প্রিয় কবিতা
প্রিয় কবিতা বলে যেসব কবিতা দেয়া হয়, আদতে তা সবার প্রিয় না ও হতে পারে। ইরাবতী চায় পাঠকদের কবি ও তার কবিতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তাই পড়ার একটা তাগিদ তৈরির প্রচেষ্টা এই প্রিয় কবিতা।প্রিয়তমাষু সুকান্ত ভট্টাচার্য …………… সীমান্তে আজ আমি প্রহরী। অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক’রে আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি- স্বদেশের সীমানায়। দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী, স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে; – ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও। আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক, হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল, রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ, আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি। আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ, স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ, চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ কিছুতেই বুঝি না কী ক’রে এড়াব তাকে? কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক? যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি, চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া, প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল, গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক, রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই। তোমাকে ভেবেছি কতদিন, কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কত গোলা ফাটার মুহূর্তে। কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে তোমার আর তোমাদের ভাবনায়। তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে, ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব। আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র। জানি না আজো, আছ কি নেই, দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে জানি না তাও। তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায় ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে। জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে; জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে, মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার। তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে সে তোমার হৃদয়। যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে; পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় আর সামনে নয়, এবার পেছনে ফেরার পালা। পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে। প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী? উত্তর তার- তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়, ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব, ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র; আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা। আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে
তসলিমা নাসরিন
…………………
কী হচ্ছে আমার এসব!
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?
বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?
আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?
সভা সমিতিতে যেতে?
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।
মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।
মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।
তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,
মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি
স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,
আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,
ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি
আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন
এত প্রেম কেউ দেয়নি,
এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।
তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!
কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?
যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি
আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা
যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,
মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,
স্বপ্নই মনে হয়।
তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা !
আবুল হাসান
…………..
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।
ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেনো আমি
চলে যাই আজো সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর !
মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ তারা
নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর
হরিকীর্তনের নদীভূত বোল !
বড় ভাই আসতেন মাঝরাতে মহকুমা শহরের যাত্রা গান শুনে,
সাইকেল বেজে উঠতো ফেলে আসা শব্দে যখোন,
নিদ্রার নেশায় উবু হয়ে শুনতাম, যেনো শব্দে কান পেতে রেখে :
কেউ বলে যাচ্ছে যেনো,
বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝড় কেন ?
পিঠে অই সারসের মতো কী বেঁধে রেখেছো ?
আসতেন পাখি শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই !
ছোটবোন ঘরে বসে কেন যেনো তখন কেমন
পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে !
আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখিহীন দৃশ্য চোখে ভরে !
দীঘিতে ভাসতো ঘনমেঘ, জল নিতে এসে
মেঘ হয়ে যেতো লীলা বৌদি সেই গোধূলি বেলায়,
পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে, ভাবতুম
এমন দিনে কি ওরে বলা যায়- ?
স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে কোরে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট !
একে একে নদীর ধারার মতো তার বহুদূরে গত !
বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো
সবার গোচরহীন আছি আজো সুদূর সন্ধানী !
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান !
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত



