১.
সে অনেক দিন আগের কথা। বছর ত্রিশ তো হবেই। আমরা থাকতাম ময়মনসিংহ শহরের আমলাপাড়া এলাকায়, তখনও সেই শহরে কিছু বাংলো বাড়ি অবশিষ্ট ছিল, তাদের সামনে ছিল মাঠ, পেছনে বাগান, বড় আঙ্গিনা বা পুকুর। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সে বাড়িটা ছিল দোতলা, পুরনো জমিদার বাড়ি, সামনে প্রায় বিঘাখানেক ফাঁকা জমি। ঐ শহরে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটবাড়ির ধারণা তখনও আসেনি, কিন্তু আমাদের বাড়িতে তিনটে পরিবার ভাড়া থাকত। ওপরে একটি, নিচে দুটি। বাড়িওয়ালা এমনভাবে নিচের তলাটি ভাগ করে দিয়েছিলেন যাতে অন্য অংশটির ভাড়াটেদের দেখা না যায়। বাড়ির সামনে একদিকে একটা বড় আম গাছ, অন্যদিকে গাঁদা আর জবার ছোট বাগান। তারকানাথ রায় রোড থেকে শুরু করে ঘাসের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথটা একটা ছোট সিঁড়ির তিন চারটা ধাপ বেয়ে উঠে এসেছে নিচু বারান্দায়। সেই সিঁড়ির এক একপাশে তিনটে করে জমিদারি কায়দার স্তম্ভ, স্তম্ভের ওপরের চার কোনায় উদ্ভিদ ও ফুলের কারুকাজ। বারান্দাটা পেরিয়ে একটা বড় প্রশস্ত সিঁড়ি উঠে গিয়েছিল, সেটা একটা ল্যান্ডিং পৌঁছে পুরো ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দোতলায়, তারপর আবার একেবারে তেতলার ছাদে। বাড়ির পেছনে একটা ছোট আঙিনা, লিচু, নিম, কাঁঠাল এরকম কিছু গাছ ছিল। গ্রীষ্মের সবচেয়ে তপ্ত দিনেও ঘন ছায়া ঘেরা থাকত সেই আঙিনা। বাইরের মাঠে খেলতাম ব্যাডমিনটন, ভেতরের আঙিনায় লুকোচুরি।
বারান্দায় উঠে ডানদিকে গেলে বাঁদিকে পড়বে আমাদের বাসা। আমার নাম অমল। আমি যে দুবছরের কথা বলছি তখন আমার বয়স নয়/দশ হবে। পড়তাম মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে, ক্লাস ফ্লাইভ আর পরে সিক্সে। আর আমার বড় ভাই বিমলদাদা পড়ত আনন্দমোহন কলেজে। সে তখন লায়েক, বাসায়ই থাকত না বেশীরভাগ সময়। আর আমাদের সবচেয়ে যে বড়, সে হল কমলাদিদি, সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, রোকেয়া হলে থাকত। এছাড়া বাসায় আমার মা ও বাবা। বাবা তখন জেলা আদালতে ওকালতি করতেন আর মা বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াতেন। দেশভাগ হলে আমাদের মাসী-পিসী কাকা-মামা গুষ্ঠিশুদ্ধ কলকাতা চলে গিয়েছিল। আমার মাতামহ ও পিতামহ রয়ে গিয়েছিলেন, নিজের দেশে নতুনভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে তাদের বেগ পেতে হয়েছিল। দেশের নানান টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁদের সন্তানরা যে যেমনভাবে পারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল।
আমাদের ওপরে, পুরো তলাটা নিয়ে থাকতেন রোকেয়া খালা আর তার মেয়ে সালমা আপা। ওঁদের সঙ্গে থাকতেন ওনাদের রান্না-বান্না আর বাজার করে দেবার একজন, তাঁকে ওনারা ডাকতেন উনিপা আর ওনাদের দেখাদেখি আমরাও ডাকতাম উনিপা। এই নামে কেন ডাকা হত সেটা আমার জানা হয় নি, তবে এতদিন পরে মনে হচ্ছে সেটা উনি এবং আপা কথাদুটির একটি সমন্বয়। রোকেয়া খালা আর সালমা আপা দুজনেই খুব স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। এমনই তাঁদের ব্যক্তিত্ব ছিল যে পাড়ার লোক তাঁদের ঘাঁটাতে সাহস পেত না। আমি তো তখন অত বুঝতাম না, কিন্তু এতদিন পরে বুঝি ঐ সময়ে সেটা কত ব্যতিক্রমী ব্যাপার ছিল।
নিচের তলার অপর অংশে থাকতেন আবদুল্লাহ সাহেব। বারান্দায় উঠে বাঁদিকে গেলেই ডানদিকে পড়ত তাঁর ঘরে ঢোকার দরজা। একাই থাকতেন, মাঝে মধ্যে কেউ এসে রান্না বা ঘর ঝাঁট দিয়ে যেত। ওনার কত বয়স হবে সেই নিয়ে তখন বেশী ভাবি নি, এখন এই কাহিনী লিখতে গেলে পাঠককে একটা ধারণা দিতে হবে, আমি বলব ত্রিশ থেকে চল্লিশ এরকম একটা পরিসরে ছিল তার বয়স। আবদুল্লাহ সাহেব কি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন সেটা আমি অনেকদিন জানতাম না। ওনাকে কোনোদিন ভাই, চাচা, আঙ্কেল এসব বলে ডাকি নি। ওনার মাথায় টাক ছিল। আবদুল্লাহ সাহেব বোধহয় ছ’ফুটের ওপর লম্বা ছিলেন। হয়তো ছ’ফুট নয়, কিন্তু ঐ সময়ে তাঁকে মনে হত মহীরুহ। তবে আসল ব্যাপার হল আমি আবদুল্লাহ সাহেবকে খুব ভয় করতাম। সহজে ওনার মুখোমুখি হতে চাইতাম না। আমাদের বাসার মূল দরজা দিয়ে বের হলেই বারান্দা, আবদুল্লাহ সাহেবকে বের হতে হলেও সেই বারান্দা দিয়েই বের হতে হত। আমি দরজা খুলে আগে উঁকি দিয়ে দেখতাম উনি বারান্দায় বের হচ্ছেন কিনা। স্কুল থেকে ফেরার সময় দূর থেকে দেখে নিতাম উনি ঘরের বাইরে আছেন কিনা। যতক্ষণ না চোখের বাইরে যেতেন ততক্ষণ আড়ালে থাকতাম। এই যে ভয় এর পেছনে কি কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল? বোধহয় না। উনি আমাকে কোনোদিন বকা-ঝকা করেন নি, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতেও তাকান নি। ছোটবেলায় নানা ধরনের ভয় ও কৌতূহল মিলে এরকম অযৌক্তিক আচরণ অনেক শিশু-কিশোরের মধ্যে গড়ে ওঠে। আমারও এরকম ছিল, কিন্তু এইসব শিশুতোষ খেয়ালীপনার আর একটি কারণ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল একটি নির্দোষ রসিকতা, সেটা নিয়ে পরে লিখছি।
আবদুল্লাহ সাহেবকে আমি যতখানি এড়িয়ে চলতাম সালমা আপাদের আমি ততখানিই ভক্ত ছিলাম। সালমা আপা আর রোকেয়া খালাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওনারা খুব সুন্দর করে কথা বলতেন, এমনভাবে কথা বলতে আমি কাউকে শুনিনি। ওনাদের উচ্চারণে একটা টান ছিল, মা বলতেন ওনারা হয়তো দেশভাগের পরে কলকাতা থেকে এসেছেন, কিন্তু রোকেয়া খালারা কোনোদিন তাঁদের পুরনো ইতিহাস নিয়ে একটি কথাও বলেন নি, এমন যেন তাঁরা অতীতটাকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছেন। তবে পুরোপুরি বিসর্জন যে দিতে পারেন নি সেটা তাঁদের বইয়ের সংগ্রহ দেখলে বোঝা যেত। একটা ঘর পুরো বইয়ের তাক দিয়ে ভর্তি ছিল। বাংলা আর ইংরেজী বই তো ছিলই, ছিল আরো অনেক ভাষার। আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘এটা কোন ভাষা?’ সালমা আপা বলতেন, ‘গ্রীক।’ জিজ্ঞেস করতাম, ‘গ্রীক তুমি পার?’ উনি বলতেন, ‘দূর, ওসব আমি জানি নাকি। এগুলো সব আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।’ উত্তরাধিকার সূত্র মানে কি আমি জানতাম না। একটা বই দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘এটা কি আরবী ভাষা?’ সালমা আপা বললেন, ‘না, এটা ফারসী।’ ‘ফারসী তুমি জান?’ ‘না রে,’ উত্তর দিলেন সালমা আপা। বইটার পাতা উল্টে দেখি হাতে আঁকা পুরনো দিনের সব মিনার, সৌধ, দেয়াল। বইটির প্রচ্ছদে শিরোনামটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি লেখা আছে। সালমা আপা উত্তর দিলেন, ‘প্রাচীন পারস্যের স্মৃতিস্তম্ভসমূহ।’ আমি বললাম, ‘এই যে বললে ফারসী তুমি জান না।’ আপা হেসে ফেললেন, ‘আরে পাগল, আমাদের লাইব্রেরির বইয়ের নাম জানব না তা কি হয়!’ হাসলে সালমা আপার গালে টোল পড়ত, রোকেয়া খালারও তাই।
আমি খুব বই-পড়ুয়া ছিলাম। সালমা আপাদের লাইব্রেরিতেই দিনের পর দিন কাটাতাম। বইয়ের তাকগুলোর পাশে সুন্দর আরামদায়ক চেয়ার আর সোফা ছিল বসার। অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে জুল ভার্ন পড়তাম – সাগরতলে কুড়ি হাজার লীগ, পৃথিবীকেন্দ্রে ভ্রমণ, রহস্যময় দ্বীপ, মেঘকাটা কাঁচি, উত্তর মেরু ক্রয়। এসব পড়ে সারাদিন স্বপ্ন দেখতাম হয় সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন চালাচ্ছি, নয় বেলুনে চড়ে শত্রুর গুলি এড়াচ্ছি। সালমা আপা, মাঝে মধ্যে রোকেয়া খালা, এমন কি উনিপা এসেও বই নিয়ে পড়তেন। উনিপা যে বাড়ির সাধারণ ঝি নন সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম, উনি এক টেবিলেই সালমা আপাদের সঙ্গে খেতেন। উনিপা আমার সামনে শুধু বাংলা বই নিয়ে পড়তেন, কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হত উনি ইংরেজী এবং অন্য আরো কোন ভাষা জানতেন। উনিপার যে জিনিসটা আমার মজার লাগত সেটা হল উনি অনেক সময় দুটো হাতকে একই সময়ে সামনে পেছনে করতে করতে হাঁটতেন, সেটার মধ্যে যেন একটা আভিজাত্য ছিল।
ওনাদের বয়স কত হতে পারে? সালমা আপার কথাই বলি, আমার থেকে অনেক বড় ছিলেন তিনি। বাইশের ওপর তো বটেই, কারণ সালমা আপা বলতেন তিনি ঢাকায় ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, কিন্তু সেখানে নাকি সেরকম কিছু শেখান হয় না, তো ময়মনসিংহে মা’র কাছে ফিরে এসেছেন। সালমা আপার বাবা আদৌ কোথাও ছিলেন কিনা (অর্থাৎ জীবিত ছিলেন কিনা) সেটা কোনোদিন আমার জানা হয় নি। চুলটাকে উনি কাঁধ পর্যন্ত রাখতেন। শাড়ি, সালোয়ার, প্যান্ট, স্কার্ট সবই পড়তেন। মাঝে মধ্যে, অন্য কোনো লোক না থাকলে, শীতের সন্ধ্যায় নিচে নেমে আমাদের সাথে ব্যাডমিনটন খেলতেন। ব্যাডমিনটনে বিমলদাদা ছিল চ্যাম্পিয়ন, কিন্তু আমার মনে হত সালমা আপা ইচ্ছা করে তার কাছে হারতেন।
একবার চন্দ্রগ্রহণ হল, আমার দিদি কমলাও ছিল ছুটিতে বাসায়। আমরা সবাই মিলে ছাদে গ্রহণ দেখতে উঠলাম। কমলাদিদি, বিমলদাদা, মা, বাবা, সালমা আপা, রোকেয়া খালা । গ্রহণের একটু আগে পূব দিকে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল, তখনও ঐ পাড়া থেকে আকাশের অনেকটাই দেখা যেত। সালমা আপা একটা ক্যামেরা স্ট্যান্ডের ওপর বসিয়ে চাঁদের ছবি তুলছিলেন। আকাশের সূর্যের শেষ আলোটা মিলিয়ে গেলে ভরা জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল আমাদের ছাদ। সালমা আপা বললেন, ‘পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়ে গ্রহণের সময়।’ আমি বলেছিলাম, ‘পৃথিবীর আবার ছায়া হবে কেমন করে। পৃথিবী তো এত্তো বড়!’ সালমা আপা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দিনের বেলা বাইরে তোমার ছায়া যে তৈরি করে, পৃথিবীর ছায়া সেই-ই বানায়।’ আমি চোখ বড় বড় করে বলেছিলাম, ‘সূর্য?’ ‘হ্যাঁ, সূর্যই’, হেসে বলেছিলেন সালমা আপা। চাঁদ পৃথিবীর উপচ্ছায়ায় ঢোকার সময় উনিপাও উঠে এসেছিলেন। পূর্ণ গ্রহণের চাঁদ এক অদ্ভূত অপার্থিব লাল আলোয় আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছিল। সালমা আপার বাইনোকুলারে চোখ রেখে চাঁদে পৃথিবীর ছায়াকে দেখলাম, সালমা আপা বললেন, ‘চাঁদের ডানদিকে যে বড় বড় কালো গোল অংশ দেখছ সেগুলোর নাম হল মারে ক্রিজিয়াম, মারে সেরেনেটাটিস, মারে ট্রানকুইলোটাটিস। সব লাটিন নাম। মারে ট্রানকুইলোটাটিস মানে হল প্রশান্তির সাগর, ওখানেই মানুষ ১৯৬৯ সনে প্রথম চাঁদে নামে।’ কমলাদিদি বলল, ‘চাঁদে আবার সাগর কি?’ সালমা আপা হেসে বললেন, ‘পুরনো সময়ে মানুষ ভাবত চাঁদের বুকে ওগুলো হল বড় বড় জলাশয়। আসলে ওগুলো চাঁদে চার শ কোটি বছর আগের আগ্নেয়গিরির কালো বাসাল্টের মসৃণ প্রবাহ।’ সালমা আপার ব্যাখ্যা আমাদের সবাইকে যেন কোটি কোটি বছর পেছনে নিয়ে গেল। তারপর বাবাই মৌনতা ভাঙলেন, বললেন, ‘আবদুল্লাহ সাহেব কোথায়? এই অমল, ওনাকে একটু ডেকে নিয়ে আয়, চাঁদের গ্রহণ তো আর প্রতি সপ্তাহে হয় না।’ আমি বিমলদাদাকে বললাম, ‘দাদা তুই যা।’ বিমলদাদা আপত্তি করল না। আমার দিকে একটু আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে নিচে গেল, একটু পরে আবদুল্লাহ সাহেবকে নিয়ে ওপরে উঠে এল।
এবার বলি আবদুল্লাহ সাহেবকে কেন আমি ভয় করতাম। সালমা আপা আমাকে আকাশ চিনিয়েছিলেন – লুব্ধক, রোহিণী, অভিজিৎ, স্বাতী তারাদের। বাইনোকুলার দিয়ে দেখিয়েছিলেন কালপুরুষের নিহারীকা। বলতেন, ‘কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে আমাদের গ্যালাক্সি, তার মধ্যে আমাদের মত উন্নত সভ্যতা কি আর পাওয়া যাবে না?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সেরকম সভ্যতা থাকলে তাদের মানুষেরা কেমন দেখতে হবে?’ সালমা আপা ঠোঁট উলটে বলেছিলেন, ‘কে জানে, হয়তো বিশাল চোখ হবে, বিশাল মাথা হবে, লিকলিকে হাত, বেঁটে খাটো চেহারা।’ তারপর হেসে যোগ করেছিলেন, ‘তবে তারা আমাদের মতও হতে পার। ধর আমাদের প্রতিবেশী আবদুল্লাহ সাহেব। উনিও এক্জন এলিয়েন, গ্রহান্তরের মানুষ হতে পারেন।’ ‘সত্যি?’ আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ‘হুঁ,’ বলেছিলেন সালমা আপা, ‘ওরকম চেহারার মানুষ আর একটা এই শহরে বার কর দেখি।’
সালাম আপার কথাটা ঠাট্টা হলেও আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমি ধীরে ধীরে আবদুল্লাহ সাহেবের মধ্যে এলিয়েন জাতীয় বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে থাকলাম। প্রথমতঃ তার দৈর্ঘ, অমন লম্বা মানুষ ময়মনসিংহ শহরে দুটি ছিল না। তারপর তার দুটো হাত – লিকলিকে লম্বা যেন সজনের ডাটা। মাথার সামনের দিকে টাক, কিন্তু পেছনে লম্বা চুল সেটা মিশেছে কানের দুপাশ দিয়ে বড় জুলফিতে। অবিশ্বাস্য লম্বা তীক্ষ্ণ নাক যেন রেডিওর অ্যানটেনা। বিশাল বড় বড় কান, ‘কুলার মত কান’ বললে ভূতের কথা মনে হয় তাই বললাম না। আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল ঐ কান আর নাক দিয়ে উনি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা মহাকাশযানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। অনেক রাতেই দেখতাম বাড়ির পেছনে যে ছোট আঙ্গিনাটা আছে সেখানে উনি পায়চারি করছেন। এক বেশ রাতে বাইরের বারান্দায় শব্দ শুনে বেরিয়ে দেখি একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে খিলানের নিচে একটা স্তম্ভের ওপর কি যেন খুঁজছেন। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে একটা দেঁতো হাসি দিয়ে টুলটা হাতে করে ঘরে ঢুকে পড়লেন। মাঝে মধ্যেই ওনার ঘর থেকে রেডিওর গান, তারপর স্ট্যাটিক ঝঝঝঝ ধরনের শব্দ শোনা যেত। আর এক রাতেও এরকম, বাইরে শব্দ শুনে বারান্দায় বের হলাম, দেখি ওনার ঘরে আলো জ্বলছে। পা টিপে টিপে ওনার ঘরের জানালার নিচে হামাগুড়ি দিয়ে বসলাম। ভেতর থেকে উঁয়া উঁয়া এরকম একটা শব্দ আসছিল। মাথা উঁচু করে জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখি উনি একটা বড় রেডিওর মত যন্ত্রের সামনে বসে আছেন আর একটা নাসারন্ধ্র আঙুল দিয়ে মাঝে মাঝে টিপছেন, তাতে উঁয়া উঁয়া শব্দ বের হচ্ছে। আমি জানতাম মোর্স কোড নামে এক ধরণের সাংকেতিক পদ্ধতিতে টেলিগ্রাফের সংবাদ আদান প্রদান হয়। আমার নিশ্চিত ধারণ হল আবদুল্লাহ সাহেব অন্য নক্ষত্রের সভ্যতার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করছেন।
পরদিন এই কথাটা সালমা আপাকে বলায় তিনি তো হেসেই কুটিপাটি। উনি রোকেয়া খালাকে ডেকে বললেন, ‘আম্মু, দেখ আমাদের ক্যাপ্টেন নিমোর কাণ্ড। আবদুল্লাহ সাহেবকে সে মোর্স কোডে উঁয়া উঁয়া শব্দে খবর পাঠাতে দেখেছে মহাশূন্যে।’ এই বলে সালমা আপা নিজের নাক চেপে উঁয়া উঁয়া করতে থাকলেন। রোকেয়া খালা হাসতে হাসতে বললেন, ‘নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ব্যাপার, উনি বোধহয় প্রাণায়ম করছিলেন।’ উনিপাও মনে হল মুখ চেপে হাসছেন। সালমা আপা বললেন, ‘আরে পাগল, আবদুল্লাহ সাহেব যদি এলিয়েনও হয় তবে কি উনি পৃথিবীর মানুষের মোর্স কোড ব্যবহার করবেন?’ আমি বললাম, ‘মোর্স না হোক, অন্য কোড ব্যবহার করতে পারেন।’ আমি সালমা আপার ওপর রাগ করলাম, উনিই তো আবদুল্লাহ সাহেব যে এলিয়েন হতে পারে সেই ধারণা দিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা করলাম তাঁর সঙ্গে আর কথা বলব না, তবে একদিনের বেশী সেই প্রতিজ্ঞা রাখা সম্ভব হয় নি।
মা কপট অভিমানে আমার সামনে রোকেয়া খালা আর সালমা আপাকে প্রায়শঃই বলতেন, ‘আমার ছেলেটাকে তো তোমরা নিয়েই নিলে।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর জামা-কাপড় বইপত্র কি ওপর তলায় তুলে দেব?’ তারপর আমি ছাড়া ওরা সবাই হাসত, আমিই বুঝে উঠতাম না মা ঠাট্টা করছেন কিনা।
একবার আমরা পাঁচজনে মিলে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বেড়াতে গেছি। আমি, বিমলদাদা, কমলাদিদি, সালমা আপা, রোকেয়া খালা। শীতের সময়, নিচে জল বেশী নেই, মাঝে মধ্যেই ভিজে বালি রোদে চিকচিক করছে। আমরা নদীতে নেমে চরের ওপর দৌড়ো-দৌড়ি করলাম। সালমা আপা চিৎকার করতে থাকলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ এমনই গলা ফাটিয়ে আবৃত্তি করছিলেন যে রোকেয়া খালা তাঁকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন। এর মধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে এল। সালমা আপা বললেন, ‘তোমরা কে কে পৃথিবীর ছায়া দেখেছ।’ আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘আমি দেখেছি চন্দ্রগ্রহণের সময়।’ সালমা আপা হেসে বললেন, ‘সূর্য ডোবার পাঁচ দশ মিনিট পরে পূর্ব দিগন্তে চেয়ে দেখবে একটা গাঢ় ধূসর নীলচে রঙ দিগন্তে, তার ওপরেই একটা লাল কমলা আভা। ঐ নিচের গাঢ় রঙটা হল বায়ুমণ্ডলে পৃথিবীর ছায়া। সূর্য পৃথিবীর ছায়া ফেলছে বায়ুমণ্ডলে।’ সূর্য ডোবার পর সালমা আপা আমাদের পৃথিবীর ছায়া চিনিয়ে দিলেন। কি বিস্ময়! আশ্চর্য হয়ে কমলাদিদি ডান হাতটা মুখের ওপর চেপে বলল, ‘বাহ, কি সুন্দর। কত কিছুই না জানছি তোমার কাছে, সালমা আপা।’ রোকেয়া খালা এসব শুনে খালি হাসেন, মেয়ের প্রশংসায় নিশ্চয় ওনার গর্ব হত, কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দিতেন না। অন্ধকার হয়ে এল, আমরা চিনাবাদাম খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে একটা ছোট আলোর বিন্দু পশ্চিম থেকে খুব ধীর গতিতে পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। সালমা আপা বললেন, ‘উপগ্রহ, কৃত্রিম উপগ্রহ, স্যাটেলাইট। হয় মার্কিন নয় সোভিয়েত।’ আমি সাথে সাথেই ভাবলাম হয়তো আবদুল্লাহ সাহেব এরকম উপগ্রহের সঙ্গেই যোগাযোগ করছিলেন। ওনার গ্রহের মানুষেরা এরকম একটা উপগ্রহে চেপে হয়তো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। তারপর ভাবলাম সেই উপগ্রহকে তো অদৃশ্য হতে হবে, তাকে চোখে দেখা যাবে না, বেতার তরঙ্গ দিয়েও পর্যবেক্ষণ করা যাবে না।
২.
এমনি করে বছর দুই কাটল। আমি ক্লাস সিক্সে তখন। বছরের শেষ দিক। ফাইনাল পরীক্ষা আর দু-এক সপ্তাহের মধ্যে। বিকেল বেলায় পড়ায় মন বসছে না, সালমা আপা নিচে নেমে বলে গেলেন আমি যদি এক ঘন্টা পড়ি তো আমরা সবাই মিলে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বেড়াতে যেতে পারি, আমাকে আইসক্রিম কিনে দেবেন। আমি টেবিলে বই রেখে পড়ছি, জানালা দিয়ে বাড়ির বাইরে দিকের মাঠটা দেখা যায়। এসময় দূরে একটা হট্টগোল শোনা গেল। শোরগোলটা ক্রমেই এগিয়ে এল। তারপর দেখি আবদুল্লাহ সাহেব উদভ্রান্তর মত দৌড়ে বাড়ির মাঠটায় ঢুকছেন। তার পেছনে অন্ততঃ পনেরোটি ছেলে, কুড়িটিও হতে পারে। তাদের কারু কারু হাতে লাঠি। আমি দৌড়ে বারান্দায় বের হয়ে আসি, কিন্তু আবদুল্লাহ সাহেব আমাকে চিৎকার করে বলেন, ‘অমল ভেতরে যাও।’ আমি বুঝে পাই না কি করব। আবদুল্লাহ সাহেব লাফ দিয়ে বারান্দায় ওঠেন, আমার ঘরের দরজা বেশ কিছুটা দূরে। উনি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দেন, আবার চিৎকার করে ওঠেন, ‘পালাও।’ আমি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠি, পেছনে ছেলেগুলোর গালিগালাজ শুনি। ওরা বলে, ‘ধর ধর ব্যাটাকে।’ আমাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিয়ে আবদুল্লাহ সাহেব বোধহয় তার ঘরের দিকে যাবার চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যে আমি লাফ দিতে দিতে সিঁড়ির ধাপ পার হতে চাই। তখনই দেখি সিঁড়ির ওপরের ল্যান্ডিংএ উনিপা দাঁড়িয়ে। বারান্দায় দু-একটা ঢিলের শব্দ পেলাম। আমি ওপরে উনিপার দিকে তাকালাম। এরপরে উনিপা যেটা করলেন সেটা আমি জীবনেও ভুলব না। উনিপা তাঁর ডান হাতটা ওপরে তুললেন, টানটান সবকটা আঙুল যেন অভয় মুদ্রা। যেন আমাকে অভয় দিচ্ছেন। আমার মনে হল ওনার কথা যেন শুনতে পাচ্ছি, বলছেন, ‘ভয় পেও না অমল। ওপরে সাবধানে উঠে এসো, তাড়াহুড়ো করো না, হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পার।’ কিন্তু ওনার মুখ বন্ধ ছিল। ঠোঁট নড়ছিল না। অথচ আমার মনে ওনার কন্ঠ স্পষ্ট ছিল। আমি শেষ দুটো ধাপ লাফ দিয়ে পাড় হয়ে ওনার পাশে দাঁড়ালাম। নিচে তাকিয়ে দেখি প্রথম একটি ছেলে বারান্দায় পা রাখছে। এবার দেখলাম উনিপা ওনার ডান হাত দিয়ে এমন একটা ভঙ্গী করলেন যেন শূন্যে একটা অর্ধচক্র আঁকলেন। সেই মুহূর্তে বারান্দায় বাতাসের সোঁসোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। মূহুর্তে যে ছেলেটা বারান্দায় উঠছিল সে যেন কিসে একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পর পর সবকটা ছেলে যারা বারান্দায় লাফ দিয়ে উঠতে চাইছিল তারা যেন একটা অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে যে ঢিল আর ইঁটের টুকরো উড়ে আসছিল সেগুলোও আর বারান্দা পর্যন্ত আসতে পারছিল না। আমি অবাক হয়ে উনিপার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে চেয়ে একটা স্মিত হাসি হাসলেন। সেই হাসিতে ওনার গালে একটা টোল পড়ল।
নিচে তাকিয়ে দেখি আবদুল্লাহ সাহেব হাত বাড়িয়ে সেই অদৃশ্য দেয়াল ধরবার চেষ্টা করছেন, উনি এই ঘটনায় আমার থেকে কম আশ্চর্য হন নি। দেয়ালের ঐপাড়ে দশ-বারোটা ছেলে মাটিতে পড়ে আছে, বেশী কিছু হয় নি, হাত পা একটু ছড়েছে। আমি নিচে নেমে এলাম। আবদুল্লাহ সাহেবের মত আমিও হাত বাড়িয়ে দেয়ালটা ধরার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় আমার হাতটা সরে এল। আমি বুঝলাম একটা অদৃশ্য দেয়ালের দুপাশে বায়ুর ঘূর্ণী সৃষ্টি করা হয়েছে। ওপাশের ছেলেগুলো আতঙ্কিত চোখে আমাদের দিকে চেয়েছিল, যারা মাটিতে পড়েছিল, তারা উঠে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। এর মধ্যেই একজন, মনে হল পালের গোদা, পেছন থেকে দৌড়ে এসে আমাদের দিকে ডান পাটা কুং ফুর মত উঁচু করে লাফ দিল, কিন্তু বাতাসের দেয়াল তাকে পুরোপুরি উল্টে ধরাশায়ী করে দিল। সে যখন মাটি থেকে উঠল তার ধুলোমাখা অন্ধকার মুখ দেখে বুঝলাম তার দলের কাছে সে সব মান সম্মান খুইয়েছে। ছেলেগুলো বেশ ভয় পেয়েছিল, তারা প্রায় দৌড়ে বাড়ির মাঠটা থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে বাতাসের ঝড়টাও বন্ধ হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে এক মিনিটের বেশী লাগল না। সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি উনিপা কখন চলে গেছেন।
আবদুল্লাহ সাহেব হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। মা বাসায় ছিলেন, উনি বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত হই চৈ কিসের রে।’ আবদুল্লাহ সাহেব বললেন, ‘অনেক ঘটনা, বৌদি, আপনি এখন অমলকে বাসার ভেতর নিয়ে যান, আমি সন্ধ্যেবেলা এসে সব বলব।’
আমি আশ্চর্য হয়ে আবদুল্লাহ সাহেবকে দেখলাম। মাকে উনি এর আগে সম্বোধন করেছেন কিনা মনে পড়ল না। মাকে ‘বৌদি’ বলাতে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম। একদল কলেজ ছাত্রর কাছে তাঁর অসহায়ত্ব প্রমাণ করেছিল যে উনি এলিয়েন না, কিন্তু আমার মাকে ‘বৌদি’ ডাকার মধ্যে দিয়ে তাঁর পৃথিবীর নাগরিকত্ব যেন পূর্ণ্যোদমে প্রতিষ্ঠিত হল। সেই বিকেলে আমার আর ব্রহ্মপুত্র পাড়ে যাওয়া হল না। মাকে পুরো ঘটনাটা ঠিকমত বলতে পারছিলাম না, আমি খুব শক পেয়েছিলাম। মা আমাকে এক গ্লাশ লেবু-চিনির শরবত করে দিলেন, বললেন এখন শুয়ে থাক, আবদুল্লাহ সাহেব পুলিশকে খবর দিতে গেছে। আমি শুয়ে থেকে শান্তি পেলাম না, মিনিট দশক পরেই পা টিপেটিপে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে শুনতে চাইলাম সালমা আপাদের বাসা থেকে কোনো শব্দ আসছে কিনা। কোনো শব্দ নেই, আস্তে করে দরজার কড়া নাড়লাম। কেউ উত্তর দিল না। ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। কি করলেন উনিপা তাঁর হাত দিয়ে? এমন অলৌকিক ঘটনা। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়লাম বলাটা ঠিক হবে না, অনেকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। সেরকম একটা আধোঘুম অবস্থায় যেন শুনতে পেলাম আবদুল্লাহ সাহেব বাইরের ঘরে এসেছেন, বাবা কোর্ট থেকে ফিরে এসেছেন। আবদুল্লাহ সাহেব বাবাকে বলছেন, ‘হ্যাঁ, ওরা প্রতি মাসে চাঁদা নিতে আসে। আগে দু শ টাকা করে নিত, এবার এসে বলে পাঁচ শ লাগবে। আমি যখন বললাম মগের মুল্লুক নাকি, ওরা সাথে সাথে একটা লাথি মেরে শেলফের কাচ ভেঙ্গে দিল। আমি হয়ত শেষাবধি টাকাটা দিতাম, কিন্তু ঐ একটা কথার পরিণাম যে এরকম ভয়ঙ্কর হবে তা ভাবি নি।’ বাবা বলছেন শুনলাম, ‘দঙ্গলে মানুষ মানুষ থাকে না।’ আবদুল্লাহ সাহেব বললেন, ‘আমি তো বুঝতেই পারি নি এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে। ওরা তো শেলফের পর শেলফ ভাঙতেই থাকল। ওষুধের ফাইল আর শিশি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছে। আমার কর্মচারী স্বপন আমাকে হাত ধরে দোকান থেকে রাস্তায় নিয়ে এসে বলল আপনি বাসায় যান, আমি দেখি ওদের শান্ত করতে পারি কিনা। কিন্তু ওরা দোকানের মালিককে ঠিকই চেনে। স্বপনকে কোনো পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল। প্রথমে তো মাত্র চার-পাঁচজন ছিল, সেটা কেমন করে অতবড় দলে পরিণত হল বুঝতেই পারলাম না।’ তারপর বাবাকে বলতে শুনলাম, ‘কিন্তু ওরা বাড়িতে ঢুকতে পারল না কেন?’ আবদুল্লাহ সাহেব বাবাকে নিচু স্বরে কি যেন বলা আরম্ভ করলেন, আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কয়েক মিনিট মাত্র, তারপর ঘুম ভাঙলে শুনলাম বাবা জিজ্ঞেস করছেন, ‘পুলিশ আপনাকে কি বলল?’ ‘পুলিশ আমার ডায়রি নিল, কিন্তু বলল কাল সকালের আগে আসতে পারবে না।’
সন্ধ্যায় নাকি বিমলদাদা সব ঘটনা শুনে আবার বের হয়ে গিয়েছিল। মা যেতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু সে মানে নি। তার কিছু ছাত্রনেতা পরিচিত ছিল। সে অনেক রাতে ফিরে বলল আনন্দমোহন আর আখতারুজ্জামান কলেজের ছাত্র ছাড়াও অছাত্র বেশ কিছু যুবক এই ঘটনায় জড়িত ছিল। তবে সে কয়েকজন নেতা – যারা বাবাকে অন্ততঃ নামে চেনে – তাদের অনুরোধ করে এসেছে যেন আমাদের বাড়িতে আর হামলা না হয়। রাতে আমরা দরজা ভাল করে বন্ধ করে শুলাম। কিন্তু আমার কান পড়ে রইল দোতলায়, সালমা আপাদের পায়ের সামান্য শব্দ শোনার জন্য। সারা রাত প্রায় ঘুমই হল না (সন্ধ্যে থেকেই তো শুয়েছিলাম)। কাক-ডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে গুটি গুটি করে ওপরে গেলাম। দরজা খোলাই ছিল, কিন্তু ভেতরে কেউ ছিল না। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকলাম, ‘সালমা আপা, রোকেয়া খালা।’ তারপর যোগ করলাম, ‘উনিপা।’ কিন্তু ডিসেম্বরের শীতের সেই ভোরে আমলাপাড়ার হলুদ বাড়িটার দোতলা খালি ছিল। দৌড়ে পেছনে শোবার ঘরে গেলাম, সেখানে একটা জানালা দিয়ে পেছনের ছোট বাগানটা দেখা যায়। কেউ নেই। তারপর ছাদে গেলাম। সূর্য সবে উঠছে, অল্প ঠাণ্ডা, দুতিনটে দড়ি ঝোলানো কাপড় শুকানোর জন্য। শ্যাওলা জমা একপাশে, তার ওপর জলের ট্যাঙ্ক। ছাদেও কেউ ছিল না। আবার ফিরে এলাম দোতলায়, এবার গেলাম লাইব্রেরিতে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সেখানে একটি বইও নেই। শুধু মাঝখানের টেবিলে দুটো বেশ বড় বাঁধানো বই পড়ে আছে, তার ওপর একটা খাম।
নিচে নেমে মাকে ঘুম থেকে উঠালাম। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘সালমা আপারা চলে গেছেন।’ এক রাতের মধ্যে সবার ঘুম না ভাঙিয়ে কেমন করে সালমা আপারা অদৃশ্য হয়ে গেলেন? আবদুল্লাহ সাহেব এলেন, বাবার সঙ্গে খুব নিচুস্বরে অনেকক্ষণ কথা বললেন। সকাল দশটার দিকে পুলিশ এল, সালমা আপাদের জন্য নয়, গতকাল বিকেলে কলেজ ছাত্রদের আক্রমণের ব্যাপারে। আবদুল্লাহ সাহেব বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন, দেখলাম উনি বাতাসের দেয়ালের কথা উল্লেখই করলেন না। বরং বললেন বারান্দায় উঠতে গিয়ে ওদের দু-একজন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, এটাতে কোনো কারণে তারা ভয় পেয়ে যায়। উনিপার উল্লেখই করলেন না। বাবাও দেখলাম সালমা আপাদের নিরুদ্দেশ হবার কথা পুলিশের কাছে ভাঙলেন না। আমার কাছে বড়দের এসব ব্যাপার খুব রহস্যজনক ঠেকেছিল। পরে শুনলাম রোকেয়া খালা আবদুল্লাহ সাহেব ও বাবাকে চিঠি লিখে গেছেন, সেখানে অনুরোধ করেছিলেন তাঁদের নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে যেন পুলিশকে কিছু না বলা হয়। আবদুল্লাহ সাহেব তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য সরাসরি উনিপার কাছে এবং পরোক্ষভাবে সালমা আপা ও রোকেয়া খালার কাছে ঋণী ছিলেন। তিনি এবং বাবা সিদ্ধান্ত নেন পুলিশের কাছে সালমা আপাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলবেন না। কিন্তু আবদুল্লাহ সাহেব কিভাবে বাবাকে উনিপার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছিলেন সেটা আমার বোধগম্য হয় নি। আর বাবা ও মাকে আমি যতবার উনিপার অভয় বাণী, উনিপার হাতের মুদ্রা, চক্রাকারে হাত ঘোরানো, বাতাসের ঘূর্ণীর কথা বলতে গিয়েছি ওনারা মনোযোগের সঙ্গে শুনে হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
আমলাপাড়ার সেই বাড়িতে আমাদের আর বেশীদিন থাকা হল না। ঐ ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে আবদুল্লাহ সাহেব এক সকালবেলা একটা বড় কাতলা মাছ আর দু বাক্স মিষ্টি এনে মাকে দিয়ে বললেন, ‘বৌদি, আমি কাল চলে যাচ্ছি। আজ রাতে আমি আপনাদের খাওয়াই আপনার রান্না দিয়েই।’ বাবা বললেন, ‘কি ব্যাপার?’ আবদুল্লাহ সাহেব বললেন, ‘শহরময় গুজব আমাদের বাড়ি নিয়ে। আসলে মূলতঃ আমাকে নিয়েই। আমি নাকি ওঝার মত কাজ কারবার করি, আর এই বাড়িটা ভূতুড়ে বাড়ি। আমার পক্ষে নতুন বাজারে আবার দোকানটা খোলা সম্ভব হবে না। ঐ ছেলেগুলো ওঁত পেতে বসে আছে। এখানে আমার আর থাকা হল না, আপাততঃ ঢাকায় আমার বোনের ওখানে যাচ্ছি। দেখা যাক কি করা যায়।’ যতদূর মনে পড়ে আবদুল্লাহ সাহেব বেশ বিমর্ষ ছিলেন সেদিন। তাঁর কথাগুলো মা ও বাবাকেও বেশ বিচলিত করেছে দেখলাম। আবদুল্লাহ সাহেব চলে যাবার মাসখানেকের মধ্যে আমরা সেই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে স্টেশন রোডের একটা বাড়িতে এসে উঠলাম। এইভাবে একমাসের মধ্যেই আমলাপাড়ার বাড়িটা খালি হয়ে গেল। আমারও ছোট বেলার একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হল।
৩.
এর পরে প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে। আমি এখন ঢাকায় থাকি। আমি আর আমার স্ত্রী শান্তিবাগের একটা ছোট ফ্ল্যাটে আছি। আমার স্ত্রীর নাম অমলা। একেবারেই অবিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাপার, কিন্তু বিশ্বাস করুন অমলার সাথে যাতে আমার বিয়ে না হয় তার জন্য আমি যারপরনাই চেষ্টা করেছি। অমলের সঙ্গে অমলার এমন সমাপতন নিতান্তই অসম্ভব একটা ব্যাপার, কিন্তু এর পেছনের কয়েকটা কলকব্জা বললে ঘটনাটা পুরোপুরি আজগবী মনে হবে না। আমার বাবার মুহূরী ছিলেন নিবারণ আইচ, নিবারণ কাকুর স্ত্রী ছিলেন মণি কাকিমা। ওনারা আমাদের ময়মনসিংহর বাসা থেকে বেশী দূরে থাকতেন না, পায়ে দশ মিনিটের হাঁটা পথ ছিল। মণি কাকিমা আমাদের সবাইকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন, তবে তার মধ্যেও কমলাদিদিকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন। তাই ওনার যখন মেয়ে হল তখন মাকে বললেন এটা হল কমলার বোন, ওর নাম আমি রাখব অমলা। আর অমল আর বিমলের বোন হবে অমলা। মা একটু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু মণি মাসীমার কাছে সেসব খাটে নি। এসব কাহিনী আমি পরে শুনেছি। অমলা আমার থেকে বছর দুয়েক ছোট ছিল। অমলার নামের জন্যই ছোটবেলায় আমি তাকে যতটা পারি এড়িয়ে গেছি। আসলে অমলা এমন বুদ্ধি নিয়ে জন্ম নিয়েছিল যে সে নিজে যতটুকু পারে আমাকে এড়িয়েছে। শেষাবধি অবশ্য অমলার ফাঁদ আমাকে ছাড়ে নি, আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তার পাণি প্রার্থনা করি। আসলে মণি কাকিমা নিজেও কোনোদিন ভাবেন নি যে ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত এরকম হবে। তবে এই কাহিনী অমল অমলার প্রেম কাহিনী নয়। এই কাহিনীতে অমলার বিশেষ ভূমিকা আছে বলেই তার অবতারণা।
অমলা সালমা আপাদের ঘটনাটা জানত, আমাদের বাসায় তার পরিবারের সবারই যাতায়াত ছিল, সে আবদুল্লাহ সাহেবকেও দেখেছে। অমলা আমাকে ঠাট্টা করে বলত, ‘পথের পাঁচালীতে বিভূতিভূষণ খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অমলা নামে একটি চরিত্রকে নিয়ে এসেছিলেন। সেই অমলা অপুর থেকে কয়েক বছর বড় ছিল, অপু তার প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু অমলা অপুকে সেরকম পাত্তা দেয় নি, খেলায় সঙ্গী হিসেবে অপুকেও নিতে চায় নি কারণ অন্যান্য অনেক ছেলে অপু থেকে খেলায় পটু ছিল। অপু যখন অভিমানে খেলা ছেড়ে চলে গিয়েছিল অমলা তার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। সালমা আপার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিল এরকম।’ আমি খুব রেগে যেতাম, ‘বলতাম বাজে কথা বল না।’ অমলা হাসতে হাসতে বলল, ‘কিন্তু দেখ, বাস্তব জীবনে তুমি আসল অমলাই পেয়েছ।’
আমার ঐ দিনের অভিজ্ঞতাকে সে কখনো বালক মনের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয় নি। তবে অমলা বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল, সে ঘটনাটাকে যৌক্তিকভাবে বিচার করতে চেয়েছিল। হঠাৎ করে বায়ুর ঘূর্ণী কিভাবে সৃষ্টি হতে পারে সেই নিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে, তর্কবিতর্কও হয়েছে। অমলা বলেছিল বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে বাতাসকে আবেশিত করা যায়। ঐ বারান্দার ছাদে যদি তড়িৎপ্রবাহের ব্যবস্থা থাকে তবে বায়ুকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালিত করা সম্ভব।
সালমা আপারা রাতের আঁধারে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন। অনেকেই ভাবতেন রোকেয়া খালার বাবা মা দেশ ভাগের সময় কলকাতা থেকে এসেছিলেন, কিন্তু আমি অন্ততঃ বুঝেছিলাম তাঁরা এই পৃথিবীর মানুষ ছিলেন না। উনিপা যেভাবে বাতাসের দেয়াল তৈরি করেছিলেন সেটা কোনো মর্ত্যবাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে এভাবে না বলে চলে যাবার জন্য আমি খুব অভিমান করেছিলাম, পরে বুঝলাম এলিয়েনদের ওপর অভিমান করে লাভ নেই, তাঁদের পরিসর যেখানে গ্যালাক্সি জুড়ে সেখানে মফস্বলের একটি কিশোরের অভিমানের তেমন মূল্য থাকার কথা নয়। তবে সালমা আপা যাবার সময় আমার কথা পুরোপুরি ভোলেন নি। আমার জন্য দুটো বই রেখে গিয়েছিলেন, ওপরে একটা খামে চিরকুট ছিল, তাতে লেখা ছিল ‘প্রিয় অমল, তোমার জন্য এই বই দুটো রেখে গেলাম, মহাবিশ্বের কত বিস্ময়, তাতে বিস্মিত হতে ভুল না। তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে।’ ব্যস, মাত্র ছোট তিন লাইনের চিঠি। চিঠিটা পড়ে চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়েছিল আমার।
সালমা আপা যে বইদুটো রেখে গিয়েছিলেন তার মধ্যে একটির নাম হল Chicago Exposition World Fair 1933। ১৯৩৩ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে যে বিশ্বমেলা হয়েছিল সেটার বিভিন্ন ফটো নিয়ে বইটি। আর একটি বইয়ের নাম হল Leonardo Da Vinci। বিশাল ভারি মোটা বইটিতে দা ভিঞ্চির আঁকা ১৬৩৫টি ছবি রয়েছে। বইটিতে দা ভিঞ্চির জীবন তার সৃষ্টি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছিল। আমার সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঐ বইটি ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। অন্যদিকে শিকাগো বিশ্বমেলার বইটি আমি সেরকমভাবে উল্টেপাল্টে দেখি নি, জানি না কেন সালমা আপা ওটা আমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন। একদিন বেশ রাতে বাড়ি ফিরেছি, অমলা দরজা খুলে বলল, ‘এখানে সোফায় এসে বস।’ সোফার সামনে টেবিলে দেখলাম শিকাগো বিশ্বমেলার বইটা, পাশে একটা আতশ কাচ। আমরা দুজনে সোফায় পাশাপাশি বসলে অমলা বইটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খুলল। বাঁদিকের পাতায় দুটো সাদাকালো ছবি, ওপরের ছবিটার দিকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে অমলা নির্দেশ করল। আমি ঝুঁকে ছবিটা দেখলাম, ছবিটা আমি আগেও দেখেছি প্রাচ্যদেশীয় বৌদ্ধ মন্দিরের পূর্ণ মডেল, নিচে লেখা আছে The Chinese Lama Temple of Jehol। মন্দিরটির সামনে শিকাগোর নাগরিকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারীদের পরনে লম্বা সাদা স্কার্ট, মাথায় ক্লোশ টুপি, হাতে পাতলা দস্তানা। পুরুষরা পরেছে ঢিলে পান্তালোন, জামা আর মাথায় ফেডোরা আর পানামা টুপি। অমলা আমার হাতে আতশ কাচটি ধরিয়ে দিয়ে বলল সামনের দুজন মহিলাকে দেখ। আমি মাথা নিচু করে কাচটা সামনে ধরলাম। সাদা লম্বা ড্রেসপরা নারীটির মুখ আতশ কাচে বড় হয়ে দেখা দিল, আমি চমকে উঠলাম, বিড়বিড় করে বললাম, ‘সালমা আপা।’ অমলা বলল, পাশের জনকে খেয়াল কর। আমি কাচটা একটু সরিয়ে পাশের জনকে দেখলাম, ইনি একটি কালো ড্রেস পরা, রোকেয়া খালা। আমি কাচটা নামিয়ে পুরো ছবিটা দেখলাম। লামা মন্দিরের সামনে কত লোক হেঁটে যাচ্ছে, আমি এই ছবিটা কতবার দেখেছি, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখার কথা কোনোদিন মনে হয় নি। ১৯৩৩এর সালমা আপা দেখতে ১৯৮০র দশকের মতই। আমি ফ্যালফ্যাল করে অমলার দিকে তাকালাম। দেখলাম অমলার চোখে মুখে উচ্ছসিত আনন্দ, এরকম একটা আবিষ্কার সে করেছে। জীবনের বিভিন্ন বিস্ময় ও সমাপতনে অমলার আগ্রহ অপরিসীম।
অমলা বলল, ‘জানো ১৯৩৩এর শিকাগো বিশ্বমেলার উদ্বোধন কেমন করে হয়েছিল?’ আমি মাথা নাড়লাম। অমলা বলতে থাকল, ‘ঐ মেলায় সন্ধ্যেবেলা যখন স্বাতী, যাকে ইংরেজীতে বলে arcturus, সেই তারার আলো ফটোইলেকট্রিক সেলে দেখা গেল তখনই মেলার সব আলো জ্বলে উঠেছিল। আর কেন স্বাতী নক্ষত্রকে বেছে নেয়া হয়েছিল জানো?’ আমি আবার মাথা নাড়লাম। ১৮৯৩ সনে শিকাগোতে একটা বিশ্বমেলা হয়। সেই সময় স্বাতী তারা থেকে যে আলো রওনা হয়েছিল সেই আলোর প্রায় ৪০ বছর পরে ১৯৩৩এ পৃথিবীতে পৌঁছনোর কথা, সেইজন্য বাছা হয়েছিল স্বাতীকে। তবে এখন আমরা আরো ভালভাবে জানি স্বাতীর দূরত্ব। হিপারকোস উপগ্রহের দূরবীন ব্যবহার করে আমরা জানি স্বাতী আমাদের থেকে ৩৭ আলোকবর্ষ দূরে।’ আমি অনেকটা যন্ত্রের মত বললাম, ‘হিপারকোস?’ অমলা বলল, ‘হ্যাঁ, প্যারালাক্স পদ্ধতিতে নিকটবর্তী তারাদের দূরত্ব মাপতে হিপারকোস দূরবীনকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল।’ আমি বললাম, ‘ওঃ,’ তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। এতসব জিনিস গ্রহণ করতে সময় লাগে। আমি দুহাত দিয়ে মাথা চেপে বললাম, ‘তোমার মনে হয় সালমা আপারা স্বাতী তারা থেকে এসেছিলেন।’ অমলা আমার কথায় হাসল না। বলল, ‘জানো, স্বাতী সূর্যের চেয়ে প্রায় দুশো গুণ উজ্বল। বিজ্ঞানীরা এখনো স্বাতীর কোনো গ্রহ আবিষ্কার করতে পারেন নি, কিন্তু প্রাণ বিকশিত হতে হলে সেই গ্রহকে স্বাতী থেকে বহূ দূরে থাকতে হবে।’ লালচে উজ্বল স্বাতী অভিজিৎ নক্ষত্রের পরে আমার সবচেয়ে প্রিয় তারা। মনে পড়ে সালমা আপা আমাকে স্বাতী চিনিয়েছিলেন ময়মনসিংহ বাড়ির ছাদ থেকে।
পরের দিন আমার ছুটি ছিল। সকালে ময়মনসিংহের ট্রেনে ধরলাম। বাবা ও মা দুজনেই বিগত হবার পরে বহু বছর এই শহরে আর আসা হয় না। স্টেশনে নেমে রিক্সা ধরলাম, বললাম আমলাপাড়া চল। কিন্তু আমাদের বাসাটা আর পেলাম না, সেখানে একটা বিরাট ছয়তলা বাড়ি উঠেছে। সামনের ছোট মাঠটা আর নেই। রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ‘ব্রহ্মপুত্র পাড়ে চল।’ গোলপুকুর পার হয়ে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল, টেলিগ্রাফ অফিস ছাড়িয়ে এককালের মহারাজ শশীকান্ত আচার্যর বাড়ি এখন যেটা মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, তারপর কোর্ট কাচারি যেখানে বাবা ওকালতি করতেন। তারপর ব্রহ্মপুত্র। নদীরে পাড়ের পার্কটায় এসে রিক্সা ছেড়ে দিলাম। শীতের দিন, নদীতে সেরকম জল নেই, নিচে নেমে চর দিয়ে হাঁটলাম। সালমা আপা ব্রহ্মপুত্রের চরে হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার করে আবৃত্তি করতেন, ‘চিক চিক করে বালি কোথা নাই কাদা, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’ বিকেল শেষ হয়ে আসে। অল্প ঠাণ্ডা, সূর্যটা টুপ করে ডুবে যায়। আমি পূর্ব দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর ঘনায়মান ছায়ার জন্য অপেক্ষা করি। এসময়ই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে, অমলা ফোন করেছে। ‘ঢাকা এস, একটা জিনিস দেখাতে হবে,’ আমলার গলায় উত্তেজনা। আমি বলি, ‘সব ঠিক আছে তো।’ সে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ আমি বলি, ‘কি জিনিস যা ফোনে বলা যাবে না।’ অমলা বলে, ‘তোমাকে এটা হাতে নাতে দেখাতে হবে।’
আমি দেরি করি না। বাস ধরে বাড়ি ফিরি। ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। গতকালের মতই দরজা খুলে অমলা আমাকে বসার ঘরে সোফায় বসিয়ে দেয়। সামনে শিকাগো বিশ্বমেলার বইটা সেই লামা মন্দিরের ছবিটার পাতায় খোলা। এবারেও অমলা আমাকে হাতে আতশ কাচ ধরিয়ে দেয়। বলে সালমা আপা আর রোকেয়া খালাকে আর একবার দেখ। আমি দেখলাম। তারপর সে বলে, এবার কাচটা ওপরে ডানদিকে একটু সরাও। সরালাম। একজন সাদা জামা, পান্তালোন আর ফেডোরা টুপি পরিহিত পুরুষ, তার পাশে গাড় রঙের ড্রেস আর ক্লোশ টুপি পড়া একজন নারী। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কেন অমলা আমাকে তাদের দেখতে বলছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে সে বলল, ‘চিনতে পারলে না। আবদুল্লাহ সাহেব ও উনিপা।’ আমার হাত কাঁপে, আতস কাচটা পুরুষটির ওপর আবার রাখি। শুধু একদিক থেকে মুখটা দেখা যাচ্ছে। বড় জুলফি নেমেছে কানের পাশে, বড় কান, তীক্ষ্ণ নাক, স্পষ্ট থুতনী। হ্যাঁ, আবদুল্লাহ সাহেবই বটে। পাশে সরাই কাচটা, আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গীর ওপরে রাখি। সে উনিপা কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তার সামনের দিকে দুহাত বাড়ানো। সেটা ছিল উনিপার ট্রেডমার্ক ভঙ্গী। উনিপা এভাবেই হাঁটতেন। আবদুল্লাহ সাহেবকে আবার দেখি। না কোনো সন্দেহ নেই, উনি আবদুল্লাহ সাহেবই বটে।
আমি আর অমলা দুজনেই নিশ্চুপ বসে থাকি। স্বাতী তারার গ্রহ থেকে উড়ে এসেছিল চার পরিব্রাজক। গ্যালাক্সি ভ্রমণ করতে গিয়ে পৃথিবীটা তাদের ভাল লেগে গিয়েছিল, থেকে গিয়েছিল তারা সেখানে অনেকদিন। যখন যে দেশে গেছে সেখানকার আচার গ্রহণ করেছে, হয়তো চেহারা বা ত্বকের সামান্য পরিবর্তন করেছে। ব্রহ্মপুত্রের চরে সালমা আপা আমাকে কৃত্রিম উপগ্রহ দেখিয়েছিল। হয়তো সেরকমই একটি উপগ্রহ পার্ক করা আছে পৃথিবীর কক্ষপথে মানবের অগোচরে, অথবা চাঁদের পেছনে। আমি বুঝি রাতে বারান্দায় টুলে উঠে আবদুল্লাহ সাহেব খিলানের নিচে বিদ্যুতের লাইন ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করছিলেন, যে লাইন হয়তো বাতাসকে আয়নিত করে ঘূর্ণী সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছিল। বুঝলাম রাতে উনি ঠিকই কোনো কোডে মহাশূন্যে সঙ্কেত পাঠাচ্ছিলেন। সালমা আপারা লাইব্রেরির অত অত বই ওনার কাছেই রেখেই গিয়েছিলেন। সুদূর স্বাতী নক্ষত্রের জগতে ভাই, বোন, মা, বাবা কি ধরণের সম্পর্কে রচিত হয় জানি না, আমি ভেবে নিলাম আবদুল্লাহ সাহেব ঢাকায় বোনের বাড়ি অর্থাৎ রোকেয়া খালাদের ওখানেই চলে গিয়েছিলেন।
আপনাদের কাছে, এই গল্পের পাঠকের কাছে, আমি একটা জিনিস স্বীকার করব – আবদুল্লাহ সাহেব যে একজন এলিয়েন, গ্রহান্তরের আগন্তুক, সেটা আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হয়েছিলেম, কিন্তু সেই বিস্ময়বোধ ছাড়িয়ে যে অনুভূতিটা আমাকে তখন গ্রাস করেছিল সেটা হল এক ধরণের ঈর্ষা। আবদুল্লাহ সাহেবকে আমি কখনও সালমা আপাদের পরিবারের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট ভাবি নি, বরং আমি ভাবতাম সালমা আপা ওনাকে পছন্দ করতেন না। সালমা আপা, রোকেয়া খালা বা উনিপাকে বলতে গেলে কখনই আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে আমি দেখি নি। এতদিন পরে যখন বুঝলাম আসলে তাঁরা সবাই একই পথের সাথী সেটা আমাকে বিষন্ন করে তুলল। আগেই বলেছি স্বাতী সৌরজগতের জীবদের সামাজিক সম্পর্ক কি ভিত্তিতে গঠিত হয় সেটা আমি জানি না, তবু আবদুল্লাহ সাহেব যে সবসময় সালমা আপার সঙ্গ পাবেন এই তথ্যটা আমাকে এক অদ্ভূত ধরণের হিংসায় ভরিয়ে দিল। পথের পাঁচালীর অমলা দৌড়-ঝাঁপের খেলায় অপুকে উপেক্ষা করে বিশুকে বেছেছিল, অভিমানে অপুর চোখ জলে ভরে উঠেছিল। আমারও অনেকটা সেরকম হল, তারপর এই প্রাপ্তবয়সে নিজের এরকম ছেলেমানুষীতে নিজের ওপরই রাগ হল, পাশে বসা অমলার কাছে আমার অনুভূতিটা আড়াল করলাম।
এর পরে আরো কয়েকটি বছর কেটে গেছে। সে কটি বছর গেছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ওপর যে বইটা সালমা আপা আমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন সেটা তন্ন তন্ন করে পড়া এবং ছবিগুলির মাঝে সালমা আপাদের কোনো চিহ্ন খোঁজার মধ্যে দিয়ে। ঐ বইটি ১৯৩৮ সনের ইতালীয় একটি বইয়ের ইংরেজী সংস্করণ যেটা বোধহয় ১৯৭০য়ের দশকের শেষে ছাপা হয়েছিল, ওপরের প্রচ্ছদটি যীশুর শেষ নৈশভোজের ছবিটি। বইটির প্রথমে লেখা An Artbras Book। পাঠকের হাতে যদি এই বইটি কোনোদিন আসে আমি তাঁকে অনুরোধ করব উনি যেন একটু খুঁজে দেখেন সেই বইতে অস্বাভাবিক বা সাধারণের বাইরে কিছু চোখে পড়ছে কিনা। ১৪ ও ১৫ শতকে স্বাতী নক্ষত্রের এই চার পরিব্রাজক রেনেসাঁ ইতালী, জার্মানি ও ফ্রান্সেও হয়তো ছিলেন এবং দা ভিঞ্চির কোনো শিল্পকলায় চিত্রিত হয়েছেন । তবে আমার ধারণা সালমা আপা পৃথিবী না ছেড়ে চলে গেলে আমার এই গল্পটি তাঁর চোখে পড়বে, আমি এখনও তাঁর আর একটি চিঠির আশায় বসে আছি।