়,
তারা কুল নিয়ে যায়।
তুমি ফুল, মেয়ে! বাতাসে ভাঙিয়া পড়
বাতাসের ভরে দলগুলি নড়নড়।
ফুলের ভার যে পাহাড় বহিতে নারে
দখিনা বাতাস নড়ে উঠে বারে বারে।
ফুলের ভারে যে ধরণী দুলিয়া ওঠে,
ভোমর পাখার আঘাতে মাটিতে লোটে।
সেই ফুল তুমি কেমনে বহিবে তারে,
ফুল তো কখনো ফুলেরে বহিতে নারে।

বিদায়-বেলায়

কাজী নজরুল ইসলাম

তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
       জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
   ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
       শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।
   হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
   আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
    ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ
     দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
     চলার তোমার বাকী পথটুকু-
     পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-
   হায়,  অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,
       ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।
 
    দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি
      তব ব্যথা কেউ বোঝে না,
        তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,
     পথে ফেরে যারা পথ-হারা,
     কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,
     বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?
   দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?
   এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!
    তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায় 
     কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
    আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-
     পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
   কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
      মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
   ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।

আমাদের ছোট নদী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে 
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। 
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি, 
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি। 

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, 
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। 
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক, 
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। 

আর-পারে আমবন তালবন চলে, 
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে। 
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে 
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে। 

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে 
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে। 
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে, 
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে। 

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর 
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। 
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, 
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। 
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, 
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

 

 

 

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

শামসুর রাহমান

 

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
 
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
 
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
 
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
 
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

দূরের পাল্লা

 সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ছিপখান তিন-দাঁড় – 
তিনজন মাল্লা 
চৌপর দিন-ভোর 
দ্যায় দূর-পাল্লা! 
         পাড়ময় ঝোপঝাড় 
         জঙ্গল-জঞ্জাল, 
         জলময় শৈবাল 
         পান্নার টাঁকশাল | 
কঞ্চির তীর-ঘর 
ঐ-চর জাগছে, 
বন-হাঁস ডিম তার 
শ্যাওলায় ঢাকছে| 
         চুপ চুপ – ওই ডুব 
         দ্যায় পান্ কৌটি 
         দ্যায় ডুব টুপ টুপ 
         ঘোমটার বৌটি! 
ঝকঝক কলসীর 
বক্ বক্ শোন্ গো 
ঘোমটার ফাঁক বয় 
মন উন্মন গো| 
         তিন-দাঁড় ছিপখান 
         মন্থর যাচ্ছে, 
         তিনজন মাল্লায় 
         কোন গান গাচ্ছে? 
রূপশালি ধান বুঝি 
এইদেশে সৃষ্টি, 
ধুপছায়া যার শাড়ী 
তার হাসি মিষ্টি| 
         মুখখানি মিষ্টিরে 
         চোখদুটি ভোমরা 
         ভাব-কদমের – ভরা 
         রূপ দেখ তোমরা ! 
ময়নামতীর জুটি 
ওর নামই টগরী, 
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে 
জল হোলো গোখরী! 
         ডাক পাখী ওর লাগি’ 
         ডাক ডেকে হদ্দ, 
         ওর তরে সোঁত-জলে 
         ফুল ফোটে পদ্ম| 
ওর তরে মন্থরে 
নদ হেথা চলছে, 
জলপিপি ওর মৃদু 
বোল বুঝি বোলছে| 
         দুইতীরে গ্রামগুলি 
         ওর জয়ই গাইছে, 
         গঞ্জে যে নৌকা সে 
         ওর মুখই চাইছে| 
আটকেছে যেই ডিঙা 
চাইছে সে পর্শ, 
সঙ্কটে শক্তি ও 
সংসারে হর্ষ| 
         পান বিনে ঠোঁট রাঙা 
         চোখ কালো ভোমরা, 
         রূপশালী-ধান-ভানা 
         রূপ দেখ তোমরা 

*        *        *        * 
   
পান সুপারি! পান সুপারি! 
এইখানেতে শঙ্কা ভারি, 
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে 
চলরে টেনে বৈঠা হেনে; 
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে 
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে 
বুক দে টানো, বইটা হানো – 
সাত সতেরো কোপ কোপানো| 
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো 
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো 
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে 
লোক দেখে কি থমকে গেল| 
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে 
রাত্রি এল রাত্রি এল| 
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে 
ফিরছে কারা মাছের পাছে, 
পীর বদরের কুদরতিতে 
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে| 

*        *        *        * 
     
আর জোর দেড় ক্রোশ – 
জোর দের ঘন্টা, 
টান ভাই টান সব – 
নেই উত্কণ্ঠা| 
         চাপ চাপ শ্যাওলার 
         দ্বীপ সব সার সার, 
         বৈঠৈর ঘায়ে সেই 
         দ্বীপ সব নড়ছে, 
         ভিল্ ভিলে হাঁস তায় 
         জল-গায় চড়ছে| 
ওই মেঘ জমছে, 
চল্ ভাই সমঝে, 
গান গাও দাও শিশ, 
বকশিশ! বকশিশ! 
         খুব জোর ডুব-জল 
         বয় স্রোত ঝিরঝির, 
         নেই ঢেউ কল্লোল, 
         নয় দুর নয় তীর| 
নেই নেই শঙ্কা, 
চল্ সব ফুর্তি, 
বকশিশ টঙ্কা, 
বকশিশ ফুর্তি| 
         ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়, 
         ঝাউ-গাছ দুলছে, 
         ঢোল-কলমীর ফুল 
         তন্দ্রায় ঢুলছে| 
লকলক শর-বন 
বক তায় মগ্ন, 
চুপচাপ চারদিক – 
সন্ধ্যার লগ্ন| 
         চারদিক নিঃসাড়, 
         ঘোর-ঘোর রাত্রি, 
         ছিপ-খান তিন-দাঁড়, 
         চারজন যাত্রি| 

*        *        *        * 
   
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে 
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে 
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে – 
স্বপন পানে পরাণ টানে| 
        তারায় ভরা আকাশ ওকি 
        ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে 
        লুটিয়ে পল আচম্বিতে 
        কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে! 

*        *        *        * 
   
কেবল তারা! কেবল তারা! 
শেষের শিরে মানিক পারা, 
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি 
কেবল তারা যেথায় চাহি| 
        কোথায় এল নৌকাখানা 
        তারার ঝড়ে হই রে কাণা, 
        পথ ভুলে কি এই তিমিরে 
        নৌকা চলে আকাশ চিরে! 
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা! 
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়, 
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায় 
জোনাক যেন পন্থা-হারা| 
        তারায় আজি ঝামর হাওয়া- 
        ঝামর আজি আঁধার রাতি, 
        অগুনতি অফুরান তারা 
        জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি| 
কালো নদীর দুই কিনারে 
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে? 
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে – 
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে| 
        বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে 
        পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা; 
        বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে 
        ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা| 
চোখে কেমন লগছে ধাঁধা – 
লাগছে যেন কেমন পারা, 
তারাগুলোই জোনাক হল 
কিম্বা জোনাক হল তারা| 
        নিথর জলে নিজের ছায়া 
        দেখছে আকাশ ভরা তারায়, 
        ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে 
        জলে জোনাক দিশে হারায়| 
দিশে হারায় যায় ভেসে যায় 
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে? 
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্ 
এক হয়ে যেথায় মেশে রে! 
        কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর 
        জোনাক কোথা হয় সুরু যে 
        নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা 
        চোখ যে আলা রতন উঁছে| 
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে 
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে’, 
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে 
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে! 
        আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা 
        আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা 
        একলা ছোটে বন বাদাড়ে 
        ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে; 
সাপ মানে না, ভাঘ জানে না, 
ভূতগুলো তার সবাই চেনা, 
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে 
রণরণিয়ে হনহনিয়ে| 
        বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া, 
        কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া, 
        জাগছে হাওয়া জলের ধারে, 
        চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে! 
শুকতারাটি আজ নিশীথে 
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে, 
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে 
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে| 
        ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া, 
        মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে; 
        রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে 
        ধরছে কারা মাছগুলোকে! 
চলছে তরী চলছে তরী – 
আর কত পথ? আর ক’ঘড়ি? 
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী, 
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি – 
        ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্ 
        দেখছ আলো? ঐতো কুঠি 
        ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই 
        রাতের মতন আজকে ছুটি| 
ঝপ ঝপ তিনখান 
দাঁড় জোর চলছে, 
তিনজন মাল্লার 
হাত সব জ্বলছে; 
        গুরগুর মেঘ সব 
        গায় মেঘ মল্লার, 
        দূর-পাল্লার শেষ 
        হাল্লাক্ মাল্লার!

 

 

আঠারো বছর বয়স

সুকান্ত ভট্টাচার্য

 

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
 
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
 
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।
 
আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।
 
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।
 
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
 
তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
 
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।

 

 

যাত্রা-ভঙ্গ

নির্মলেন্দু গুণ

 

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷
 
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷
 
তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷
 
তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷
 
নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷
 
তুই কেমন করে যাবি?

 

ফেরীঅলা

হেলাল হাফিজ

 

কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
 
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
 
ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
 
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
 
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
 
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।

এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে

তসলিমা নাসরিন

কী হচ্ছে আমার এসব!
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?
বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?
আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?
সভা সমিতিতে যেতে?
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।
মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।
মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।
 
তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,
মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি
স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,
আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,
ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি
আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন
এত প্রেম কেউ দেয়নি,
এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।
তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!
কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?
যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি
আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা
যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,
মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,
স্বপ্নই মনে হয়।
তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।

 

আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য

হুমায়ুন আজাদ

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।

আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট  কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।

 

 

 

গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না

হুমায়ূন আহমেদ

 

প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগী হবার মত জ্যোৎস্না কি উঠেছে ?
বালিকা ভুলানো জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্নায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে-
ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ !
নবদম্পতির জ্যোৎস্নাও নয়।
যে জ্যোৎস্না দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন-
দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর !
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্না বাসি স্মৃতিপূর্ন ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জ্যোৎস্না নয়। যে জ্যোৎস্না দেখে কবি বলবেন-
কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ !
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।
যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়।

 

 

 

দুজন

জীবনানন্দ দাশ

 

‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
 
দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;
 
যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–
 
প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

সেই গল্পটা

পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিল মেঘকে
আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
 
সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘেকে বললে
আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
আজ তোমাকে স্মান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।
 
ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনেরআগুনে
পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
ওঠ্ ছুড়ি! তোর বিয়ে।
 
এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতো পারো
পাহাড়টার হাড় পাঁজর,
ভিতরে থৈ থৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।

হঠাৎ নীরার জন্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

 

বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল

                                   স্বপ্নে বহুক্ষণ

দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–

বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে

তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের

নীল দুঃসময়ে।

 

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি

আজই কি ফিরেছো?

স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন

তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে

তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,

অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।

 

এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম

ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়

বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা

নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি

এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে

বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে

পুণ্যবান হবো।

 

বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,

                                   বাড়িতে আসবেন!’

 

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।

‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে

কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে

সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন

ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে

পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়।

 

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।

 

 

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

 

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই

মহাদেব সাহা

 

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

আমার ভিতরে কোথায় নেমেছে ধস,

কোথায় নেমেছে ঘোর কালো!

দেখো আমার ভেতরে এখন প্রবল গ্রীষ্মকাল

খরা আর খাদ্যের অভাব; ভালো করে চেয়ে দেখো

আমার ভিতরে সমস্ত কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন, ভগ্ন ও ব্যথিত

ঠিক যে আঁধার তাও নয় মনে হয় মধ্যাহ্নে অকালসন্ধ্যা

অস্তমিত সকল আলোর উৎস;

ভালো আছি বলি কিন্তু ভিতরে যে লেগেছে হতাশা

লেগেছে কোথাও জং আর এই মরচে-পড়া লোহার নিঃশ্বাস

গোলাপ ফুটতে গিয়ে তাই দেখো হয়েছে ক্রন্দন,

হয়েছে কুয়াশা!

আমি কি অনন্তকাল বসে আছি, কেন তাও তো জানি না

চোখে মুখে উদ্বেগের কালি, থেকে থেকে ধূলিঝড়

আতঙ্কের অন্তহীন থাবা; ভিতরে ভীষণ গোলযোগ

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

ভিতরে কেমন কোলাহল উদ্যত মিছিল

ঘন ঘন বিক্ষুব্ধ শ্লোগান, ডাক-তার-ব্যাঙ্ক ধর্মঘট

হরতালপ্লাবিত দেখো আমার ভিতরে এই এভেন্যু ও পাড়া,

হঠাৎ থমকে আছে ব্যস্ত পথচারী যেন কারফিউতাড়িত

আমার ভিতরে এই ভাঙাচোরা, দ্বন্দ্ব ও দুর্যোগ;

দেখো অনাহারপীড়িত শিশু

দেখো দলে দলে দুর্ভিক্ষের মুখ

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

ভিতরে কী অস্থির উন্মাদ, ভিতরে কী নগ্ন ছেঁড়া ফাড়া!

 

 

 

যদি ভালবাসা পাই

রফিক আজাদ

যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি
যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি
যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাব
যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো
আর সমুদ্র সাঁতরাবো
যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল
যদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও পাব
মধ্য অন্তমিল।

 

 

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা

জয় গোস্বামী

 

আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতুহলে
‘এই ছেলেটা, নাম কি রে তোর?’
আমি বললাম, ফুস মন্তর
মেঘবালিকা রেগেই আগুন,
মিথ্যে কথা, নাম কি অমন হয় কখনো?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই হয়, আগে আমার গল্প শোনো
সে বলল, শুনবো না যাঃ, সেই তো রাণী সেই তো রাজা
সেই তো একই ঢাল তলোয়ার
সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে
শুনবো না আর ওসব বাজে।
আমি বললাম, তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে।
সে বলল, সত্যি লিখবি! বেশ তাহলে মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে? লিখেই কিন্তু আমায় দিবি।
আমি বললাম, তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী।
 
লিখতে লিখতে লেখা যখন সবে মাত্র দু চার পাতা
হঠাৎ তখন ভুত চাপলো আমার মাথায়
খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার মেঘের মাঠে
গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে
একজনকে মনে হল ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই
তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?
সে বলেছে, মনে তো নেই। আমার ওসব মনে তো নেই
আমি বললাম, তুমি আমায় লেখার কথা বলেছিলে।
সে বলল, সঙ্গে আছে? ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে।
আর হ্যা, শোন, এখন আমি মেঘ নই আর
সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।
বলেই হঠাৎ এক পশলায় আমায় পুরো ভিজিয়ে দিয়ে
অন্য অন্য বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়, দূরে দূরে…।
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….আপন মনে বলতে বলতে
আমিই কেবল বসে রইলাম ভিজে এক-সা কাপড় জামায়
গাছের তলায় বসে রইলাম
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য…
 
এমন সময় অন্য একটি বৃষ্টি আমায় চিনতে পেরে বলল
তাতে মন খারাপের কি হয়েছে?
যাও ফিরে যাও-লেখ আবার
এখন পুরো বর্ষা চলছে, তাই আমরা সবাই এখন নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত
তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে।
বর্ষা থেকে ফিরে আমরা নিজেই যাব তোমার কাছে।
 
এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম গহিন বনে
সঙ্গী শুধু কাগজ কলম
একাই থাকব, একাই দুটো ফুটিয়ে খাব
ধুলোবালি দু এক মুঠো যখন যারা আসবে মনে
তাদের লিখব, লিখেই যাব।
এক পৃথিবীর একশ রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য থাকবে যে রূপকথার
সে রূপকথা আমার একার।
 
ঘাড় গুজে দিন লিখতে লিখতে
ঘাড় গুজে রাত লিখতে লিখতে
মুছেছে দিন মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত অসাড় হল
মনে পড়ল, সাল কি তারিখ, বছর কি মাস
সেসব হিসেব আর রাখি নি।
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতাও শেষ করিনি।
 
সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল খাতার উপর, আজীবনের লেখার উপর
বাইরে তখন গাছের নিচে নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ গাছ ও গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি
এই অরণ্যে কবির জন্যে আমরা থাকি
বলছে ওরা, কবির জন্য আমরা কোথাও, আমরা কোথাও, আমরা কোথাও হার মানিনি।
 
কবি তখন কুটির থেকে, তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে মাঠের পরে নদীর পরে
সেই যেখানে সারা জীবন বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেউ যায়নি, কেউ যায় না কোনদিনই
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝর্ণা তলায়
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী
কিশোর বেলার সেই হরিণী।

 

 

 

অবনী বাড়ি আছো

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
 
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
 
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?’

 

 

আদর

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 

মরুভূমি মাঝে যেন, একই কুসুম,
পূর্ণিত সুবাসে।
বরষার রাত্রে যেন, একই নক্ষত্র,
আঁধার আকাশে ||
নিদাঘ সন্তাপে যেন, একই সরসী,
বিশাল প্রান্তরে।
রতন শোভিত যেন,  একই তরণী,
অনন্ত সাগরে।
তেমনি আমার তুমি, প্রিয়ে, সংসার-ভিতরে ||
 
চিরদরিদ্রের যেন, একই রতন,
অমূল্য, অতুল।
চিরবিরহীর যেন, দিনেক মিলন,
বিধি অনুকূল ||
চিরবিদেশীর যেন, একই বান্ধব,
স্বদেশ হইতে।
চিরবিধবার যেন, একই স্বপন,
পতির পীরিতে।
তেমনি আমার তুমি, প্রাণাধিকে, এ মহীতে ||
 
সুশীতল ছায়া তুমি, নিদাঘ সন্তাপে,
রম্য বৃক্ষতলে।
শীতের আগুন তুমি, তুমি মোর ছত্র,
বরষার জলে ||
বসন্তের ফুল তুমি, তিরপতি আঁখি,
রূপের প্রকাশে।
শরতের চাঁদ তুমি, চাঁদবদনি লো,
আমার আকাশে।
কৌমুদীমুখের হাসি, দুখের তিমির নাশে ||
 
অঙ্গের চন্দন তুমি, পাখার ব্যজন,
কুসুমের বাস।
নয়নের তারা তুমি, শ্রবণেতে শ্রুতি,
দেহের নিশ্বাস ||
মনের আনন্দ তুমি, নিদ্রার স্বপন,
জাগ্রতে বাসনা।
সংসার সহায় তুমি, সংসার-বন্ধন,
বিপদে সান্ত্বনা।
তোমারি লাগিয়ে সই, ঘোর সংসার-যাতনা ||

 

 

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

শঙ্খ ঘোষ

 

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
 
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
 
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
 
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
 
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

অমলকান্তি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

 

অমলকান্তি আমার বন্ধু,

ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।

রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,

শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে

এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,

দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

 

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।

অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।

সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!

ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,

জাম আর জামরুলের পাতায়

যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

 

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।

সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।

মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;

চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”

আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

 

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,

অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,

যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,

উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।

অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।

সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে

ভাবতে-ভাবতে

যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

 

 

 

আলো

মলয় রায়চৌধুর

 

আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁসেঁতে ধুলো-পড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুনি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার
কষ বেয়ে রক্ত গড়াতে থাকে টের পাই
আবার তীব্র আলো মুহূর্তে জ্বলে উঠে নিভে যায়
গরম লোহার রড খালি পিঠে মাংস ছেঁচে তোলে
আমাকে ল্ষ করে চারিদিক থেকে আলো ঝলসে ওঠে ফের
আপনা থেকেই চোখ কুঁচকে যায় দেখতে পাই না কাউকে
একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্যে নিজেকে তৈরি করে নিই।

পরানের গহীন ভিতর-১২

সৈয়দ শামসুল হক

 

উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,
শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,
পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,
তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,
আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,
গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,
গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,
দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।
একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?
একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?
যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,
এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?
ও ওখানে দাঁড়িয়ে নেই
শম্ভু রক্ষিত
ওখানে বাণিজ্য জাহাজরা নোঙর ফেলে। দরিদ্র এক মানুষ
.        ভগ্নস্তূপ দ্যাখে। সর্বপ্রাচীন বাড়ি ধ্বংস হয়ে আসে
.        সুস্থ করে গাছের পাতা। অন্ধপ্রথাগুলি
দাবি জানায়। মানুষ জাতি পারিশ্রান্ত স্বপ্নচারী প্রান্তর
.        বা জলরাশি অগ্নিময় হৃদয়ের পারে নেমে আসে।
.                মেঘের শুকনো আনাগোনা বিদ্যুতের সিরসিরানির
.                সঙ্গে অন্তরীক্ষের শেষ খেলা দূরে সরে যায়
.        কৃষ্ণবর্ণ অরণ্যের অন্তরালে ঘ্রাণময় হ্রদে
.                আমার হৃদয় স্বপ্নে মুগ্ধ হয়
জরা-মৃত্যুর পাশে ভিড় করা গাছের মধ্যে
.                উন্মুস্ত উদার সূর্যালোক এসে দাঁড়ায়
.        বক্ষের প্রতঙ্গ নড়ে এবং মৃদু হয়ে ভাসে বিষণ্ণতা।
আমার স্মৃতি নেই, আমি বিদ্বেষ কলহের
.        অন্তঃসার বুকে নিয়ে বৃদ্ধ হয়ে আছি
আজ দেখি, অসংখ্য হিমাদ্রি-মত্যুভয়গুলি
.        একাদিন দুহাত দিয়ে বেঁধেছিল আমায়
আমায় ধরে থাকে অনন্ত সুচিরমৃত শোভন পৃথিবী
আমার একাকী পাখি আমার মধ্যে বিশ্রাম রাখে চিরকাল
মেঘে মাস্তুলে চিহ্নিত একটি সান্ধ্য আকাশ, জলে সূর্যাস্তের আভা
.        ত্রিশ কোটি অসহায় ছেলের কাছে বসে ক্ষমা চাই
হে জনচিহ্নহীন, দিশাহীন ছড়ানো যৌগিক পরাজয়
.        স্বর্ণধরণীর মধ্যে সবুজের বৈষম্য হয়ে আসা দেখি
মধুর জীবিত শীত নিয়ে যে-লোকটা গুঁড়ি মেরে আসছে
.                ও ওখানে দাঁড়িয়ে নেই
.        ওকে চিরমুক্ত সৃজনব্রতে নামতে দাও
ভূগর্ভের পাথর খুঁড়ে ও একবার তাপময় নির্জনতা
.                                        গ্রাস করেছিল


অসভ্যদাদাবাবুদেরবাড়ি

মণীন্দ্র গুপ্ত

কসবা-পঞ্চাননতলা থেকে মেয়েরা এসে বাড়ির কাজ করে যায়।

রমণী চাটুজ্যে স্ট্রীটের এই শেষ বাড়িটা হচ্ছে অসভ্য দাদাবাবুদের।

মেয়েরা টিপে টিপে হাসে, চোখ মটকে ইঙ্গিত করে :

অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি।

স্বাধীন চার বাইয়ের ছটা বড় বড় ঘর। মাঝে মাঝে কাজিনরা

এসে রাত কাটিয়ে যায়,

অসভ্য দাদাবাবুদের বাড়ি জেন মঠের মতো চুপচাপ।

 

এ বাড়ি কি মহেশ যোগীর কোনো আর্কিটেক্টের করা?

স্পাইরাল গ্যালাক্সির মতো অচিন্ত্যনীয় সিঁড়ি…

আড়ি পাতার জন্য ছোট ছোট ফোকর আছে দেয়ালে…

সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় গোপন সুড়ঙ্গ থেকে হাওয়া এসে

শাড়ি উতলা করে…

ধ্যানঘরে অন্ধকার— হার্ট লাং ব্রেন সার্জারি টের না পাওয়া

চেতনালুপ্ত অন্ধকার…

রান্নাঘরে অনেক রকমের যন্ত্রপাতি— দাদাবাবুরা

কোনো কথা বলে না, হাতে ধরে রান্না শেখায়।

চার ভাই মিলে অনেক মাইনে দেয়— মেয়েটির

সন্দেহপুলক জন্মে : অসভ্যই যদি না হবে তো এত মাইনে দেবে কেন?

ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘটবে ঘটবে করে কিছুই ঘটে না,

তাই আরো ভয় করে : যেন অদৃশ্য স্তম্ভের মাথায়

বাজ চিল ঈগল কণ্ডর বসে আসে— স্তব্ধ,

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে— ঝপ করে মাছটিকে ধরে নিয়ে

নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ বসে বসে খাবেই একদিন।

নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক্ষা, আধ্যাত্মিকতা, আত্মসমর্পণ।

 

 

জীবনেও চাই

দেবারতি মিত্র

যে একবার চলে যায়,
সে কি বার বার ফিরে আসে?
পাহাড়ের বুক থেকে তীব্র জলপ্রপাতের
অজস্র ঝর্ঝর,
একঘেয়ে নামতা পড়ার সুরে বৃষ্টি টিপটিপ,
জুঁইফুল ফুটে ওঠবার কান্না,
আর
আমার রক্তের স্রোতে তাকে শুনতে পাই।

শব্দে আসে, দৃশ্যে তো আসে না।
আমি তাকে স্পর্শে, গন্ধে, নীলাকাশে, সমীরণে—
জীবনেও চাই।

 

 

 

কবিতা বুঝিনি আমি 

বিনয় মজুমদার

কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে –
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি-সব ; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।

 

তোমার ক্ষমায় স্নাত 

অমিতাভ দাশগুপ্ত

 মেঘের খোঁপায় ফুটেছে আলাের ফুল,
তােমাকে কি দেব অনন্য উপহার ?
কোন ঘাটে পার
হ’তে চেয়েছিলে খুঁজে অনুকুল হাওয়া,
নাবিক বাছাে নি, এ-নৌকো বেয়ে যায় কি সুদূরে যাওয়া
ভাবাে নি, নরম অঞ্জলি মেলে ফুল
ভাসালে জোয়ারে রাজহাঁস বলে – সব ভুল, সব ভুল!

কেবল কথায় বহে গেল বেলা
জল ঝরে গেল মেঘে,
বুকের গভীরে কি শঙ্কা ছিল জেগে
বলে নি বাচাল মুখ,
কথার সাঁকোয় হৃদয়ের আসা-যাওয়া
হয় নি, সমুসুক
অধীরতা প্রাণে এসে ফিরে গেছে পাহাড়তলির হাওয়া।

এখন জেনেছাে, নীরবতা কত ভালাে,
ক্ষীণ সম্বল নিবিড় আঁচলে ঢেকে দিলে, অনুপমা,
বুঝেছ, আমার সকলই চাতুরি, ছল-
জলপ্রপাতে ধাবিত তােমার চোখের তরল ক্ষমা।

 

 

 

 

যদি স্পর্শ করি 

রাজলক্ষ্মী দেবী

যদি স্পর্শ করি,- তবে সহস্র বর্ষের ব্যবধান, –
অগ্নিবলয়ের মতো,-একে একে পার হবো আগে।
যেন স্পর্শে হৃদয়ের মূল ধ্রুবপদখানি থাকে,
     – বিশ্বাস করি না আমি বিবিধ ঝংকার, ঐকতান।
        ঋজুচোখে দেখতে যদি পাই হৃদয়ের মেরুদেশ,
         অকম্পিত পদে হাঁটি হৃদয়ের বিষুবরেখায়,
         যদি না লুণ্ঠিত হই শত বৎসরের পরিখায়,
         – যদি ছেড়ে দিতে পারি বিবিধ ভণিতা, ছদ্মবেশ।
ততোদিন মুক্ত তুমি, ততোদিন ফেরো ইচ্ছাসুখে,
ততোদিন প্রৌঢ়া হও বাসনার রসদ কুড়িয়ে ।
স্পর্শগুলি আস্বাদন করতে হয় সস্নেহে জুড়িয়ে,
এমন উত্তাপ আছে প্রত্যেক রোমকূপের মুখে ।
        যদি স্পর্শ করি, তবে সহস্র বর্ষের যোগফল
        শূন্য হবে । পার হবো স্বর্গ-নরকের মধ্যপথ ।
        সূর্য-চন্দ্রে ব্যবধান, সে তো শুধু অংগুলিবিঘত ।
        যদি স্পর্শ সত্য হয়,- সোনা হবে লোহার শিকল।।

যেন কেউ মন্ত্রী হয়ে

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

যেন কেউ মন্ত্রী হয়ে এইসব মানুষের প্রেম, মানবতা

কিনে নেয়, যেন দুর্ভিক্ষের বাংলা মন্ত্রীদের সোনার থালায়

পায়েস খাওয়াবে লে এই সব খবরের কাগজের বার্তাবহদের

জলশাঘরে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

 

এরা ভুলে যায়

দুদিন আগেও অন্য প্রভুদের বাহবায় কীভাবে কেটেছে ভোর থেকে সন্ধ্যা।

ভুলে যায় বিশ বছর জন্মভূমির দিকে পিঠ রেখে অন্ধকার রাত্রির আড়ালে

গুপ্তচর, খুনী, গুণ্ডাদের সঙ্গে খানাপিনা, যখন তখন ককটেল পাটি ;

অতিভোজনের শেষে কীভাবে সামলাতে তো ছিড়ে যাওয়া প্যান্টের বোতাম।

 

এরা খবরের কাগজের সাংবাদিক :

ভুলে যায়, নিরন্নের বাংলাদেশ মন্ত্রীর মুখের শোভা নয়, অন্ন চায়

ভুলে যায়, বাংলার মানুষ আজ আগুনের পথ হাঁটছে।

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব- প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে- আমি চুপ করে বসে থাকি- অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা- তারপর হঠাৎ
সব মোমবাতি ভোজবাজীর মত নিবে যায় একসঙ্গে- উৎসবের দিন
হাওয়ার মত ছুঁতে যায়, বাঁশির শব্দ

আর কানে আসে না- তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয়- জলের ভেতর- শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিঃশ্বাস নিই সারাক্ষণ- ভালো লাগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মত না, আলো না, স্বপ্ন না- পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশঃ- ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন- আমার ভালো লাগে না- শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব

একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম
জানলার কাছে- চারদিক অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না সেদিন- সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম- চুলে, দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার-
এখন আমি মানুষের মত না- রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার- ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নীচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না- আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি এখন- যে দিক দিয়ে আসি, সে দিকেই দৌড় দি
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব।

তোমার নাগকেশর

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

 

অনেক খুঁজে ফুটপাতের দোকানে পেয়ে যাই

তোমার ‘নাগকেশর’

জীর্ণ মলাট, উইপোকারা এসে

আমার প্রিয় কবিতাগুলি থেকে

মুছে দিয়েছে দু-তিনটি অক্ষর

 

ঠাকুর দেখতে গিয়েছে কারা সপ্তমীতে শ্রাবণধারায় ভেসে –

 

অন্যদিকে কবিরা আজ ব্যস্ত আছে তোমার অনুল্লেখে

একমাত্তর আমিই বুঝি পিছুটানের অাঁজলকাজল মেঘে

তোমার বেঁচে-থাকার পথের স্টেশনগুলো গুনতে-গুনতে চলি;

নদীয়া আর বরানগর, বনহুগলি, হিন্দুস্থান পার্ক

 

 শহর এসে এখানে হলো সময়হীন শ্যামল শহরতলি

 

আর যখুনি আমার মাথায় তোমার নাগকেশর

ঝরতে থাকে আশ্বিনের শীতে

ছুটতে থাকি নবনীতার সঙ্গে সেটার সিংহভাগ নিতে –

সে আছে ঠিক উল্টোদিকেই

‘ভালোবাসা’-অঙ্কিত বাড়িতে!

 

ফুল ফুটুক না ফুটুক 

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে –
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে –
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।

গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত–তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।

লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল –

ঠিক সেই সময় চোখের
মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল;
আ মরণ ! পোড়ারমুখ
লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !

তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত