| 24 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

পথের পাঁচালী প্রকাশের গল্প 

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অর্পণ ঘোষ

উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন?

“পথের পাঁচালী” ও “অতসী মামী” প্রথম যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো, সেই বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক তিনি।

বাংলা সাহিত্যের দুই বন্দোপাধ্যায় কে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দোপাধ্যায়।

আজ বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী প্রকাশের গল্প বলবো। তখন কলকাতা থেকে চাকরি নিয়ে বিভূতিভূষণ থাকতেন ভাগলপুরে। তিনি তখন সেখানকার খেলাত ঘোষ নামক জমিদারের সেরেস্তায় নায়েবির কাজ করতেন, আর ভাগলপুরের বাঙালীটোলায় ছিলো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামাবাড়ি। এই বনেদি বাড়ির ছেলে হলেন সাহিত্যিক ওরফে প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়য়ের মামা- উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তখনও “প্রবাসী” পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেনি।

পেশায় উকিল কিন্তু সাহিত্য প্রেমের জন্য রোজ সন্ধ্যায় তার বাড়িতে বসতো সাহিত্যের আড্ডা যেখানে ওকালতির যুক্তিজালের থেকে সাহিত্যের আলোচনা আর গান-বাজনাই বেশি হতো। প্রায় সকল মানুষের সেই বৈঠকী আড্ডায় ছিলো অবাধ যাতায়াত। সেই সময় একজন বাঙালি মুখচোরা লাজুক যুবকের সেই আড্ডায় রোজ আসতো। পড়নে হাঁটু ছুঁই ছুঁই খাটো ধুতি,গায়ে পাট ভাঙা পাঞ্জাবী, এক হাতে লণ্ঠন আরেক হাতে লাঠি। কেউ তখন তার পরিচয় জানেনা, পরিচয় জানবার প্রয়োজনবোধও কেউ করেননি, বৈঠকী আড্ডায় তিনি রোজ আসেন, এই শুধু তার পরিচয়।

তো এমনই একদিন গ্রীষ্ম কালে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়ের দিন। বৈঠকের মধ্যেমণি তথা প্রবাসী সম্পাদক উপেন্দ্রনাথের মন খরাপ, কারণ তিনি ধরে নিয়েছেন সেদিন ঝড় বৃষ্টির চোটে কেউ আর আড্ডায় আসবেনা, কিন্তু কিছুক্ষন পরেই তিনি দেখেলন দূর থেকে একটি লণ্ঠনের আলো তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে, তিনি আশ্বাস দিলেন নিজের মনকে, এই ভেবে যে সেদিনের সন্ধে নেহাত মাঠে মারা যাবে না, আগন্তুক ব্যক্তির সাথে বেশ খানিকক্ষণ আলাপ করা যাবে, কিন্তু কিছুক্ষন পরেই তার আশায় জল পড়লো।

তিনি দেখলেন আগন্তুক ব্যক্তি সেই মুখচোরা লাজুক ব্যক্তি যিনি একটিও কথা না বলে রোজ আড্ডার এক কোণে বসে থাকেন।এখন সম্পাদক ও লেখক উপেন্দ্রনাথের স্বভাব ছিলো প্রত্যেকের মধ্যেই তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র খুঁজে বেড়ানো, তিনি ঠিক করলেন এই লাজুক ব্যক্তির সাথেই সেদিনের সন্ধ্যায় আলাপ জমাবেন। এরপর-ঘরে ঢুকে সেই ব্যক্তি নিজের অভ্যেস মতন এক কোণায় বসতে গেলে-প্রবল আপত্তি জানিয়ে উপেন্দ্রনাথ বললেন-‘আপনি অতো দূরে গিয়ে বসলেন কেন, সামনের চেয়ারটায় বসুন’।

আগন্তুক অন্য অনেকে আসবে বলে আপত্তি জানালে, উপেন্দ্রনাথ তাকে আশ্বাস দিলেন, ‘আপনার সংকোচের কোনো কারণ নেই,ঝড় বৃষ্টি মাথায় আজ আর কেউ আসবেনা। আপনি এগিয়ে আসুন।’ এরপর সেই ব্যক্তি সংকোচের সাথে উপেন্দ্রনাথের সামনে বসতে, উপেন্দ্রনাথ বললেন,

-‘আমাদের আড্ডায় আপনার নিত্য যাতায়াত অথচ আপনার পরিচয়টাই নেওয়া হয়নি। অবশ্য এই আড্ডায় পরিচয়ের তো প্রয়োজন হয়না, মুখচেনা হলেই চিরচেনা। তা-আপনার নামটা জানতে পারি?

-‘আজ্ঞে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়’।

এরপরে জমে উঠলো আলাপ, কথায় কথায় জানতে পারলেন সেই আড্ডায় বিভূতিভূষণ আসতেন দু-মাইল জঙ্গলের পথ পেরিয়ে।সেই কারণেই হাতে থাকতো লাঠি (সাপ মারার উদ্দেশ্যে )। উপেন্দ্রনাথ পেয়েগেলেন এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ যিনি দু-মাইল পথ পেরিয়ে আড্ডায় আসেন শুধু সাহিত্যের রস লোভে। আগ্রহের সঙ্গে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ কে জিজ্ঞেস করলেন-

‘আপনার সাহিত্য চর্চার বাতিক আছে নাকি?’

-না তেমন কিছু না একটু আধটু ।

-‘আহা লজ্জার কি আছে কবিতা-টবিতা নিশ্চই দু -একটা লিখেছেন। অরণ্যের নির্জনতায় আপনি যখন থাকেন নিশ্চই লিখেছেন।’

এরপর সংকোচের সাথে বিভূতিভূষণ বললেন তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন।

হতভম্ব হয়েগেলেন উপেন্দ্রনাথ।

একজন লেখক তার হাতেখড়ি কবিতা নয়,প্রবন্ধ নয়…
এক্কেবারে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস!!
তাও চারশো পাতার উপন্যাস!!

যেখানে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র প্রত্যেকেই শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে সেখানে একজন সাধারণ পরিবারের সাদামাটা লেখক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস!!

কিন্তু, সমস্যা হল।
অন্য জায়গায়।
বিভূতিভূষণ উপন্যাস লেখার সময় পরিচ্ছেদ ভাগ করেছেন কিন্তু অঙ্ক মেলান নি, আসলো সে সময় উপন্যাস লেখার সময় প্রতিটি পরিচ্ছেদের শব্দ সংখ্যা মেলাতে হতো যেটি বিভূতিভূষণ করেননি, উপেন্দ্রনাথ চিন্তায় পড়লেন, বলেলেন, পরের দিন শব্দ সংখ্যা গুণে আনতে, বিভূতিভূষণ গুণে দেখলেন আগাগোড়া অমিল।

সেই অবস্থাতেই পথের পাঁচালির পাণ্ডুলিপি তিনি দিলেন উপেন্দ্রনাথকে। কয়েক দিন পরে উপেন্দ্রনাথ জানালেন,

‘আপনার হবে..
হবে কেন..
হয়েছে।’

অঙ্কের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তো হতেই পারে, আপনি ছাপানোর কথা কিছু ভাবছেন? “

বিভূতিভূষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কলকাতায় থাকতেই প্রবাসী পত্রিকায় দিয়েছিলাম, এখানে চাকরি নিয়ে চলে আসবার সময় খোঁজ নিতে গিয়ে ফেরত পেলাম ।”
হ্যাঁ।
প্রবাসী পত্রিকা ফিরিয়ে দিয়েছিল পথের পাঁচালির পাণ্ডুলিপি। উপেন্দ্রনাথ সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে বলেছিলেন তিনি ছাপবার ব্যবস্থা করবেন।

এর দু-মাস পরে ভগলপুর থেকে উপেন্দ্রনাথ চলে এলেন কলকাতায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যে কয়েকমাস পরেই প্রকাশ হলো বিচিত্রা। শোনা যায় পত্রিকা প্রকাশের আগের দিন কলকাতার দেওয়াল বিচিত্রার পোস্টারে ছেয়ে গেছিলো। সে এক এলাহি ব্যাপার।

না,
বিচিত্রার প্রথম সংখ্যায় কিন্তু পথের পাঁচালি প্রকাশ হয়নি।

এর কয়েক দিন পরে, এক সকালে কলকাতার ফড়িয়াপুকুর লেনের দোতলার একটি বাড়িতে তখন জোড়কদমে চায়ের পেয়লার শব্দ আর সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে সাহিত্যের শ্লীলতা অশ্লীলতা নিয়ে তর্ক চলছে। হঠাৎ আসলেন আধময়লা ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবী পরিহিত বিভূতিভূষণ ।

তখন পোষাকী আড্ডাধারীরা তাকে দেখে বললেন, কী চান আপনি? আপনি কী এজেন্ট? আপনাকে কিন্তু দশ কপির বেশি দিতে পারবো না, বিচিত্রার ভয়ানক ডিমান্ড।
এরকম একটা কথপোকথন শুরু হচ্ছে, এইসময় এসে পৌঁছলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ।

দেখেই জড়িয়ে ধরলেন বিভূতিভূষণকে…

‘কী খবর বিভূতিবাবু? কবে কলকাতায় এলেন?
তা এসে ভালোই করেছেন। আপনাকে সুখবর টা দিই আগামী সংখ্যা থেকেই আপনার উপন্যাস বেরুচ্ছে।’

এতক্ষন যে সকল আড্ডাধারী বিভূতিভূষণ কে এজেন্ট বলে ঠাউরে ছিলেন তারা হতভম্ব, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন বিভূতিভূষণের মাথা থেকে পা। বিভূতিভূষণও আনন্দে বাকরুদ্ধ। কিছু মাত্র না দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে এলেন রাস্তায় ।
সেদিনের কলকাতা শহরের আনন্দ তিনি কিছু মাত্র ভোলেননি ।
পরে তিনি বলেছিলেন,
‘দ্যাখো, কলকাতা শহর আমার কোনো দিনই ভালো লাগেনা। গ্রামে আর অরণ্যে আমি শান্তি পাই। তবে হ্যাঁ, সেদিন সন্ধ্যায় বিচিত্রা “অফিস” থেকে রাস্তায় বেরিয়ে কলকাতা শহরটাকেও আমি ভালোবেসেছিলাম ।’

তথ্য – সাগরময় ঘোষ, “সম্পাদকের বৈঠকে”।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত