Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Prithibi Amare Chay na bangla golpo

ইরাবতী গল্প: পৃথিবী আমারে চায় না ।  ইকবাল তাজওলী

Reading Time: 7 minutes

আমার নাম রাবেয়া।

রাবেয়া মানে চতুর্থ। আমি আমার বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। আমাদের ভাইবোনদের সংখ্যা মাশাল্লাহ সব মিলিয়ে এগারোজন। বোন সাতজন আর ভাই চারজন। আমাদের মধ্যে একটি ফারাক আছে। চিন্তা করছি এই পরিবেশে এই ফারাকের কথা বলব কিনা। সাধারণত এ সব কথা এমনিতে বলি না।  লজ্জা লাগে। পাছে লোকে যদি কিছু বলে! আচ্ছা, মুখে যখন হিন্টস দিয়েই ফেলেছি, তখন পাছে লোকে কী বলল না বলল ভেবে লাভ নেই। বলেই ফেলি। আমরা ভাইবোন সকলে কিন্তু একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান না, অর্থাৎ সহোদর না, আবার একই পিতার ঔরসজাতও না।  আমাদের মধ্যে আরও একটা ফ্যাঁকড়া আছে। লজ্জা-শরমের কারণে চাচাতো ভাইবোনদেরকেও লোক সম্মুখে নিজের ভাইবোন বলে পরিচয় দিই। যাইহোক, কেবল আমরা বড়ো চারবোন যথাক্রমে আম্বিয়া আপা, শাহিদা আপা, জাহিদা আপা আর আমি একই পিতার ঔরসজাত এবং একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান।

আমাদের বাজান ছিলেন শ্রীমঙ্গলের একটি চাবাগানের পিকআপের ড্রাইভার। মদ খেতেন আর বাপের বেটা পিকআপ চালাতেন। আর মুখে হিন্দি গানের তুবড়ি ফুটত! খাইকে পান বানারসওয়ালা! চাশ্রমিকদের সঙ্গে বাজান আমার মিশেও গিয়েছিলেন।  টিকালো নাক থাকলেও তাঁর গায়ের রং ছিল চাশ্রমিকদের মতো।  চাশ্রমিকদের ভাষায় অনর্গল কথাও বলতে পারতেন।

তখন আমার বয়স চার কী পাঁচ।  বাজানের একটি কথা এখনও আমার কানে বাজে! কী একটা কারণে কথা কাটাকাটির চূড়ান্ত পর্যায়ে বাজান গোবিন্দ কৈরী কাকাকে বাজে একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন,

‘ কুলি কা বাচ্চা কভি নেহি আচ্ছা।

   যো ভি আচ্ছা, ও ভি শুয়ার কা বাচ্চা।’

এই হচ্ছে বাজানের সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি।  সে যাই হোক, ওইদিনই পান বানারসওয়ালা বাজান আমার মদ্যপ হয়ে এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় পিকআপ চালাতে গিয়ে পিকআপ নিয়ে গভীর খাদে পড়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।

বাজানের মৃত্যুর মাস ছয়েক পর ছোটো বাজান মাকে বিয়ে করেন।

ততদিনে আমরা বাড়িঘরে চলে এসেছি।  দাদি, সেজো বাজান, আর ছোটো বাজান গিয়ে আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন।

আর আমাদের মাকে বিয়ে করতে গিয়ে ঢাকা-সিলেট রুটের ঈষাণ পরিবহনের ভলভো এসি কোচের ড্রাইভার ছোটো বাজানকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! রীতিমতো টাগ অব ওয়ার করতে হয়েছে সেজো বাজান আর মায়ের এক দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে।  কারণ, মা ছিলেন সুন্দরীদের মধ্যে সুন্দরী, মানে যাকে এক কথায় বলে হুরপরি।  এই ঘরে আমাদের চারভাই যথাক্রমে কামাল, জামাল, সালাম আর আজাদের জন্ম হয়।  মা সম্পর্কে আর কিছু বলছি না । মেয়ে হয়ে মা সম্পর্কে কী থেকে কী বলে ফেলি এটাও একটা কথা।

কিন্তু মায়ের সুখ বয়সের হিসেবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।  দুই স্বামী মিলিয়ে বছর পঁচিশেক সংসার করার পর একদিন বৈশাখ মাসের সন্ধ্যেবেলায় নানাবাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে একদম বাড়ির দোরগোড়ায় মা নিহত হোন।  তখন তাঁর বয়স কেবল চল্লিশ অতিক্রম করছিল।

তারপর ছোটো বাজান জৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে মনে হয় দিন গুনলে ত্রিশ দিনে যে মাস হয়, সেই এক মাস যেতে না যেতেই আবার কনে দেখা শুরু করেন। কিন্তু শেষ-মেশ নিজ চাহিদা মতো যোগান সহজলভ্য না হওয়ায় দুই কন্যা সন্তানের জননী ছোটো খালাকে অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনেন। এই যে কামরান, ফরিদা, আয়েশা এরা একদিকে আমার আপন চাচাতো ভাইবোন, আবার অন্যদিকে আপন খালাতো ভাইবোনও বটে।

এবার ছোটো খালা প্রসঙ্গে দু-এক কথা বাদচিৎ করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি। অবশ্য বাদচিৎ না করলেও মহাভারত যে অশুদ্ধ হয়ে যাবে তা কিন্তু না। তবে নিজের কথা বলতে যেহেতু এসেছি, তাই তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া একান্ত দরকার আছে।

আমার একদম শৈশবে এবং কৈশোরকালে  ছোটো খালার যখন বিয়ে-সাদি হয়নি, তখন ছোটো খালা বলা যায় মায়ের বদলে মা-ই ছিল! হায়রে কী তার স্নেহ-ভালোবাসা, হায়রে কী তার আদর-যত্ন, মনে হত মা স্বর্গ থেকে সাময়িক সময়ের জন্যে মর্তে নেমে বাড়িতে এসে হাজির হয়ে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা প্রশমন করতে এসেছেন।

তখন আমার বয়সই বা কত। বেশি হলেও চৌদ্দ কিন্তু অতিক্রম করিনি। সেভেনে পড়ি। সেই সময়ের একটি ঘটনা, ঘটনা বলব না, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল, সেই দুর্ঘটনা কী সুন্দর করে হেণ্ডেল করে ছোটো খালা আমাকে বলা যায় নবজীবন দান করেছিলেন।  সে কথা ভাবলে তার প্রতি এখনও কিছুটা শ্রদ্ধার ভাব এলেও পরক্ষণেই আবার অশ্রদ্ধা এসে চোখের সামনে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে যায়।

অবশ্য দুর্ঘটনাটির জন্যে আমাকে এককভাবে দায়ীও করা যায় না। একে তো বয়স ছিল অল্প, তারওপর ক্লাসমেট সুয়াদার অনবরত ইন্ধন আর হারিসের হারিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার সংকল্প সেই রোমান্টিক সময়ে একজন কিশোরীর পক্ষে উপেক্ষা করা একবারেই সম্ভব ছিল না।  তাই গোটা দুই দিনের জন্যে হারিসের সঙ্গে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম।  ছোটো খালা কীভাবে কী করে যেন আমাকে উদ্ধার করে চারিদিকে এই বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যে তিনিই সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে গেছেন।  এবং এই তিনি নিয়েও এসেছেন।

আর সেই ছোটো খালা-ই কিনা সামান্য সন্দেহের বশে খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে আমার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছিলেন!

আচ্ছা, থাক সে সব কথা।

এখন আমি আমার নিজের সুরতের বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করব। এসব বলারও দরকার আছে।  তবে একটুও বাড়িয়ে বলব না।  যা আছে তাই বলব।  তার আগে আমার বড়োবোনদের কথা একটু বলে নিই। আমার বড়ো তিনবোনই রুপের রানি।  রুপের রানি হওয়ায় চোরের রাজাদের উৎপাতে নাইন থেকে টেনে ওঠার সুযোগ কারুরই হয়নি।  বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে।  বড়োবোনদের ধারাবাহিকতায় আমারও রুপের রানি হওয়ার কথা ছিল।  কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা আমার বেলায় এসে খেই হারিয়ে কৃপণ হয়ে টিকালো নাক আর শ্যামলা এবং ঘোর কালোর মাঝামাঝি একটা রং দিয়ে আর আমাকে এগোতে দিলেন না। খানিকটা বাজানের মতো করে রাখলেন।  আমি হলাম না ঘরকা না ঘাটকা, না সুন্দরী না রূপসী।

এই হচ্ছে আমার নিজের সুরত বা নিজের রূপ নিয়ে আমার নিজের মূল্যায়ন।  এবং এটিই আমি ধারণ করি।  এর বাইরে তরুণ-যুবারা অথবা বুড়ো-হাবড়ারা আমাকে দেখলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে তা নিয়ে আমি আমাকে দাঁড়িপাল্লার নিক্তিতে মেপে মূল্যায়ন করি না।  এমনিতে তো আমার ধারণা, চোখ-কান তো  আমার খোলা, মনে হয় এক দুই তিন করে সংখ্যা গুণলে ৭০% পারসেন্ট অথবা তারও বেশি পুরুষদের চেনার আর আমার কিছুই বাকি নেই।  শেষ শ্বাস-প্রশ্বাস সচল  থাকা পর্যন্ত মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে মজা লোটার চেষ্টা সে করবেই।  আর ওই বুড়ো-হাবড়াগুলোর কথা তো বললামই না।  সব কিছু টের পাই।  সব কিছু বুঝি।  একবার তো  এক বুড়ো-হাবড়াকে মনে হয়েছিল পাশের নর্দমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিই।  পরে ভাবনা-চিন্তা করে, নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর এগোয়নি।

যাইহোক, এখন আমি এই সময়ে অবস্থান করছি আমার ইমিডিয়েট বড়োবোন জাহিদা আপার বাসায়।  এখন এই সময়ে অবস্থান করছি বললে আমার মনে হয় আপনাদের কাছে ভুল বার্তা যায়।  মনে হয় হয়ত ঘন্টা খানেক আগে এসেছি, অথবা দিন দুয়েক বা দিন সাতেক হয় বেড়াতে এসেছি।  বিষয়টি কিন্তু তা নয়।  আমার এখানে অবস্থান করার মেয়াদ বছর তিনেক ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে অনির্দিষ্ট সময়ের দিকে মনে হয় ধাবিত হচ্ছে।  কেউ কি ইচ্ছে করে নিজ বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয় বাড়ি আরও বিশদভাবে বললে বোনের বাড়িতে গিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে? প্রয়োজনে নিরুপায় হলে কেউ কেউ করে থাকে।  আমি প্রয়োজনে না, নিরুপায় হয়ে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছি।

মা মারা যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বাড়িতে বসবাস করা আমার পক্ষে যে অসম্ভব হয়ে যাবে, তা কল্পনাতেও ভাবিনি।  একটা সময় ছোটো খালা পান থেকে চুন খসলেই আর থেমে থাকত না, অনবরত তার বকবক শুরু করত। কোনো উত্তর করলেই দৌড়ে এসে চুল-মুঠি  ধরে গায়ে হাত তুলত। গালাগালির তো কোনো ইয়ত্তা ছিল না। মেয়ে মানুষ যে এত মুখ খারাপ করতে পারে, একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের  মেয়ে হলেও এরকম দৃশ্য আমাদের পরিবারে কখনও দৃষ্টিগোচর তখন পর্যন্ত আমার হয়নি। আমার আর কী করার ছিল।  মায়ের ছবি বের করে হাতে নিয়ে খুব কান্নাকাটি করতাম।  কামাল, সালাম, জামাল, আজাদ এরা আমার মায়ের পেটের ভাই হলেও কামাল বুদ্ধি প্রতিদ্বন্ধী, আর অন্যরা তখন নিতান্তই নাবালক পর্যায়ে থাকায় চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তাদের কিছুই করার বা বলার ছিল না।

ক্রমেই এই নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছিল।

এই তো গত বছরের আগের বছরের আগের বছর মায়ের মৃত্যুবার্যিকীর আগের দিন আমি আমার টেস্ট পরীক্ষা শেষ করে এসএসসি ফাইনাল দেয়ার জন্যে জোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছি , তাই বিকেল বেলাও ঘন্টা খানেক পড়াশোনায় সময় দিচ্ছি, ওই সময় খামোখা একটা ছুতো বের করে বকাঝকা করে এগিয়ে এসে চুল-মুঠি ধরার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে দৃঢ়চিত্তে তখন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।  উত্তরও দিতে শুরু করলাম।

বলল,‘ছি, ছি, ছি। বেশ্যা মাগি কাম থইয়া পড়াত লাগছে।  বালেস্টার অইত! আইজ তোরে বালেস্টার ওয়াইতাম। চুত… মাগি।’

বললাম,‘তুই বেটি বেশ্যা।  জামাইরে থইয়া আরেক বেটার লগে বাগিয়া ( ভেগে ) আইসত।  তুই বেশ্যা, তুই মাগি।’

‘বুয়াই ( বড়োবোন ) অতো বালা আসলা।  ই নটী কান ( কোথায় ) তাকি আইলো! বেশ্যা, নটী। বাগরি।’

বলুন, এই অবস্থায় কেউ কি নিজেকে সংযত করে ধরে রাখতে পারে?

না, পারে না।

আমিও পারলাম না।

ভীষণ বাজে একটা গালি উচ্চারণ করে মাটিতে একদলা থুতু নিক্ষেপ করে দ্রুত চিরদিনের জন্যই নিজ মাটি ত্যাগ করে এলাম।  হ্যাঁ, চিরদিনের জন্যেই তো।  মামাদের পক্ষ থেকে, বোনদের পক্ষ থেকে কম চেষ্টা-চরিত্র  করা হয়নি।  কিন্তু ওদের হিসেব  পাক্কা । থাক, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

বাড়ির কথা, ভাইবোনদের কথা বেশ মনে পড়ে।  জাহিদা আপার এই  বাসস্থান থেকে কিলোমিটার চারেক দূরে আমাদের বাড়ি হলেও একজন অবিবাহিতা মেয়ের পক্ষে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করা কী যে কষ্টের তা একমাত্র সমব্যথী ছাড়া উপলব্ধি করা কারুরই পক্ষে সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে বাড়ির জন্যে মনটা হাহাকার করে ওঠে, কাঁদে।  তখন নিজেকে প্রবোধ দিই।  বান্ধবী আফরিনের ভাষ্য নকল করে নিজেকে বলি,‘মেয়ে মানুষ তো পুরুষ শাসিত সমাজে যাযাবর। যাযাবরের মতো এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানা, তারপর আরেক ঠিকানা, এই তিন ঠিকানার ঘুর্ণাবর্তে নিয়তি তাকে নিয়ত বয়ে নিয়ে চলে। কেউ শান্তি পায়, কেউ কোনোদিনই শান্তি পায় না।’

অনেকটা পড়াশোনার জন্যেই তো বলা যায়  বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।  তাই পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ভর্তি হলাম। সহসাই ক্লাস শুরু হবে।

এখন আমি এই মুহূর্তে সিনথিয়া, সিনথিয়ার মা এবং মামা সম্পর্কে দুয়েক কথা বলতে চেষ্টা করব। সিনথিয়া আামর ছাত্রী।  এরকম আরও তিন-তিনটি ছাত্রী আছে আমার।  হাতখরচা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় মেটানোর নিমিত্তে প্রাইভেট টিউশনি আমাদের মতো মেয়েদের জন্যে বেঁচে থাকার একটি ভালো পন্থা। বোন এবং বোনের জামাইর ওপর তো পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না।  বিবেক বলে তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে।

আমার এই ছাত্রীদের মধ্যে সিনথিয়াকে একটু বেশি সময় আমি ইচ্ছে করেই দিই।  এর কারণ হলো দুটো।  প্রথমত, ওরা আমাকে প্রত্যাশার চেয়ে সম্মানী বেশি দেয়।  দ্বিতীয়ত, ওর মা এবং মামা আহমেদ ফয়েজ সাকলাইন খুবই আন্তরিক এবং বিবেচনা প্রসূত মানুষ।  সাকলাইন সম্পর্কে আরও একটি কথা আমার না বললেই নয়।  আমি আমার জীবনে সৌন্দর্য  এবং ব্যক্তিত্বের কম্বিনেশন এই সাকলাইন ছাড়া আর কারও মাঝে খুঁজে পাইনি।

ওর আর আমার প্রথম কথাবার্তা, বিশেষ করে আমার সঙ্গে ওর প্রথম কথাবার্তার ধরণ একটু খেয়াল করুন।  কী ভদ্র, কী জ্যান্টেলম্যান সে!

‘গুড মর্নিং মিস।’

‘গুড মর্নিং, স্যার।’

‘আজ কী জন্যে এসেছেন, মিস?’

‘কেন, সিনথিয়াকে পড়াতে এসেছি।’

‘ওরা তো আমাদের বাসা ঢাকায় গেছে। আজই সন্ধ্যের দিকে ফিরবে।’

‘তাহলে আমি যাই।’

‘যাবেন ? আচ্ছা, যান।’

‘কিছু কি বলবেন?’

‘ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন।  আনন্দ- ভালোবাসায় মেতে উঠুন।

তারপর, সত্যি কথা বলতে কী, আমার কী থেকে যে কী হয়ে গেল! ধীরে ধীরে মাস ছয়েকের মধ্যে আমি আর আমাতে থাকতে পারলাম না।  সাকলাইনে লীন হলাম।  সাকলাইনও একই কাজ করল।

মনে আছে, একবার ওর বুকে মাথা রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমার খুব ভয় হচ্ছে।  আমার আর তোমার মধ্যে যে পাহাড় সম  ব্যবধান, এইটি কি কেউ মেনে নেবে?

বলেছিল,‘মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজি।’

তখন দুজনে কী হাসাহাসি।  হাসতে হাসতে যেন চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল!

আমার স্পষ্ট মনে আছে।  মা একবার এরকম হাসাহাসি করতে দেখে আমাকে বলেছিলেন, ‘মাইগো, অতো বেশি আশিও না।  যে যত বেশি আশে, হে তত বেশি কান্দে।’

মা কি আমার ভবিষ্যৎ দেখে গিয়েছিলেন? কী জানি, মায়ের মন, মায়ের অন্তর্দৃষ্টি।

আজকাল আমার চারিদিকে ভীষণ বিদঘুটে অন্ধকার। নেই কোনো ভরসার জায়গা আমার।

সাকলাইন ফাঁকি দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। একটিবারও আমার কথা ভাবেনি। যোগাযোগও রাখেনি। আমি তো তার জন্যে অপেক্ষায় থাকতে পারতাম।

বোনও গতকাল আলটিমেটাম শুনিয়েছে। তাঁদের নাকি এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।  হ্যাঁ, তাঁরা তো হতদরিদ্র! দিন এনে দিন খাওয়া প্রান্তিক মানুষ! অবশ্য দুলাভাই আমার থাকায় বোনের  এই আলটিমেটাম আমি ধর্তেব্যের মধ্যেই আনি না।

বুঝে গেছি আমি, এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আমার জন্যে না। পৃথিবী আমারে চায় না।

আমার এই পরিণতির জন্যে আমিই দায়ী।

সাকলাইন আর মজা লুটে খাওয়া দুলাভাই কেবল উপলক্ষ মাত্র।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>