তেভাগু
সোনাগাছির যত ভেতরে ঢুকবে ততো গলিঘুঁজি, নোংরা ভরা প্লাস্টিকের প্যাকেট আর কুকুরের মোটা গুয়ের লাড্ডিতে ছয়লাপ। গলির গলি তস্য গলি শেষে এমন চেহারা নেয় যে মনে হয় ছুরির ঘায়ে পেটফাঁসা মানুষের নাড়িভুড়ি। হাতে করে এদিকে তুললে ওদিকটা এলোমেলো হয়ে ঝুলে পড়বে, ওদিক তুললে এদিকটা। মোট কথা গুছিয়ে এসব গলির হদিস পাওয়া মুশকিল। বাইরে থেকে প্রথমবার যারা আসে, ভয় পায়, রাস্তা চিনে ফিরতে পারব তো!
এরকম ধাঁধাওয়ালা রাস্তায় নয়, এনজিও-র বাড়িটা মসজিদবাড়ি গলির একেবারে মুখে। একপাশে ওদের ক্লিনিক, আর একপাশে এই শর্ট স্টে হোম। ফুসলে আনা বা নিজের ইচ্ছেয় ঘর পালানো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের কিছুদিন এখানে রাখা হয়। এখন যেমন একটি অল্পবয়সী মেয়ে আছে। তার দেখভালের দায়িত্বে আছে রিতা, এই পাড়ায় এই পেশায় যে প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। বয়স হয়ে যাবার পর সে এখন এনজিও-র সর্বক্ষণের কর্মী।
রেস্কিউড মেয়েটার চোপা নেই, খুব কম কথা বলে। ভালো, তাতে বকবক করতে হয় না, কাজ কমে। আলস্যে রিতা চেয়ারে বসে লম্বা হাই তোলে। চোয়ালের বাঁধান দাঁতের নীচে চুমকুড়ি মতো হয়।
কাল এই নতুন মেয়েটা ধরা পড়েছে রামবাগানে। ধরা ঠিক নয়, বাড়িউলি নিজেই দিয়ে গেছে এই হোমে। নইলে হুজ্জোতি বাধার চান্স ছিলো। একে তো বোধহয় মাইনর, তার ওপর আবার ছম্মক ছল্লো গড়নপিটন। এ পাড়ার কাউন্সিলরের ডানহাত শুভজিত বিশ্বাস সোনাগাছির রাখি উৎসবে স্টেজে উঠে রাখি পরে, মাইক টেনে বাতেলা মারে, আবার রোজ সন্ধেয় এ পাড়ায় ঘাঁটি গাঁড়ে। মুখ মিষ্টি খুব, কিন্তু নজর সর্বত্র। কে এলো, কে গেলো। তারমধ্যেই নিজের আশ মিটিয়ে নিতে জানে।
ফাউ জুটেছে কালু গুন্ডা। মাসির থোবড়ায় বায়নার টাকা ছুঁড়ে দিয়ে গেছে। ডাগর-ডোগর মেয়েটাকে তার চাই। নিলে লাও, নইলে তোমরা আটকে রেখেছ এই নালিশ যাবে পুলিশের কাছে। তারপর হুজ্জোত সামলাও। আর পুলিশ তো দুপক্ষের হাতেই তামাক, দুদু দুটোই খায়। সমঝে চলে একমাত্র এই এনজিও-কে। তাই ফালতু টাইম না উড়িয়ে বাড়িউলি রেখে গেল এইখানে।
মেয়েটা জল খাচ্ছিল, রিতা অলস চোখে মাপছিলো ওকে। মোটা গুছি বিনুনিটা পাছাটাকে ঘসটে আরো নীচে নেমে গেল, কনুই ভেঙে হাত উঠে গেল মুখের সামনে, টিয়া-লাল ঠোঁট ফাকা করে সরু ধারায় জল খেতে লাগলো মেয়েটা। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। বুকদুটো উঁচু হয়ে আছে থুতনি বরাবর। রিতা নিজেও এই লাইনে পঁচিশ বছর পার করেছে। ঠিকঠাক মাল চেনে বলে দেমাক আছে। এ মেয়ের দাম উঠবে। কী
গবগব করে জল খাচ্ছে দ্যাখো! এতো ভয়,আতঙ্ক যদি, দেশ ছেড়ে পালাবার সময় মনে ছিল না? যে জ্বালায় জ্বলেছিস, যে নরকে ফেঁসেছিস, আমার মতো বুড়ি হয়ে পেশা ছাড়ান না দিলে তার শেষ নেই। অন্য জ্বালাও এসে জুটবে তখন। হরেক রোগ। শরীর জ্বলে যাবে, পচা মাংস হাতে উঠে আসবে মাখা ময়দার মতো। তাও আগে তারা ডাক্তারের কাছে যেতে বেজায় লজ্জা পেতো, এখন এ লাইনের মেয়েরা বুক বাজিয়ে যায়। এনজিও থেকে ক্লিনিক করে দিয়েছে। চেম্বারে ডাক্তার আসে রোজ। আজও সেখানে মেয়েদের লম্বা লাইন, আর প্রচুর খিস্তি খাস্তা। দোতলার ঘরেও সেসব দেদার উঠে আসছে এই ভরদুপুরে।
– মাসি
মেয়েটা আচমকা রিতাকে ডাকে। রিতা মুখ তুলতেই বলে,
-তুমি কে?
এইবার রিতা একটু থমকায়। কি বলে এখন সে! পেশা ফুরোনো এক বুড়ি বেবুশ্যে, যে এই শর্ট স্টে হোমের ইন চার্জ এখন, তাকে সরাসরি পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে একটু ফাঁপর লাগে বইকি! একটু নড়েচড়ে বসে সে, পাশের জানালা দিয়ে গলার কাছে বুজকুড়ি কাটা একদলা কফ ছুঁড়ে ফেলে নীচে গলির দিকে। ততক্ষণে মেয়েটা এগিয়ে এসেছে তার কাছে। দুশ্চিন্তায় তার মুখের কালো রঙে আরো কালোর পোঁচ পড়েছে,
– কি হবে আমার!
গায়ে বোটকা গন্ধটা আজ একটু কম। কদ্দিন পর স্নান করতে পেল কাল কে জানে। কার কি হবে? ওর নিজের ? একটু হেসে নেয় রিতা,আর হবার কি বাকি রেখেছে, নাগর ফুসলে এনে দুদিন পর বিক্রি করে দিয়েছে শেয়ালদায় এক বিহারি ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে। তার কাছ থেকে আর একবার কিনেছে রামবাগানের মাসি।
– কি আর হবে, বাপু! তোমার হাড়ের পরিক্ষে হয়েছে। রিপোট এলে বোঝা যাবে বয়স কতো। আঠারোর নীচে হলে বাড়ি ফিরতে পারো। আর ওপরে হলে এ পাড়ায় পেশা করতে পারো। তোমার যা মন চায়।
– নিবে নি। মোকে আউ ঘরকে ঘুরেই নিবে নি।
হতাশায় মেয়েটার মুখ দিয়ে তার গ্রামের ভাষা বেরিয়ে আসে। যেন সে আলাপ করছে কোন আত্মজনের সঙ্গে।
– না নিবে তো না নিবে। থাকবি এখেনেই। আঠার হতে এক বচ্ছর বাকি থাকলে এক বচ্ছর, ছ’ মাস হলে ছ’ মাস। তারপর এডাল্ট হলে ঘর ভাড়া নিয়ে এ পাড়াতেই পেশা করবি। এই যে পুজো এসেছে, কতো মেয়ে নেপাল, বাংলাদেশ থেকে এসেছে। পুজোআচ্চায় সোনাগাছি রামবাগানে টাকা ওড়ে বুঝলি। শুধু ধরতে জানতে হয়।
যাইহোক যা রিস্ক থাকুক, একদিকে অন্তত এই পেশা করা কতো লাভজনক এটা মেয়েটার সঙ্গে নিজেকেও যেন বুঝিয়ে খুশি হচ্ছিল রিতা, হঠাৎ মেয়েটা পরিষ্কার গলায় বলল,
– না।
– কি না?
– পেশা না।
– ওবাবা, তুই যে দেখি সতীমায়ের অবতার। তো ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলি কেন আবাগির বেটি ? জানতিস না এসব ? ন্যাকামি হচ্ছে?
রীতার কেন এতো রাগ হয়ে যায় সে নিজেও জানেনা। শর্ট স্টে হোমে যে ক’দিনই রেস্কিউড মেয়েরা থাকুক না কেন, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে পইপই করে কো অর্ডিনেটর দিদি বলে দিয়েছে। মুখ খারাপ করা চলবে নাকো। এই এনজিও তাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে, নিজের পেশাকে সম্মান করতে বলেছে, আপদেবিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। আর রিতার মতো পেশার বয়স পেরিয়ে যাওয়া মহিলাদের জন্য অন্য সংস্থানের ব্যবস্থা করারও চেষ্টা করে। তাছাড়া বদ মেয়েও তো আসে। এটার মতো ম্যাদামারা তারা নয়কো মোটেই, পেশা করবে বলেই ঘর ছাড়ে, বাধা পেলে যা খুশি তাই করে বসতে পারে। এই তো কিছুদিন আগে দুটো রেস্কিউড মাইনর ঘুমন্ত ইন চার্জ কমলাদির মাথা শিলনোড়ায় থেঁতলে পালিয়ে গিয়েছিল। সাদা টপে রক্তের দাগ দেখে পুলিশ হাওড়া স্টেশনেই তাদের পাকড়াও করে। এ মেয়ে তেমন খুনচড়া নয়। কথাই বলে না, সারাক্ষণ বেজার মুখে বসে কি সব চিন্তা করে। তবু সাবধানের মার নেই। তাই পেশার অপমানে বেদম রাগ হলেও সে সুর নরম করে,
-কোন কাজকেই ছোট দেখতে নেই রে। অতো আপত্তি থাকলে তোর বাড়ি ছাড়া উচিৎ হয়নি বাপু। হ্যাঁরে, তোর নাম যেন কি ?
– তেভাগু।
– এ আবার কোন ঢঙের নাম রে! তেভাগু! তিন ভাগ করে খাবে…নাকি…
আবার একটা অশ্লীল ইঙ্গিত সে নিজেই হজম করে নেয়। এই হোমের ইন চার্জ সে। পদের সম্মান বলে একটা কথা আছে না। কোঁত করে কথা গেলে রিতা। সঙ্গে কিছু শ্লেষ্মারও সদ্গতি হয় আবার।
রিতার কথার জবাব না দিলেও তেভাগার মনে অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি। মা কাঁঠালগাছ জুড়ে ঘুঁটে দিচ্ছে। ভাইটা ছাগলের মুখে পাতা ধরবে বলে দৌড়চ্ছে, কোমরের ঘুনসিতে বাঁধা ঘুঙুর মৃদু আওয়াজ তুলছে ঠুংঠুং। বাড়ির সামনের ডোবাটায় এইসময় বালি হাঁস নামে। লোকে বাচ্চাগুলোকে ধরে ধরে খেতো বলে সে একদিন বারণ করে গুপী মামার চড় খেয়েছিল,
– দেওয়ানী হইবু?
তবু জোছনা পড়ে জলের ধারে কচুপাতা চকচক করলে সে জগন্নাথদেবকে আকুল হয়ে ডাকতো, আজকের মতো যেন বেঁচে যায় নরম খুদি বাচ্চাগুলো! আর মাঝরাতে মা হাঁসের কক কক আওয়াজ আর হুটোপাটিতে বুঝতো পুকুরে আজও লোক নেমেছে।
আর কখনো তার ডোবার ধারের বাড়িতে ফেরা হবে না! পথ হারিয়ে ফেললে যে ভয় আতংক ঝুঁটি ধরে নাড়া দিতে থাকে তেমন ভয় নয় তার। বরং যেন কেউ নিদান চড়িয়েছে আর কক্ষনো সে জল খেতে পারবে না, গলাভর্তি তেষ্টাতেও না। তাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যেন ঠাণ্ডা জল ভর্তি মেটে কলসির দিকে। ভয়ংকর আপসোস, কিন্তু দোষ দেবে কাকে! নিজের ইচ্ছেতে ঘর ছেড়েছে গোপালের হাত ধরে।
গ্রামের চৌহদ্দি না পেরোনো তেভাগু প্রথমে গেল ভুবনেশ্বর, সেখান থেকে হাওড়া। কত বড় রেলগাড়ি চড়ে মহানদী পেরোলো ঝমরঝম। নদীর শুখা বুক জুড়ে বড় বড় চাকার দাগ। কিসের দাগ গোপালকে জিজ্ঞেস করায় সে ছ্যাঁতলা পড়া দাঁত বার করে হাসে,
– ট্রাক বালু খুদতে আসে। আমি যেমন তোরে খুদি।
এখনো গায়ে কাঁটা দেয় তেভাগুর। সেই নিমগাছের নীচে প্রথমবার। হলদে খড় ঢুকে গিয়েছিল তার কালো চুলে, ফ্রক ধুলো মাখামাখি।
– মোকে ছাড়িবু তুই, গোপালদা?
তার কাতর মিনতির উত্তরে গোপালের হাত নতুন নতুন জাদু দেখাতে শুরু করে। টুকুস টুকুস টোকা মারে তার কপালে, থুতনিতে, বুকে পেটে। হাতদুটোই গোপাল হয়ে গেলে তেভাগুর শরীর ফুলে ফুলে উঠতে থাকে ভরা নদীর মতো। ছাড়তে চেয়ে সে আরো ঘন হয়ে লেপ্টে যায় গোপালের বুকের সঙ্গে। পউল পরবের গানের ছন্দের মতো ওঠা পড়া করতে থাকে তার নগ্ন কিশোরী শরীর যতক্ষণ না গোপাল এলিয়ে পড়ে তার উদোম বুকের ওপরেই। দম আটকে এলেও সে কিছু বলতে চায় না, এতো ভালো লাগে তার গোপালের গায়ের গন্ধ!
কিন্তু এইরকমই এলিয়ে থাকার সময় একদিন আকাশমুখো তেভাগু পরিষ্কার দেখলো দুটো পেঁচা উড়ে গেল নিম গাছের কোটর ছেড়ে, তাদের গোল ভাঁটার মতো চোখ থেকে ঘেন্নার আগুন নেমে এলো গোপালের পিঠে আর ডানা ঝাপটানোয় আওয়াজ উঠলো ছি ছি ছি। ভয়ে কেঁপে উঠল তেভাগু। গোপাল সেই ভয় বুঝতে না পেরে নির্লজ্জভাবে হাসল,
-কি রে, আরো চাই?
আসলে নিমগাছ খুব পবিত্র গাছ। ধর্মের গাছ। ওষুধের গাছ। মা বলতো। বহু যুগের পর কোন নিম গাছের বাকলে শঙ্খ চক্র গদা পদ্মের রেখা ফুটে বেরোয়। তখন আর সে গাছ গাছ থাকে না। দারুব্রহ্ম হয়ে যায়।
পান্ডারা আরো লক্ষণ মেলায়। খোদলে বাস করে কিনা শাবকসহ লক্ষ্মী পেঁচা আর গোড়ায় বিষধর সর্প। সব মিলে গেলে মহা ধুমধামে সেই দারুব্রহ্ম প্রভুর নবকলেবর নির্মাণের কাজে লাগে। জয় প্রভু জগন্নাথো!
বড় একটা নিশ্বাস ছাড়ে তেভাগু। কে জানে দারুব্রহ্মের অভিশাপেই সব এমন তছনছ হয়ে গেল কিনা। স্কুলে যেত তেভাগু। ক্লাস এইট পাশের পরীক্ষা দিয়েছে। ভূগোল বই পড়ে জেনেছে তাদের এই বান্ধিয়াজঙ্গল গ্রামটা পূর্ব মেদিনীপুরে হলেও, গোপাল আর তার মতো জড়াজড়ি করে আছে উড়িষ্যার সীমানার সঙ্গে। বাপ ছিল ভাগচাষী, লাল পাট্টির মাতব্বর। সেইই তার নাম রেখেছিল তেভাগা থেকে তেভাগু, আর ভাইটার নাম আকাল থেকে আকালু। একদিন ওই নিমগাছের তলেই বাপের বল্লমবেঁধা দেহ মিলল, সাজোয়ান শরীরটা পুরো রক্তশূন্য, গোঁয়ার মাথাটা অসাড় হেলে রয়েছে একদিকে। তারপর থেকেই বাপের গায়ের গন্ধ পাবে বলে মা পইপই করে না বলা সত্বেও তেভাগু স্কুল ছুটির পর একা বসে থাকতো গাছতলায়। নদীর দিক থেকে আসা শনশন হাওয়া চুলে বিলি কাটতো, মনে হতো বাপের চাষাড়ে মোটা মোটা আঙুল। ভুতে পাওয়ার মতো তেভাগু সেই আদর নিতে নিতে দেখতে পেত পাটে বসা সূর্য থেকে ঝরে পড়া সর্ষেফুলের রেণুর মতো গুঁড়ো হলুদ আলোয় কালোকোলো মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে মাথা সমান পাটক্ষেতের আবছায়ায়।
– বাপ গো!
-হ’ মা!
– অপঘাতের মরলা, ভুত হইবু বাপ।
বাবা উত্তর দিত না আর। কাছেও ডাকতো না। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিলিয়ে যেতো সন্ধ্যার অন্ধকারে।
একদিন ঐ পাটখেতের ভেতর থেকেই উদয় হলো গোপাল। মেয়েলি চেহারা, ফর্সা, পাতলা গোঁফের রেখা, তবে দাড়ি নেই। হাত পায়ে লম্বা লম্বা আঙুল, আর পেঁচার মতো বাঁকানো নাক। ঠাকুর গড়ে সে সীজনে, কিন্তু মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যায় গ্রাম থেকে। জিজ্ঞাসা করলে বলে সুরাতে কাপড়কলে কাজ করতে যায়। এইরকম কিছুদিন যাতায়াতের পর তার মুখের ভাষা বদলে গেল, চোখের চাউনি হলো ঝকঝকে। সে নাকি এখন মেট্রোরেলের মজুর হয়ে আছে বড় শহর কলকাতায়। তার মা হঠাৎ ভেদবমিতে মারা গেলে সে এসে গ্রামে রইল কিছুদিন আর তার মধ্যেই একদিন চক্কর কাটতে কাটতে তেভাগুর মুখোমুখি হল গোপাল। শুকনো মুখ, তেলহীন রুক্ষ চুলের কালো মেয়েটা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসেছিল।হাওয়ায় দুগাছি চুল উড়ে এসে পড়েছিলো চোখের ওপর। গোপালের চোখে কেমন নেশা লেগে গেল। সে তাড়াতাড়ি হাতে এলোমেলো করে ফেললো নিজের সযত্নে টেরিকাটা চুল, চোখ ভালো করে কচলে মুখ ঝুলিয়ে হতাশ এসে দাঁড়ালো তেভাগুর সামনে, যেন প্রথম যে কথা মেয়েটার মনে আসে তা হলো ‘আহা রে’!
হলোও তাই। তেভাগু শুকনো নিমপাতা হাতে সরিয়ে তাকে বসতে দিল। খুব নরম গলায় শহুরে উচ্চারণে গোপাল শুধোল,
– ভালো আছো, তেভাগু?
– ভালা আছি।
– ভালো নেই তুমি। বাপ ওমন ভাবে ফুঁড়ে গেলে ভালো থাকোই বা কি করে ! বুঝি গো আমি সব বুঝি।
– হ।
চোখ ভর্তি জল নিয়ে মাথা নাড়ে তেভাগু,
– ভালা নাই আমি।
গোপাল পাশে বসে অবলীলায় তেভাগুর হাঁটুর ওপর হাত রাখে।
– জানি রে জানি। সব কথা কি কওয়া যায়, না কইতে হয়। আয় তোকে কইলকাতা শহরের গপ্পো শুনাই। মন ভালো হয়ে যাবে।
সে গল্পে হাওড়া ব্রীজ আসে, ময়দান, গঙ্গার ধারে বসে ছেলেমেয়েদের প্রেম করা, সিনেমা দেখা। বড় বড় দোকান আর তেভাগুর মন্দ ভাগ্যের জন্য বড় মায়া। তারপর থেকে গোপাল ঘুরে ঘুরে দেখা করতে আসে। একদিন ওঠার আগের মূহুর্তে গোপাল লম্বা আঙুলে তেভাগুর থুতনি ধরে নিজের দিকে ফেরায়,
– নাকছাবি নাই তোর?
– নাই। নাকছাবি রইলে দ্যাখতে বড় ভাল্লাগে, না গোপালদা?
– লাগেই তো। এতো মায়াদারি মুখ!
এই মায়ার কথায় তেভাগু যেন গোপালের পোষা মেনি হয়ে যায়। তার সারা শরীরে আদর ছড়াতে ছড়াতে এতোদিন পর আলহাদে গোপাল নিজের ভাষায় বকবক করতে থাকে,
– হাতে কি রইবে? তেভাগুমণির হাতে কি রইবে? শাখা, পলা কতরি। কাইয়া মাইজি তো কি, গলায় সোনার চ্যান দিলে রূপ ফাটি যাবা। আমার সাথে রইবা তো সোনার রিং বনি দেবা।
তেভাগুর টান টান স্নায়ুতে ঢিল পড়ে। মায়ের আর আকালুর কথা ভুলে সে সমস্ত শরীর লম্বা করে দেয় মেনিটার মতোই। না দেখা ল্যাজের ডগা মৃদু মৃদু আছড়ায় মাটির ওপর। কান দুটো খাড়া করে গভীর চোখে তাকায় গোপালের দিকে। নাভির ভেতর থেকে আরামের উদগার উঠে আসে, গররররর। গোপাল আরো ঘন হয়, যেন এখনি কোলে তুলে নেবে আলহাদী মেনিটাকে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। রিতা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নীচে দারোয়ান আসতে দিয়েছে যখন তখন এ কোঅর্ডিনেটর দিদিই হবে। তনুজা ঘরে ঢুকে বলে,
– জল খাওয়াবে রিতাদি?
– এই যে দিদি।
কাচের গ্লাসে জল ঢেলে রিতা টেবিলের ওপর সদ্য রাখা বড় প্যাকেটটা দেখায়,
– রিপোট এলো, দিদি?
– হ্যাঁ।
আড়চোখে মেয়েটাকে একবার দেখেও নেয় কোওর্ডিনেটার। এক মুখ দুশ্চিন্তা নিয়ে জানালার শিক ধরে ভয়ে ভয়ে দেখছে তাকে।
– এদিকে এসো।
বাধ্য মেয়ের মতো তেভাগু এগোয়। কিন্তু ক্লান্ত লাগে তার খুব। এখুনি যেন মেঝের ওপর স্তূপ হয়ে খসে পড়বে সে।
– আরে আরে মেঝেতে বসছো কেন! এই চেয়ারটা আছে কেন তাহলে! বসো বসো। কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো ?
ঘুম ঘুম ভাব, তবু তেভাগু মাথা নাড়ায়। দিদির কামিজে কি সুন্দর ফুল ফুটে আছে, কানের ঝোলান দুলটাও কি সুন্দর!
– তুমি তো পড়াশুনো জানা মেয়ে। ক্লাস নাইনে উঠেছিলে। আমার কথা বুঝতে কোন অসুবিধে হচ্ছে কি? এখন কিন্তু আমি তোমাকে অনেকগুলো জরুরি কথা বলব।
বালিহাঁসের আর্তনাদ শুনতে পায় তেভাগু। মায়ের কাছে ফেরত দেবে তাকে, না এপাড়ার ঐ পুতনা রাক্ষসীর কাছে যেটাকে মাসী বলে ডাকে সবাই? সাত আটদিন ঘরে তালা মেরে রেখেছিল তাকে। দুবার একটু খাবার আর জলের বোতল। ভয়ে তার সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবু পেচ্ছাপ তো পেত একবার দুবার। সেই কটু গন্ধ, অন্ধকারে ইঁদুরের কিচকিচ, আর জং ধরা তালার শব্দ ঘিরে ধরলো তেভাগুকে । মাঝে মাঝে লোক এসে দেখে যেত তাকে। সঙ্গে দোক্তার গন্ধ ছড়ানো মোটা মাসির খিচুনি, ওঠ মাগি, ঢেমনি কোথাকারে, গোঁ ধরে বসে আছে। উঠে দাঁড়া বলছি। উঃ, মুতে একেবারে ফাটিয়ে রেখেছে গন্ধে !
পাশের ঘর থেকে বমির হড়হড়, মাতালের জড়ানো কথা, গালিগালাজ, হাসি।
তেভাগুর বড় কালো চোখ জলে ভরে গেল।
– এই দ্যাখো, আগেই কাঁদে! রিতাদি ওকে বোঝাওনি আমরা কি ভাবে কাজ করি ?
দিদি তার হাত ধরলো। নরম ঘেমো হাত। তারপর বলতে লাগলো,
– একটা মুশকিল হয়েছে তেভাগু। বোন অসিফিকেশন টেস্টে, মানে তোমার হাড়ের যে পরীক্ষা হয়েছে তাতে ডাক্তারবাবু একটু কনফিউজিং, মানে গোলমেলে রিপোর্ট দিয়েছেন। এই দ্যাখো লেখা আছে, শি হ্যাজ ফোরটিন টিথ ইন আপার জ’… তোমার ওপরের পাটিতে চোদ্দটা, নীচের পাটিতে তেরোটা দাঁত আছে।
গ্লাসে পড়ে থাকা জলটুকু খায় দিদি,
-হার হাইমেন শোড ওল্ড হিলড টিয়ার্স…আচ্ছা থাক,এটা না জানলেও চলবে। তারপর, আই টুক হার এক্স রে, মানে তোমার কবজি, কনুই,কাঁধের হাড়ের এক্সরে নিয়ে দেখা গেছে কনুইয়ের জয়েন্ট ১৩/১৪ বছরের মতো, রিস্ট জয়েন্ট ইজ ইউনাইটেড হুইচ ইউনাইটস এট দ্য এজ অফ 16/17 ইয়ার্স, আবার কাঁধের জয়েন্ট দেখাচ্ছে ১৮ বছর।
-ও মা, মাদারির খেল নাকি!
রিতা ফোড়ন কাটায় দিদি বিরক্ত হয়,
-থামো না রিতাদি। দেখছো তো কেমন নার্ভাস হয়ে আছে মেয়েটা…তেভাগু শোন, ফলে ডাক্তারবাবু লিখেছেন, আই এম অফ দ্য ওপিনিয়ন দ্যাট দ্য এজ অফ দ্য গার্ল ইজ 17/18 ইয়ার্স উইথ মার্জিন অফ এরর অফ সিক্স মান্থস অন আইদার সাইড। মানে আমরা ধরে নিচ্ছি তোমার বয়স আঠার হতে হয়তো এখনো ছ মাস বাকি। এই ছ মাস তুমি এই শর্ট স্টে হোমেই থাকবে।তারপর বাড়ি ফিরতে চাইলে ফিরবে, পেশা করতে চাইলে করবে।
চরম আতঙ্কিত অবস্থাটা কেটে যেতেই তেভাগুর চোখ বুজে আসে। কতকাল ভালোমতো ঘুমায় না সে। গলা শুকিয়ে কাঠ। অনেককাল আগে কাঁথিতে দেখা ক্ষুদিরামের সিনেমার মতো সে যেন গোল পাকানো দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ। হাত দুটো পেছনে আঁটা। দিদির বলা শেষ হলেই রিতা ফাঁসটা আঁটো করে দেবে। পেশা পেশা পেশা। এ কথাটা কতোরকমের হয়! তার বাপ ছিল চাষা, গোপালের বাপ তাঁতি। এখানে পেশা মানে মুখে রঙ মেখে রাস্তায় পুরুষ ধরা, বন্ধ দরজার পাল্লার ফাঁকে চোখ রেখে দেখেছে সে এ ক’দিন। আর ভাবতে পারছিলো না তেভাগু। তার দু চোখ ভারি হয়ে গেছে। ছ’ মাস অনেক সময়। বাঁচা মরা ঠিক হয়ে যায় ছ’ মাসে, আর পেশা ঠিক হবে না !
-দিদি, ঘুমাই?
তার এই হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোতে একটু ঘাবড়ে যায় দিদি।
-ঘুমোবে? এখুনি? রিতাদি, ওর খাবার ব্যবস্থা করে দাও, ও শুয়ে পড়ুক।
তেভাগু যেন শুনতেই পায় না। পাশের ঘরের বিছানাটা তাকে টানছিলো গোপালের গায়ের গন্ধের মতো। দু’জোড়া অবাক চোখের সামনে দিয়ে সে প্রায় দৌড়ে যায় মাঝের দরজাটার দিকে। ও ঘরে ধপাস শব্দ হয় বিছানার ওপর।
একটা হাত তার চৌকির বাইরেই ঝুলছিল। ভয়ানক তাড়াহুড়োয় ঘুমিয়ে পড়লে যা হয় আর কি! মাথার কাছে মন্দির, কাবা, চার্চ, গুরদোয়ারার ছবি নিয়ে একটা ক্যালেন্ডার ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছিল ফররফর। এপাড়ার প্রায় ঘরেই এই ক্যালেন্ডারটা দেখা যায়। তার নাক বরাবর ছাদ থেকে তাকিয়ে ছিল মস্ত টিকটিকি, নজরে হলুদ বালবের গায়ে কালো ফুটকির পোকা। এসব কিছুই তেভাগুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনা, কারণ তার স্বপ্নে তখন সেই বুড়ো নিমগাছ আর তার ছোট ছোট সাদা ফুল। গুঁড়ির গায়ে যেগুলোকে মনে হয়েছিল বৃষ্টি আর হাওয়ার আঁক কাটা, সেগুলো আসলে শঙ্খ চক্র গদা পদ্মের আদল। নতুন দেহ ধারণ করবেন প্রভু, তাই দলে দলে পান্ডা ধেয়ে আসছে বৃক্ষদেবতার দিকে যার নীচে প্রথম শরীর মিলেয়েছিলো সে আর গোপাল। তেভাগু স্বপ্নেই হাঁকপাক করে, তার মুখ ভিজে যায় ঘামে, সে সবাইকে ডেকে বলতে চায় এ গাছকে তারা দুজন মিলে অশুচি করে দিয়েছে, এতে নব কলেবর হবেনা। তাছাড়া ডিম ফুটে সবে বেরিয়েছে প্যাঁচার সাদা তুলতুলে বাচ্চা, সাপ খোলস ছেড়ে এখনো বেশিদূর যায়নি, এ তাদের আশ্রয়। এর গায়ে কুড়ুল মারতে আছে!
কিন্তু তার সব কথা চাপা পড়ে যায় অজস্র কলরবে, ঢোল সানাই কত্তাল জগন্নাথের জয়গান, গ্রামের বৌ ঝি, শিকনি পড়া ল্যাংটা বাচ্চা, জোয়ান মরদের ফিসফাস। তার সঙ্গে মেঘের হাঁকড়ানি, বাতাসের গর্জন। কেমন গম্ভীর অন্যরকম শব্দের হাট, যেন গা ছমছম করে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে গোপাল এসে তার হাত ধরে। শহুরে ভাষায় বলে,
– সবাই ব্যস্ত। চল এই ফাঁকে পালিয়ে যাই।
– মট্টে না। আর না।
জেদি তেভাগু ঘাড় নাড়ে।
খ্যা খ্যা হাসে গোপাল। লালায় ভেজা ওর আলজিভটা অব্দি দেখা যায়। দু হাতে পাকলে ধরে মেয়েটাকে। তেভাগু চেঁচাতে থাকে,
– ছাড়, কুত্তার বাচ্চা। জুত্তা মারি তর মুখ ফাটি দেবা। সব লোক ডাকি কইবা, মাইর খাওয়াইবা।
– তাই নাকি! মাইর খাওয়াইবা! জুত্তা মারি মুখ ফাটি দেবা! এত্ত সাহস! দ্যাখ কাইয়া মাইজি, দ্যাখ…
তেভাগুর চোখের সামনে গোপাল যেন গলে গলে পড়তে থাকে। তার চোখ বিশাল গোল হয়ে ওঠে, ফর্সা চামড়ায় মেশে কালচে নীল। হাঁটুর নীচটা গলে পড়তে তেভাগুর কোমরের কাছে এসে পড়ে তার মাথা। হাতদুটো কনুইয়ের নীচ অব্দি মিলিয়ে যাবার আগেই সে খামচে ধরে তেভাগুর বুক,
– চিল্লা কাইয়া মাইজি চিল্লা। আরে আমিই জগতের নাথো। তোকে বাঁচাইবে কে?
এইবার ডুকরে ওঠে তেভাগু,
– বাবা… বাঁচাও।
পাশের ঘরে টেবিলে ভাত বাড়তে থাকা রিতার কানে যায় সেই অস্ফুট গোঙানি। কেউ তার কথা শুনছে না জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে সে দেদার মুখ খারাপ করে,
খানকি মাগির ঢঙ দ্যাখো। নাং কে মনে পড়ে ঘুমের মধ্যে কতো রঙ্গই না কচ্ছে ঢেমনিটা।
অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক