Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,

ইরাবতী প্রবন্ধ: থিয়েটার, ডিরেক্টর, অভিনেতা ও দর্শক । ব্রাত্য বসু

Reading Time: 8 minutes

প্রথম নাটক ‘অশালীন’ প্রসঙ্গে

‘অশালীন’ নাটকটি যখন লিখি, আমার বয়স তখন ২৫। কিন্তু প্রচুর কাটাছেঁড়ার পর মূল নাটকটি, অর্থাৎ প্রযোজনার উপযোগী করে তৈরি হলো। শুরু হতে হতে তাই এক বছর গড়িয়ে গেলো। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হলো রিহার্সাল। পরিচালক অমিতাভ দত্ত। সে সময় দলের নাম গণকৃষ্টি। পরিচালক হঠাৎই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবাই মিলে স্থির করলেন যে, পরিস্থিতি যেহেতু আকস্মিক তাই ‘অশালীন’-এর নির্দেশনাও আমাকেই দিতে হবে। এর দু-দিন পর প্রথম নির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। সকলেই জানেন, জার্মান দার্শনিক ফ্রিড্রিক নিৎসের Thus Spake Zarathustra বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৪০ কপি, আর নিৎসে বন্ধুবান্ধবদের উপহার দিয়েছিলেন মাত্র ৭ কপি। সেই সময় নিৎসে যা বলেছিলেন তা পরবর্তীতে আমার কাজে বার বার লেগেছে। তাই এ কথা পুনরায় উল্লেখ করছি, যে ভালো কি মন্দের স্রষ্টা হতে চায় তাকে সবার আগে ধ্বংসশীল হতে হবে, ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে সব মূল্যবোধকে। এইভাবে সর্বোচ্চ পাপ আসলে সর্বোচ্চ মঙ্গলেরই অংশ। কিন্তু তা হচ্ছে সৃষ্টিশীল মঙ্গল। হে জ্ঞানীগণ, যত মন্দই হোক, চলুন আমরা সব খুলে বলি। সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে চুপ করে থাকা। না বলা সব সত্যই কালক্রমে বিষাক্ত হয়ে পড়ে…। মানুষ শুধুমাত্র উদ্দেশ্য বা গন্তব্য নয়। মানুষ এক সাঁকো। তাতেই তার মহত্ত্ব। মানুষের মধ্যে যা ক্ষণস্থায়ী আর ধ্বংসযোগ্য, তাকেই শুধুমাত্র ভালোবাসা যায়।

মঞ্চভাবনার জন্য বেছে নিলাম ছোটো চন্দন সেনকে। সে তখন রমাপ্রসাদ বণিকের ‘থিয়েটার প্যাশন’ দলে অভিনয় করে। অদ্ভুত এক সৃজনশীল দক্ষতায় মঞ্চটা বানালো চন্দন সেন। আমি তাকে বলেছিলাম, মঞ্চে একটা দোলনা চাই। তার পেছনে যেন অজস্র অক্ষর ঝোলে। চন্দন সেসব তো করলই, আর তার সঙ্গে গোটা মঞ্চজুড়ে অজস্র মোটা শণের দড়ি ঝুলিয়ে দিলো। স্টেজের ডাউন রাইটে ছোট্ট একটা ভিক্টরি স্ট্যান্ড। মাত্র তিন হাজার টাকার বাজেটে অবিশ্বাস্য কাজ করেছিল চন্দন।

অশালীন-এর মূল চরিত্র সুজনের পোশাক করলাম কালো আলখাল্লার মতো। আর তার সামনে ও পেছনে চিন্তাবিদ উইটগেনস্টাইনের দুটি পঙক্তি যার অর্থ—সকল শব্দ শেষ পর্যন্ত নিরবতায় শেষ হয়ে যায়। খুবই অল্প সময় ও ব্যস্ততার মধ্যে সংগীত করলো আমাদের বন্ধু লাল, অর্থাৎ সুমন মুখোপাধ্যায়। আমরা চেতনার কল্যাণদার বাড়িতে তাঁর সেট-আপেই কাজ করলাম। সাইমন গারফেঙ্কলের ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ এবং সুমন চট্টোপাধ্যায় অধুনা কবীর সুমনের স্তব্ধতার গানকে মোটিফ হিসেবে চাইলাম। ও সেগুলোকে তো যুক্ত করলই, তার সঙ্গে ‘নন কমিউনিকেশন’-কে মূল ভাবনা হিসেবে ধরে অসংখ্য নাগরিক ধ্বনি ও তৎকালীন বিএসএনএল ফোনের ‘এনগেজড’ টোনকে থিম্যাটিক আবহ হিসেবে ব্যবহার করলো। অদ্ভুত এক মৌলিক ভাবনা। আমি তো ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

… দেড় মাস টানা রিহার্সাল চললো নানা জায়গায়। শ্যামবাজার দেশবন্ধু পার্কের কাছে একটি জায়গায় রিহার্সাল হতো। একদিন রিহার্সাল শেষে যখন আমরা বেরোচ্ছি, আমাদের গায়ে বালতি বালতি জল ঢেলে দেওয়া হলো। আমরা বুঝলাম, আস্তানা বদলানোর সময় হয়েছে। এর পর রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়র কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতেই মহলার জায়গা স্থির হলো। অশালীন-এর প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সকাল দশটায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ প্রথম মঞ্চায়ন। প্রথম শো-এর পরেই বুঝলাম, নাটক ধরে গেছে। আশাতীত প্রতিক্রিয়া পেলাম। প্রায় সবাই বিষয়বস্তুর নতুনত্ব নিয়ে কথা বললেন। প্রযোজনার বৈচিত্র্যও দেখলাম মানুষকে টেনেছে। পুলকদা, রুনাদির অভিনয় সকলের ভালো লেগেছে। সুজন চরিত্রে আমাকেও মানুষ গ্রহণ করেছে।

ইতিমধ্যে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিলাম। তখন বিভাগীয় প্রধান কবি শবরী ঘোষ। আর আমার এক বিখ্যাত সহকর্মী, কবি সুবোধ সরকার। সুবোধদার সঙ্গে আড্ডা শুরু হলো। কবিতা, সাহিত্য, থিয়েটার, শিল্প বাজারের ভেতরের রাজনীতি, কী নয়। পল এলুয়ার, লিওতার, মায়াকোভস্কি থেকে মায়ারহোল্ড, কিংবা বাদল সরকার, সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন আমাদের সেই আকণ্ঠ আড্ডায়।

অন্য দিকে ‘অশালীন’ কিন্তু খ্যাতি পেয়ে গেলো। কবি জয় গোস্বামী তো দু-বার দেখলেনই, এ ছাড়াও অনেক কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর প্রযোজনাটি দেখতে শুরু করলেন। কফি হাউস প্রায় উঠে এলো অ্যাকাডেমিতে। সুবোধ সরকার নিয়ে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। কিছু দিনের মধ্যেই দেশ পত্রিকায় অশালীন নিয়ে তাঁর লেখা আলোচনা প্রকাশ হলো। অশালীন সেই উত্তর-বিশ্বায়ন সময়ের সংকট, মানুষে মানুষে এক নতুন ধরণের সম্পর্কহীনতা, সামাজিক শব্দ ও অসামাজিক শব্দের সামাজিক প্রেক্ষিতে বিভাজনরেখাটির ঘুচে যাওয়া মঞ্চে প্রথম নিয়ে আসে। নবারুণীয় ‘ফ্যাতাড়ু’ তখনও লেখা হয়নি। ভাষা যে অর্থহীন, আবার ভাষাই যে এক ধরণের নাশকতামূলক অস্ত্রও বটে, অশালীন প্রথম তার ইঙ্গিত দিয়েছিল।

সে সময় রাও জমানার সার্বিক সংস্কারের পর উন্নয়ন ও উন্নয়নহীনতার মধ্যে পার্থক্য খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রান্তিক করে দেওয়ার প্রক্রিয়া তৃতীয় বিশ্বে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অশালীনকে কেন্দ্র করে আমাদের সে সময়ের দল গণকৃষ্টি গ্রুপ থিয়েটারে লড়ার মতো ব্রিদিং স্পেস পায়। সেটা সেই মুহূর্তে আমাদের শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষা নয়, বরং বৃদ্ধি ও প্রসারের জন্যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এর অনেক পরে আমার বর্তমান নাট্যদল ‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ গড়ে ওঠে।

কে ডিরেক্টর, কে অভিনেতা?

আমাদের থিয়েটারে পরিচালক বা নির্দেশক শব্দটি ইংরেজি ‘ডিরেক্টর’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। ‘অশালীন’-এর সময় থেকেই আজকের এই ‘বোমা’ বা ‘মুম্বই নাইটস’-এর সময় পর্যন্ত এই শব্দটা নিয়ে আমি প্রচুর ভেবেছি। আসলে ‘ডিরেক্টর’ শব্দটি মোটেও দীর্ঘ দিনের কোনও ইতিহাস বহন করে না। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলে মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি। বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা আমার এক বন্ধু এক শুটিং-এর গল্প আমায় শুনিয়েছিলেন। অভিনয় করছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বিগ বি-র উপস্থিতিতেই একজন সহ-অভিনেতাকে পরিচালক রীতিমতো বকাঝকা করছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অমিতাভ বচ্চন সেই অভিনেতাকে বলেন দেখো, একটা বিষয় সব সময় মনে রাখবে। প্রত্যেক পরিচালকই একজন হতাশ অভিনেতা। অভিনয়ের ইচ্ছা নিয়ে তিনি এই জগতে আসেন। কিছু দিন পরেই বোঝেন, অভিনয় তেমনভাবে তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। তখন অনেকেই টেকনিশিয়ান হয়ে ওঠেন। আর যিনি একটু বলিয়ে-কইয়ে হন, তাঁরা পরিচালক হওয়ার পথে পা বাড়ান।

ইউরোপে থিয়েটার বিষয়টা সাড়ে পাঁচ হাজার বছর থেকেও বেশি সময় ধরে চলমান থাকলেও, ডিরেক্টর শব্দটির উত্থান মোটামুটি ১৫০ বছর আগে। ফিল্ম বিষয়ে যেমন বলতেই হবে যে এটা ডিরেক্টরের মাধ্যম, কিন্তু থিয়েটারের বেলায় আমার তা মনে হয় না। থিয়েটার হলো essentially an actor’s medium । এই প্রসঙ্গেও আরেকটা গল্প শোনাই।

আমার এক বন্ধু-অভিনেতা কোনও একটি ছবি বা সিরিয়ালের কাজে সহ-অভিনেতা হিসেবে পান নাসিরুদ্দিন শাহকে। এই অভিনেতাটিকে বসতে বলা হয় যে ঘরে, সে ঘরে নাসির স্বয়ং বসে রয়েছেন। প্রচুর ধূমপান করার ফলে তাঁর দুই চোখ রক্তাভ। কথাবার্তা প্রায় বলছেনই না। একটু high-brow মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি শট দেওয়ার সময় আমার বন্ধু-অভিনেতাটি একটু সমস্যায় পড়েন। তখন তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নাসিরুদ্দিন শাহ। বলেন, যে পায়ে ভর দিচ্ছিস, তার উলটো পায়ে ভরটা দে, দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। শট দেওয়া শেষ হলে আমার বন্ধু সাহসে ভর করে নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করেন, স্যার, আপনার কী মনে হয়, আমার কি একটু-আধটু অভিনয় হবে? প্রশ্নের উত্তরে নাসির যা বলেছিলেন সেটা আমি বেদবাক্যের মতো মেনে চলি। মানতে পারি কি না জানি না, কিন্তু মানতে চাই। যেমন, জীবনে কেউ সমস্যায় পড়লে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে, আমি যে বইটি পড়ি তা হলো মারিও পুজোর ‘দ্য গডফাদার’। এই বই পড়লে আমার নানা ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। যাই হোক, আমার ওই বন্ধুকে নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন দেখো, আমাদের সমাজে কেউ ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়, আমলা হয়, নেতা-মন্ত্রী হয়। এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সমাজ বিষয়টা ঠিক করে। কিন্তু অভিনয়কে পেশা হিসেবে নির্বাচনটা একান্তভাবে তোমার নিজস্ব। ফলে এই নিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না। কেমন হলো, ভালো না মন্দ, এ নিয়ে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না। এটা তোমার নিজের লড়াই।

আমি এই প্রসঙ্গে বলি, থিয়েটারে আমার বন্ধু যাঁরা, তাঁদের বিষয়ে আমি নানা কথা বলতে পারবো। থিয়েটারে আমার অগ্রজ যাঁরা, তাঁদের সম্পর্কেও নানা কথা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করা যায়। কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে একটা বড়ো সমস্যা দেখা যায়। আমি কি যথেষ্ট সচেতনভাবে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রশংসার মধ্যে তফাত করতে পারছি? প্রকৃত প্রস্তাবে আমার নিজের ঢাক পেটানো হয়ে যাচ্ছে না তো? আত্মবিশ্বাসে ভর করে কথা আত্মপ্রশংসা হয়ে উঠছে না তো? এই প্রসঙ্গে কনস্তান্তিন স্তানিশ্লাভস্কির একটা কথা বলা খুব জরুরি। তিনি বলেছিলেন, তুমি কি নিজের মধ্যে দিয়ে কোনও শিল্পকে ভালোবাসছো, না কি ওই শিল্পের অছিলায় নিজেকেই ভালোবেসে চলেছো?

আমাদের সকলের মধ্যে নিজেকে ভালোবাসার জোরালো প্রবণতা রয়েছে। যখন সেটা মেগ্যালোমেনিয়া হয়ে উঠে, সেটা কিন্তু ভীষণ ভয়ের। নিজেকে ভালোবাসা, আবার একই সঙ্গে নিজেকে ঘিরে নানা প্রশ্ন তোলা, বিষয়টা খুব সহজ নয়। আমি যখন দেখি কেউ সব বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে যেতে পারে, আমি সেই স্থান থেকে পলায়ন করি। আমি নিজের বিষয় অভ্রান্ত নই, বরং সংশয়াতুর।

এটা অন্যান্য পরিচালকদের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।

থিয়েটার অন্য শিল্পের চেয়ে আলাদা কেননা থিয়েটার একটা টাইমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এটা একটা ক্ষণজ শিল্প। ‘মীরজাফর’ নাটকের যে শো রবিবার হচ্ছে, সেটা একটা নাটক। কিছু দিন পরেই আরেকটা যে শো হবে, সেটা একেবারে আলাদা নাটক। অভিনেতা, পরিচালক, কলাকুশলী—সকলে মিলে প্রত্যেক শো-এ তিল তিল করে তিলোত্তমাকে গড়ে তোলেন।

আমরা জানি যে, language-scape কিছু বছরের মধ্যেই বদলে যায়। আমার বাবা যেভাবে কথা বলতেন, আমি সেভাবে বলি না। আবার, আমার পরবর্তী প্রজন্মের ভাষাও আমার থেকে ভিন্ন। ভাষা বদলানোর অর্থ মানে তো সমাজের আঁকবাঁকগুলোও বদলে যাওয়া। এই যে পটপরিবর্তন বা ভাঙচুর, বা সমাজের আনাচেকানাচে যত সব রদবদল—এই সব রদবদল যে অভিনেতা তাঁর কণ্ঠে বা অভিব্যক্তিতে নিয়ে আসতে পারবেন, সে-ই আমার কাছে সার্থক অভিনেতা। সেই অভিনেতা হয়তো শেক্সপিয়র বলছেন, কিন্তু কথা বলছে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে। ফলে তাঁর দায়িত্বও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তিনি শেক্সপিয়রের সংলাপের মধ্যে দিয়ে তাঁর নিজের সময়ের সত্যকে প্রতিভাত করছেন। এটা কিন্তু সহজ বিষয় নয়। এই প্রসঙ্গে আমার মারলোন ব্র্যান্ডোর একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি বলছেন—এই যে হলিউডে সব তাবড়ো তাবড়ো অভিনেতা, তাঁরা কেউ শেক্সপিয়রের কাব্য বলতে পারেন না। ব্রিটিশ মঞ্চ থেকে যাঁরা হলিউডে কাজ করতে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সকলকেই হলিউডের ফিল্মগুলোতে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।  

আমি যখন থিয়েটার করতে যাই, তখন খুব সংশয়াতুর থাকি। আমাদের চারপাশে যা সব ভালো কাজ হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল তো? পৃথিবীজুড়ে যেসব ভালো ফিল্ম নির্মিত হচ্ছে, যতটা সম্ভব আমি তা দেখছি তো? দেশ-বিদেশে থিয়েটারেও যা ভালো কাজ হচ্ছে, সে সম্পর্কেও কি আমি যথেষ্ট খবর রাখছি? কবিতা লেখার আঙ্গিক, ভাষা-ব্যবহার বা ছন্দ-প্রয়োগে যা কিছু ঘটছে, সেসব আমি পড়ে দেখছি তো? আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন ঝড় উঠতো অ্যালবেয়ার কামু, কাফকা, জঁ পল সার্ত্র এঁদের নিয়ে। পরবর্তীতে দেখা গেলো, চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলেছেন মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, জাক লাকাঁ। ক্রমশ পেরি আন্ডারসন, দেলিউজ—এঁদের নিয়ে চিন্তাভাবনার জগতে নানা লেখা আত্মপ্রকাশ করলো। আমি কিন্তু name drop করার জন্য বলছি না। সম্ভ্রম আদায় করার জন্যও এই নামগুলোর উল্লেখ নয়। বরং যা বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে, চিন্তার জগতে যেসব পালাবদল ঘটছে, আমি সেগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট মনোযোগী তো? না কি আমি ফেসবুক, টুইটার, এগুলোতেই বেশি সময় দিচ্ছি? ২০০৪ সালে ফেসবুক আসে, ২০১০ সালে টুইটার এবং ২০১১ সালে হোয়াটসঅ্যাপ। এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক এবং আমাদের সংস্কৃতির ওপর এগুলির প্রভাব কী?

পরিচালক বা ডিরেক্টরের ভূমিকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আগে নাটকে অভিনয় করেছেন, পরে নাটক লিখেছেন। আমরা দেখবো, ১৮৯৬ থেকে ১৯০৮ রবীন্দ্রনাথ কোনও নাটক লিখছেন না। তিনি সামগ্রিকভাবে পরিপ্রেক্ষিতটা পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্‌কালের কথা বলছি। এক্সপ্রেশনিজমের প্রচার-প্রসার হচ্ছে। প্রাচীন গ্রিসেও সোফোক্লিস, এস্কাইলুস প্রমুখ ছিলেন অভিনেতা। আমাদের দেশে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে বলা হতো ‘মোশন মাস্টার’, ‘ম্যনেজার’, ‘বুক কিপার’, অর্থাৎ যিনি আগাগোড়া শো সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বা রান করাবেন।

১৮২৫ সালে বিখ্যাত ফরাসি কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার ভিক্টর হুগো থিয়েটার নিয়ে এক ইস্তেহার লেখেন। এই ইস্তেহারে ছিল সে সময়ের আভাঁ গার্দ থিয়েটার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য। হুগো বললেন,  ট্র্যাজেডি, কমেডি, এই বিভাজনের কোনও অর্থ হয় না। অ্যারিস্টটলের তিন ঐক্যের সূত্র, অর্থাৎ স্থান, কাল এবং অ্যাকশনের ঐক্য—এই থ্রি-ইউনিটিকে হুগো অস্বীকার করলেন। হুগো আরও বললেন, নতুন শতাব্দীতে যাঁর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন ডিরেক্টর। তাঁকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পরে, শিল্পবিপ্লব ঘটার পরেই আমরা দেখি, ধীরে ধীরে ডিরেক্টরের ধারণাটা বিকশিত হচ্ছে। এর আগে প্রধান অভিনেতাই ডিরেক্টর হতেন। শিল্পবিপ্লবের সময়ই অপেরা আঙ্গিকটিরও উদ্ভব হয়। এই প্রসঙ্গে ভাগনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, সংগীতের সুর হচ্ছে নারী, কথা হচ্ছে পুরুষ। এদের সহাবস্থানের তাৎপর্য কে বুঝবেন? তিনি হচ্ছেন কনডাক্টর। এই কনডাক্টরের ধারণা থেকেই ক্রমশ ডিরেক্টরের ধারণা গড়ে ওঠে।

১৮৮৭ সালে ফ্রান্সের আন্তোনিও, যিনি ল্যুভর থিয়েটারের পরিচালক ছিলেন, তাঁকেই ডিরেক্টর বলা হতো। এর পর আমাদের পৌঁছোতে যেতে হবে ১৮৯৮ সালে মস্কো আর্ট থিয়েটারে। এই নাট্যশালাকেই কেন্দ্র করে গোটা ইউরোপে আধুনিক অর্থে ডিরেক্টর বিষয়টি প্রসারিত হয়। সকলেই জানেন, কনস্তান্তিন স্তানিশ্লাভস্কির কথা। স্বভাববাদী অভিনয়ের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই রুশ নাট্যপরিচালক। অনেকেরই মনে পড়বে, ভ্লাদিমির দাঞ্চেঙ্কোর সঙ্গে তাঁর ১৮ ঘণ্টার আলোচনা, যার ফলশ্রুতি ১৮৯৮ সালে মস্কো আর্ট থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা এবং ইতিহাস-সৃষ্টিকারী সব প্রযোজনা, যার প্রথমটি হলো আন্তন চেকভের ‘দ্য সিগাল’ (১৮৯৮)। স্তানিশ্লাভস্কি অভিনয় করেছেন, কিন্তু কখনওই প্রধান অভিনেতা ছিলেন না। তবে আমাদের দেশে গিরিশবাবু, শিশিরবাবু, দানীবাবু, এমনকী শম্ভুবাবু, উৎপল দত্তরাও নিজেরাই পরিচালক এবং নিজেরাই প্রধান অভিনেতা। নান্দীকারকে বলা হতো অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়র দল, বহুরূপীকে বলা হতো শম্ভু মিত্রের দল।

ইউরোপে ১৮২৫-পরবর্তী সময় থেকেই প্রশ্ন উঠতে লাগলো যে প্রধান অভিনেতাই ডিরেক্টর হবে কেন? অভিনেতার কাজ আলাদা এবং ডিরেক্টরের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। ডিরেক্টরকে তো মঞ্চ, আলো, সংগীত, অভিনয়—প্রত্যেকটা বিষয়ই দেখতে হবে। আমাদের দেশে বিভাস চক্রবর্তী অনেকাংশে এই বিষয়টা কার্যকরী করার চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া থিয়েটারের দলগুলি হতো অনেকটা কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সংগঠনগুলির ধাঁচে গঠিত। বিভাসবাবু এই মডেলটা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখা গেলো অপ্রধান অভিনেতার ভূমিকায় এবং পরিচালকের দায়িত্ব সামাল দিতে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সুমন মুখোপাধ্যায় এই বিষয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যখন পরিচালকের ভূমিকায়, তখন সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রণিধানের ক্ষেত্র।

থিয়েটারে দর্শক কি কমছে?

থিয়েটারে লোকসংখ্যা বাড়া-কমা নিয়ে আমি ঋত্বিককুমার ঘটকের মতকেই সম্পূর্ণ সঠিক মনে করি। ওই যে উনি বলেছিলেন—ছবি ফ্লপ করবে কেন, আমার দর্শক ফ্লপ করেছে। এটা ঠিক যে, খুব ভালো থিয়েটার হয়তো হচ্ছে না। সেটা কি শুধু বাংলার সমস্যা না কি? ভার্চুয়াল স্পেস কি শুধু বাংলায় তৈরি হয়েছে, আর কোথাও না? উদাহরণ হিসেবে, মহারাষ্ট্রে কি খুব দারুণ কাজ হচ্ছে? কিন্তু দেখুন, মহারাষ্ট্রে একজন থিয়েটার অভিনেতা লোন-এ ফ্ল্যাট কিনে ইএমআই শোধ করতে পারছেন। একটা তামিল ছবির মুক্তি পাওয়ার সাত আট দিনের মধ্যে তার টাকা উঠে আসছে। আমাদের এখানে থিয়েটার করে টাকা চাওয়াকে একসময় দোষের বলা হতো। গ্রুপ থিয়েটারের লোকেরা পেশাদার রঙ্গমঞ্চকে নেকনজরে দেখতেন না। এই সব সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষতি হয়েছে। থিয়েটারের মধ্যে এই লড়াই থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। কাজের গুণ দিয়ে থিয়েটারকে বিচার করতে হবে। আমার ’১৭ জুলাই’ নাটকে একটা সংলাপ ছিল, ‘একটা প্রতিপক্ষ চাই!’। আমাদের অভ্যাসেও একটা অপরকে নির্মাণ করার ঝোঁক আছে। এটা ভয়ের।  

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>