| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ভালো লাগা বই: প্রদোষে প্রাকৃতজন । জয়ন্ত ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,prodosh-prakritojon book review gitoranga-special

বিংশ শতকের শেষার্ধের বাংলা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে শওকত আলী (১৯৩৬-২০১৮) যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার রয়েছেন, সে সম্পর্কে দ্বিধার অবকাশ নেই। উপন্যাস ও গল্পে, তাঁর যে বাস্তবমুখী মানবতার চেতনার পরিচয় আমরা অনুভব করি, এই ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কোনও অর্থেই ব্যতিক্রম নয়।

১৯৮৩ সালে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, তারপর ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘দুষ্কালের দিবানিশি’। ১৯৮৪ সালেই এই দুই খণ্ড একত্রে ঢাকার দি ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের পটভূমি সেন যুগের শেষপর্বের বাংলা। লেখকের ভাবনায় বাংলার ইতিহাসের এই প্রদোষকালে প্রাকৃতজনের অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে দেখার এই প্রয়াস বাংলায় পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে খুব বিশেষ দেখা যায়নি, মূলত রাজবৃত্তের অনুষঙ্গে তাঁদের লেখনী সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলার পাল রাজবংশের শাসনের যাঁরা অবসান ঘটান, সেই সেন ও বর্মণ বংশীয় শাসকরা ছিলেন বহিরাগত, দক্ষিণ ভারত থেকে তাঁরা এসেছিলেন পালরাজাদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে। পাল রাজবংশের রাজত্বকালে বা তার পূর্বেই বাংলার সমাজের উপর ব্রাহ্মণদের ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি শুরু হয়ে যায়, কিন্তু শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা আর সাধকদের প্রয়াসে মহাযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব থেকে বাংলার সমাজের কোন অংশই সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল না। পালবংশীয়দের শাসনকালে মগধ আর বাংলায় তাঁদের স্থাপিত মহাবিহারগুলিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কখনও কম হয় নি। সেন ও বর্মণশাসকরাবাংলায় এসে দক্ষিণ ভারতের মত শিব ও বিষ্ণুর উপাসনার জন্য বৃহদাকার মন্দির নির্মাণের ধারা প্রচলিত করলেন, আর উত্তর ভারত থেকে নিয়ে এলেন কঠোর বর্ণাশ্রমপ্রথার অনুসারী ব্রাহ্মণদের, ভূমিদানের মাধ্যমে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল। সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে বাংলার নিম্নবর্গের সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ এবং কৌমগুলির সুনির্দিষ্ট বর্ণ ও জাতিগত অবস্থান শাস্ত্রগ্রন্থে নির্ধারিত করা হল, প্রয়োজন মতো পরিবর্তনও করা হল। এই কালপর্বে রাজস্বের অধিকাংশ ভোগ করতে শুরু করলেন সামন্ত শাসক আর রাজপাদোপজীবীরা (রাজকর্মচারীরা), তাঁদের অত্যাচারও বৃদ্ধি পেল। দ্বাদশ শতকের শেষে, যখন একদিকে বাংলার সিংহাসনে আসীন দুর্বল বৃদ্ধ সেনরাজ লক্ষ্মণসেন আর অন্যদিকে নিম্নবর্গের প্রজাদের মধ্যে ধুমায়িত অসন্তোষ, সেই সংকটময় কালে, বাংলা আক্রান্ত হলো সুদূর আফগানিস্তান থেকে আগত হিংস্র লুন্ঠনকারী বিদেশী সেনার হাতে। বাংলার ইতিহাসের এই দুর্যোগময় পর্বের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাস।

এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র কে নির্ণয় করা কঠিন, আমার মনে হয়, আত্রেয়ী নদীর তীরের মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ। মন্দির গাত্রের মৃৎফলক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিমালক্ষণশাস্ত্রের নির্দেশ ও শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে গুরু বসুদেবের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর, শ্যামাঙ্গ মন্দিরের মৃৎফলক নির্মাণের কাজ থেকে বিতাড়িত হন। ব্যথিত, মর্মাহত শ্যামাঙ্গ নিজের গ্রামের উদ্দেশে পথ চলতে শুরু করেন, আর এই পথ চলার কাহিনি নিয়েই এই উপন্যাস। চলার পথে শ্যামাঙ্গের পরিচয় হলো মায়াবতী আর লীলাবতীর সঙ্গে, আশ্রয় পেলেন মায়াবতীর পিতৃগৃহে, লাভ করলেন মায়াবতীর মায়ের সন্তানস্নেহ।মায়াবতীর স্বামী বণিক বসন্তদাস বাণিজ্যের প্রয়োজনে প্রবাসে, মায়াবতী তাই পিত্রালয়ে। লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যুর আবার বিবাহে বিশ্বাস নেই, লীলাবতীও তাই পিত্রালয়ে স্বচ্ছন্দ।শ্যামাঙ্গের যাত্রা কিন্তু এখানে থামে না, তিনি আবার শুরু করেন তাঁর যাত্রা। শুধু শ্যামাঙ্গ নন, বসন্তদাস, মায়াবতী, লীলাবতী, সোমজিৎ উপাধ্যায় – উপন্যাসের অন্য চরিত্ররাও শ্যামাঙ্গের মতোই গতিশীল। শ্যামাঙ্গের পথ চলার সূত্রেই বরেন্দ্রভূমির ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস সীবন করে চলে তৎকালীন সমাজের সংঘাত ও সহমর্মিতার একটি বর্ণময় নকশিকাঁথা। উপন্যাসের শেষে শ্যামাঙ্গের পথ চলার সমাপ্তি হয় আফগান সেনার হাতে নির্মম মৃত্যুতে, বাকিদের শেষ খবর আর জানা হয় না।

এই উপন্যাসে ‘অন্ত্যজ’ সামাজিক জনগোষ্ঠীসমূহ, নাথ যোগী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সেন আমলের সামন্তশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে তার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহের হয়ত অবকাশ রয়েছে, কিন্তু সেনযুগের বাংলার নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। একদিকে বাংলায় আগত আরব বণিক ও বাংলা আক্রমণকারী আফগান সেনা আর অন্যদিকে সেন রাজ্যের সামন্ত শাসক ও বাংলার গ্রামীণ প্রান্তিক প্রজা – একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও দুজন মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের পার্থক্য যে শ্রেণী ভিত্তিক, এই সহজ সত্য ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর মতো এত সুস্পষ্টভাবে খুব কম বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসেই এর পূর্বে বলা হয়েছে।

শওকত আলী, প্রদোষে প্রাকৃতজন, ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৪।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত