এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। এবার বসতে দেওয়া হয়েছে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার থেকে হাত-পা ছড়িয়ে বসা সব সময়েই আরামের। কিন্তু দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা থাকলে বসা আর আরামের থাকে না। কাধ দুটো ঝুঁকে পড়ে। কনুইগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে সামনের দিকে। পিঠে লাগে। মনে হয়, কে যেন লোহার চেন দিয়ে পিছনেও টানছে, আবার সামনেও টানছে। কষ্ট হয়।
পচা কষ্ট করেই বসেছে। এটা মারের সময়। সাধারণ মার নয়। চোরের মার। চোরের মার অতি মারাত্মক জিনিস। কথায় আছে ‘চোরের মার’। কথা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এই সময় এত সুবিধে-অসুবিধে দেখলে চলে না। বসতে বলেছে এটাই যথেষ্ট।
‘অ্যাই ছোঁড়া, তোর নাম কী?’
পচা বিড়বিড় করে বলে, ‘পচা’।
কেউ শুনতে পেল বলে মনে হয় না। চোরের নাম জানার জন্য কেউ ব্যস্তও নয়। জিজ্ঞেস করতে হয় তাই করা।
মার বলতে প্রধানত থাপ্পড় এবং লাথি। সেই সঙ্গে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি। সমস্যা হচ্ছে, প্রতি ঝাঁকুনিতেই হাতে চুল উঠে আসছে। গোছা গোছা চুল। বারো-তেরো বছরের একটা নোংরা ভিখিরি ধরনের ছেলের চুল হাতে উঠে আসা ভাল জিনিস নয়। একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। হারামজাদা কতদিন স্নান করেনি তার ঠিক আছে? কোনও ঠিক নেই। করলেও তেল, সাবান যে দেয় না সেটা নিশ্চিত। মারের সময় তো হাতে শ্যাম্পুর শিশি ধরিয়ে বলা যায় না, ‘যা আগে ভাল করে স্নান করে আয়। তারপর তোকে ঠ্যাঙাব।’বলা যায় কখনও? বলা যায় না।
তবে সুসংবাদ হল, খানিক আগে চুল ওঠা বন্ধ হয়েছে। সম্ভবত অনেকটা ছিঁড়ে, ওপরে উঠে যাওয়ার পর চুল নিজেই নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নিয়েছে। অনেক সময় এরকম হয়। শরীর কিছুটা সময় বাইরের সাহায্যের জন্য হাঁকুপাঁকু করে। তারপর নিজেই নিজের জন্য এগিয়ে আসে। তবে ঘটনা যাই হোক, আসল কথা হল, চুল এবার ধরা যাচ্ছে নিশ্চিন্তে। চোর ঠ্যাঙানোর সময় ঘনঘন চুলের মুঠি ধরতেই হবে। চুল খামচে ধরে ইচ্ছেমতো মাথাটা ডানদিক-বাঁদিকে, ওপরে-নীচে পেঁচিয়ে-পুঁচিয়ে ফেলতে হয়। এই ক্ষেত্রেও হচ্ছে। সুবিধে হল, ছোট মানুষ। বেটার ঘাড় এখনও তেমন শক্ত হয়নি। একটা প্লাস্টিক প্লাস্টিক ভাব রয়েছে। মাথা দুমড়ে-মুচড়ে দিতে বিরাট কিছু কসরত করতে হচ্ছে না। অল্পেই হচ্ছে।
মঙ্গল এবং তার বড় জানকী দু’জনেই এই ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করে। দু’জনের দু’রকম কাজ। মঙ্গল পেয়েছে দারোয়ানের দায়িত্ব। তার চেহারা ভারী এবং গলার আওয়াজ মোটা। দারোয়ান হিসেবে এই দুটি জিনিসেরই খুব প্রয়োজন। এই যোগ্যতার জোরে তাকে দিনে এবং রাতে ডিউটি দেওয়া হয়েছে। দিনের ডিউটিতে সারাদিন গেটের সামনে টেবিল নিয়ে বসে থাকতে হয়। কেউ এলে মোটা খাতায় তার নাম, ঠিকানা, বাবার নাম লিখে ফেলতে হয়। রাতের ডিউটিতে লেখালিখির কোনও ব্যাপার নেই। কাজ হল শুধু দু’ঘণ্টা অন্তর একবার করে বাড়ি চক্কর দেওয়া এবং হাঁক পাড়া। এর জন্য তাকে খাকি পোশাক এবং বেঁটে লাঠি কিনে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তার বউ পেয়েছে খুটখাট ফাইফরমাশের দায়িত্ব। দোকান-বাজার, পোস্টাপিস এইসব।
কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।
চেহারা ভারী হলেও মঙ্গল খুবই ভিতু ধরনের একজন মানুষ। ফ্ল্যাট চক্কর তো দূরের কথা, রাতে ঘরের বাইরে যাওয়ার মুরোদই তার নেই। গভীর রাতে ঘরের বাইরে খুটখাট আওয়াজ হলে সে হাত বাড়িয়ে জানকীকে ঠেলা দেয়। জানকীর ঘুম গভীর। চট করে ভাঙতে চায় না। তবু সে স্বামীর ঠেলায় চোখ কচলে তক্তপোশের ওপর উঠে বসে। বসে হাঁক মারে— ‘কৌন হ্যায়? কৌন হ্যায় শালা?’
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যের গোপন খবর হল, বেঁটে লাঠিটা আজকাল মঙ্গলের বদলে জানকীর হাতের কাছেই থাকছে।
আজ ভোরে বাড়ির সামনে পচাকে সন্দেহজনকভাবে ঘুরতে দেখে মঙ্গল তাকে ধরতে পেরেছে দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ, ঘটনা দিনের আলোয়। দু’নম্বর কারণ হল, চোরের বয়স অল্প। অল্পবয়সি চোর ফ্ল্যাটবাড়ির উলটোদিকের মাঠে দাঁড়িয়ে হিসি করছিল। মঙ্গল গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে।
মঙ্গল চোর ধরেছে— এই খবর জানাজানি হয়েছে খানিকটা পরে। চোরকে বেঁধে ফেলার পর।
‘বল, হারামজাদা বল। সাতদিন ধরে তুই এই ফ্ল্যাটের সামনে ঘুরঘুর করছিলি কিনা বল। তিনতলার চুরিটা কার কাজ?তোর?বল, বল আগে। তিনতলায় উঠলি কী করে?সিঁড়ি দিয়ে? পাইপ বেয়ে?চেহারাটা যেরকম টিকটিকির মতো রেখেছিস তাতে তো মনে হচ্ছে, দেওয়াল বেয়ে ওঠা-নামা করিস৷ বল, চুরির জিনিস কোথায় বেচিস?আর ক’টা বাড়িতে এই কাণ্ড করেছিস?মালগুলো বেচেছিস কোথায়?কী রে চুপ করে আছিস কেন? কথা বল। না বললে তোর ঘাড়খানা মটকে একদম মেরে ফেলব। এই দেখ, এইভাবে মটকাব, এই যে, এই এই এইভাবে…।’
পচা চিৎকার করে ওঠে। প্রথমে চাপা। তারপর তীব্র, তীক্ষ্ণ। ঘাড় যত বেঁকে চিৎকার তত তীক্ষ্ণ হয়। উঁচু ফ্ল্যাট, অনেকে উঁকি দেয়।
আরো পড়ুন: মিথ্যে মৌ । প্রচেত গুপ্ত
চুল খামচে শুধু মেরে ফেলার হুমকি নয়। প্রতিটা হুমকির শেষে একটা করে জোর থাপ্পড় দেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। থাপ্পড় যে মঙ্গল একা দিচ্ছে এমন নয়। অন্যরাও দিচ্ছে। আশপাশের ফ্ল্যাট থেকেও অনেকেই চোর দেখতে আসছে। দারোয়ান, কাজের লোক, মিস্ত্রি-মজুররা যেমন আছে, তেমনি বাবুরাও আছে। বাজার যাওয়ার পথে, ছেলেমেয়েকে স্কুলবাসে তুলে এসে দেখে যাচ্ছে। দেখে যাওয়ার পথে থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের থাপ্পড়ে গাল লাল হয়ে ওঠার কথা। শুধু লাল নয়, ফেটে রক্ত পড়লেও আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু পচার সেরকম কিছু হচ্ছে না। সম্ভবত, ছোকরার রক্তে টানাটানি আছে। থাপ্পড়ে লাল হওয়ার মতো এক্সট্রা রক্ত তার নেই।
একটা ভাঙা কাচের প্লেটে আলুর দম আর পাউরুটি এসেছে। সঙ্গে হাতল ভাঙা কাপে জল। আলুর দমে ঝোল অনেকটা, আলু মোটে একটা। তবে পাউরুটি দুটো। আনন্দের কথা হল, মিষ্টিও আছে। প্লেটের কোণে, পাউরুটির আড়ালে একটা লাড্ডু উঁকি মারে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, জিনিস বাসি। হোক বাসি। পচা ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে, লাড্ডু সে সবার শেষে খাবে। শেষপাতে মিষ্টি।
কেউ একজন হাত খুলে দিল।
‘নে খেয়ে নে। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। তারপর ঠেলা কাকে বলে বুঝবি। তখন চুরির মাল বের করবি সুড়সুড় করে। এক ফোটা ছেলের রস নিংড়ে বের করব।’
হাত নামিয়ে প্লেটটা ধরতেই কাঁধের কাছটা টনটনিয়ে উঠল। হাতে কে যেন পাথর বেঁধে রেখেছে। ব্যথার পাথর। সেই পাথর হাত নামিয়ে দিতে চাইছে টেনে। আঙুল নড়তে চাইছে না। মনে হচ্ছে, নখে নখে সুই ফোঁড়ানো! অনেক কায়দাকানুন করে, দাঁতে দাঁত চেপে খাবার তুলে মুখে দিল পচা। মুখে দিতেই মাথা পর্যন্ত ঝনঝনিয়ে উঠল! বাপ রে! বাপ রে কী ঝাল! সত্যি ঝাল?নাকি, মুখের ভেতর কাটাকুটি হয়েছে?অসম্ভব নয়। হতেই পারে। বেমক্কা মারধরে সারা গায়েই কাটাকুটি হয়েছে। ঠোঁট ফেটেছে, নাক থেকে রক্ত পড়েছে, মুখের আর দোষ কী?এখন মনে পড়ছে খানিক আগে জ্বালার সঙ্গে একটা রক্ত রক্ত স্বাদও পাচ্ছিল। হোক, যা খুশি হোক। মারধরে জ্বালা-যন্ত্রণা হবে না তো কী হবে?আরাম হবে? খাওয়ার সময় ওসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।
পচা কামড় দিল পাউরুটিতে। কামড় হল না। ব্যথার কারণে চোয়াল জমে গেছে। থম মেরে আছে। নড়তে চাইছে না। কিছুতেই নড়তে চাইছে না। নড়াতে গেলে ব্যথা বাড়ছে। মাথা ঘুরে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, ডাক দিয়ে কেঁদে উঠি। পচা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। আবার চেষ্টা করল।
না, পাউরুটি খারাপ নয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের মারের পদ্ধতিপ্রকরণ কীরকম হবে? সম্ভাবনা অনেক। সকাল থেকে চোরকে ঘিরে আলোচনা চলছে। মার-সম্পর্কিত আলোচনা। অনেকরকম পরামর্শ, পরিকল্পনা।
‘বেটা যে মুখ খুলছে না কিছুতেই। একেবারে কুলুপ দিয়েছে।’
‘খুলবে। ঠিক খুলবে। তোমরা খোলাতে পারছ না তাই খুলছে না।’
‘থানায় দিয়ে এলে কেমন হয়? পুলিশ বুঝে নেবে। পুলিশের ডান্ডা খেলে জামাপ্যান্টে হেগেমুতে দেবে।’
‘অসভ্যের মতো কথা বোলো না। মনে রাখবে এটা ভদ্রলোকের পাড়া। চোর পেটাচ্ছ বলে লাটসাহেব হয়ে যাওনি। পুলিশে দিলে খারাপ হয় না। ভালই হয়। তবে তার আগে নিজেরা আধমরা করে দেওয়াটাই ভাল। পুলিশের সঙ্গে এদের কনাইভেন্স আছে। বখরার ব্যবস্থা থাকে। তোমরা চলে এলে, ছেড়ে দেবে। মনে রেখো, এত বড় একটা বিজনেস এমনি এমনি রান করে না। অনেক ভেবে রান করাতে হয়। ভাল করে ধোলাই দাও। আর যেন এমুখো না হয়।’
‘ধোলাই তো কম হচ্ছে না।’
‘মনে হচ্ছে, কম হচ্ছে না। আসলে কমই হচ্ছে। এরা মার খেয়ে খেয়ে হ্যাভিচুয়েটেড। অভ্যস্ত। আমার ধারণা চোরদের মার খাওয়ার ট্রেনিং হয়। এদের শুরুই করতে হয় ওপর থেকে।’
‘দাদা, সেটা একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা মাঝখান থেকে শুরু করেছিলাম। প্রথমেই হারামজাদার পাছায় মারা হয়েছে।’
‘আবার?আবার স্ল্যাং?তোমার বললাম না, এই বাড়িগুলোতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টিচাররা থাকেন?বলিনি তোমায়?তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আছে। তারা কী শিখবে?হোয়াট দে উইল লার্ন? কথা বলবে মুখ সামলে।’
‘আর হবে না। তা হলে কি দাদা, হাত-পা ভেঙে দেব?’
‘বুদ্ধি খারাপ নয়। তবে হাত-পা দুটো ভাঙার দরকার নেই। শুধু হাত ভাঙতে পারো। হাত ভাঙলে কী হবে জানো?’
‘কী হবে?’
‘অনেকদিন মনে থাকবে।’
‘তা হলে দুটো হাতই ভেঙে দিতে বলি?’
‘বোকার মতো প্রশ্ন করছ কেন?ছোকরার কি দশটা হাত? হাত যখন দুটো তখন দুটোই ভাঙবে। দশটা হলে দশটা ভাঙতে। সামান্য একটা ফচকে চোর | কবে কোন ফ্ল্যাট থেকে দুটো ঘড়ি, একটা মোবাইল, দুটো গলার হার চুরি করেছে, তাকে তোমরা এতজন মিলে ট্যাকল করতে পারছ না! টিচ হিম আ গুড লেসন।’
‘কীরকম দাদা?’
‘আঃ চুপ করো। ইংরেজি জানো না সেটা জাহির করে বলতে হবে না।’
‘আচ্ছা, ঝোল্লা মার দিলে কেমন হবে?
‘ঝোল্লা মার!সেটা আবার কেমন?
‘ঝোল্লা মার হল ঝুলিয়ে মার। হাত দুটো বেঁধে ওপর থেকে শরীরটা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। ছোকরার বডি দুবলা পাতলা আছে। সহজেই ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেব। তারপর লাঠি দিয়ে পায়ের তলায়…। মাথা পর্যন্ত টং টং করে বাজবে। মানে হবে পায়ে নয়, লাঠি মাথায় পড়ছে। নকশাল পিরিয়ডে এ জিনিস হেভি পপুলার ছিল দাদা। থানায় থানায় ঝোল্লা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পাকা ব্যবস্থা।’
‘আইডিয়া মন্দ নয়। তবে মরে টরে যাবে না তো? দেখো বাবা। মরে গেলে আর এক চিত্তির। ফ্ল্যাটসুদ্ধু লোকের হাতে হাতকড়া পড়বে। আমাদের দেশ বড় অদ্ভুত। সব কিছুতেই মরা পর্যন্ত ছাড় আছে। মরা পর্যন্ত যা খুশি আলাউ। মরলেই কেস ঘুরে যায়।’
‘কী যে বলেন। এরা হল গিয়ে দাদা কই চোর।’
‘কই চোর!কই চোর ব্যাপারটা কী?’
‘কই চোর মানে হল কই মাছের মতো প্রাণ। কড়াইতে তেল ফুটিয়ে ফেললেও মরবে না। লাফাবে। চেঁচাবে। মরবে না। ছিচকেগুলো এরকমও হয়। কই ধরনের।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাজে বকতে হবে না। তোমরা যা ভাল বোঝো করো। তবে যেটাই করো সাবধানে করবে।’
ব্যবস্থা সাবধানেই হচ্ছে। পচা খাওয়াদাওয়া শেষ করে জল খেয়েছে। প্যান্টে হাত মুছেছে। তারপর তারিয়ে তাড়িয়ে লাড্ডুটা খেয়েছে আর পিটপিটে চোখে সেই ব্যবস্থা দেখছে। মই এনে বাড়ির গ্যারাজে উঁচু করে দড়ি ঝোলানো হচ্ছে। মইয়ের ব্যবস্থা করেছে মঙ্গল। দড়িও তার আনা। মনে হচ্ছে, ঝোল্লা মারের ব্যাপারে তার খুবই উৎসাহ।
এই পর্যন্ত ব্যবস্থা পচা মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু এর পরেরটুকু মারাত্মক। পচার দুবলা শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে দুটো চোখই বন্ধ করে।
এক বালতি জল আনা হয়েছে। ঠান্ডা জল। ঝোল্লা মারের সময় নাকি ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান। খুব বেশিক্ষণ নয়, মিনিট পাঁচেকের মামলা। তবু জলের ঝাপটা লাগে। তাই জলের ব্যবস্থা।
পচাকে যখন ঝোলানো হচ্ছে তখন ভয়ে এবং আতঙ্কে তার সারা শরীর কাঁপছে। এটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এরকম সময় শরীর কাপাঁটাই স্বাভাবিক। একটু পরে এ ছেলে জামাপ্যান্টও নোংরা করে ফেলবো।
পচা ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘নিয়ে যাও। নিয়ে যাও আমাকে…।’
সামনের লোকটা খনখনে গলায় হেসে উঠল।
‘নিয়ে যাও!কে তোমাকে নিয়ে যাবে বাবা হিরের টুকরো? হি হি। একটু পরেই নিয়ে যাওয়া কী জিনিস বুঝতে পারবে। হি হি।’
পচা তবু চোখ বুজে ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও আমাকে…’
ঘটনা সত্যি। দ্বিতীয় পর্যায়ের মার শুরুর আগেই পচা জামাপ্যান্ট ভাসিয়ে বমি করে ফেলে।
প্রথমটায় ভেবেছিল, অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু অজ্ঞান কোথায়?এই তো দিব্যি চোখ খুলে আছে। দেখতে পাচ্ছে সব। ঝুলে থাকা পা দুটো নাড়তে পারছে একটু একটু। তা হলে?তা হলে কি মার এখনও শুরু করেনি?আয়োজনের কি বাকি আছে আরও?
না, তা নয়। মার শুরু হয়ে গেছে। মঙ্গলের হাতে লাঠি। বেঁটে লাঠি। লাঠি দিয়েই সে মারছে। ভালই মারছে। কখনও পায়ের তলায়। কখনও হাঁটুতে। বেচারি মোটা মানুষ। এত লাফালাফি কি তার পোষায়? হাঁপিয়ে পড়ছে।
কে যেন বলে উঠল, হারামজাদার কাণ্ড দেখো। চিৎকার নাই। কান্না নাই। উলটে কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকায়! শালার শলিলে কি ব্যথা-বেদনা কিছু নাই? কষিয়ে আরও দু’ঘা লাগা।’
কষিয়ে লাগিয়েও কিছু হচ্ছে না। তা হলে কি এটা সত্যি মার নয়? এটা কোনও স্বপ্ন? কিন্তু আওয়াজ হচ্ছে যে? স্বপ্নে আওয়াজ হয় না। নাকি হয়? সে কি এমন একটা স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছে যেখানে মারের সময় আওয়াজ থাকে, কিন্তু ব্যথা থাকে না?
আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য!
ঘটনা আশ্চর্যের হলেও সত্যি। মারে আর কোনও ব্যথা নেই। শুধু তাই নয়, পচার মনে হচ্ছে, শরীরের পুরনো যন্ত্রণাগুলো যেন কমে কমে আসছে! কাঁধ দুটো আর ভারী ঠেকছে না। বরং বেশ হালকাই লাগছে। পালকের মতো?জিভের জ্বালাটাই বা কোথায়? পিঠটা যে টনটন করছিল! ওমা কী হল তার?কোথায় পালাল? মাথার যন্ত্রণাটাও যে উবেছে!
খানিক আগেই পচা বারবার কাকে নিয়ে যেতে বলেছিল জানা যায়নি। যে-ই হোক, সে পচাকে নিয়ে যেতে পারেনি। শুধু তার ব্যথাটুকু নিয়ে গেছে।
শারদীয় আজকাল, ১৪১৩
একজন বাঙালি সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তাঁর জন্ম কোলকাতার বাঙ্গুর অ্যাভিনিউতে একটি বৈদ্য পরিবারে। তিনি বাঙ্গুর বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি আরম্ভ করেন। মাত্র বারো বছর বয়েসে তাঁর প্রথম গল্প আনন্দমেলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালক তরুণ মজুমদার তাঁর ‘চাঁদের বাড়ি’ উপন্যাসটি অবলম্বনে একটি বাঙলা চলচ্চিত্র তৈরি করেন। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ‘চোরের বউ’ গল্পটি অবলম্বনে পরিচালক শেখর দাস ‘নেকলেস’ নামের একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। তিনি সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একটি পরিচিত নাম। তাঁর কিছু গল্প হিন্দি, ওড়িয়া এবং মারাঠি ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা পত্রিকা যেমন ‘উনিশ কুড়ি’, ‘সানন্দা’ এবং ‘দেশ’-এর নিয়মিত লেখক।