পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ স্মরণে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর

Reading Time: 3 minutes

পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ এর ১০৯তম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামী ০২ আগস্ট শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশেষ মিলনায়তনে স্মারক বক্তৃতা ও ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। স্মারক বত্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক মোঃ আলী নকী।


যন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ওস্তাদ মূর্তজা কবির মুরাদ (বাঁশি), মাহমুদুল হাসান (বেহালা) এবং নিশীথ দে (সেতার)।
তবলায় সঙ্গত করবেন স্বরুপ হাসান, সুপান্থ মজুমদার এবং প্রশান্ত কুমার। উত্তরপর্বের এ আয়োজন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাঁশির বিবর্তন ও বিকাশে পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ (১৯১১ – ১৯৬০) এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম। পান্নালাল ঘোষ জন্ম নিয়েছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) বরিশালে, কীর্তনখোলা নদীর পারে। ডাকনাম অমলজ্যোতি ঘোষ। পিতামহ হরকুমার ঘোষ প্রখ্যাত ধ্রুপদী ও পিতা অক্ষয় কুমার ঘোষ ছিলেন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক, মা সুকুমারী ছিলেন সুগায়িকা। চৌদ্দ বছর বয়সে পান্নালাল বাঁশি শিখতে শুরু করেন। কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। সে সূত্রে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৯২৬ সালে বরিশাল থেকে চলে যান কলকাতায়।

ওখানে প্রথমে তিনি যুক্ত হন নিউ থিয়েটার্স-এর সঙ্গে। সংগীতের প্রাথমিক তালিম পিতার কাছে নিলেও নাড়া বেঁধে রাগসংগীতে পদ্ধতিগত তালিম নেন অমৃতসরের ওস্তাদ খুশী মোহাম্মদ খানের কাছে। গুরুর মৃত্যুর পর সংগীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর কাছেও পান্নালাল দীর্ঘদিন তালিম নেন এবং তাঁরই উৎসাহে সৃষ্টি করেন নানা রাগ; নূপুরধ্বনি, চন্দ্রমৌলি, দীপাবলি, কুমারী। ফৈয়াজ খান ও ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মতো কণ্ঠশিল্পীদের অনুরোধে পান্নালাল তাঁদের খেয়ালের সঙ্গে বাঁশিতে সঙ্গত করেছেন। পান্নালাল ঘোষের সহধর্মিণী পারুল ঘোষ। পান্নালালের ছোট ভাই নিখিল ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত তবলাবাদক।

১৯৫৬ সালে আকাশবাণী দিল্পী কেন্দ্রে সংগীত নির্দেশক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তারও আগে, ১৯৪০ সালে সংগীতের বৃহত্তর অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যাশায় গিয়েছিলেন বোম্বে; যুক্ত হয়েছিলেন সেখানকার চলচ্চিত্র অঙ্গনে। স্নেহবন্ধন (১৯৪০) তাঁর সংগীত পরিচালনায় প্রথম ছবি। আনজান (১৯৪১), বসন্ত্ (১৯৪২), দুহাই (১৯৪৩), নন্দকিশোর (১৯৫১), বসন্ত বাহার (১৯৫৬), মুঘল-এ-আজম (১৯৬০) প্রভৃতি বিখ্যাত ছবির গান ও আবহসংগীতে মিশে আছে তাঁর বাঁশির কারুকাজ। আঁধিয়া (১৯৫২) ছবির আবহসংগীতে তিনি কাজ করেন ওস্তাদ আলী আকবর খান ও পন্ডিত রবিশঙ্কর-এর সঙ্গে যৌথভাবে। মুঘল-এ-আজম (১৯৬০) ছবিতে মধুবালার ওপর চিত্রায়িত লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘মোহে পনঘাটপে নন্দলাল’ গানের সঙ্গে বাঁশি বাজানোর জন্য নওশাদ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পান্নালাল ঘোষকে। শঙ্কর-জয়কিশেনের সংগীত পরিচালনায় বসন্ত বাহার (১৯৫৬) ছবিতে একই শিল্পীর গাওয়া গাওয়া ‘নৈন মিলে চৈন কাঁহা’ গানেও রয়ে গেছে পান্নালালের ফুঁ-য়ের জাদুর নমুনা। যেটা তাঁর মূল বাজানো রেকর্ডে বহু রাগে রঞ্জিত পান্নালাল ঘোষের সুরসম্ভার অক্ষয় হয়ে আছে।

বাঁশির যে আধুনিক রূপটি আমরা দেখি, সেটি পান্নালাল ঘোষের উদ্ভাবন। ৩২ ইঞ্চি আকৃতির সাত ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশির প্রথম প্রচলন তিনিই করেছিলেন। আগেকার বাঁশিতে দু’একটি স্বর বাজানো বেশ অসুবিধাজনক ছিল। সপ্তম ছিদ্রটি উদ্ভাবন করে পান্নালাল সেই সমস্যার সমাধান করেন। তিনিই বাঁশিকে উন্নীত করেছিলেন সেতার, সরোদ, সানাই, সারেঙ্গীর পর্যায়ে যা এককভাবে ধ্রুপদী সংগীতের গৌরবে বাজতে পারে মূল যন্ত্র হিসেবে। কণ্ঠ সংগীতের গায়কীকে তিনি তাঁর বাঁশিতে ধারণ করেছিলেন। এটা তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রই অনন্য। তবু বাঁশিকে আলাদা স্থান দিতেই হয়। বাঁশি শুনলেই কেন মন উচাটন হয়ে ওঠে, এ প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই। তাই, ভাবতে প্রলুব্ধ হই, কিবোর্ড এসে অন্য সব বাদ্যযন্ত্রের স্থান যতই দখল করুক; যমুনা আর উজানে না-ই বা বইল, ডাকাত-স্বভাবের এই বাঁশির আবেদন থেকেই যাবে; সুরপিয়াসী মানুষের অন্তরে তেমনই থাকবে পান্নালাল ঘোষের নাম।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>