যখন চোখ মেলে চাইলাম, তখন একেবারে অন্ধকার। প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলাম না, উঠে বস্লাম, আর তখনই বুঝতে পারলাম শিবেটার শ্মশান চাটাইয়ে শুয়ে আছি। এখান থেকে অন্ধকারে, আর একটা দালান পার হতে হয়, তবে উঠোন, অন্ধকারে যেতে পারব তো! মঞ্জরীর নাম ধরে ডাকলাম, কেউ জবাব দিল না, তারপরে শিবের। তাও না। তখন শুনতে পেলাম, কে যেন শিবের নাম ধরে ডাকছে। গলা শুনেই চিনতে পারলাম শুটকা ডাকছে—আর ডাকতে ডাকতে ও একেবারে ঘরের কাছে এসে পড়লো, আর বলতে লাগলো, ‘ধূ-র, ভূতের বাড়ি মাইরি, কেউ নেই!’
‘আমি আছি।‘
‘কে, গুরু?’
‘হ্যাঁ।‘
‘আরে, আমি তো তাই দেখলাম, তোমার মোটরবাইকটা রয়েছে দরজার কাছে, অথচ কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।‘
তখন শুটকার কথা আমার মনে পড়লো, ওকে আমি খুঁজেছিলাম, কেশবের লুকনো মালের কথা বলে দেবার জন্যে কিন্তু এখন ওর ওপরে আমার রাগ হচ্ছে না, কেন তা জানি না। মিথ্যা কথা তো বলেনি। শুটকা আবার বললো, সারাদিন কি এখানেই ছিলি?’
‘না, দুপুর থেকে।‘
শুটকা ফস করে একটা দেশলাইয়ের কাটি জ্বালালো, আর এগিয়ে গিয়ে, একটা কুলুঙ্গিতে মোমবাতি ধরালো। ও সব জানে এ ঘরের। বললো, একটা দিশি রেখে গেছলাম, দেখি আছে না সেঁটে দিয়েছে!’
মধ্যেই কোথা থেকে একটা বোতল টেনে বের করলো। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘খাবি?’
যেন খেতেই ব্যস্ত, এইভাবে খানিকক্ষণ কাটিয়ে বললো, ‘বাড়িতেই।‘ মনে হল মিথ্যা কথা বলছে। কিন্তু আমার রাগ হল না। উঠে পড়ে বললাম, ‘চলি। এদের বাড়িতে কেউ নেই নাকি? বোনেরা, ওদের মা?’
‘কাউকে তো দেখতে পেলাম না। তুই এখন কোথায় যাবি গুরু?’
‘বাড়ি।‘
‘চ’, তোর সঙ্গে চলে যাই।‘
শুটকার সঙ্গে বেরিয়ে এলাম, ও পিছনে উঠলো, ডায়নামোটা অন করে এগিয়ে চললাম। রাস্তায় বেশ ভিড়, কাল তো হরতাল, তাই সবাই বাজার-টাজার করে নিয়ে যাচ্ছে, সিনেমাও নিশ্চয় বন্ধ থাকবে, তাই সেখানেও ভিড়, কালকেরটা আজই মিটিয়ে নিতে হবে।
শুটকা বলে উঠলো, ‘বাড়ি যাবি বললি যে?’
তা-ই নাকি, কিন্তু আমি তো শিখাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছি, শিখাকে বলে এসেছিলাম, এবেলা যাব। হাত তুলে ঘড়ি দেখলাম, সোয়া আটটা। বললাম, ‘শিখাদের বাড়ি যাব।‘
‘তবে আমাকে এখানেই নামিয়ে দে।‘
ব্রেক কষে দাঁড়ালাম, আর তখনই দেখলাম, কেশব দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজনের সঙ্গে ৷ একবার কোনরকমে চোখাচোখি হতেই, চোখ দুটো সরিয়ে নিল ও। আর আমার মনে পড়লো, ‘ওকে বলে দিও, ও সাপের গায়ে পা দিচ্ছে ‘….রোয়াব! চোট্টা কোথাকার, বেশী বললে, আজই শহরের সব লোককে বলে দেব। ওর চোখ জ্বলছিল, আর তখন রমেশের চোখ দুটোও আমার মনে পড়ে গেল, গরীবদের নেতা। নিরাপদবাবুরা কিছু বলেন না কেন, ভয় পান, না কি ভাবেন, রমেশদের কথা ফাঁস করে দিলে তাঁকে বিশ্বাস করবে না? আচ্ছা, আসলে কেশবের আলমারি থেকে সেদিন মালের বোতল ফাঁক করেছিলাম বলে ওরকম চটে নেই তো! না, তা হলে শিখা বলতো।
শিখাদের বাড়ির ভিতরে গাড়িটা রেখে, বাইরের ঘরে দেখি, শিখা একলা বসে আছে। তার আগেই, কোথা থেকে যেন ডাক্তারের হাসি-কাশি মেলানো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বোধ হয় বেলাদির আসরে। শিখা আমার দিকে চেয়েই চমকে উঠলো, বললো, ‘এ কি, কোথেকে এলে?’
আমি বসে পড়ে বললাম, ‘কী জানি স্লা, মনে পড়ছে না।‘
শিখা আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, আমার আপাদমস্তক দেখলো, যেন বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, তারপরে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাড়ি যাওনি তখন থেকে?’
‘না।‘
শিখা বারে বারে আমার প্যান্টের দিকে তাকাতে, আমিও তাকালাম। বিচ্ছিরি, তাড়াতাড়ি বোতাম লাগালাম, খেয়ালই ছিল না। জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় ছিলে?’
‘শুটকাদের বাড়ি।‘
মিথ্যা কথা না বলে উপায় ছিল না, কারণ আমি জানি, শিবেদের বাড়ির কথা বললেই, মঞ্জরীর কথা ওর মনে হবে। অবিশ্যি জানি না, ও বিশ্বাস করলো কিনা, সেরকম ভাবেই তাকিয়ে রইলো, যেন বিশ্বাস করছে না, ও চোখ দুটো নামিয়ে রাখলো।
বললাম, ‘বড্ড খিদে পেয়েছে।‘
ও আবার অবাক হয়ে বললো, ‘খাওনি সারাদিন?’
‘না।‘
সেই মুহূর্তেই নাক কোঁচকালো, ঠোঁট কুঁচকে বললো, ‘কাড়িখানেক মদ গিলে এসেছ দেখছি।’
‘কিছু ভাল লাগছিল না।‘
শিখা আমার দিকে একবাব তাকিয়ে, ঘরের বাইরে চলে গেল, খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললো ‘রুটি আর কুমড়োর তরকারি খাবে?’
‘খাব।‘
‘তবে একটু বস।‘
বলে আমার হাতখানেক দূরের চেয়ারে বসলো। আমি শিখার দিকে চেয়ে কী যেন বলব বলব ভেবে বললাম, ‘আমি শিবেদের বাড়িতে ছিলাম দুপুরে।’
বলে যেন নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, আর শিখার ভুরু দুটো কেমন একরকম ওপর দিকে ঠেলে উঠলো, জিজ্ঞেস কবলো, ‘কোনটা সত্যি?’
‘এটা।’
‘বলতে গেলে কেন?’
‘কী রকম খারাপ লাগছে।‘
শিখা চেয়ে রইলো। এখন ওর চুলে বিনুনি, কালো আর চকচকে, বাসন্তী রঙের জামা, সবুজ একটা এমনি সাধারণ শাড়ি। কিন্তু ওবেলার মতন শুধু জামা না, নিচেও কিছু আছে। আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম, একটু পায়চারি করে হঠাৎ বললাম, ‘জান শিখা, ছেলেবেলা থেকে-না, আমার-না, আমার কীরকম একটা ভয় ভয় ভাব আছে, আমি কোনদিন কারুকেই বলিনি, কীরকম একলা একলা থাকলে—মানে একা একা কারুকেই বলিনি, কীরকম একলা একলা থাকলে—মানে একা একা লাগলে, বুক গুরগুরিয়ে ওঠা একটা ভয় হয়, তখন আমি চেঁচামেচি করি, যা-তা…।”
শিখা যেন কীরকম অবাক হয়ে গেছে, আর শক্ত হয়ে বসে আছে। সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কী হয়েছে?’
শিখা উঠে দাঁড়ালো, আর বুকের ওপর রাখা আমার হাতটার ওপরে ওর একটা হাত রাখলো, আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে তোমার বল তো?’
আচ্ছা, কেন, শিখা আমার মুখের এত সামনে, মদের গন্ধ তো পাচ্ছে, বলছে না তো! যেন এখন ওর সেকথা মনেই নেই। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আজ তুমি একলা কেন?’
‘আজ তো সবাই ব্যস্ত, কাল হরতাল, কেশবদাদেরও কী একটা আছে, আমার খুব খারাপ লাগছে, কাল একটা কাণ্ড না ঘটায়। কিন্তু শোন—’
কিন্তু শিখা আমাকে ছাড়লো না, হাতটা ধরে তাড়াতাড়ি বাইরে টেনে নিতে গেল, বললো, ‘চল, কুয়াতলায় চল।‘
যেতে গিয়েও পারলাম না, শিখার গায়ের ওপরেই বমি করে ফেললাম—ভাবলাম, শিখা ছিটকে সরে যাবে। কিন্তু ও আমাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো, এখানেই কর। ইস, কেন এসব ছাইপাশ খাও, কী দুৰ্গন্ধ।‘
‘ওয়াক-ও-ও-ওয়াক, শিখা, আমি তোমার গায়ে—ওয়াক…।’
তখন আমি বসে পড়েই বমি করছি মেঝেতে। আর শিখা আমার ঘাড়ের কাছে হাত রেখেছে, বললো, আমি কাপড়টা ছেড়ে আসি, উঠো না যেন।’
আমি মেঝেতে একটা হাত রেখে, শুধু মদ বমি করতে লাগলাম। মনে হল, কে যেন একবার এল, কার যেন একটা ছায়া পড়লো, আবার সরে গেল, তারপরেই শিখা এল, বেলাদিকে সঙ্গে নিয়ে। বেলাদির হাতে একটা জলের বালতি আর ঘটি। শিখা তখন একটা অন্য শাড়ি পরে এসেছে। জিজ্ঞেস কবলো, ‘হয়েছে?’
বললাম, ‘হ্যাঁ।‘
ঘটি থেকে ও আমাকে জল ঢেলে দিল, আমি মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপরে ও জল-হাত দিয়ে আমার মুখে মাথায়, জামার কয়েক জায়গায় বুলিয়ে দিল, বললো, ‘যাও, বস গে ওখানে।‘
বলেই, আমার কোমরের বাঁ দিতে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কী?’
এখন আর জবাব দিতে পারছি না, আসলে ওটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, সারাদিনই ওটা আমার কোমরে আছে, ওবেলা শিখা টের পায়নি। আমি উঠে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।
পাখাটা খুলে দিল, আর দুজনেই জল দিয়ে বমি ধুয়ে পরিষ্কার করলো। বেলাদি তিনবার তিন বালতি জল নিয়ে এল, শিখা একটা ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করলো। বেলাদি একবার বললো, ‘কেন যে খাও।‘
বেলাদি যেন আমাকে বললো না, হয়তো ওর বাবার বন্ধু সেই ডাক্তারকেই বললো, তবু বেলাদির বলাটা যেন কষ্টের মত। তারপরে শিখা এসে আবার বসলো, বেলাদি চলে গেল। আমি চেয়ারের পিছনে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিলাম—এমন কিছু না, একটু দুর্বল লাগছিল। মাথাটা আস্তে আস্তে তুলে তাকালাম, দেখলাম, পাশে শিখা আর-একটা চেয়ারে বসে আছে, আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। কী যে বলতে যাচ্ছিলাম, কিছুই মনে করতে পাবছিলাম না। শিখা জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবে বলছিলে?’
‘এখন আর খেতে পারব না। আমি বাড়ি যাই।‘
‘না, না, এখন না, একটু বস। এখন তুমি মোটর-সাইকেল চালাতে পারবে না।”
‘পারব।‘
‘একটু বস-না!’
‘আস্তে আস্তে যাব। শিখা—।‘
‘বল।‘
কিছু না বলে, হাত বাড়িয়ে আমি ওর একটা হাত ধরলাম, তারপরে উঠে দাঁড়ালাম। শিখাও উঠলো। আমি ওর হাত ধরে বাইরে গেলাম, সেখানে অন্ধকার—বিশেষ করে এ বাড়িটার চার পাশেই গাছপালার জন্যে অন্ধকার। বারান্দা থেকে নামবার সময়, তখনো ওর হাতটা ছাড়িনি, ও বললো, ‘কাল বাড়ি থেকে বেরিও না, বলা যায় না, কী গোলমাল হবে?’
‘বিকেলের দিকে টুক করে একবার তোমার কাছে চলে আসব।’
ও বললো, ‘সত্যি চালিয়ে যেতে পারবে?
‘পারব। এইমাত্র বমি করেছি—সত্যি, মদের গন্ধ, তবু একটা চুমু খেতে দেবে?’
নিশ্চয়ই দেবে না, কিন্তু ঠোঁটটা অন্ধকারে এগিয়ে নিয়ে এসে, নিজেই খেল, বরং আমাকেই দিল না। গাড়িটা ঠেলতে আমার কষ্ট হল, তবু ঝাঁপের বাইরে নিয়ে গেলাম, ডায়নামে অন করে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম, মনে হল, একবার যেন শিখাব গলা শুনতে পেলাম, ‘সাবধান।‘
মনে হয়, মোটরবাইক-এব এঞ্জিনের সঙ্গে আমার রক্তের কী একটা মাখামাখি আছে, শব্দটা কানে গেলেই প্যাডেলে পা বাখলেই, মনে হয়, আমার শবীর-খারাপ বলে কিছু নেই, একেবারে ঈজি চলে যেতে পারি। তা হলেও, বুকের কাছটা কী রকম ঢকস ঢকস করছে, যেমন কোনো আলগা জিনিস ধাক্কা খেলে ঢকস ঢকস করে, সেই রকম। ওবেলা যে-বাস্তা দিয়ে ফিরেছিলাম, সে-ই রাস্তা ধবেই ফিরে চলি, এবার বাডি যেতেই হবে, আমার চান করতে ইচ্ছা কবছে। কিন্তু আবাব-আবার সেই শিউবোনি ভাবটা ঘাডের কাছে শিবশিবিয়ে উঠছে, স্সাহ্, কী যে হচ্ছে! প্রায় সেই জায়গাটায চলে এলাম, শহবেব বাস্তাটা যেখানে সব থেকে চওড়া, ওবেলা কমেশ যেখানে গরীবদেব উদ্ধাব করছিল। এখানটায় শহবেক দুটো বড় বেস্টরেন্ট, সিনেমাটাও কাছে, তাছাড়াও বড় বড় দোকান, তাই এখানে বাস্তাব পাবে দাডিয়েই শহরের ছোড়ারা আড্ডা দেয়—এই আব কি মেয়েটেযে দেখা, টিকা-টিপ্পুনি কাটা, হিডিক মারা যাকে বলে আর কী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে, রেস্টুরেন্টেব সামনে বেঞ্চি পেতে বসে, একটু ব্যালা না করলে চলবে কেন, আমিও কবি। কিন্তু বিজে ছোড়াটা আমার দিকে ওবকম তাকিযে আছে কেন, খালি তাকিয়ে না, হাসছেও যেন, হাসছে অথচ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না, বাপাব কী। ওদের একটা নেড়ি মাস্তানের দল আছে, আসলে কেশবেরই ফাইফবমায়েস থাটে। এই—এই সেই জিনিস, আবাব আমার ভয়ের গুব গুরোনিটা চেপে এল—না, ঘাড়ের শিউবোনি না, সেই ভয়, শিরদাঁড়ার কাছটা কী রকম করে ওঠা, যেটা হলেই,হাত-পা অবশ হযে আসতে চায়, কে যেন আমার ঘাড় মুচড়ে ধরতে আসে, মূর্ছা রুগীর মত মুখ গুজরে পড়ে যাবে হয়তো …
মনে হতেই, রাস্তার ধারে, একেবারে পাঁচিলেব পাশে, মোটরবাইকটা কোনরকমে থামিয়ে, ঠেকিয়ে রেখেই প্রায় পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম, আর বিজে—বিজয়টাকে ক্যাত করে একটা লাথি কষলাম, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বড় যে হাসি দেখছি।’ বলতে বলতেই, ঘুষিও চালালাম, নাকে মুখে পেটে, আর সঙ্গে সঙ্গে এদের দলের দু-তিনটে নেড়িও ছুটে এল, ‘খবরদার সুখেন’ বলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আমি তখন কী যে করছি, নিজেই জানি না, ভয়ের ভাবটা কাটাবার জনো পাগলের মত হাত চালিয়েছি। আমার সেই চেহারাটা দেখে, বিজেদের নেড়ি দলটা প্রায় হকচকিয়ে যাবার মত, তবু পাল্টা দু-একটা ঘুষি আমার গায়ে লাগতেই, ভয়ের ভাবটা যেন কেটে যেতে লাগলো, ভীষণ চিৎকার করে আমি আরো জোরে হাত চালালাম। এ সময়ে আমার দলেরও কেউ নেই, হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোমরে ছুরি আছে। মনে হতেই, সেটা টেনে বের করলাম, একটা নেড়িকে তার আগেই পাঁজরায় লাথি মেরেছি, বাকীরা দৌড়ুতে আরম্ভ করেছে। শুধু নেড়িগুলোই না, রাস্তার লোকেরাও দৌড়ুতে আরম্ভ করেছে। কে যেন ‘খুন খুন’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন, আর কয়েকটা দোকানের ঝাঁপ ঝপ ঝপ বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। আমি তখন ভয়ের ভাবটা একেবারে কাটিয়ে উঠেছি, আর ঠিক এ সময়েই আমার চোখে পড়লো রমেশ একলা দূর দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে, ঠিক একটা ল্যাজ গুটানো কুকুরের মত। আসলে একলা বলেই ভয় পেয়েছে, ভেবেছে, গুণ্ডাটা চোখে পড়ে গেলে যদি ভুকিয়ে দেয়। ‘কেন, এখন আয়!’ মনে হল রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা, আর ট্রাফিকের জন্যে যে-সেপাইটা দাঁড়িয়েছিল, সে ছুটে এল আমার কাছে, বললো, এই সুখেনদা, কী করছেন, ছুরিটা রাখুন। হ্যাঁ, এখন আর আমার কোন ভয় নেই। ছুরিটা বন্ধ করে, আস্তে আস্তে কোমরে গুজে রাখি, সেপাইটা তখনো বলতে থাকে, ‘ওরা কখন চলে গেছে। যান চলে যান, থানায় খবর গেলে আবার ও. সি. আসবে, একটা হাঙ্গামা হুজুক…।‘ ও বলেই যাচ্ছে, আর আমি মোটরবাইকটা সোজা করে, চেপে স্টার্ট দিই। এখন ভবসা পেয়ে, অনেকেই আড়াল-আবড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকায়, সসুখেন গুণ্ডাকে দেখছে সবাই। আমি বলতে থাকি, কিন্তু কি জানি, আমার যে কী রকম একটা হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। বিজে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসবে, ঠোঁট বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে, সেটা টলারেট করতে পাবি না, কিন্তু আসলে তো আমার সেই ভয়ের কাঁপুনিটা লেগেছিল বলেই ওরকম করছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, আমি দুর্বল, হাঙ্গার-স্ট্রাইকের পরে যেরকম হয়েছিল, সেই রকম, অথচ তার সঙ্গে আরও একটা যেন কী হচ্ছে—কী একটা—কে জানে স্সাহ্, কেঁদেই ফেলব কি না। লাও, দেখ আবার কোথায় চলে এলাম। আবার সেই দয়ালদার দোকানেই। আসলে, সেই টাকাটার কথা ভুলতে পারিনি বলেই বোধহয় এসেছি, কিন্তু মদের কথাই তো বেশী মনে হচ্ছে। তা হলে বোধহয়, মদ খেতেই এসেছি।
কথা শুনলে, এ লোকটাকে ঠিক দলবাজদের মত মনে হয় না, তার ওপরে আবার আমার সঙ্গে, যাকে ওরা শত্ৰু মনে করে। আর সত্যি বলতে কি, না কি, এও আমার সেই ভুতুড়ে বিদঘুটে ব্যপারের মতই একটা কিছু। লোকটা যে আমার হাত ধরেছে, তার মধ্যে কেমন যেন একটা—কী বলব—একটা মন-টানা মন-টানা ভাব, ওই আর কি, ভালবাসাবাসি মত। ও যদি মেয়ে হত, আর বয়স কম হত, তা হলে এই হাত ধরাটা শিখার হাত ধরার মতই মনে হত বোধহয়। অথচ ও হচ্ছে পূর্ণেন্দুদের গরীব দলের লোক, আমাকে কেন ঘেন্না করছে না কে জানে! হয়তো ঘেন্নাই করছে ‘তুমি তো আবার গরীব দলের নেতা?’
‘নেতা?’
লোকটার কয়েকটা দাঁত নেই, শব্দ না করে হাসতে বোঝা গেল। যেন এমন মজার কথা সে কোনদিন শোনেনি। হাসিটাও এমন, লোকটাকে কেমন চালাক চালাক বিটলে বলে মনে হচ্ছে। বললাম, ‘তোমরা তো মাতালদের ঘেন্না কর।‘
‘ঘেন্না করব? কেন, আমিও তো মাল খাই, মাতাল হই।‘
ওহ্ স্সাহ্, তাও তো বটে, অনেকদিন তো নিজের চোখেই বচনকে মাল খেতে দেখেছি। বললাম, ‘তবে, গুণ্ডাকে তো ঘেন্না কর।‘
‘তা করি, সে তো তোমার গুণ্ডাদের সবাই ঘেন্না করে।‘
‘তবে আর কি, এবার আমাকে ছেড়ে দাও, আমিও তো গুণ্ডা।‘
লোকটা এ কথার কোন জবাব দিল না। বলল, ‘একটু বস না।‘
খচরামি করছে নাকি আমার সঙ্গে। বললাম, ‘আমি মাতাল না, মাল সব বমি করে ফেলেছি।‘
‘সেটা তো আরো খারাপ। খেলে, আবার পেটেও রাখতে পারলে না। তা হলে তো নদীর ধারে একটু বসাই ভাল, ভাল লাগবে।‘
হাত টানলাম, আশ্চর্য, লোকটা হাত ছাড়লো না, তেমনি করে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আর মনে মনে সন্দেহ হলেও, আমি যেন রাগ করতে পারছি না। আচ্ছা, লোকটা বোধহয় বোকা, নিশ্চয়ই বোকা, ভাবভঙ্গিটা বোকাল মতই। একথা মনে হতেই আমি বলে উঠলাম, ‘আচ্ছা, পূর্ণেন্দু রমেশ বিমলে, এরা তোমাদের দলের লিডার কেন?‘
লোকটা খানিকক্ষণ একেবারে চুপচাপ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল, তারপরে সেইরকম বিটলে ভাবে হেসে বললো, ‘ওরা লিডার হয়েছে, তা-ই।’
‘ওরা আবার লিডার কিসের? ওরা তো সব জুচ্চোর-ফেরেববাজ।‘
‘তবু, গরীবদের জন্যে বলে তো।‘
‘ও, বললেই নেতা?’
বচন কোন জবাব দিল না, চুপ করে, আগের মতই খানিকক্ষণ চেয়ে রইল, তারপর বললো, ‘তোমার আবার এসব কথা কেন। তুমি অত বড়লোকের ভদ্দরলোকের ছেলে হয়ে, দাদাদের মত হলে না কেন?’
‘কী জানি, আমি তা জানি না, ওদের সঙ্গে আমার মিল নেই। তুমি তো চাঁদ আমার কথার জবাব দিলে না। তার মানে ধোকা খেয়ে খেয়ে মগজে কিছু নেই।‘ বচন কয়েকটা দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, তা হবে। আমার তো দেখ, তিন পুরুষ কারখানায় কাজ করছি, তার আগে,ঠাকুদার বাপেরা শুয়োর চরাত—আই, কী আর বলব বল, অনেক তো দেখলাম, দিন এক রকম যায় না। গায়ে ঘা থাকলে একদিন সে ধরা পড়েই।‘
বলে, উঠতে লাগলাম, আর বচনের যেন হাসি হাসি ভাবের কথা শুনতে পেলাম, ‘তুমি আমাদের চেয়ে বেশী।‘
সে কথার আর জবাব দিতে ইচ্ছা করলো না, লোকটা শুলাদার মত মনে হচ্ছে, ওর কাছে বেশীক্ষণ থাকা বা চোখে চোখ রাখতে ভাল লাগে না। ওপরে উঠেই মোটরবাইক-এ চেপে স্টার্ট দিলাম, দয়ালদা চেঁচিয়ে বললো, ‘পাঁট বের করতে বললে যে?’
‘না, খাব না।‘
চলতে চলতে, প্রথমেই আমার মনে হল, না, ও স্লা চোপরার কারখানাতে আমি চাকরি করব না। আচ্ছা, আমি যা লেখাপড়া শিখেছি, তাতে যদি একটা গাঁয়ে গিয়ে প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারি করি, কোঁচা দিয়ে কাপড় পরে, মাস্টারমশাইয়ের মত একটা জামা গায়ে দিয়ে—স্সাহ্, মারাত্মক হাসি পাচ্ছে মাইরি। নিজেকে ওরকম ভেবে, দারুণ হাসি পাচ্ছে, ঠিক যেমন বাঁদরনাচওয়ালাটা বাঁদরকে পায়জামা পাঞ্জাবী পরিয়ে ঘুরিয়ে বেড়ায়, সেটা যেমন অদ্ভুত—সেই রকম। কিন্তু আমাদের বাড়ির রাস্তার মোড়ে, লোক তিনটে কে যে, বাইক-এর শব্দ শুনেও সরছে না। শেষটায় আমাকে দাঁড়াতেই হল। উহ্, শরীরটা ঢিলঢিল করছে, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে রে?’
তিন জনেই ফিরে দাঁড়ালো। ওহ বাব্বা, বড়বাবু যে, দুজন পেটেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, মানে আমার বড়দা কেশববাবু। আমি থামতেই দুজন সরে গেল, কেশব আমার দিকে এগিয়ে এল। মতলব কী! উহ্রে বাব্বা, আমার মায়ের মত সুন্দর মুখ হয়েও, কেশবকে এখন ছুঁচোর মত দেখাচ্ছে। বললো, ‘একটা সত্যি কথা বলবি?’
‘কী?’
‘চাল আর ফুডের কথা কার কাছ থেকে জেনেছিস তুই?’
ও, বাছাধনের ভাবনা ধরেছে, এমন সিক্রেট খবরটা আমি পেলাম কোথা থেকে। তাও আবার জানতে চাইছে আমার কাছ থেকে, অততো সহজ না চাঁদ। বললাম, ‘যার কাছ থেকেই শুনি, তোকে বলব কেন?’
‘আমাদের কেউ কী?’
সেটাই আমার—কী বলে, জ্যেষ্ঠ স্সহোদরের ভাবনা হয়েছে, সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে নাকি। বললাম, ‘বলব না, যেতে দে।‘
উ-উ-উ-স্লা, মুখখানি দেখ একবার, বিম্লের থেকেও যেন বেশী দাঁত কড়মড় করছে। বললে, ‘দ্যাখ টুকু, একটা কথা বলে দিই, ভাগ চাস তো দিতে পারি—একদিন তোকে আমার কাছে আসতেই হবে, তোর আর কোন ফিউচার নেই, কিন্তু যদি এভাবে—।’

সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তাঁর ছদ্মনাম। তাঁর রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠে নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন।
বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির এক জন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়। তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন জেলখানায়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
‘কালকূট ’ছদ্মনামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাব তারে’ সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন।
তাঁর লেখা ছোট গল্পের সংখ্যা ২০০ এবং উপন্যাসের সংখ্যা ১০০।