| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: প্রেম ও আমি । যশোধরা রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
“দনাদ্দন মন খারাপ আর সেই মন খারাপ থেকে উঠে পড়া
আরেক প্রেমের জন্য সেই প্রেম যা দেয় পাহারা
তোমার ও তোমার মধ্যে আসতে দেয়না স্বভাব বিষাদ
এলে তার ছাত পায়, কার্নিশে বেড়াল বসা পায়
বিষাদ ততক্ষণ ভাল যতক্ষণ
ভাল ঘুম হয়
 
বাকিটা ভাল না, আর মরে থাকা, কুঁকড়ে থাকা নির্বেদ ভাল না
এইসব নাশকতা তুমি আর নেবেনা হৃদয়ে
আর এই বাধ্যবাধকতা
 
বিষাদের আর তোমার। পরস্পর কথা বল কেন
প্রেমেরও ত হিংসে হয়, হয়না আবার?
 
প্রেম তাই পুরোটা তোমাকে চায়, ঘুমন্ত আগুন আর নেবানো কামনা
এসব প্রেমের নিজ খাদ্য নয়, জেনো।“

কমবয়সে প্রেমের কবিতা লেখেনি এমন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মধ্যবয়সে প্রেমের কবিতা লেখা নিয়ে নানা মুনির ত নানা মত আছেই। অনেক কবিই চান একটা প্রেম করে তার ভেতরে থাকাকালীন প্রেমের কবিতা লিখতে, তাহলে একটা তুঙ্গমুহূর্তের চিহ্ন সেই লেখায় থেকে যায়। আবার অনেকে প্রেম ভেঙ্গে গেলে তবেই প্রেমের কবিতা ভাল লিখতে পারেন। কিন্তু কোনটাই চেয়ে বা ইচ্ছে করে , বানিয়ে করা যায়না। তা বাদে আরেক রকম প্রেমের কবিতা থাকে যা বানানো অনুভূতি, বানানো কবিতা। আমি বাড়িতে আমার স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে খিটখিট করছি অথচ একা বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেমের কবিতা লিখছি। এটাও হয়, এটাও সম্ভব।

আমার কথা যদি বলি, নতুন করে নতুন লোকের প্রেমে পড়ার কোন রেকর্ড আমার নেই। তাহলে কী আমার জীবন, মানে প্রেম জীবন জোলো , ডালভাত মার্কা? যে আমি পিশাচিনীকাব্যে নিজের প্রেমের কথাকেই অপ্রেমের কথার মত করে কবিতায় ঢেলে দিয়েছিলাম সেই আমি এখন বিবাহিত জীবনে, দীর্ঘকাল একই সম্পর্কের ভেতরে থেকেই , কীভাবে নতুন করে প্রেমের কবিতা লিখব, বা লিখছি তাহলে? তাহলে কি আমার প্রেমের কবিতা, এখন যা কিছু লিখছি, তা বানানো? কৃত্রিম, সাজানো শব্দের?

আসলে প্রেমের কবিতার সেকেন্ড একটা ঢেউ আমার মতে মধ্যবয়সে, মানে ৪০+ হবার পর এসেছে যেটা প্রথম ঢেউয়ের থেকে অনেক আলাদা, খুব জোরালো। সেটা হয়ত মধ্যবয়সের ঢেউ। জয়দেব বসু একবার লিখেছিলেন, যশোধরার জীবনে কী কী ঘটেছে ওর কবিতা পড়লেই বোঝা যায়। দ্বিতীয়, তৃতীয় বই প্রেমের কবিতা, চতুর্থ বই বাচ্চাকে নিয়ে লেখা কবিতা। মানে প্রথমে যশোধরা প্রেমে পড়লেন, তারপর বিবাহিত হলেন, তারপর বাচ্চা হল, পুরোটাই ওঁর কবিতার বই পড়ে বোঝা গেল। মহিলাদের লেখা নিয়ে তো এটা বলাই হয় যে মেয়েদের লেখার মধ্যে নিজেদের জীবনটাই বেশি থাকে। জয়দেবের কমেন্টটা খুব আনকাইন্ড কমেন্ট তখন আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা তো সত্যি। পণ্যসংহিতার থিমটা আলাদা। তারপর পিশাচিনী কাব্য, চিরন্তন গল্পমালা এবং রেডিও বিতানের বেশ কিছু কবিতায় প্রেম ব্যাপারটা আছে। তারপরে আমি লাইন চেঞ্জ করে ফেললাম। তারপর আমি ছানাপোনা নিয়ে লিখলাম। ছানাপোনাদের নিয়ে তো খুব কম লেখা হয়। সেই লেখাগুলো সত্যিই সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু তারপরে যে প্রেমের কবিতা একদম লিখিনি তা তো নয়, জোয়ারটা অনেক কমে যায়। যেমন রাজনীতির কবিতা ঢুকে গেল, কুরুক্ষেত্র অনলাইন। তারপর ভার্চুয়ালে নবীন কিশোর-এ আবার নেট দুনিয়া ঢুকে গেল। একটা করে থিম ঢুকে যাচ্ছে এক একটা বইতে।
ফর্টিজ থেকে জীবনে আর একটা জোয়ার আসে… ইনফ্যাক্ট কোথায় একটা যেন পড়লাম যে ফর্টিজ হল দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি। এই যে মেয়েদের মেনোপজের যে সময়টা, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে, পুরুষদেরও পৌরুষ চলে যাবার ভয়, মৃত্যুভয়, প্রেম হারানোর ভয় আসে। অন্য নাম আছে অবশ্য তার। অ্যান্ড্রোপজ।
মহিলাদের ক্ষেত্রে আমি কারওকে বলতে শুনিনি খোলাখুলি। কিন্তু আমরা তো এখন সবকিছু নিয়েই কথা বলতে ভালোবাসি। এই দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি ব্যাপারটা কিন্তু আছে, ডেফিনিটলি আছে। আমার এই সময়টা খুব টালমাটাল গেছে, তুমি এটাকে হরমোন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারো। জীবনের আর একটা ফেজ। আরো জটিল। হয়ত সেটাই ধরা আছে কবিতার মধ্যে।
যদিও প্রেমের সংজ্ঞা পাল্টায়নি। সংজ্ঞাটা কিন্তু একই আছে। প্রেম তো একটা কনসেপ্ট। আমার জীবনে প্রেমের একটা খাঁচা আছে। সেই খাঁচার মধ্যে আমি বিভিন্ন লোককে প্লেস করি। কমবয়সের যে খাঁচাটা থাকে সেটা একদম ফাঁকা থাকে। আমরা তো ছোটবেলা থেকে নানারকম গল্প পড়ে সিনেমা দেখে গান শুনে নানাভাবে প্রেমটাকে কনস্ট্র্যাক্ট করি। এবং অবশ্যই তার মধ্যে যৌনতাটাও থাকে। এবার কমবয়সে ওই ফাঁকা খাঁচাটার মধ্যে আমরা কারওকে বসাই। কমবয়সে তোমার কাছে অনেক অপশান আছে। ব্যাপারটা অনেকটাই ওপেন থাকে। কিন্তু তোমার যখন বয়স হয়ে যাচ্ছে তখন তোমার মধ্যে আরও অনেক জটিলতা ঢুকে যাচ্ছে। যেমন তোমার সন্তান বড় হয়ে গেছে। আমার সন্তানের যখন তেরো বছর বয়স হয়ে গেছে তখন আমার প্রেমের অনুভূতির মধ্যে যে কনফ্লিক্টটা হচ্ছে যে আমি তো একজন মা, আমার মেয়েরও তো প্রেমে পড়ার বয়স হয়ে গেছে। তাহলে আমার কি আর অধিকার আছে? দ্বিতীয় একটা জিনিস হচ্ছে ওই যে ফাঁকা খাঁচাটা, ওটা তো নানান রকম মুখে ভরে গেছে। ছাপ পড়ে পড়ে ছাপ পড়ে পড়ে ওটা আবিল হয়ে গেছে। পরিষ্কার একটা অবয়ব, একটা ফাঁকা জায়গা তো তুমি আর পাচ্ছ না। সেই জটিলতাগুলো তখন আসতে থাকে। নানারকম সুপার ইমপোজিশন হতে থাকে। বা একজনকে হয়তো ভালো লাগল, তাকে মনে হল এ অমুকের মতো, এ আমার দু নম্বর প্রেমিকের মতো, তিন নম্বর প্রেমিকের মতো। অনেক সময়ে আমরা নিজেদেরই প্রশ্ন করতে থাকি যে ওই লোকটার ওই জিনিসটা কেন ভালো লাগছে, তাহলে কি এরকম আগে কেউ ছিল, এরকম বিভিন্ন স্মৃতি কাজ করতে থাকে। ভীষণ জটিল, কিন্তু ভীষণ টালমাটাল পর্ব।
এইসময়ে যে প্রেমের লেখা, সে লেখাগুলো আগের মতো নয়।

“সে এক সময় ছিল আমাদের
সকালে দাঁত না মাজা ঘুম ভাঙা ছিল আমাদের
বিকেলে বিছানার চাদর কিনতে যাওয়া হত
ইস্ট বেঙ্গল ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে
আর তারা বা ফুলের ছাপ বালিশের ওয়াড়া
 
সে এক সময় ছিল আমাদের
ঘুম ভেঙে থম হয়ে পড়ে থাকতাম বিছানায়
রবিগান বাজত, বেজে বেজে যেত
আর আমি মনে করতে পারতাম স্বপ্নটা
যেটা একটুক্ষণ আগেই দেখেছি
একটা তরল নরম মুখ
তাকে চুমু খাচ্ছিলাম,
খাচ্ছিলাম ত খাচ্ছিলাম…
 
সমস্ত অচেনা, ওই মুখ , ওই তারল্য
ওই চুমু…”

একদম প্রথম দিকের লেখাগুলো খুব কাঁচা ছিল। নির্মাণগত ভাবে খুব রগরগে ছিল। ২০ বা ২১ বছর বয়সে মানুষ প্রেমের কবিতা দিয়ে কবিতালেখার খেলাটা শুরু করে। সেই সময়ে আমার সব কবিতাই ছিল ডায়েরির ভেতরে বন্দী। খুব অল্পসংখ্যক কারুকে পড়িয়েছি। বেশিটাই না পড়ান। সেই কনফিডেন্স নেই। কাকে পড়াব! লাজুক মুখচোরা ভীষণ বিভ্রান্ত এক যশোধরা সেটা।

১৪-১৫-১৬ খাঁচায় বন্দী পাখির মত আড়ালযৌনতা যাপন করেছি শুধু। জানালার ফাঁকে পাড়ার ছেলেকে সাইকেলে চেপে যেতে দেখা। আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস মোচন। মেয়ে ইশকুলে পড়ি। বুকের কাছে ব্যাগ টেনে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলবাসে উঠি। সেইসব দিনকাল,’রাস্তার ছেলেরা” আওয়াজ দিচ্ছে। ক্রিকেটের বল এসে পিঠে লাগলে একজন বলছে “দেখে ভাই!” অন্যজন বলছে “ও দেখেই মেরেছিল”। কর্ণমূল আরক্তিম হচ্ছে অথচ উপেক্ষা শিখছি। এই দশার পরের দশা কলেজে যাওয়া ও প্রেমের বীজতলায় অজস্র এন্ডিগেন্ডি প্রেম রোপণের পর একজনকে বেছে নেওয়া ও ব্যর্থতা।

কলেজ জীবন। বলগাহীন অশ্বের মত টগবগে দিনকাল আসলে । ১৯৮৪ -৮৭ । বি এ। দর্শনের অনার্স। আমি প্রেম করতাম না যতদিন, প্রচন্ড আওয়াজ দিয়ে চলতাম যারা প্রেম করে তাদের। এদিকে আমাদের বন্ধুদের সকলের মধ্যে তখন অনিবার্যভাবে গিসগিস করছে প্রেম বা প্রেমের সম্ভাবনা। এক দুজন স্কুল লাইফ থেকে স্টেডি বয়ফ্রেন্ড সম্পন্ন, যাদের আমরা বাকিরা গোপনে ঈর্ষা করি প্রচন্ড ।একটা পয়েন্টে ওরা এগিয়ে থাকা। বাকিরা, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, বিভিন্ন ইয়ারের মধ্যে , বন্ধুত্ব ও তৎপরবর্তী এ ওর প্রেমে পড়ে যাওয়া খুব সহজ।
প্রতি কলেজে তখন বাৎসরিক ফেস্ট হত। হয়ত এখনো হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। সে সময়ের কলেজের ফেস্টিভালগুলো এক একটা প্রেমের বীজতলা। বিজকুড়ি বিজকুড়ি হয়ে প্রেম গজাচ্ছে আমাদের। পারমুটেশন কম্বিনেশনে প্রেম হচ্ছে, দ্রষ্টব্য পরশুরামের প্রেমচক্রের সেই হারীত -জারীত-লারীত বা লপিতা-শমিতা কেস। অবধারিত প্রেমে পড়া , প্রেম ভাঙা, হৃদয় বিদারণ… একই ছেলের প্রেমে দুজনে পড়া বা একই মেয়ের দুই ছেলেকে ইকুয়ালি নাচানোর ব্যালান্সিং অ্যাক্ট। এই সময়টাই চিরবসন্তের।
কেন আমার প্রথম প্রেম ব্যর্থ হল? ব্যর্থ হওয়া মানে কদিন পরে কেটে যাওয়া। বা বিয়ে অব্দি না পৌঁছন। সেটাও তখন একটা বড় ক্রাইটেরিয়া। এখন বোধ হয় ততটা না। কেন প্রেম ব্যর্থ হত ? হয়? এখনো , তখনো , বুঝিনি। আমার মধ্যে প্রেম করার মেটিরিয়াল কম আছে তখন ভাবতাম। এখন ভাবি বেশি আছে… এত স্বাধিকারসম্পন্ন আপোসহীন এবং উচকুম্বো খ্যাপা ছিলাম যে প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধতা বা কোন একজনের প্রতি আনুগত্য সম্ভব হত না? ইচ্ছে করেই ভুল প্রেমিক বাছতাম? যাতে পরিণতি না পায়? কে জানে কী? তবে নিট ফল অনেক অনেক বেদনা, নিখাদ কষ্ট, পশ্চাত্তাপ…

প্রথম প্রেমিক তখন সেটল ডাউন হত কার কী ভাল লাগে তার লসাগু গসাগু কষে। তোর কী গান ভাল্লাগে? তোর কী বই ভাল্লাগে? তোর অমুকের আঁকা ভাল্লাগে? আঁকতে পারিস? গাইতে পারিস? এইসব। তাছাড়া ক্যান্টিন টেবিলের উল্টোদিকে বিঁধে যাওয়া চাউনি গিলতে না পারা। তাও কারণ।

প্রথম প্রেমিককে প্রথম চুমু খেতে তখন তিন মাস প্রেম করা লাগত। এরকমই কথিত ছিল সে অরণ্যের প্রাচীণ প্রবাদে। আরও কত এরকম ছিল। সেই চুম্বন বড় শীতল হল, নিজেকে ফ্রিজিড ভেবে আরো কয়েক মাস কাটার পর মনোগত যে মিল সেগুলোও আর খুঁজে পেলাম না। ব্রেকাপ হয়ে গেল। প্রথম প্রেম একবারই ত ভাঙে। কিন্তু মনে হয় সেই ভাঙাটা সবচেয়ে কাতর করে যায়। প্রেম বুভুক্ষুরা ভাবতে বসে আমার কী কী ভুল ছিল। অমুক দিন ওকে হতাশাগ্রস্ত গলায় বলেছিলাম, তুমিও মিথ্যে বল? তমুক দিনে আমার মা হঠাৎ রূঢ় ব্যবহার করেছিল ওর সাথে? এইসব কারণেই ভেঙেছে? অনন্ত ভাবনা, অজস্র রকমের দ্বিধা ও সংশয়। যেন সারাজীবনে আর কখনো প্রেম আসবে না। আর কোনদিন প্রেম করে উঠতে পারব না আমি। এখন, শুধু এখন কেন, আমাদের থেকে দশ বছরের ছোটরাই , ক্যাজুয়াল হয়ে গেল, সর্বসমক্ষে বলা শুরু হল, ওটা ঘটেছিল আমার প্রথম ব্রেকাপের পর, ওই শাড়িটা কিনেছিলাম আমার দ্বিতীয় ব্রেকাপের পর। ব্রেকাপ থেকে ব্রেকাপে যেতে যেতে জলচল হয়ে যায় এখন সব। আমাদের হত না। তাছাড়া আশেপাশে অনেক দিন যাবত বান্ধবীরা বিয়ে করে ফেলছে, প্রেম করে বা না করে।

তবে , ইদানীঙ পুরনো গান শুনে বুঝি, আমার প্রেমধারণা কতটাই উড়ুক্কু, আদর্শবাদী তথা মূলে নষ্টদুষ্ট ছিল। এই সেদিন এরিক রোমেরের দ্য গ্রিন রে, ছবিটা পুরোটা দেখতে খুব কষ্ট হল, এত ক্লিশে লাগছিল নায়িকাকে… এত বোকা বোকা লাগছিল, এত বেশি দ্যাখানেপনা মনে হচ্ছিল ওই দ্বিধাকে সংশয়কে, হঠাৎ কেঁদে ফেলা বা হঠাৎ উঠে যাওয়াকে… মুডি মেয়েটির সবটাই অসহ্য। অনেক ক্ষণ পরে টের পাই, আসলে এরিক রোমেরের কথনের এই নায়িকা একেবারে হুবহু ৩০ বছর আগেকার আমি! সেরকমই মেজাজি, ভাল লাগা মন্দ লাগায় বিধুর। খ্যাপা। যেরকম বাক্স বদলের অপর্ণা সেন। অথবা, সেই যে লেনার্ড কোহেনের গানটা, সেই সুজান? সেইরকম…

And just when you mean to tell her that you have no love to give her
Then she gets you on her wavelength
And she lets the river answer that you’ve always been her lover
And you want to travel with her, and you want to travel blind
And then you know that she will trust you
For you’ve touched her perfect body with your mind

আমরা আমাদের কুড়ি বা বাইশে, ঠিক ততটাই আত্মকেন্দ্রিক, ততটাই আত্মরতিময়, নার্সিসিস্টিক, যা দিয়ে নিজেকে প্রেমের ট্র্যাজেডির নায়িকা বানানো চলে…আমরা ততটাই ছিলাম অন্ধ, ততটাই কাব্য-কাব্য, যাতে বার বার হৃদয় ভেঙে ফেলা চলে।


আরো পড়ুন: সহজিয়া কবিতার গভীর গমনে আজকের কয়েকজন কবি


ভাগ্যক্রমে সেসব ফেজে লেখা কবিতা কিচ্ছু ছাপিনি। সেন্টিমেন্টে আর মারাত্মক আবেগে ভিজে গোবর হয়ে থাকত তাহলে আমার কাব্য সংগ্রহ। স্মার্ট, প্রেম থেকে উঠে পড়া ও ঝকঝকে করতে গিয়ে , নিজের আবেগের পার্টটাকে কুচ করে কেটে বিদেয় করে দিয়েছিলাম ছাপাছাপির আগেই। নীরক্ত, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত হয়েছিলাম।

এই সময়ের লেখা আমি ছেপেছিলাম পণ্যসংহিতায়। প্রেম হীন কবিতা। তারপর পিশাচিনীকাব্য। সে ত অপ্রেম বলেই লিখে ফেলেছি। রগরগে, রাগি, কাঁচা কিন্তু সক্ষম সচেতন, আত্ম শ্লেষের প্রেম -অপ্রেমে মেশা একটা বিষয় । এখন পড়লে মনে হয় আমি কোনও দিন আর ওভাবে লিখতে পারব না। মানে নিজেকে নিজে ঈর্ষা হয়। মধ্যবর্তী পর্যায়ে যখন সম্পাদক বলে, দুটো প্রেমের কবিতা লিখে দিন। ব্যাপারটা তো জোর করে লেখার মতো হয়ে যায়। ক্রাফট এসে তখন তোমার হাত ধরে। কিন্তু এই লেখাগুলো আমার ভেতরের একটা অন্ধ তাড়না থেকে এসেছিল। আমি একম কোনও ক্লেম করছি না যে একটা নতুন গ্রামার তৈরি করছি। তবে এগুলো আমার নিজের লেখা। কেউ বলে দেয়নি।

“টিপ্পুনির হাল হকিকত
প্রাণ মলমের হদিশ
পিটুনির ক্রমবিকাশ
হস্তশিল্পের নিঃস্বতা
মৈথুনের টোটাল মিথ্যা
মরা মাছের মত মুখ
হাঁ করে ঘুমনো
 
তথাপি স্বপ্ন
এবং স্বপ্ন
এবং স্বপ্ন
 
প্রেমের…”

মধ্যবয়সের প্রেমের কবিতায় কিন্তু প্রত্যাশিতভাবে আমার ক্ষেত্রে অন্তত কোন সামাজিক ঢাকাচাপা, আড়াল বা সেনসরশিপ একদমই কাজ করছিল না, কারণ আমি জানি আমি যে ভাষায় লিখি তাই আড়ালের কাজ করে। ক্রাফট বা নির্মাণটাই। তবু, যথাসম্ভব অকপট হতেই হবে নিজের কাছে, কিন্তু কাব্যভাষাই ত আসলে আড়াল দিচ্ছে আমাকে। আর, মধ্যবয়সে আসলে প্রেম বল যৌনতা বল, তাড়নাটা এত বেশি হয়ে যায়! চলে যাবার আগে মরণ কামড়ের মতই বল আর স্তব্ধতার আগে ঢাকের জোরালো আওয়াজের মতই বল। খুব সোরগোল ফেলে আসে এই অনুভূতিরা।
যে জন্য লেখাগুলোকে আমি খুব ভ্যালু দিতে বাধ্য হলাম। কারণ লেখাগুলো আমার কাছে খুব পিওর। পিওর মানে সেখানে আর কোনও কনস্ট্রেইন্ট কাজ করছে না। প্রেমের সম্বন্ধে আমার খালি মনে হয় একটা ছবি। যেন ওই সমুদ্রের একদম ধারে আমি বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নিজেকে দেখছি ষোলো বছরের আমার প্রেমটার শব নিয়ে। একটা বিষাদের ছায়া আছে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে, কারণ আমি জানি এটাও হারিয়ে যাবে। এটাও চলে যাচ্ছে। ট্র্যানজিয়েন্ট। এই ফিলিংটা আসছে নতুন। একের পর এক শব বহন করছি আর সব ছিঁড়ে ছিঁড়ে খসে খসে পড়ে যাচ্ছে পথে। তবু চলছি। আমৃত্যু ত প্রেমের শব মাথা থেকে ঘাড় থেকে নামাতে পারব না। বেতালএর গল্পের বিক্রমাদিত্যের মত শবদেহ ঘাড়ে ঘুরে বেড়াব। প্রেম নিয়ে আমার মনের মধ্যে যে চাওয়া যে চাহিদা, হিন্দিতে যাকে বলে চাহত।

“সমস্ত শরীর অকেজো হয়ে যাবার পর
কেবলমাত্র মন জেগে থাকে
 
যেন অন্ধকারের টিলা
যেন আলো চোঁয়ানো শেষ জানালা
যেন দূরাগত রেলগাড়ির স্বর
যেন ভ্যাপ্পোঁ ভ্যাপ্পোঁ ভ্যাঁ
 
প্রেম চিরদিন রয়না ঘরে
আলোর মত ছড়িয়ে পড়ে
 
সমস্ত অষ্টাবক্র দিন ও শরীরে
একমাত্র জেগে থাকা ভাসা ভাসা এই মন
এই প্রেম”

যখন কেউ আঠারো বছর বয়সে প্রেমের কবিতা লিখছে তখন তো তার সামনে অনেকটা রাস্তা আছে, পঞ্চাশ বছর বয়সে যখন প্রেমের কবিতা লিখছে তখন একটা বিষাদ কাজ করে কোথাও যে, আমি তো ক্রমশ আমার নিজের এই প্রেমের সত্তাকে হারিয়ে ফেলছি, যেন চলে যাচ্ছে আমাকে ছেড়ে, এই কষ্টটা। অন্য কারও বইয়ের কথা যদি বলি, ভালোটি বাসিব বলে জয়ের যে বইটা, একটা কোথাও এই বিষাদের ব্যাপার আছে না, যে হারিয়ে ফেলব হারিয়ে ফেলব…

“এখন সকাল থেকে – শরীর
এখন খালাস হয়না – শরীর
এখন প্রতিটি দিন ভাত খোঁজে – শরীর
এখন টুথপেস্ট কিনে বাড়ি ফিরছে – শরীর
 
এখন ঝামরে মরছে বাসনা অতলে – শরীর
এখন কুয়োর মধ্যে ব্যাঙের মত লাফাচ্ছে – শরীর
এখন সামাজিক দূরত্বে – শরীর
স্পর্শ লালসায় মরে যাচ্ছে।“

মনে হয় আমৃত্যু প্রেমের কবিতা লিখে যাব। লিখে যেতেই হবে।

“শীত থেকে উঠে আসে কুয়াশা
আর সেই সব সকালের দিকে
আমাদের চা দোকানে বসা
সমস্ত রাতের লেপ উষ্ণতার পর
হাত দিয়ে ঘিরে রাখা চায়ের গেলাসে
আরো কিছু উষ্ণতা যোগ করতাম
 
মুখ থেকে ভাপ বেরুত
তাই দিয়ে কাটাকাটি হত কুয়াশার শীত
 
এভাবেই আজো লড়ছে
পৃথিবীর উদাসীনতার সঙ্গে
প্রেম”

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত