Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,prem ki bujhini

ভাসাবো দোঁহারে: বন্ধু হে আমার । গাজী তানজিয়া 

Reading Time: 9 minutes

এভাবে অতনুর সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে ভাবে নাই পৃথা। বিশেষ করে এমন একটা নাটকীয় পরিবেশে। পৃথিবী যখন গোল, আর তারা যেহেতু সেই চক্রে ঘুরে বেড়ায় না না উসিলায় দেখা তো হতেই হতো। কিন্তু সেটা যে এমন হবে কে ভেবেছিল!

সে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সেটা একটা দাতা সংস্থা। তাই প্রায়ই এনজিওগুলোর কাজকর্ম ভিজিট করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়। পৃথা যে  বাংলোটাতে উঠেছে সেখানকার কেয়ারটেকারের মুখে শুনেছে, বাংলোর সামনের রাস্তাটা ধরে কিছুদূর গেলেই বলেশ্বর নদী। ঢাকা শহরে যে বদ্ধ পরিবেশে মানুষকে বাস করতে হয় তাতে করে বাইরে কোথাও গেলেই প্রকৃতির কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করে সে। নির্জনতা সে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে, আর মন দিয়ে ছুঁয়ে দেখে সবুজ দিগন্তকে। 

এই শহরে পৃথা এই প্রথম এসেছে। অনেকটা হেঁটে হেঁটে নদীর ধারে পৌঁছে মন ভালো হয়ে গেলো তার। যতটা সুন্দর সে ভেবেছিল তার চেয়েও সুন্দর নদীটা। সে যে জায়গাটায় এসে পৌঁছেছে সেখানকার নদীর পাড়ে বড় বড় কংক্রিটের চাই ফেলে রাখা হয়েছে নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে। তাই  চমৎকার বসার জায়গা হয়েছে সেখানে। পৃথা এমনিই গুন গুন করে কিছু একটা গান ভাজে মনে মনে। কতকাল সে গান গায় না। গানটাকে মনেপ্রাণে ভুলে থাকতে চেয়েছে। অতনু তার জীবন থেকে সব রূপ-রস-গন্ধ কেড়ে নিয়ে গেছে। আর সাথে নিয়ে গেছে সুর। অতনু ওর গান এতো ভালোবাসত। মাঝে মাঝে পৃথার মনে হতো তাকে না, বরং তার গানই ভালোবাসে বেশি। আর তাই গানটাকেই বিসর্জন দিয়েছে সে।

দেখতে দেখতে গোধূলির লাল আলোয় ছেয়ে যায় চারপাশ। কতটা সময় মুগ্ধ হয়ে বসেছিল জানে না সে। হঠাৎই দেখে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চরাচর। 

দ্রুত বাংলোর দিকে পা বাড়ায় পৃথা। সত্যি, বোকামি হয়ে গেছে। অচেনা জায়গায় একা চারদিকে অন্ধকার। সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যেতেই সে দেখতে পেল দুদিকে দুটি পথ চলে গেছে। কোনটা ধরে যে বাংলোতে পৌঁছতে হবে অনুমান করতে পারছে না সে। কোন রাস্তাটা সঠিক এটা নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে যায়। অন্য সময় হলে এমন অস্থির বোধ করত না। কিন্তু যেহেতু কুয়াশা পড়ে কেমন একটা প্রহেলিকা তৈরি করেছে তাই অনন্যোপায় হয়ে জিন্সের পকেটে সেলফোনটা ট্রেস করার চেষ্টা করে। সেলফোনে এখানকার কো-অর্ডিনেটর এর নাম্বার সেভ করা আছে। ভদ্রলোককে ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলবে পৃথা এখানে। কিন্তু একি? রক্তস্রোত দ্রুত গড়িয়ে যায় হৃদপিণ্ড থেকে। ফোন আনতে ভুলে গেছে সে! অগত্যা দুটি পথের একটা ধরে সামনের দিকে এগোতে শুরু করে। 

কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারে ভুল পথে চলে এসেছে সে! সে জানতো এমনটা হবে, তার জীবনটা কখনো সহজ পথে চলে নাই। এটা হলেই বরং ব্যতিক্রম হত। 

রাস্তার দুই দিকে বড় বড় বৈদ্যুতিক খুঁটি শুয়ে আছে। আচ্ছা এত বৈদ্যুতিক খুঁটি কেন এখানে? কয়েকটা ছোট বড় বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে! একটা ঝোলানো সাইনবোর্ড পড়ার চেষ্টা করে পৃথা! পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অফিস। হালে পানি পায় সে। কিন্তু দোতলা বাড়ির কাছে পৌঁছে আর একবার ধাক্কা খায় যেন। গেটে বড় একটা তালা ঝুলছে। আশেপাশে কোন গার্ড বা এ জাতীয় কাউকে দেখতে পেল না। মফস্বলের অফিস, তাই সন্ধ্যা হতেই বন্ধ! 

এমন সময় পেছন থেকে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ডিপার লাইট ফেলে এগিয়ে আসা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটাকে হাত ইশারা করে থামতে বলে পৃথা। অন্য কিছু ভাবার সময় নেই এখন তার। 

এই জমাট কুয়াশায় ড্রাইভ করতে কষ্ট হচ্ছিল অতনুর। দু’ধারে ধবধবে সাদা বরফের প্রান্তর, মাঝে লবণ দিয়ে বরফ কাটানো রাস্তায় ড্রাইভ করেছে সে। তবে বিদেশের রাস্তা অনেক প্রশস্ত, এতো জিকজ্যাক নয় তাই রিস্ক কম। এখানে এতো ফগ, সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা, এই শীতেও অতনুর ঘাম ছুটে যাচ্ছে।   শুরুতে জার্মানি তারপর ৫ বছর ফ্রান্সে কাটিয়ে বছরখানেক হলো একটা প্রাইভেট পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে দেশে ফিরেছে সে। যদি ভালো লাগে দেশেই থেকে যাবে ভাবছে। না লাগলে আবার অন্য কোনোখানে। অতনু জীবনে থিতু হতে পারে নি কোথাও, ছুটে বেড়িয়েছে কোথায় কার টানে সে জানে না। 

কুয়াশা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। দুই ফুট দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। এরই মাঝে হঠাৎ করে একজন কাউকে হাত তুলে লিফট চাইতে দেখে অতনু। জিন্স, ফতুয়া আর গায়ে চাদর জড়ানো মানুষটিকে পুরুষ ভেবেছিল সে প্রথমে। কিন্তু কাছাকাছি আসতে দেখে একটা মেয়ে! কিছুটা অবাক হয় অতনু। এই মফস্বল শহরে এই সময়ে এই গেটআপে একজন নারী! ভুল দেখছো না তো? না, সত্যিই। গাড়িটা মেয়েটার পাশ ঘেষে দাঁড় করায় অতনু। 

পৃথা গাড়ির উইন্ডে মুখ বাড়িয়ে বলে, লিফট  প্লিজ! 

গলার স্বরটা ভীষণ পরিচিত লাগে অতনুর। চকিতে গাড়ির ভেতরের লাইটটা জ্বালায় সে! জানালার গ্লাস সরিয়ে বলে, ইয়েস প্লীজ! 

চমকে ওঠে পৃথা, অতনু তুমি? আমারও তো একই প্রশ্ন! তুমি এখানে এসময়ে কিভাবে? বলতে বলতে গাড়ির গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে অতনু! ড্রাইভিং সিটের উল্টো দিকের দরজা খুলে গাড়িতে উঠতে আহ্বান জানায় পৃথাকে! 

অতনুর এই পশ্চিমা ভদ্রতা পৃথার খুব ভালো লাগে। যা এদেশে অনেকেই করে না। 

তোমাকে যে এখানে দেখব ভাবতেই পারি নাই, ইনফ্যাক্ট তুমি যে এদেশে  ভাবি নাই।

পৃথা তার আচরণে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। তার ভেতরে যে একটা ভাঙন চলছে এটা কিছুতেই বুঝতে দেবে না এই হতচ্ছাড়া পুরনো প্রেমিককে।

অতনু তার চেয়েও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। তার বুকের ভেতরের কম্পন হাতে এসে পৌঁছুতে চাচ্ছে। তার স্টিয়ারিংয়ে রাখা আঙুলগুলো যে কাঁপছে এটা যেন পাশে উপবিষ্ট ভদ্রমহিলা কিছুতেই বুঝতে না পারে সে জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অতনু বলল, তা  তুমি এই কুয়াশার ভেতরে এখান থেকে কোথায় যাচ্ছিলে? 

পৃথা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে তার এখানে আগমনের উদ্দেশ্য থেকে আজকের হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত খুলে বলে। সঙ্গে ডাকবাংলোর ঠিকানাটাও বলে পৌঁছে দেয়ার জন্য। 

পৃৃথা বরাবরই স্বল্পভাষী হলেও অতনুকে দেখলেই কথার খই ফোটে। কিন্তু তুমি এখানে কেমন করে অতনু? আমি যতদূর জানি তুমি তো প্যারিসে ছিলা। 

অতনু মৃদু হেসে বলে, দেখো তুমি যেখানে থাকো ঈশ্বর কিভাবে যেন আমাকেও সেখানে টেনে আনেন। তুমি এখানে তাই আমিও! বাই দ্যা ওয়ে, আমি যে প্যারিসে এটা তুমি জানতা অথচ যোগাযোগ করো নাই তো? 

তুমি চাও নাই তাই করি নাই,  ভেরি সিম্পল। 

এনিওয়ে তুমি কিন্তু আগের মতোই রয়ে গেছে? সেই আমাদের পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর সময়ে হামবোল্ড ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনে যেমন ছিলা। তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখার দিনটা মনে আছে পৃথা? সেই যে ইমিগ্রেশনে, ফরম ফিলআপ করার সময় কি একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল তোমার, কারো কাছে কারেকশন পেন আছে কিনা জানতে চাইলে আমি দিয়েছিলাম, আর তুমি একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে পেনটা এমনভাবে নিলা যে তোমার নখের আঁচড়  লাগলো আমার হাতে। কোনো মেয়ের নখের আঁচড় যে কি তুমি বুঝবা না! অথচ তুমি আমাকে একটা থ্যাংকসও দিলা না। পেনটা ফেরত দিয়েই দৌড়। কথা বলার সুযোগই হলো না। 

পরে দেখো কাকতালীয়ভাবে একই ক্যাম্পাসে তোমার সাথে আমার আবার দেখা ! আমি সোশ্যাল সাইন্স আর তুমি এঞ্জিনিয়ারিং।

তাতে কি, বাঙালি তো হাতে গোনা দু-তিনজন! কথা তো হওয়ারই ছিলো। তবে আমি সেই প্রথম দিন থেকেই  বুঝে গিয়েছিলাম যে, ইউ আর কোয়াইট ডিফারেন্ট! তুমি যে সাবকন্টিনেন্টের তোমার চেহারা সেটা বলে দিচ্ছিল, তবে আচরণ অদ্ভুত! আর তখন থেকেই মেয়ে হিসেবে তুমি, নাকি অদ্ভুত সব আচরণ করা তুমি, নাকি অসম্ভব শরীরি বৈবভের তুমি, নাকি সুরেলা গাইয়ে তুমি, কোন তুমিটার প্রতি যে আমি ক্রাশড হয়ে গিয়েছিলাম জানি না।

শুধু ক্রাশড হলে এমনই হয় অতনু, ভালোবাসলে তুমি হয়ত এর কোনোটাই দেখতা না। ভালোবাসা অন্ধ হয় জানো তো! তুমি কিভাবে জানবা, তুমি তো ভালোবাসতেই জানো না। তুমি প্রেমটাকে শরীরেই রেখে দিলা, মনে ঠাঁই দিলা না।

তোমার তাই মনে হয়?

নয় তো কি?

হ্যাঁ, তুমি এমন ভাবতেই পারো। ইউ হ্যাভ অল দ্যা রাইটস। বাট তুমি কিন্তু এটা বলতে পারো না যে আমি তোমার সাথে কখনো সেক্স করেছি। বা তোমাকে ইনসিস্ট করেছি সেক্সের জন্য।

 ৩

কথা বলতে বলতে গাড়িটাকে একটা গেইটের সামনে এনে দাঁড় করায় অতনু। খাটো গ্রিলের গেট দিয়ে ভেতরের লনে ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে। কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে গেট খুলে দেয় দারোয়ান। পৃথার দিকে তাকিয়ে অতনু বলে, এটা আমার বাঙলো। তোমার যদি কোন প্রবলেম না থাকে তাহলে এক কাপ চা খাবে আমার সঙ্গে? তোমার ফেভারিট ব্র্যান্ডের চা আছে আমার কাছে। টুইনিং ক্লাসিক আসাম ট্রাডিশনাল টি। এটাই সবসময় দেখেছি তোমাকে খেতে। তারপর থেকে আমিও ওটাতে অভ্যস্ত।

তোমার এটা মনে আছে? বাহ্ দারুণ তো! 

কি দারুণ!

এই মনে রাখার ক্ষমতা!

তখন থেকে এমন খোঁচা মেরে কথা বলছ কেন বলো তো! তুমি  তো এমন ছিলা না!

আমি কেমন ছিলাম?

যে পৃথাকে আমি চিনি, সে এক কাপ চা ডিনাই করার জন্য এতোটা ক্রিটিকাল হতো না। না খেতে চাইলে সোজা বলে দিত ‘না’।

কোনো বিশেষ কারণে ক্রিটিকাল হয়ে যাওয়া খারাপ বুঝি?

তুমি চা খেতে আসবা কি না বলো।

পৃথা একটু শ্রাগ করে বলে, ওকে, নো প্রবলেম, চলো যাই! 

অতনুর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু একটা ছিল যে পৃথা না করতে পারে না! 

অতনু যে বাড়িটাতে আছে সেটা বেশি বড় নয়! নীচতলায় ড্রইং ডাইনিং দোতলায় দুটো বেড কাঠের মেঝে! অনেকটা ইউরোপিয়ান স্টাইল এর বাড়ি! অতনু চা বলতে ভেতরে যায়! 

ড্রইংরুমে বসে কাচের জানালা দিয়ে সবুজ ঘাসে ভরা ছোট্ট লনটাতে চোখ রাখে পৃথা! সেখানে বাগানে আলো জ্বলছে, ঘাসগুলোকে লাগছে জলপাই রঙের মতো, আবার কখনো ধূসর! সে ঘাসের বদলে যাওয়া রঙ দেখে আর ভাবে, অতনু কী এখনো ভালোবাসে তাকে? অতনু কি আদৌ কখনো ভালবেসেছিল তকে? নাকি শুধুই কিউরিসিটি? কিউরিসিটি শেষ তো প্রেমও শেষ! নইলে কেন সেদিন ওভাবে পৃথাকে একা ফেলে চলে এসেছিল সে?

সহজে অতনুর প্রেমে পড়েনি পৃথা। এজন্য অতনুকে অনেক যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়েছে। সেই যে অল সেইন্টস ডের আগের রাতে ক্যাম্পাসের হ্যালোইন পার্টিতে ভূত সেজে ফ্লোরে জুটি হয়ে দুজনের প্রথম কাছাকাছি আসা! এরপর একদিন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বার্লিনের পথে ট্রেনের জনশূন্য কম্পার্টমেন্টে দুজন বাদামি নর-নারীর উষ্ণ আলিঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া।  সেই থেকে পৃথার ভালবাসার শুরু। ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর তখন সে। অতনু সবে থিসিস পেপার জমা দিয়েছে। পৃথার শেষ সেমিস্টার। হঠাৎই একদিন জরুরি তলবে দেশে ফিরে অতনু। তারপর কোন যোগাযোগ নেই। অথচ সে বছর নিউ ইয়ারে বিয়ের কথা ছিল ওদের। পৃথা একের পর এক মেইল করে যায়, কোন রিপ্লাই করে না অতনু। ফোন করে, নো আনসার। উদ্বিগ্ন হয় সে। কি হলো অতনুর? দেশে ফিরলো, তাহলে কি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট? নইলে এতদিন এভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ না করে থাকতে পারে না অতনু। 

সে বছর বার্লিনে ভীষণ বরফ পড়েছিল। ঠান্ডায় কেউ বাইরে বের হয় না সচরাচর। রাস্তাঘাট সব বরফাচ্ছন্ন। একদিন দুপুরে মেইল চেক করতে বসে পৃথা। মেইলবক্সে অতনুর একটা মেইল দেখতে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সে। দ্রুত ওপেন করে মেইলটা। মাত্র দুইটা লাইন। ‘এখানে এসে আমাকে বিয়ে করতে হলো। আই অ্যাম সরি’।

এক নিমেষে সারা পৃথিবীটা যেন শূন্য হয়ে গেল পৃথার কাছে। এই এত বড় পৃথিবীতে যেন কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, সে একা দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল শূন্যতায়! মনে হল যেন ছুটে বাইরে যেতে পারলে মুক্তি মিলবে যন্ত্রণা থেকে। ছুটে বাইরে বের হয়ে যায় পৃথা। কিন্তু বরফাচ্ছন্ন জন-মানবহীন নগরী তার ভেতরটার মতোই ফাঁকা। অপমানে, ঘৃণায় দুইহাতে মুখ চেপে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে সে! 

এরপর কি ভীষণ বেঁচে থাকার লড়াই তার নিজের সঙ্গে নিজের। আধা বোতল ওয়াইন শেষ করে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারে না সে। শুধু মনে হতো অতনু উইথ সামবডি  এলস। 

এরইমধ্যে চা নিয়ে আসে বেয়ারা, সঙ্গে অতনু। ঘন নিশ্বাস নিচ্ছিল পৃথা। ওই দিনের কথা মনে হলে তার প্রেসার বেড়ে যায়। এই ঠান্ডার ভেতরও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। 

একি পৃথা আর ইউ ওকে? তোমার মুখটা এমন লাগছে কেন?

না না, আমি ঠিক আছি, তুমি ব্যস্ত হবে না প্লিজ! মনে মনে বলে এখনো আমার জন্য এত উৎকণ্ঠা! ঢং, মেয়ে পটানোর ফন্দি।

চা নিতে নিতে পৃথা জানতে চায়,  তোমার স্ত্রীকে দেখছি না যে তিনি কোথায়? 

আছে কিন্তু এখানে নাই, বাদ দাও। তোমার কি খবর বলো।

ভালো। একটা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে আছি, একটা প্রজেক্ট ডিল করছি ব্যাস। ভালো লাগলে ওদের সঙ্গে আরও কন্টিনিউ করতে পারি।

বিয়ে করো নাই? এক ধরনের সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করে অতনু।

বিয়ে করার কথা ছিলো বুঝি?

কথা থাকা না থাকার কি। মানুষ বিয়ে করে না? সঙ্গীহীন জীবন কতক্ষণ টেনে নেয়া যায়?

আর একজন নামকাওয়াস্তে সঙ্গী থাকলে বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?

না-আ, তা ঠিক না। তুমি খুব পেচিয়ে কথা বলতে শিখেছো।

ঠিক আছে আর পেচাব না, বিয়েটা এখনো করি নাই। ঠোঁটে একটা নকল হাসি ধরে রাখে পৃথা।

কেন? বিস্ময় প্রকাশ করে অতনু! ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করে অপরাধবোধের।

আসলে পুরুষের প্রতি বিশ্বাস উঠে গেছে আমার। আই জাস্ট হেট দেম। তাছাড়া আমার প্রতি কেউ যে লয়াল হবে এমন আশ্বাস পাই নাই  ভেতর থেকে।


আরো পড়ুন: প্রেম অপ্রেমের কথকতা


কিন্তু তুমি কিন্তু এটা ঠিক করো নাই পৃথা। না জেনে তুমি অনেক বড় একটা ভুল করে বসে আছো।

ভুল, সেটা কিরকম?

আসলে ভুলটা আমারই, আমি ভেবেছিলাম তুমি যে জেদি মেয়ে তাতে আমার এ খবর শুনে দুই মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলবা। তোমাকে কেউ ডিচ করেছে, অথচ তুমি তাকে এক হাত দেখে নিবা না, এমনটা ভাবি নাই। 

তো, আমি ভুলটা কি করলাম, এটা? 

আসলে প্রকৃত কারণটা তোমাকে আমি বলতে চাই নাই। তাই মিথ্যা বলেছিলাম সেদিন।  আমি, আমি আসলে…, দম নেয় অতনু।

তুমি আসলে কি? তার ভেতরের উদ্বেগ চেপে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে এ সময়ে।

অতনু একটু ঝুঁকে পৃথার হাতটা ধরে। পৃথা বাধা দেয় না। এরপর ধীরে ধীরে বলে, আমি আসলে এইচ আই ভি পজিটিভ!

হোয়াট! কেঁপে ওঠে পৃথা। অজানা আতঙ্কে তখন অতনুর হাত ছেড়ে দেয় সে। এইচআইভি পজেটিভ মানে কি? তোমার এটা কিভাবে হতে পারে? ইম্পসিবল! এর চেয়ে বরং আমাকে দেয়া তোমার মিথ্যা গল্পটাই ভাল ছিল।

তুমি তো জানতা, মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারির কথা শুনে আমি দেশে ফিরি। তখন অপারেশনের জন্য অনেক রক্তের প্রয়োজন ছিল। যেটা ডাক্তার আমাদের আগেই ইনফর্ম করেছিলেন প্রস্তুতির জন্য। স্বভাবতই আমার আর মায়ের ব্লাড গ্রুপ এক বলে আমার রক্ত টেস্ট করার জন্য দেই। তখনই ধরা পড়ে। এরপর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেশের বাইরেও টেস্ট করাই। কিন্তু ফলাফল একই। আশার কথা এই যে, এটা আমার রক্তের সুপ্ত অবস্থায় আছে। তবে আমি কাউকে মেট করলে তার ভেতরে রোগটা ফরম করবে। 

তার মানে এটা প্রমাণ করে যে তুমি কাউকে মেট করেছিলে? নইলে সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও এটা টেস্টে ধরা পড়তো না!

এ ভাইরাস সবার ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। ইউ আর রাইট। আর তুমি তো আমার x-girlfriend ক্যাথরিনাকে জানতে। 

হ্যাঁ, তুমি বলেছিলা, যে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সত্যি বলতে কি তোমার ওই দুঃখ ভরা কাহিনী শুনে আমি তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

আসলে ক্যাথিকেই, আই মেট হার। তাছাড়া তোমার পার্সোনালিটি বলো, বা তোমার ইস্টার্ন ইনোসেন্স বলো, এ সব কিছু আমাকে তোমার  এতটা কাছে যেতে দেয় নাই। তাই তুমি বেঁচে গেলে।

একথা শুনে পৃথা রেগে যাবে কি ক্যাথরিনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। আর ক্যাথরিনা? 

শুনেছি ও, ও মারা গেছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় পৃথার শরীর বিবশ হতে হতে ফিরে এলো যেন। এক মুহূর্তে পৃথার এতদিনে লালিত রাগ-অভিমান, ঘৃণা-বিদ্বেষ কোথায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ গভীর আবেগে বলল,  তুমি আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবা?

কি রিকোয়েস্ট, বল? 

তুমি আমার সঙ্গে থাকবা বাকিটা জীবন? প্লিজ, না বলো না। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে থাকতে। তুমি যদি রাজি হও প্লিজ তাহলে আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। 

না, এটা কি করে সম্ভব? তোমার আকর্ষণ কি আমার পক্ষে এড়ানো সম্ভব হবে? দুজন নর-নারী যেখানে এমন একটা রোমান্টিক রিলেশনে থাকে সেখানে কতদিন সন্নাসীর মতো বসবাস করা সম্ভব?

তুমি এখনও ছেলেমানুষ পৃথা তাই এমন ভাবতে পারো।

না, অতনু, আমি কোন কথা শুনতে চাই না। আমরা বিয়ে করবো, ব্যাস। আমি কালই সবকিছু গোছগাছ করে তোমার কাছে চলে আসব।

অনেক রাত হয়েছে পৃথা, চলো ডিনার সেরে তোমাকে বাংলোয় পৌঁছে দেই।

সেদিন রাতে পৃথার যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও তাকে বাংলোয় পৌঁছে দেয় অতনু! সারাটা পথ আনন্দে আবোল-তাবোল কত কি বলে যায় পৃথা। কিছুক্ষণ হাসে তো কিছুক্ষণ কাঁদে।

পরদিন সকালে এসে সে আর অতনুকে খুঁজে পায় না। জরুরী কাজে সে নাকি ঢাকায় ফিরে গেছে জানায় গার্ড। 

পৃথা এরপর সম্ভব সব জায়গায় অতনুর খোঁজ করে। দেশে বিদেশে পৃথিবীর সব প্রান্তের যত বন্ধু, যত পরিচিত আছে সবাইকে নক করে অতনুর খোঁজ পাওয়ার জন্য।

এরপর কেটে যায় তিন বছর।  একটা অচেনা আইডি থেকে পৃথাকে মেইল করে কেউ একজন। যেখানে লিখেছে ‘অতনু সিলেটের শ্রীমঙ্গলে আছে, ভীষণ অসুস্থ’। হতে পারে লাস্ট স্টেজ। ঠিকানাও দেয়া ছিল সেখানে। 

পৃথা ভাবে, অতনু তাহলে ওর বাড়িতে ফিরেছে!

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ছেড়ে সেখানে কেন! বাড়িই কি মানুষের শেষ আশ্রয়! নাকি পৃথার কাছে ফিরতে চেয়েছে সে!

পৃথা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে যায় শ্রীমঙ্গলে। সেদিনও সন্ধ্যা নেমে গেছে। কুয়াশার বদলে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ধোঁয়া ধোঁয়া আচ্ছন্ন চারিদিক। টালির ছাদে অদ্ভুত শব্দ করে ঝরছে। যেন একটা ঘোরলাগা সিম্ফনির মতো। বিটোফেন যেমন রাতভর পাম পড়ার শব্দ শুনে সুর তৈরি করতেন। তেমন একটা আচ্ছন্নতা।

অতনু শুয়ে আছে বিছানায়, একটু কুঁজো হয়ে। লম্বা শরীরের সেই ঋজু ভাবটা নেই। শুকিয়ে গেছে অনকটাই। শিরা ওঠা হাতে স্যালাইন চলছে। পৃথাকে দেখে নার্স মেয়েটা বাইরে গিয়ে দাঁড়াল! যেন আগে থেকেই জানত সে আসবে। এই মেয়েটাই হয়ত তাকে মেইল করেছিল। ওকে হয়ত অতনু বলেছে সব, সবটা। 

বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে ছিলো সে। শেষে ঘুম না ভেঙে যায় তাই আলতো করে পাশে বসে হাতে হাত রাখে পৃথা। 

মুহূর্তেই চোখ মেলে তাকায় অতনু! সেই চোখে বিস্ময় নেই, উচ্ছ্বাস নেই। আনন্দ বা বিষাদ কিছুই ধরা পড়ে না। সাদা ঘোলাটে হয়ে আসা চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে শুধু। অতনু অন্য হাতটাও বাড়িয়ে দেয় পৃথার দিকে। শক্ত করে আকড়ে ধরে পৃথার হাত। 

পৃথা অতনুর বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে বলে, সেদিন না বলে চলে এসেছিলে কেন তুমি?

কম্পিত কন্ঠে অতনু বলে, তুমি বিশ্বাস করবা না জানি, তবুও বলছি, ভালোবাসি বলেই কখনো কাছে আসি নাই। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>