| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

দেবদাসী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

অনীর ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে বিজয়ন বলল,

–কে বলল তোমাকে যে দেবদাসী প্রথা উঠে গেছে? হাও মেনি অব দেম ডু ইউ ওয়ান্ট? নিজের চোখে দেখে এসো।

— আমার একটাও চাই না। তবে ভাল স্টোরি যদি হয় যেতে পারি বস। কিন্তু পয়সা লাগবে। ইউ কান্ট ডু অল দিস উইথ এম্পটি পার্স।

–আরে সব পাবে। তবে সান্দৌতিতে কোনও হোটেল নেই। নারকেল পাতার ছাউনি দেওয়া মেঠো দোকানে বসে ধোসা খাবে আর রাত হলে নদীর ধারে দেবদাসীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়বে। আর কি চাই!
আম্মা, তেরি মুন্ডা বিগড় গয়ে রে…

কন্নড় উচ্চারণে হিন্দি গানের দফারফা করতে করতে বিজয়ন নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

অনী প্রথমে শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। এখনও নাকি কর্ণাটকে অনেক জায়গাতেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় গুপ্ত আচারের মাধ্যমে ইয়েলাম্মা দেবীর মন্দিরে অনেক মেয়েকে দেবদাসী করা হয়। তারা আর বিবাহ অথবা সংসারের অধিকারী থাকে না। ইয়েলাম্মার সেবা মানে মন্দিরের কাজকর্ম করে দিন কাটাতে হয়। খাবার জোটে ভিক্ষে করে। কিন্তু সবচাইতে বড় কথা, দেবতার এই দাসত্বের আড়ালে মেয়েগুলিকে নিয়ে চলে ছিনিমিনি খেলা। ওড়িষ্যার দেবদাসীরা যেমন নৃত্যগীতে এককালে পারদর্শী ছিল, ইয়েলাম্মাদাসীরা সেসব ট্রেনিং কোনওকালেই পায়নি। তারা স্রেফ ভোগ্যা। মন্দিরে টপ বসের অধিকার সবার আগে। তারপর রামশ্যামযদুমধু যে-কেউ। অনেক মেয়ে এইসব সহ্য করতে না পেরে মুম্বাই বা অন্য বড় শহরে লালবাতি এলাকায় গিয়ে ঠাঁই নেয়। যারা ইয়েলাম্মা মন্দিরে শেষ অবধি পড়ে থাকে তারা নানা রোগ আর একগাদা অবৈধ সন্তান নিয়ে বুড়োকালে হেজে মরে। ভিখিরিরও অধম।

অনী ব্যাঙ্গালোরে এই বিদেশী মিডিয়া স্টার্টআপে যোগ দেবার আগে চিন্তাও করতে পারেনি যে এইরকম একটা স্টোরি তাকে করতে হতে পারে। কোথায় ব্যাঙ্গালোরের কুল আইটি হাব আর কোথায় সান্দৌতিতে কর্ণাটকী দেবদাসীর নূপুরনিক্কণ। তবে সুযোগটা পেয়ে সে খুশিই হয়েছিল, আর পাঁচটা শিক্ষিত আধুনিক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি ছেলের মতো, যারা নিজের দেশকে জানতে চায় আর মিথ্যা আচারের পর্দা ফাঁস করতে চায়। ফলে অনী যেদিন ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বেরোল সেদিনটা ছিল ‘বানাবা হুন্নিমে’ – মার্গশীর্ষ বা কার্তিক মাসের পূর্ণিমার আগের দিন।

কার্তিক পূর্ণিমার প্রায় ভরে ওঠা ঠান্ডা চাঁদ বাসের জানালায় সারারাত উঁকি দিয়েছে। যতবার বাস দাঁড়িয়েছে বা প্রবল ঝাঁকুনিতে অনীর ঘুম ভেঙ্গেছে, তার চোখ চলে গেছে পাশের সিটে বসা বালাশঙ্করের দিকে। দেখেছে বালা বিষ্ফারিত চোখে ভূতে পাওয়া মানুষের মত চাঁদ দেখছে। বালাকে নিয়ে এমনিতেই অনীর একটু অস্বস্তি আছে। মানুষটা অদ্ভুত। কখন কোথায় কী করে বসবে কোনও ঠিক নেই। হয়ত কোনও খবর ছাড়াই অফিসে তিনদিন এল না। আবার যখন এল, কম্পিউটারের সামনে বসে একনাগাড়ে কাজ করে গেল রাত এগারোটা অবধি। এসব জায়গায় এরকম মামদোবাজি চলে না বলেই জানত অনী, কিন্তু এ ব্যাটাকে কেন জানি কেউ ঘাঁটায় না। হয়ত বড় মালদার কেউ আছে পেছনে। তার কলিগ ইমন একদিন বলছিল,
– অনীদা, শুনছি বালাশঙ্কর পিশাচসিদ্ধ। নানা মন্ত্রটন্ত্র জানে। সাবধান। তোমায় সুন্দরমত দেখে আবার ভেড়া না বানিয়ে দেয়।

ওসবে কান দেবার ছেলে অনী নয়। অতিপ্রাকৃতে তার কোনও বিশ্বাসই নেই। তবু প্রত্যেকেই যখন ঢুলছে, তখন বালাশঙ্করের কাজলপরা ড্যাবাড্যাবা চোখে সারারাত চাঁদ দেখা তার অস্বস্তিকর লেগেছে। লোকটা কি জেগে থাকবার জন্যই চোখে এত গাঢ় করে কাজল পরে!

ভোর চারটে নাগাদ লম্বা ঘাসের ছোটছোট ঢিবিতে ছাওয়া একটা বালিয়াড়ির মত জায়গায় তাদের বাস থেমে গেল। অনী বুঝতে পারছিল না এটাই গন্তব্য কি না। বালা তাকে নামবার জন্য ইশারা করে বলল,

–লেটস গেট ডাউন। গডেস ইয়েলাম্মা টেম্পল ইজ অনলি টেন কিলোমিটার অ্যাওয়ে।

এইজন্যই বিজয়ন বালাকে সঙ্গে দিয়েছে। ব্যাটা রাস্তা চেনে, কন্নড়-তামিল-তেলেগুতে অনর্গল কথা বলতে পারে। ইংরেজি আর হিন্দিতেও। ইমন একদিন বলছিল এখন নাকি বাংলা শিখবে বলে টিচার খুঁজছে। ভাষাশিক্ষাই নাকি তার হবি।

–তুই শেখা না দ্বিতীয় সুনীতি চাটুজ্যেকে।

অনীর কথায় সভয়ে মাথা নেড়েছিল মেয়েটা,

–ওই পিশাচসিদ্ধকে! বাবারে! ওর চোখ দুটো দেখেছ? কী লাল! তাতে আবার কাজল পরে থাকে। না বাবা, আমি না।

বালার পেছন পেছন নামতেই অনীর চোখে পড়ল পাশের সরু রাস্তাটা পুরোটা ধূলোর মেঘে ঢাকা। কুয়াশার মত সেই ধূলোর আস্তরণের ভিতর দিয়েই মন্থরগতিতে গড়িয়ে যাচ্ছে অজস্র গরুর গাড়ি। পুলিপিঠের ভিতরে পুরের মতো ছাউনিগুলোতে বোঝাই মানুষ, বোঁচকা-বুঁচকি, থালাবাসন। মাথার ওপরে আকাশের এককোণে ফ্যাকাশে রক্তহীন চাঁদ লটকে আছে। নীচে বলদের ক্ষুরে ক্ষুরে উড়ে যাওয়া ধূলো উপরে উঠে ধোঁয়ার মত সর্পিল চেহারা নিচ্ছে। অনীর মনে হল সে একটা বিশাল ল্যান্ডস্কেপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

–দে কান্ট অ্যাফোর্ড এনিথিং আদার দ্যান দিস কার্ট। খুব গরীব এরা জানো। আর আসেও কতো দূরদূর থেকে। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া থেকে আসা দলিতেরা রয়েছে এই ভীড়ে। ঘরের কাছে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ তো আছেই। এদের ক্যারাভান ভোররাতেও চলতে থাকবে। বেলা বাড়লে কোনও ছায়ায় আগুন জ্বেলে রেঁধেবেড়ে খেয়ে নেবে। তারপর আবার যাত্রা।
বালার কথা শুনতে শুনতে অনী ভাবছিল অফিসে গোমড়াথেরিয়াম হলেও এখানে লোকটা বকবক করতে করতে বকতিয়ার খিলজি বনে যাচ্ছে। অনীর প্রশ্ন তাকে আরেকটু উসকে দেয়,

– দলিতস এলোন?

-না না অন্য কাস্টও আছে। কিন্তু মেইনলি দলিত। কেন জানো তো? সবচেয়ে গরীব আর অসহায় হল এই দলিতরা। অসুখ করলে ঝাড়ফুঁক ছাড়া গতি নেই। হাসপাতালে মরে গেলে আপার কাস্ট ড্রাইভার হলে অ্যাম্বুলেন্সেও তুলবে না। সাইকেলে বেঁধে অথবা ঘাড়ে করে মড়া নিয়ে যেতে হবে।

–তার সঙ্গে তীর্থযাত্রার কী সম্পর্ক বালা?

–আছে আছে। ভারী অসুখ হলে, ঝাড়ফুঁকে না সারলে দলিতরা দেবী ইয়ালাম্মার কাছে মনে মনে মানত করে সন্তানকে দান করে দেয়। হে দেবী ইয়ালাম্মা, আমার হুদুগা, হুদুগি, মানে ছেলে অথবা মেয়েকে ভাল করে দাও। ওরা তোমার সেবা করবে সারাজীবন। মেয়েটার বয়েস হয়ত তখন পাঁচ। না জেনেই সে হয়ে গেল যোগাম্মা বা দেবদাসী।

-আর মেল চাইল্ড?

-সে হবে যোগাপ্পা। দেবীর সেবার জন্য সারাজীবন সে মেয়েদের মত পোষাক পরবে। নিজেকে নারী ভাববে। এদেরও অবধারিত ডেস্টিনেশান বেশ্যাপাড়া।

বালা এবার এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষারত এক গাড়োয়ানের সাথে কথা বলতে লাগল। বাসরুটে সে তাদের পৌঁছে দেবে। আর আধঘন্টা আছে হয়তো, কিন্তু ক্লান্ত শরীরে এই বালিয়াড়ি হাঁটাপায়ে পেরিয়ে যাওয়া মুশকিল।

এইরকম একটা দূর্গম যাত্রার পরে বাস থেকে নেমেই নদী দেখে অনীর মন ভাল হয় গেল। নদীর নাম মালাপ্রভা। দক্ষিণভারতের নদীদের নাম খুব মিঠে – তুঙ্গভদ্রা, তাপ্তি,কৃষ্ণা, কাবেরী, গোদাবরী। যেন মাথায় ফুল জড়ানো ক্ষীণকটি শ্যামাঙ্গী সব। দুর্বোধ্য ভাষায় সারাক্ষণ কলকলাচ্ছে।

অনী দেখল নদীতে প্রচুর লোক স্নান করছে। কুম্ভমেলার মত নদীর তীর ঘেঁষে শুধু কালো কালো মাথা। ইয়েলাম্মা নিয়ে সে যতটুকু পড়াশোনা করে এসেছে তাতে মন্দিরের পেছনে তিনটি পুণ্যকুণ্ডে স্নান করার কথা ছিল। তাতে পুণ্য তো লাভ হয়ই, দূরারোগ্য চর্মরোগ এবং অন্যান্য রোগও নাকি ভাল হয়ে যায়। দেবদাসীরাও মূল মন্দিরে ঢোকার আগে কুঙ্কম কুন্ডম, যোনি কুন্ডম এবং অরিহান কুন্ডমে স্নান করে শুচি হয়। তবে এই লক্ষ লক্ষ লোকের জন্য তিনটে ছোট কুন্ড তো যথেষ্ট নয়ই।
অনীর নজর নদীর উপর প্রসারিত দেখে বালা বলে উঠল,

-মালাপ্রভা ইজ অ্যা সেক্রেড রিভার। কিন্তু জানো তো, বেশী কাছাকাছি গেলে পায়ে নোংরা জড়িয়ে যাওয়ার ভয়। লক্ষলক্ষ পুণ্যার্থী, বাট দে হ্যাভ টু টেক টু ওপেন ডেফেকেশন ডিউ টু ল্যাক অব অ্যাডিকোয়েট টয়লেট। অথরিটি কোনওকালেই ব্যবস্থা করে উঠতে পারে না।

অনী আতঙ্কিত হল। জিজ্ঞাসা করল, –আমাদের কপালেও কি তাই আছে বালা?

বালা কোনও উত্তর দিল না। সে যেন সবসময়ই নিজের ইচ্ছাধীন। ইচ্ছে হলে কথা বলবে, নইলে নয়। রোগা কালো,তার থেকে বড় এই যুবককে কী একটা রহস্য ঢেকে রেখেছে, চব্বিশঘন্টা গায়ে গা লাগিয়ে থেকেও অনী তার হদিশ করে উঠতে পারল না।

সারাদিন ঘোরাঘুরির পর, ট্রাস্টপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে ইন্টারভ্যিউ নিয়ে দুজনেই ক্লান্ত বোধ করতে থাকল। মন্দিরের কিছু দূরেই মূল দ্বারের পাশে ফাঁকা জায়গাতে পুরুষেরা যথেচ্ছ মূত্রত্যাগ করছে। বোধহয় একেবারে গর্ভগৃহ থেকেও সেই তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে। তারই মধ্যে একটু দূরে নারকেল পাতায় ছাওয়া কিছু খাবারের দোকান। দোকানী মনে হল বালার পূর্বপরিচিত। সেই খাতিরে ইডলির সঙ্গে সাম্বরের পরিমাণ যেন একটু বেশিই পাওয়া গেল। খাবার পর একটা স্প্রাইট খেল অনী। পেটের ওপর সারাদিন বেল্ট চেপে বসে থাকায় যেন আইঢাই লাগছে।

অনীর বেল্ট ঢিলে করতে যাবে বালাশঙ্কর বলল,

–চলো একটু নদীর দিকে যাই।

দেবীদর্শনের কোনও ইচ্ছে অনীর ছিল না। ছবিতে দেখে নিয়েছে কালীঘাটের কালীর মত বিশাল নয়না ও বিকট দর্শনা এক নারীমস্তক পূজিত হচ্ছে। ও দেখার চাইতে মানুষ দেখা, দেবদাসীদের সম্পর্কে জানা অনেক জরুরী তার কাছে।

নদীর ধারে এই পড়ন্ত বেলাতেও লোক ছিল। বেশীরভাগই স্নান করে উঠে কপালে হলুদ আর সিঁদুর লেপছে। মেয়েরা শায়ার দড়ি দাঁতে চেপে রেখে ওইটুকু ঘেরাটোপের আড়ালেই অনায়াসে ব্লাউস-ব্রেসিয়ার পরে নিচ্ছে। এক ফোকলা কালো বুড়ি তাদের পাশ দিয়ে লাঠিতে ভর করে যাবার সময় হেসে কী যেন বলে গেলো। ভাষা বুঝতে না পেরে অনী বালার দিকে তাকাল, কিন্তু সে তখন চিন্তিত মুখে বালিতে আঁকিবুঁকি কাটছিল। কীসের এত চিন্তা সেটা বুঝতে না পেরে অনী আবার নদী দেখতে লাগল। একটি দশ বারো বছরের মেয়ে স্নান শেষে কিছুতেই হলুদ ও সিঁদূর লাগাতে দেবে না। কাঁদতে কাঁদতে অনীর পাশ দিয়ে ছুটে পালাতে গেল। পেছন পেছন তাড়া করে এল এক মুশকো জোয়ান। অনেক বকাবকির পর লম্বা চুল মুঠোতে ধরে নিয়ে গেল দূরে বয়স্কা মেয়েদের কাছে। মহাসমারোহে মেয়েটির মুখে হলুদ ও সিঁদূর লেপা হতে লাগল।
পাশ থেকে টুক করে বালা বলল,

-ও দেবদাসী হতে চায়না। ইশকুলে পড়তে চায়।

শাশ্বত ভারতের চিরন্তন ছবি দেখছে চোখের সামনে, এইরকম একটা রোমান্টিক চিন্তা অনীকে ছেয়ে ফেলে ছিল, ভরপেটে একটা ঘুমঘুম ভাব, বালার কথা শুনে তার চটকা ভেঙ্গে গেল।

কলকাতা মেট্রোতে একদিন মিমিকে খারাপ ইঙ্গিত করার জন্য অনী তেড়ে গিয়ে থাপ্পড় লাগিয়েছিল এক দঙ্গল ছেলের মধ্যে সবচেয়ে অসভ্যটাকে। সে এক বাওয়াল! অনীর ভাগ্য ভাল মেট্রোর পাহারাদার পুলিশরা তড়িঘড়ি নাক গলিয়েছিল। না হলে সেদিন নিশ্চিত প্যাঁদানি ছিল তার কপালে। অসভ্য গুন্ডাটার বাইসেপ ফুলে বেরিয়েছিল টি-শার্টের ছোট হাতার নীচ থেকে !

সেইদিনের মত চণ্ডাল রাগে অনীর কপালের শিরা ফুলে দপদপ করতে লাগল,

-আমি ওদের বোঝাতে যাচ্ছি। এই জঘন্য ব্যাপারটার প্রতিবাদ করা দরকার বালা।

বালা প্যান্টের ওপর দিয়ে অনীর ঠ্যাং চেপে ধরল,

-মেরে ছাতু করে দেবে।

-দিক। কাল ন্যাশন্যাল নিউজে হেডলাইন হবে সান্দৌতিতে সাংবাদিক খুন। কিন্তু একটা নিষিদ্ধ প্রথা…এইভাবে…

-কুল ডাউন বাডি। স্যরি বাঙালি বাবু, তোমার এখনও অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। এই যে এখানে যত লোক দেখছ তার মধ্যে একশও পাবে না তোমার মতো। এরা সবাই বিশ্বাসী। যে কঠিন জীবন এরা কাটায় সেখানে দৈব মহিমায় বিশ্বাসী না হয়ে কোনও উপায় নেই। সো দে বিলিভ ইন মিরাকুলার হিলিং পাওয়ার অব দেবী গডেস ইয়ালাম্মা। ব্যাঙ্গালোরের আইটি হাব কিংবা কলকাতার শপিং মল আমার দেশ নয়। এখানে যা দেখছ, ভালমন্দ মিলিয়ে সেটাই ভারতবর্ষ। তোমার আমার দেশ।

-তুমিও কি বিশ্বাস কর বালা? এই কুপ্রথায়? এত অমানবিক…বাচ্চা মেয়েগুলোকে নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা…

যতক্ষণ তারা কথা বলছিল মেয়েটাকে ঘিরে একটা মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল। এবার গান গাইতে গাইতে তাদের দিকে এগিয়ে এল কিছু নারীপুরুষের সেই নাতিদীর্ঘ মিছিল। ভ্যাঁপরভ্যাঁপ বাজনা, কাঁই কাঁই কাঁসি, বিজাতীয় গান, ইয়ালাম্মার জয়ধ্বনি – এই সবকিছুর আগে এক বিশালবপু অর্ধনারীশ্বর। যোগাপ্পা। তার শরীর পুরুষের, কিন্তু সাজসজ্জা নারীর। চোখে একটি নীলরঙা সানগ্লাস। গলা ছেড়ে গান গাইছে সে, মৃদুমৃদু নাচছেও। তাকে অনুসরণ করছে সেই রোগা মেয়েটা। রোগা কিন্তু মুখখানা ভারী মিঠে আর সরল। খোলা চুল কোমর ছাপিয়ে নেমে গেছে। সে দাঁতে কামড়ে রেখেছে একটি ছোট নিম ডাল। শাড়ির উপরেই দড়ি দিয়ে বাঁধা নিমের বড়বড় পাতাসুদ্ধ শাখা ঝুলছে কোমরে ও বুকে। যেন কেউ তাকে নিমপাতার সজ্জা পরাতে চেয়েছে। নিমডাল হাতে চলে যাবার সময় সে উদাস চাহনিতে অনী ও বালার দিকে একবার তাকাল।

মিছিলটা চলে গেলে বালা বলল,

-দেখলে?

-কী দেখলাম, বালা?

-ওই যে নিমডাল পরানো মেয়েটা। ও যতোই কাঁদুক আজ রাতেই ওকে দেবদাসী করা হবে। যোগাম্মা। এগুলো তারই প্রস্তুতি ।

-কিন্তু এই মেয়েটা! বাচ্চা তো!

অনী জিভে একটা খেদের আওয়াজ তুললো।

-হ্যাঁ, পাঁচ থেকে পঁয়ত্রিশ অবধি দেবদাসী হওয়া যায়।

সু্প্রীমকোর্ট নিষিদ্ধ করার পরও এইরকম প্রকাশ্য দিনের আলোয় কাউকে বাজনা বাজিয়ে হেঁটেহেঁটে দেবদাসী হবার জন্য নিয়ে যাচ্ছে তারই আত্মীয় পরিজন, এটা দেখে এবার অনী বেজায় ভড়কে গেল। আগের প্রতিবাদের কোন রেশ আর নেই তার গলায়।
কোনওমতে বলতে পারল,
-অবিশ্বাস্য। আনবিলিভেবল।

-দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ, হোরাশিও,দ্যান আর ড্রেমট ইন ইওর ফিলোজফি।

আরে শ্লা, এ যে দেখছি হ্যামলেট কপচায়। নাঃ ছেলেটাকে ভাল করে জানতে হবে তো। অনী মনে মনে ভাবল। মুখে বলল,
–আচ্ছা, এই ইয়েলাম্মার দলিত প্রীতির কারণটা একটু খুলে বলবে, বালা।

বালার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ সে তাকিয়ে রইল প্রাচীন নদীটির বিস্তারের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলতে থাকল রেণুকা-ইয়ালাম্মার কাহিনী। কখনো মালাপ্রভার ঢেউয়ের শব্দে, কখনও পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা হিমেল হাওয়ার দাপটে, কখনও পূণ্যার্থীদের চিৎকারে মাঝেমাঝেই তার কথা হারিয়ে যাচ্ছিল। অনীর মনে হচ্ছিল বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা ক্ষীণ অথচ প্রত্যয়ী কন্ঠস্বর তার সামনে একের পর এক আঁকা পট তুলে ধরছিল। যেমনটি ক’রে থাকে মুর্শিদাবাদের মুসলমান মেয়েরা হস্তশিল্প মেলায়।

রেণুকা-ইয়ালাম্মা মুনিশ্রেষ্ঠ জমদগ্নির পত্নী। ঋষি অগস্ত্যের অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যা। পতিব্রতা রেণুকা নিজের হাতে পরিপাটি করে গুছিয়ে দিতেন স্বামীর যজ্ঞের উপাচার। অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী এবং শুদ্ধাচারিনী ছিলেন তিনি। তাই রোজ মালাপ্রভা নদীতে স্নান সেরে ফিরবার সময় অলৌকিক উপায়ে যজ্ঞের বিশুদ্ধ জল আহরণ করতে পারতেন। নদীতটের অজস্র বালুকণা বাতাসে উৎক্ষিপ্ত হয়ে এক নিটোল কলসের আকার ধারণ করত। তাতেই জল পূর্ণ করে রেণুকা গৃহে ফিরতেন।

একদিন জমদগ্নি কুশের আসনে বসেই আছেন, রেণুকা আর ফেরেন না। সে সময়টা ছিল ভরা বসন্ত ; প্রকৃতি, মানুষ — সকলের চিত্ত চঞ্চল, এমনকী দেবতা, গন্ধর্বদেরও। রেণুকা নদীতীরে পৌঁছে দেখলেন এক গন্ধর্বজুটি প্রেমক্রীড়ায় ব্যস্ত। পরস্পরকে নদীর জলে ভিজিয়ে কখনও মদমত্ত পুরুষটির বক্ষকপাটে আছড়ে পড়ছে অপরূপা নারী, চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে দোসরকে। রেণুকারও শুদ্ধমতি চঞ্চল হয়ে উঠল। একটি প্রাণোচ্ছল স্বাভাবিক পুরুষের আলিঙ্গনকামী রেণুকা চূড়ান্ত আবেশে দুইচোখ বন্ধ করে তার জটাধারী, দীর্ঘ এবং শীর্ণকায় কূপিত-স্বভাব স্বামীকেই লীলাসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করতে লাগলেন। কল্পনায় অন্তর্হিত হল জমদগ্নির শুষ্ক শেকড়সদৃশ জটা-ভার, অগ্নিসান্নিধ্যহেতু দেহের পোড়া কটু গন্ধ, চক্ষুদ্বয়ে ক্রোধের লালাভা। কল্পনায় রেণুকা অনুভব করতে লাগলেন স্বামীর দৃঢ় বাহুবন্ধন থেকে উৎসারিত উচ্ছসিত আনন্দ আর কামনার নির্যাস। রেণুকার রোমরাজি কদম্বের মত শিহরিত হয়ে উঠল। প্রথমবার নিজের অন্তস্থ ক্ষরণ টের পেলেন তিনি।

তখনই বিশ্রী চিৎকারে খানখান হয়ে গেল তার দিবাস্বপ্ন। আশ্রম থেকে ভেসে এল ক্রোধী জমদগ্নির অধৈর্য বিকট চিৎকার। তাড়াহুড়ো করে রেণুকা বালিরাশির উদ্দেশ্যে অঙ্গুলি প্রসারিত করলেন। কিন্তু হায়, যে অঙ্গুলি হেলনে রোজ তারা কলসের রূপ ধারণ করে, আজ তাকে অনেক বেঁকিয়ে চুরিয়েও কিছু হল না। মর্মান্তিক পরিহাসের মত ঘুর্ণিহাওয়া এসে কিছু বালুকণাকে অল্প উত্তোলিত করল মাত্র।

রেণুকা বুঝলেন তার মানসিক শুদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে অলৌকিক ক্ষমতাও অন্তর্হিত হয়েছে।তার অপরাধীর মতো আনত মুখ জমদগ্নির ক্রোধকে আরও প্রজ্জ্বলিত করে তুলল। তিনি দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীকে। তর্জনীর বক্র, কৃষ্ণাভ, দীর্ঘ নখের ইশারা দূর বনস্থলীর দিকে।

অনেকদিন পরে বিপুল প্রায়শ্চিত্ত আর কঠোর সংযম সাধনার পর সাহস সঞ্চয় করে রেণুকা স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। অমনিই ক্ষিপ্ত জমদগ্নি চিৎকার করে পুত্রকে আদেশ দিলেন,
-পরশুরাম, এই কুলটার শিরোচ্ছেদ কর এই মুহুর্তে।
পরশুরামের কুঠারের আঘাতে মুহুর্তেই রেণুকার ছিন্ন শির বহুধা-বিভক্ত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। জমদগ্নির পায়ের কাছে যে অংশ এসে পড়ল তা রেণুকার ধড়ে পুনর্স্থাপন করে স্ত্রীকে তিনি পুনর্জীবিত করলেন। রক্ত আর হিংসা তাঁর ক্রোধকে ততক্ষণে প্রশমিত করেছে। একটি টুকরো পড়ল সান্দৌতিতে এক নীচজাতা দলিত রমণীর কাছে। তখন থেকেই মহাসমারোহে পুজো শুরু হল দলিতের রক্ষাকর্ত্রী রেণুকা- ইয়েলাম্মার।

অনীর কোনওদিনই ধর্মেকর্মে ইন্টারেস্ট ছিল না। পুরাণটুরানের গল্পও সে তেমন শোনেনি। রামানন্দ সাগরের রামায়ণ দেখেছে টিভিতে। আর রামায়ণ মহাভারতের কিছু রংচঙে কমিক্‌স, এই তার দৌড়। কিন্তু আজ এই প্রাচীন নদীর তীরে, সন্ধ্যার অন্ধকার যখন বাদুড়ের মত ঝুলে আছে জলের ওপর, বালির ওপর, তখন হঠাৎই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বালা অদ্ভুত ভালো কথক। মনে হচ্ছে যেন সব সত্যি। এক্ষুণি খোলা চুলে জল থেকে উঠে আসবেন রেণুকা, মাথায় তার অলৌকিক জল-কলস।

বালার হাত চেপে ধরল অনী,

–তুমি খুব ভাল গল্প বলতে পার বালা। একসেলেন্ট স্টোরিটেলার। মনে হচ্ছে সব চোখের সমানে দেখতে পেলাম।

বালা প্যান্টের পেছনের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল

-চল, মন্দিরে যাই। দেখি তোমাকে রিচুয়ালটা পুরো দেখাতে পারি কি না।

মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই সম্মিলিত গানবাজনার আওয়াজ তীব্রতর হতে থাকল। এত রাতেও মেয়েপুরুষ থিকথিক করছে। পূজোর ডালা বিক্রি করে যে দোকানগুলো সেগুলোর পৃথুল মালিকেরা দোকানের বাইরে এসে খদ্দের ডাকছে,

–আম্মা বা ইল্লি ।

ইলেকট্রিসিটি আছে বটে,কিন্তু তাতে অন্ধকার ঘোচে না। দূরের দোকানগুলোতে হ্যাজাকবাতি জলছে। সেগুলোকে ঘিরে অজস্র ছোট পোকার উড়ান। অনী এর আগে কখন হ্যাজাক দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। দূরে দূরে গাছতলায় অন্ধকার ভেদ করে উজ্জ্বল কমলারঙের ছোট ছোট অগ্নিকুন্ড। রান্নার আয়োজন চলছে।

মেয়েদের বেশীরভাগের মাথায় ফুলের মালা আর পরনে উজ্জ্বল রঙের চকচকে শাড়ি। বালা বলে দিয়েছিল দেবদাসীদের হাতে সবুজ রঙের কাচের চুড়ি থাকবেই। ফলে গাদা সবুজ চুড়ি হাতে দেখলেই অনীর মনে হচ্ছিল মহিলাটি দেবদাসী।
সত্যি সত্যিই একজন ওইরকম চুড়ি পরা, কপালে হলুদ এবং সিঁদূর লেপা মোটাসোটা মহিলা বালাকে দেখে দৌড়ে এল,

–হুদুগা…

জড়িয়ে ধরল বালাকে, বারবার সব হাতের আঙুল ভাঁজ করে কানের ওপর ছোঁয়াতে লাগল। যেন বহুদিন পর কোনও স্নেহাস্পদকে খুঁজে পেয়েছে। বালা স্পষ্টতই বিব্রত, কিন্ত মনে হয় সেটা অনী সামনে আছে বলে। তবে সেও হাঁটু ছুঁয়ে কপালে হাত ঠেকাল। তারপর নিজেদের মধ্যে প্রায় পনের মিনিট কথা বলা হলে অনীর দিকে ফিরে বলল,

–অনী, শি উইল বি আওয়ার গাইড। উনি সঙ্গে থাকলে মন্দিরের কেউ কিছু বলবে না। একটা এনজিওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেবদাসীদের যে ইউনিয়নটা সদ্য তৈরী হয়েছে তারই কর্মকর্তা উনি।
ভালই করেছ এবার এসেছ। সামনেরবার থেকে এই বোধহয় এই মিডনাইট রিচুয়্যালটা বন্ধ হয়ে যাবে।

–দেবদাসী ব্যাপারটাই উঠে যাবে বলছ?

বালার মুখে ব্যঙ্গের হাসি,

–উঠে যাওয়াটা এত সহজ নয়। অপুষ্টিতে গরীবদের নানা অসুখ করবেই, ফলে দেবীর কাছে বাচ্চাকাচ্চা উৎসর্গ করার মানতও চলতে থাকবে। যোগাম্মা আর যোগাপ্পার সাপ্লাই অন্তহীন। এদের বিয়ে বারণ, কিন্তু লাইনে নামা বারণ নয়। ফলে অবৈধ ছানাপোনাও জন্মাবে আর ভবিয্যতের হাজারটা দেবদাসী বড় হয়ে উঠবে ওদের মধ্যে। দিস ইজ আওয়ার ইন্ডিয়া – ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া !

সেই মহিলার পিছুপিছু গর্ভগৃহের দিকে বালা আর অনী এগিয়ে যাচ্ছিল। উনি সামনে আর দুপাশে অকাতরে পানের পিক ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলেন। কাঁই কাঁই কাসরের আওয়াজ যখন কানে তালা ধরিয়ে দেবার পর্যায়ে পৌঁছে গেল, তখন উনি গর্ভগৃহকে বেড় দেওয়া একটা জাফরি কাটা দেওয়ালের সামনে দুই বন্ধুকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বালাকে আবার অনেক আদরটাদর করে বিদায় নিলেন। জায়গাটা একটা সরু ঘেরা বারান্দামতো। ছাদ নেই কিন্তু দরজা আছে। কিছু তুলো, তেলের শিশি, পুরনো প্রদীপ দেখে মনে হয় সলতে পাকাবার এবং প্রদীপ রাখবার জন্য জায়গাটা ব্যবহার করা হয়। দেওয়ালের কুলঙ্গিতে পাকানো সলতের গোছা যত্ন করে প্লাস্টিক মুড়ে রাখা আছে।

বালা বলল,

–এঁর নাম আধ্যাম্মা, রিচুয়্যালটার নাম মুট্টুকাট্টুভুদু। কেউ এসে কিছু বললে আধ্যাম্মার নাম বলতে হবে কিন্তু।

দেবীর গর্ভগৃহ তখন ভাঁজ করে সাদা লুঙ্গি পরা বয়স্ক পৃথুল লোকে ভর্তি। এরা নাকি সব মন্দিরের কর্মকর্তা। কিছু অল্পবয়েসি ছেলে আছে ঠিকই, কিন্ত তারাও নাকি সব ভবিষ্যতের যোগাপ্পা। প্রচুর ধূপধুনো ভেতরটা আবছা করে রেখেছে। মিটমিটে ইলেকট্রিক আলোর ঘাটতি পুষিয়ে দিতেই যেন সর্বত্র বড়বড় পেতলের প্রদীপদানি। এমনিতেই পঞ্চমুখী, তার উপর পাঁচটি করে আলোর সারি নেমে গেছে প্রদীপদানির চূড়ো থেকে নীচ অব্দি।
সবমিলিয়ে একটা আধিভৌতিক পরিবেশ। ধোঁয়া গলায় ঢুকে অনীর কাশি পেয়ে গেল। বালা তার কনুইতে চাপ দিয়ে ইশারা করল-চুপ, আওয়াজ করা যাবে না।

ওই আধো অন্ধকারে এককোণায় কিছু সাধারণ নারীপুরুষ জোড়হাতে দাঁড়িয়েছিল। বালা বলল, যে মেয়েটি দেবদাসী হতে যাচ্ছে ওরা তার আত্মীয়স্বজন। হঠাৎ ওই জটলা থেকেই ছিটকে বেরুল নদীতীরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া কিশোরীটি। অনী সবিস্ময়ে দেখল বিকেলে শাড়ির ওপর নিমডাল বাঁধা থাকলেও এখন মেয়েটি সম্পূর্ণ নগ্ন। তবে তার বুক ও লজ্জাস্থান ঢাকা আছে আগের মতই ঘন সবুজ নিমশাখায়। সে দাঁতে কামড়ে আছে একটি শাখা, হাতে চামরের মত দোলাচ্ছে আরেকটি ডাল। খোলা চুল। মুখের উপরেও এত চুল পড়েছে যে সে কাঁদছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
মামাদের গ্রামের বাড়িতে বলির পাঁঠাকে হাঁড়িকাঠের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছে অনী। অনিচ্ছুক অথচ অনিবার্য সেই চলন সে আবার দেখল নিমপাতার ঘেরের নীচে রোগা কালো অপুষ্ট দুটো পায়ে। বাজনার তালে তালে তারা কোনরকমে উঠছে নামছে। বিগ্রহকে একচক্কর দিয়ে কর্মকর্তাদের সামনে আসতেই ইয়েলাম্মার জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ছে সবাই আর কতগুলো লোমশ কালো হাত মেয়েটির কপালে, মুখে, সারাগায়ে হলুদ ও সিঁদূর লেপে দিচ্ছে। প্রত্যেক পাক ঘোরা শেষ হলে মেয়েটি বিগ্রহের সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে প্রণিপাত করছে। তখন সরে যাচ্ছে পাতার আবরণ। অপুষ্ট অল্প উঁচু শ্রোণি দেখে ঢিমে আলোতেও চকচক করছে ভাঁজ করা লুঙ্গিদের জোড়া জোড়া চোখ।

অনী আর বালা মালাপ্রভার বালিতে লম্বা হয়ে শুয়েছিল। তারা পুরোটা দেখেনি। একঘেয়ে আবর্তন আর গগনবিদারী বাজনায় কোনও মাহাত্ম্য খুঁজে পায়নি। তাদের কোনও পূণ্যেচ্ছাও ছিল না। বরং এই ভাল। আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ, কিন্ত কেমন যেন কুয়াশা মাখা। হিম হয়ে আসছে আঙুলের ডগা। দিগন্ত দেখা যাবে যেখানে, সেখানে বেশী ঠান্ডা পড়বেই। এখানে মালাপ্রভার ওপারে কালো পাহাড়ের সিল্যুয়েট। মাথার ওপর রাতচরা পাখি অকারণ পাক দিয়ে যাচ্ছে।
অনী জেগেই ছিল, স্টোরিটা কীভাবে বানাবে সেটাই ভাবছিল। পাশে বালার হালকা নাকডাকার আওয়াজ কানে আসতে অনী সরীসৃপের মত গড়িয়ে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করল। বালির আস্তরণের ওপর সেই নড়াচড়া কোনও কম্পন সৃষ্টি করেছিল কি না কে জানে, বালা হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসল। ভূতে পাওয়া গলায় প্রচন্ড জোর দিয়ে চাঁদের দিকে তর্জনী তুলে চিৎকার করল,

–হাউদু, নান্না আম্মা দেভাদাসী।

বালার গলায় কী যেন একটা ছিল, আর্তি, ভয়, প্রত্যয়, স্পর্ধা নাকি অন্যকিছু, অনী অবাক হয়ে উঠে বসল,

-কী বলছ বালা? কোন আম্মা? আধ্যাম্মার কথা বলছ?

বালা যেন অনেকদুর থেকে নিজের মধ্যে ফিরে এল। মাথা ঘুরিয়ে অনীকে অনেকক্ষণ দেখল। তার সর্বাঙ্গ থেকে তখন চাঁদের আলো ঝরছে। মাথার পেছনেও যেন আলোর বলয়।
বালা ফিসফিস করে অনীকে বলল,

–অনী আমাকে বাংলা শেখাবে? তাহলে তোমাকে বলে দেব এইমাত্র যা বললাম তার মানে কি। বুকের মধ্যে অনেক ভার জমে আছে, আমিও তো কাউকে বলতে চাই।

-বাংলা শিখবে কেন? শুনেছি তুমি তো অনেক ভাষাই জান।

-আমি রবীন্দ্রনাথ অরিজিন্যালে পড়তে চাই। শুনেছি ওঁর কবিতা উপন্যাসে উনি মেয়েদের ওপর অত্যাচারের অনেক প্রতিবাদ করেছেন।

-হ্যাঁ, কিন্তু ট্রান্সলেশনে পড়তে অসুবিধা কোথায়!

-না না, সম্বর ডালের স্বাদ কি তোমাদের মুঙ ডালে মেটে? আমি বাংলাতে টেগোরকে আমার মনের সব কথা বলতে চাই। হয়ত উনিই একমাত্র আমার সব কথা বুঝবেন। জানো তো, আমি যত ভাষা শিখেছি সবগুলোর সেরা সাহিত্যিকদের সঙ্গে মনের কথা বলি। তাদের থেকে ইন্সপিরেশন নিই।

চাঁদের আলোয় মানুষ পাগল হয়ে যায় শুনেছিল অনী। কিংবা হয়ত তাদের শেষ সিগারেটে গাঁজা বেশী ভরা হয়ে গেছিল এই বিবেচনায় অনী তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে দিতে চায়,

–বেশ শেখাব। চল তো ফিরি ব্যাঙ্গালোরে।

উত্তেজনায় বালা অনীর কনুইটা চেপে ধরে। অনেকবার থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ করে, তারপর কী ভাবতে ভাবতে নদীর চরে ঘুমিয়ে পড়ে।

ব্যাঙ্গালোরের ট্রাফিক অনীকে অফিস যাবার সময় খুব ভোগায়। এইজন্য সে বাইক অব্দি কিনে ফেলেছে, কিন্ত ছুঁচো গলবার জায়গা থাকলে তো! স্টোরির আউটলাইন মাথায় তৈরি হয়ে গেছে। বেলা দুটোর মধ্যে না পাঠালে আজ আর যাবে না।
অফিসে সে যখন পৌঁছাল তখন এগারোটা পাঁচ। তাড়াহুড়ো করে কম্পিউটারে বসতে গেল সে, এরমধ্যেই বিজয়ন এসে হাজির,

-হাও ওয়াজ দ্য ট্রিপ?

-খুব ভাল। এই ভারতবর্ষকে চিনতাম না জানো। অচেনা কিন্তু ইন্টারেস্টিং।
বালা এসেছে অফিসে?

-না। দ্যাখো এখন দুদিন ডুব না দিলেই হয়।

-আমাকে বাংলা শেখাতে বলেছে।

-ভালই তো, তুমি কন্নড় শিখে নেবে ও বাংলা।

হঠাৎ অনীর মনে পড়ে গেল বালার বলা কথাটা, সে বালাকে অবাক করে দেবে বলে আগেভাগে মানেটা জেনে নিতে চাইল,

–হ্যালো বিজয়ন, এই কথাটার মানে কী গো
হাউদু, নান্না আম্মা দেভাদাসী?

বিজয়ন ফূর্তিবাজ হাতে অনীর পিঠ চাপড়ে দিল,

-আরেব্বাস দুদিনের ট্রিপেই কন্নড় শিখে ফেলেছ! হাউদু, নান্না আম্মা দেভাদাসী কথাটার মানে হচ্ছে ইয়েস, মাই মাদার ইজ আ দেভাদাসী। আমার মা একজন দেবদাসী।

এই সময় বিজয়নের বুক পকেটে মোবাইলটা তারস্বরে বেজে উঠল। এক্সকিউজ মি, বলে অনীর কিউবিকলের বাইরে গিয়ে সে কথা বলতে লাগল। ওর একেকটা কলে মিনিমাম সময় লাগে ছত্রিশ মিনিট।

কম্পিউটারটা আবার অন করতে গিয়ে অনী টের পেল হাত অসাড়, মাথা থেকে স্টোরি হাপিস হয়ে গেছে। বাজে পোড়া গাছের মত নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকতে থাকতে সে বুঝল আজ আর তার স্টোরি করা হবে না।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত