| 19 এপ্রিল 2024
Categories
রাজনীতি

রাজনৈতিক ফিচার: সাত বছরের সাতকাহন । শ্রীশুভ্র

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

সাত বছরের সাতকাহন শুরু করবো সামান্য একটি পরিসংখ্যান দিয়ে। খুবই ইনটারেস্টিং পরিসংখ্যান। আমাদের মনে হয় এই পরিসংখ্যানটুকুই ভারতবর্ষের মূল ভিত। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সাংসাদদের ভিতর ৩০% সাংসদই ছিল নানাবিধ ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত আসামী। কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছিল। মামলা শেষ না হওয়া অব্দি কোন অভিযুক্তকেই অপরাধী শাব্যস্ত করা যায় না। তেমনি তিনি নিরপরাধ, বলা যায় না এমন কথাও। এই ৩০% সাংসদ তাঁরাই যাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে খুন জখম ধর্ষণ ইত্যাদি নানান অপরাধ বিচারাধীন। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ভাষণে হবু প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিলেন। তাঁকে ক্ষমতায় বসালে তিনি সকল অভিযুক্ত সাংসদ বিধায়ক কাউন্সিলার পঞ্চায়েত সদস্যদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। এমনকি কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যাতে তাঁর দলের প্রার্থী হিসাবে টিকিট না পায়। সেটাও তিনি নিশ্চিত করবেন। অর্থাৎ আমরা বিশ্বাস করলাম দেশকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন দেওয়ায় তিনি ভারতবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর পরের ইতিহাস আরও রোমাঞ্চকর। সেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচিত সাংসদদের ভিতরে নানাবিধ ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত আসামীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হলো ৩৪%! এরপর পালাবদলের শাসন আমল শুরু হলো। ২০১৯ সালে পাঁচ বছর রাজত্ব পূর্ণ করে পুনরায় লোকসভা নির্বাচন। ২০১৯-এর সেই লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সাংসদদের ভিতর অভিযুক্ত অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হলো ৪৩%! এবং সব মামালাই চলছে চলবে। ঝুলে রয়েছে। ঝুলে থাকবে। আর এই ৪৩% অভিযুক্ত সাংসদদের ভিতরে শুধু শাসক দলেরই ১১৬ জন। মোট অভিযুক্ত সাংসদদের অর্ধেক! অতয়েব ২০১৯ এ গঠিত সপ্তদশ লোকসভায় এই ১১৬ জন অভিযুক্ত আসামীর সমর্থনেই পাশ হচ্ছে প্রতিটি আইন! যার ভিতরে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, তিন কৃষি আইন ২০২০, নতুন শ্রম আইন, নতুন শিক্ষা আইন ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয়ে গিয়েছে। আগামী সাড়ে তিন বছরে আরও হবে। তা হোক। কিন্তু আমাদের দেখার বিষয় একটাই। ২০০৯-২০১৪-২০১৯ লোকসভায় নির্বাচিত সাংসদদের ভিতরে ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত আসামীর সংখ্যা ৩০%-৩৪%-৪৩%! এইভাবে শ্রীবৃদ্ধি হলে আশা করা যেতেই পারে ২০২৪ এ নির্বাচন হলে, সংখ্যাটি ৫০% অতিক্রম করে যাবে। আমরা বলতে চাইছি। এটাই ভারতবর্ষের ভিত। ভারতের রাজনীতি শাসন ব্যবস্থা আইন প্রশাসন এবং সমাজ এই ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে। এবং অর্থনীতি! মানুষের প্রতিদিনের জীবনসংগ্রাম!

ফলে আমরা যারা ২০১৪ সালের সেই যুগান্তকারী প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেছিলাম। উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। আমরা আমাদের উপযুক্ত প্রাপ্যটুকু হাতে হাতেই পেয়ে গিয়েছি যে, সেই বিষয় আশা করি কারুর মনে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। এখন দেখা যাক। বিগত সাত বছরে ভারতবাসীর প্রাপ্তির ভাঁড়ারে আর কি কি সংযুক্ত হলো। উন্নয়নের ধারার স্বরূপটা ঠিক কি রকম। বিগত সাত বছরে সুইস ব্যাংকের একটি কালোটাকাও সরকার উদ্ধার করে নি। চেষ্টাও করে নি। এবং একজন ভারতীয়েরও ব্যাঙ্ক একাউন্টে পনেরো লাখ টাকা ঢোকে নি। উল্টে সরকারের স্বরাস্ট্রমন্ত্রী পনেরোলাখি প্রতিশ্রুতিকে তাদের ভাষায় নির্বাচনী জুমলা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। খুব ভালো। কথা ছিল মানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল। বছরে দুই কোটি সরকারী চাকরি দেওয়া হবে বেকার যুবক যুবতীদের। যে প্রতিশ্রুতিতে তাদের ভোটগুলি অধিকার করা হয়েছিল। বিগত সাত বছরে ১৪ কোটি বেকার যুবক যুবতীর সরকারী চাকরি হওয়ার কথা তাহলে। হলে দেশের অর্থনীতির হাল এবং জিডিপির বৃদ্ধি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোন হয়ে যেত। কিন্তু না তা হয় নি। ১৪ কোটি কেন পঞ্চাশ লক্ষ সরকারী চাকরি সৃষ্টি হয়েছে কিনা এই সাত বছরে। সে বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। উল্টে একই সময়পর্বে কয়েক কোটি সরকারী চাকুরিজীবী চাকরি খুইয়ে বেকার হয়ে গিয়েছেন। এবং এই সাত বছরে একের পর এক সরকারী প্রতিষ্ঠান হয় জলের দরে বিক্রী করা হয়েছে। নাহয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গড়ে ওঠেনি নতুন কোন সরকারী উদ্যোগ। দিনে দিনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে সরকারী উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বার্ষিক জিডিপির উপরে। এবং দৈনন্দিন অর্থনীতির উপরে। যার ফল আমরা সকলেই কম বেশি ভোগ করছি। করবো। করতেই হবে।

এবং লাইন! কতবার আমাদেরকে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে এই সাত বছরে? অনেকেই আমরা আর সেই হিসেব রাখতে পারি নি। মনে করে দেখলে দেখা যাবে এই লাইনে দাঁড়ানো ভারতবর্ষের চিত্রটা শুরু হয়েছিল রান্নার গ্যাসের ডিলারের দেকানের সমানে থেকে। গ্যাসের ভর্তুকি পেতে ব্যাংক একাউন্টের সাথে গ্যাসের রেজিস্ট্রেশনের সংযুক্তির লাইন দিতে হয়েছিল একবার ডিলারের দোকানে। একাবার ব্যাংকের কাউন্টারে। সেই শুরু। তারপর চার ঘন্টার নোটিশে নোটবাতিলের মহাপর্ব! আমরাও উদ্বুদ্ধ হলাম। জাল নোটের কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। টেররিজম বন্ধ হয়ে যাবে। কালোটাকার কারবারিরা সব ধরা পড়ে যাবে। সে এক হইহই রইরই ব্যাপার। দেশপ্রেমের আবেগে আমাদের লাইনে দাঁড়ানোর সব কষ্টই জল হয়ে গেল। যারা মারা পড়লো, তারা হয়তো ততটা দেশপ্রেমী ছিল না আমাদের মতোন। তাই হয়তো লাইনে দাঁড়ানোর কষ্টটা সহ্য করতে পারেনি। তা না পারুক। তাদের মৃত্যুতে দেশের কোন ক্ষতি হয় নি। কিন্তু সেদিন আমারা বুঝতে পারি নি। দেশের ঠিক কত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকায় যে অন্ধকার নামিয়ে আনলো এই নোটবাতিলের খেলা। তার থেকে দেশ আজও উঠে দাঁড়াতে পারে নি আর। কত মানুষ জীবিকা হারালো। কত মানুষ পথে বসে গেল। কিন্তু কালো টাকা উদ্ধার হলো কতো? রিজার্ভ ব্যাংকের দেওয়া সেই তথ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে মরে যাওয়া মানুষগুলিও হেসে ওঠে এখনো। আর কালোটাকার কারবারিদের কজনের শাস্তি হলো শেষমেশ? প্রশ্নটা তোলা থাক সরকারে অধিষ্ঠিত শাসকদলপন্থী ভোটারদের উদ্দেশেই। 

নোটবাতিলের পরেও যারা টিম টিম করে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে টিকে থাকছিল। জিএসটি’র থাবায় তাদেরকেও পাততাড়ি গোটাতে হলো সাততাড়াতাড়ি। আর উপভোক্তাদের পকেট খালি হতে শুরু করলো দ্রুত। এখন তো মরার আগে শেষ নিঃশ্বাস নিতেও অক্সিজেন সিলিণ্ডারে জিএসটি গুনতে হচ্ছে মৃত্যপথযাত্রীকেও। এই ভারতবর্ষ সত্যই নতুন। সত্যিই অভিনব উন্নয়ন। না উন্নয়ন যে হচ্ছে একটা। সেটা কিন্তু শাদা চোখে দেখাও যাচ্ছে। আসুন আমরাও একটু দেখে নি। কোন কোন ক্ষেত্রে কতটা উন্নয়ন হলো এই সাত বছরে। সাত বছরে পেট্রলের দাম ষাট টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে একশো টাকা অতিক্রম করে গিয়েছে। যখন একই সাত বছরে জ্বালানী তেলের আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য প্রায় অর্ধেকের কাছে নেমে এসেছে। ডিজেলের মূল্য পঞ্চাশ থেকে বেড়ে নব্বই পার করে ফেলেছে। চারশো চোদ্দ টাকার গ্যাস সিলিণ্ডারের দাম বেড়ে হয়েছে সাড়ে আটশো টাকা। এবং উল্লেখযোগ্য সেই একই সময়পর্বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ১০% থেকে বেড়ে ২০২১ সালের বিধানসভায় ৩৮% পার করেছে। কি বিপুল জনসমর্থন! এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্যে। যে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রায় অচল ছিল সেদিন অব্দিও। সর্ষের তেলের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে চারগুন। অন্যান্য শস্যের মূল্যবৃদ্ধিও আকাশছোঁয়া। এবং সাত বছরের উন্নয়নের এই ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই রাজ্যের ৩৮.১৩ শতাংশ মানুষ এই মূল্যবৃদ্ধির স্বপক্ষে রায় দিয়েছেন। গত সাত বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের আনা প্রতিটি আইনের স্বপক্ষে রায় দিয়েছেন। এবং তাঁরা রাজ্যে এবারে ডবল ইঞ্জিন সরকার গড়তেই বিপুল উৎসাহে ভোট দিয়েছেন। ফলে গত সাত বছরের নীতিমালায় জনসমর্থনের অভাব নেই।

সাত বছর সময়পর্বে অনেক বড়ো বড়ো সরকারী সংস্থা দুই একজন শিল্পপতির নামে হাত বদল হয়ে গিয়েছে। ফলে রাতারাতি তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুন। বিশ্ব ধনকুবেরের তালিকায় তাঁদের উত্থান ঘটেছে রকেট গতিতে। ভারতে এই সাত বছরে এবং বিশেষ করে লকডাউন পর্বে পনেরোজনের মতো নতুন বিলিওনীয়র হয়েছেন। এই বিকাশ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সত্যিই আভিনব। এবার আসুন দেখে নিই বর্তমান বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী আরও কোন কোন সরকারী সম্পত্তি বেসরকারী হাতে হাত বদল হতে চলেছে। বিমানবন্দ। রেল। সড়কপথ। বিদ্যুত সরবরাহের লাইন। ইণ্ডিয়ান অয়েল সরবরাহের পাইপলাইন। এবং গ্যাস অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া লিমিটেড। সাধু সাধু। এগুলি কিন্তু ঘোষিত। অঘোষিত যেগুলি লাইনে রয়েছে তার ভিতর রয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক, জীবন বীমার মতো লাভজনক সংস্থাগুলিও। সরকার এই পর্বে বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যায় বরাদ্দ লাগাতার কমিয়ে চলেছে। না তাতে জনতার বলার কিছু নেই। জনতা তো এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে। দেশকে ইসলামী আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে হিন্দুত্বের প্রবক্তাদের বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করতে বুথে বুথে লাইনে দাঁড়াতে হবে। করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি করতে এমার্জেন্সীতে লাইনে দাঁড়াতে হবে। মুমূর্ষু রুগীর শেষ সম্বল অক্সিজেন জোগাতে অক্সিজেন সিলিণ্ডারের লাইনে দাঁড়াতে হবে। শ্মশানে মৃতজনদের দাহ করতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে। চিতার দুর্মূল্য কাঠ জোগার করতেও লাইন দিতে হবে। এবং ভ্যাকসিন নিতে নাম রেজিস্ট্রেশন করতেও লাইন দিতে হবে ভোর রাত থেকে। তারপর ভ্যাকসিন নেওয়ার লাইন। আর এরপর তো এনআরসি’র লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভারতীয় নগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার দিন পড়েই আছে সামনে। ফলে দেশ এখন লাইনে দাঁড়িয়ে। লাইনেই থাকবে। বলা যেতে পারে ইণ্ডিয়া অন লাইন।

বিগত সাত বছরে কত লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। তার সরকারী পরিসংখ্যান রাখাই সম্ভবত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাতে আজ আর সঠিক তথ্যও নেই। কিন্তু প্রতিদিন গণ্ডায় গণ্ডায় কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। সরকারী ঋণের জালে জড়িয়ে। কৃষিকাজ থেকে আয় কমে গিয়েছে ব্যাপক ভাবে। এই কমে যাওয়ার পিছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। একদিকে কৃষিকর্মের ব্যায় বৃদ্ধি ঘটেছে বিপুল ভাবে। সারের মূল্য। কীটনাশকের মূল্য। সেচের জলের বিদ্যুৎ মাশুলের মূল্যবৃদ্ধি সহ নানাবিধ মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষিপণ্য উৎপাদন বিশেষ ভাবেই ব্যায়বহুল হয়ে পড়েছে। অপর দিকে কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের উপরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে কারণে বছর ভর আর্থিক ক্ষতির বোঝা টানতে টানতে ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু কৃষকের আত্মহত্যার বিষয়ে সরকারের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কৃষিঋণ মকুবের বিষয়ে সরকার উদাসীন। এই বিষয়ে একটি তথ্য সকলের জানা দরকার। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছর থেকে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের সময় সীমায় মাত্র ছয় বছরে সরকার শিল্পপতিদের ৬ লক্ষ ১০ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দিয়েছে। আর ১৯৪৭ থেকে ২০২০ সময়পর্বে বিগত ৭৪ বছরে বিভিন্ন সরকার কর্তৃক কৃষি ঋণ মকুবের পরিমাণ মাত্র ২ লক্ষ ২১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। একদিকে ৭৪ বছরের হিসেব আর উল্টো দিকে মাত্র ৬ বছরের হিসেব। এই একটি ছবিই সব কা সাথ সব কা বিকাশের আসল চেহারা বেআব্রু করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ।

এরপর ২০২০ সালের নতুন তিন কৃষি আইন কৃষকদের একেবারে খাদের ধারে ঠেলে দেওয়ায় কৃষকরা আজ ছয় মাস দিল্লীর সীমান্তে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং দীর্ঘতম গণআন্দোলনে সামিল হয়ে রাজপথে ধর্ণা দিয়ে পড়ে রয়েছে। সরকার কখনো কৃষকদের খালিস্তানী, কখনো পাকিস্তানী, কখনো চীনপন্থী দেশদ্রোহী বলে প্রচার করে চলেছে। আর লক্ষ লক্ষ কৃষকের আন্দোলনের খবর সরকারী বেসরকারী সব ধরণের সংবাদ মাধ্যমে চেপে যাওয়ার কাজ চলছে। এর আগে ২০১৯ এর সিএএ আইনের বিরুদ্ধে গোটা ভারতব্যাপী প্রতিবাদের ঢেউকে দিল্লীতে দাঙ্গা লাগিয়ে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। করোনা মহামারী ও লকডাউনের সুযোগ নিয়ে সেই কাজে সরকার আপাতত সফল। এই আন্দোলনে সামিল শতশত ছাত্রছাত্রী আজও বিনা বিচারে দেশদ্রোহের আইনে জেলে বন্দী। 

করোনা মহামারী প্রতিরোধে ব্যর্থ সরকার লকডাউন করে সাধারণ মানুষের জীবনে সত্যি করেই নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিয়েছে বলা চলে। ২০২০ সালে মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন করে দিয়ে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে বর্তমান সরকার হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তাদের পাশে দাঁড়ানো তো দূরস্থান। কত হাজার পরিযায়ী শ্রমিক পথেই মারা পড়েছিল। সেই পরিসংখ্যানও সরকারের কাছে চেয়ে পাওয়া যাবে না। এই সকল কাজ হারানো শ্রমিকদের জন্য সরকারের কোন পরিকল্পনাও নেই। ভাবনা চিন্তাও নেই। দায়ও নেই দায়িত্বও নেই। গত সাত বছরে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেল। সরকার অনড় অটল। আজকে যখন সেই গঙ্গা দিয়ে লাশের মিছিল বয়ে চলেছে। তখনো সরকার নির্বিকার। লকডাউনের দিল্লীতে বরং অত্যাবশ্যকীয় পরিসেবা আইনে ২০ হাজার কোটি টাকার সেন্ট্রাল ভিস্তার কাজ শুরু হয়েছে জোর কদমে। নতুন আইনসভা ভবন ও প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির প্রাসাদ নির্মাণের জন্য। যখন গোটা দেশে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭ হাজার ৮৩২ জন করোনা সংক্রমিত। ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ১১৪ জন মৃত। শত শত শবদেহ ভাসছে গঙ্গা যমুনার জলে। হাসপাতালে বেড নাই। অক্সিজেনের অভাব। অক্সিজেনের কালোবাজারী চরমে। এম্বুলেন্সের অভাবে মুমূর্ষু রুগীর মৃত্যু হচ্ছে পথের উপরেই। একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডার পাওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। শ্মশানে চিতার কাঠের অভাব। গণ্ডায় গণ্ডায় চিতা জ্বলছে শ্মশান জুড়ে। কবরে কবরে মৃতদেহ নিয়ে আত্মীয়স্বজন প্রতীক্ষায়। যার করোনা হয়নি, সেই রুগীও অক্সিজেনের অভাবে বেঘোরে মারা পড়ছে। ঠিক সেই সময় অত্যাবশ্যকীয় পরিসেবা আইনে রাতদিন জুড়ে তৈরী হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রাসাদ। 

এবং এরই মধ্যে গত বছর পাশ করা নতুন তিন কৃষি আইনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে সকল শস্যকেই বাদ দিয়ে দিয়েছে সরকার। অর্থাৎ এখন বৃহৎ পুঁজির মালিক যতখুশি চাল ডাল গম তেল চিনি মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি করতে পারবে। দেশের কোন আইন তাদের টিকি ছুঁতে পারবে না। ফলে সাধারণ ভোটার যারা হিন্দু মুসলিম বিভেদনীতির স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে নৃত্য করতে থাকে। তাদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরোবার অবস্থা হবে। তাহোক তবুও দেশ এখন হিন্দুদের রক্ষাকর্তাদের হাতে সুরক্ষিত। চিন্তা কি শুধু জয়শ্রীরাম বলে ঘুমিয়ে পড়লেই আর অসুবিধে নাই।

আসুন এবারে আন্তর্জাতিক স্তরে এই সাত বছরে ভারতবর্ষের তুলনামূলক অবস্থানের একটা চিত্রে আলোকপাত করা যাক। তাহলে বিশ্বের নিরিখে আমারা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে বুঝতে সহজ হবে। মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের ভিতরে আমাদের অবস্থান ১৩১তম স্থানে। বাহ! খুবই ভালো বলতে হবে অন্তত প্রথম দেড়শোটি দেশের ভিতরেই রয়েছি আমরা। বিশ্ব ক্ষুদা সূচকে আমাদের অবস্থান ১০৭ এর ভিতরে ৯৪তম স্থানে। অর্থাৎ ভারতবাসী ক্ষুধার্ত বলে গর্ব করতেই পারে। এই সাত বছরে আমাদের এতটাই উন্নতি ঘটছে। আমরা আরও বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছি। আশা করা যায়, আর কয়েক বছরের ভিতরে আমরাই বিশ্বে এই বিষয়ে চ্যাম্পিয়ান ক্ষুধার্ত দেশ হয়ে উঠতে পারবো। বিশ্ব শান্তি সূচকে ১৬৩’র ভিতরে আমাদের স্থান ১৩৯এ। বিশ্ব সুখ সূচকে এই অবস্থান ১৫৩’র ভিতরে ১৪৪এ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ১৯৫ এর ভিতরে আমরা ১৪৫এ রয়েছি। লিঙ্গ বৈষম্যে আমনাদের অবস্থান ১৫৬তে ১৪০এ। পরিবেশ সূচকে আমরা রয়েছি ১৮০’র ভিতরে ১৬৮তে। ইনটারনেট কোয়ালিটির সূচকে ভারত রয়েছে ৮৫’র ভিতরে ৭৯তে। পানীয় জলের শুদ্ধতা সূচকে আমদের দেশের অবস্থান আরও চমৎকার। ১২২এ ১২০! সব শেষে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে আমরা কিন্তু ১৮০তে ১৪২এ। কম কথা নয়। আশা করা যেতে পারে, এই সূচকগুলি থেকে বিগত সাত বছরে ভারতবর্ষ ঠিক কোন অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে, সেটা পরিস্কার বোঝা যাবে। 

কিন্তু সবটাই কি এইরকম? নিশ্চয় নয়। বিগত সাত বছরে ভারতবর্ষ বিশ্বকে চমকিয়ে দেওয়ার মতো নানান কীর্তিও করেছে বইকি। বিশ্বের বৃহত্তম মূর্তি স্থাপন। ৩০০০ কোটি টাকা ব্যায়ে। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম জীবিত দেশপ্রধানের নামে। কয়েকশো কোটি টাকা যে স্টেডিয়ামের উদ্বোধনেই ব্যায় করা হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলগ্রহ অভিযানের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। বিশ্বের বৃহত্তম পার্লামেন্ট ভবন তৈরী হচ্ছে দিল্লীতে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ সাধন। এখন থেকে যেকোন ভারতবাসী কাশ্মীরী কন্যাকে বিবাহ করার আইনি অধিকার পাবে। কাশ্মীরে জমি কেনার আইনি অধিকার পাবে। স্বাধীনতার পর যে অধিকারগুলি থেকে আপামর ভারতীয়দের বঞ্চিত রেখেছিল ভুতপূর্ব সরকারগুলি। তিন তালাক প্রথা বাতিল। পোশাক দেখে মানুষ চেনার ফর্মূলা আবিষ্কার। প্রকাশ্য দিবালোকে দিল্লীর দাঙ্গা সংঘটিত করা নেতা নেত্রীদের আজও আইনের আওতার বাইরে রাখা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ চালু করা। একমাত্র মুসলিম শরণার্থী বাদে সকলেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবে এখন থেকে। ভারতীয় সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটির পর একটি আইন প্রণয়ন সংবিধানের এক একটি ধারাকে ভঙ্গ করে। এগুলিও কম বড়ো কথা নয়। ৩৭০ ধারা বিলোপ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ প্রণয়ন। তিনটি নতুন কৃষি আইন প্রণয়ন। সকলেই জানেন এই আইনগুলির কোনটিই সংবিধানের বিধি মেনে তৈরী হয় নি। ফলে বিগত সাত বছরে সংবিধানকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দেওয়ার কাজটি কিন্তু সুসম্পন্ন হয়েছে। 

আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বইকি এই সাত বছরে। বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একটি সিস্টেম কার্যকর করা হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর এই একটা অভিনব কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে। আরও যে কাজটি প্রায় ১০০% সাফল্যের সাথে নিশ্চিত করা গিয়েছে। সেটি হলো সংবাদ মাধ্যমকে শাসক দলের ও সরকারের তল্পিবাহক করে তোলার কাজ। স্বাধীনতার পর এমন সর্বাত্মক ভাবে এবং এমন চরম সাফল্যের সাথে এই কাজটি আগের কোন শাসকদলই করে উঠতে সফল হয়নি। আর শেষ কাজটি। যেটি সবার প্রথমে শুরু করা হয়েছিল। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে সরকারী কোষাগার খালি করে দেশপ্রধানের বিশ্বব্যাপী প্রচার। এই বিষয়ে ভারত বর্তমানে বিশ্বে এক নম্বর দেশ। করোনা সংক্রমণে দ্বিতীয়। করোনায় মৃত্যুতে তৃতীয়। ভ্যাকসিন হাহাকারে প্রথম। আরও যে কত কিছুতে ভারত এই সাত বছরে বিশ্বে প্রথম হয়ে উঠেছে। সেই বিষয়ে রীতিমত গবেষণার আশু প্রয়োজন। না হলে সামনের দিনে আরও অনেক কিছু বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষায়। অবশ্য আজও যদি বিস্মিত হওয়ার মতো সক্ষমতা বজায় থাকে আমাদের। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত