| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

প্রজাপতি (পর্ব-৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 28 মিনিট

যাই হোক, সেই কলেজ-ছাড়া, তারপরে পুরোপুরি গুণ্ডা, শহরের এখন আমি নাম-করা সেরা মাস্তান, কিন্তু এই বড়দা, মেজদা ক্রমেই আমার সঙ্গে গোলমাল পাকিয়ে তুলছে, ওরা আমাকে রেগুলার শাসাচ্ছে, যে কারণে, কারখানার ম্যানেজার চোপরা পর্যন্ত বলেছে, আমি যেন কেশবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলি। কাঁচকলা, ওসব ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই, আমি ওর সব কীর্তি জানি, ও রাজনীতির খচড়ামি ছেড়ে আসুক না, তা হলে আর ওর সঙ্গে আমার কতটুকু তফাত। যেমন শুটকা আজকাল প্রায়ই বলে, পূর্ণেন্দুদের দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে! কেননা, ওরা নাকি আমাকে একদিন হাপিস করে দেবে। দিলেই হল, কেন, ও কোথাকার পীর, গরীবদের নেতা সেজে বসে আছে। ওদের দলে গরীব কোথায়, ওরা যেসব গরবীদের কথা বলে, তারা তো ওদের চারপাশে নেই, নিজেরা গিলছে, কুটছে, দলাদলি করছে, আর বড় বড় বাত মারছে, ওই বাত মেরেই লোকের মন ভুলিয়ে রেখেছে, গরীবদের রাজা করে ছাড়ছে। ওদের দলের সব ক’টা ছেলেকে আর লোককেই আমি চিনি, জানি ওদের দলে গুণ্ডামি করবার ছেলেরও অভাব নেই, আমার সঙ্গে যে কোনদিনই লড়ে যেতে পারে, কিন্তু আমিও তো ওদের চিনি। মারামারি করবার লোক ওদের দুই দলেই আছে, কিন্তু আমি কেন যাব। আজ পর্যন্ত তো ওদের দলেব কোন মাস্তান আমার সঙ্গে এটে উঠতে পারেনি, বরং মার খেয়েই গেছে, তাতে আক্রোশ বেড়েছে, আর গালাগালি দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমার দলের ছোঁড়াগুলো কেমন যেন একটু বেগড়বাই করছে, কোন-না-কোন দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে চাইছে। যাক, চলে যাক, আমি ওসবের মধ্যে নেই।

বড়দাটা তবু এক রকম, ওর চরিত্র লোকে জানে, কোন গুণেই ঘাঁট নেই, দল করে, টাকা মারে, চোরাই ব্যবসা করে, সবরকম আছে। মেজদা কেন গরীবদের নেতা, ওর জোচ্চোরিও তো অনেকখানি। চাকরি করতে গেলে, সাহেব আলাদা মানুষ—এই সেদিনও খবর পেয়েছি, কোম্পানি আটাশ বিঘা জমি কিনেছে, জমির যারা মালিক ছিল, সেইসব গরীবদের টাকা ওর হাত দিয়েই পেমেন্ট হয়েছে, বিরাশি হাজার টাকা থেকে আট হাজার টাকা কম নিতে হয়েছে সবাইকে। ও নিজে কিছুই করেনি, ওর কেরাণীবাবুই, মানে শিখার এক দাদা, সব ব্যবস্থা করেছে, আর গরীবরা টাকাটা তাড়াতাড়ি পাবার জন্যে আট হাজার টাকা ছেড়েই ভাগাভাগি করে নিয়েছে, খবর আমার সব জানা। আর এখানে দেখ, ধুতি পাঞ্জাবি পরে, রাজনীতি করছে, তাও আবার গরীবদের দল। ঘরের আলমারিতে গিয়ে দেখ, স্কচ হুইস্কির বোতল লুকানো রয়েছে। এখন আবার বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাকি, পুরো রাজনীতিই করবে, ইলেকশনা দাঁড়াবে, উহ্‌রে স্‌সাহ্‌, আরো মারাত্মক।

তা যা খুশি তাই করুক গে, আমার দেখবার দরকার নেই, তবে ওই গরীব কথাটা ওদের মুখে শুনলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। গরীব তো শিখার দাদার মত লোকেরা, যারা আসলে বুলি আর তেল দেওয়া, নচ্ছারিপনা ভাল জানে, জানি গরীবের থেকে ওরা সেটাই বেশী পারে, আর এদের দিয়েই বড়দা মেজদার দল চলছে, আর আসলি আদমিরা সব জাহান্নামে চলে গেছে। তা হলে বাবাও তো একরকেমর নেতাই ছিল, একজন—কী বলে এদের খবরের কাগজে—আমলা, হ্যাঁ আমলা, মস্ত বড় সরকারী আমলারা যেমন ঘুঘুদের দিয়ে কাজ চালায় সেইরকম। একবার জেকে বসতে পারলেই হল একটা উঁচু জায়গায়, তখন তাকে সরাও দেখি, সে তখন নেতা, বাবার মতন একটা বড় আমলা। সবাই তখন তাদের মানে, ভয় পায়, কারণ তখন তারা বেশ জমিয়ে বসেছে, যেমন কেশব আর পূর্ণেন্দু। তা যা খুশি তাই করুক গে, আমি দেখতে চাই না, তবে আমার পিছনে লাগতে এলে, আমি ছাড়ব না। তোমরা সব ভাল, আর আমি খারাপ, স্‌সাহ্‌ খচ্চর। তাই দেখেছি, দু’দলই এখন আমার পিছনে লাগছে, যেন ওরা হল, কী বলে, সুপ্রীম—সুপ্রীম, ওদের কবজায় থাকতে হবে, যা-ই করি না কেন।

এ সবের জন্যে আমি ভাবি না, এ সবে আমার কোন কষ্ট হয় না, কিন্তু শিখা—এই শিখাকে নিয়ে এই অসহ্য একটা কষ্ট, একটা জঘন্য ঘেন্না আর রাগ, অথচ ছেড়ে যেতে পারি না, কেন তাও জানি না, এই একটা ভূতুড়ে ব্যাপার আমাকে যেন ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে চায়। আমি জানি না, কেশবের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক, পূর্ণেন্দুর সঙ্গে কী সম্পর্ক, অনিলের সঙ্গে কী সম্পর্ক, ওরা মৌমাছির মত এখানে এসে জমেই বা থাকে কেন। অবিশ্যি, আরো অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, সেটা তো আমি জানি, আমার তো খাল শিখাই না, তবু আমি শিখাকে ছাড়া তো আর ভাবতেই পারি না—মানে শিখাকে পেলে, আর কাউকেই চাই না—জানি না, এটা আমার মিথ্যা কথা কিনা, কেননা, মঞ্জরী বলে যে মেয়েটার সঙ্গে মিশি, ওকে দেখলেই তো মনে হয় দিনরাত চটকাই, তবু শিখার ব্যাপারটা একদম আলাদা মনে হয়। আর আমার অন্য মেয়েদের ব্যাপারের মত যদি শিখার অন্য ছেলেদের ব্যাপার হয়—অসম্ভব, তার চেয়ে মেরে ফেলাই ভাল। একটু আগে, আমি জানি না, ওকে কী করতে যাচ্ছিলাম, হয়তো মেরে ফেলতেই চাইছিলাম, অথচ পারি না, আর এসব কিছু ঘটলেই, আমার সেই কথাটা মনে হয়, দিশেহারা হয়ে যাই, আর মনে হতে থাকে, ‘কেন, আহ্, জঘন্য ব্যাপার, কেন আমি এসেছিলাম এই পৃথিবীতে ‘ এখন আমার সেই কথাটাই মনে হচ্ছে, কুকুর বেড়ালরা যেমন জানে না, তারা কেন এসেছে, আমিও তেমনি জানি না—না না, বাবা মায়ের জন্যেই আসা সেটা বুঝি, কিন্তু আমিই কেন—আমি এই সুখেন্দু-টুকু-আমিই কেন, যে জন্যে বাবার কথাও মনে পড়ে যায়, সে কথা কেউ বলতে পারে না, অথচ এই যে এসব যন্ত্রণা, আমাকেই ভোগ করতে হচ্ছে।

শিখা এখন আর আসবে না, আর এই চারদিকে নিঝুম চুপচাপ ঘরটাতে, এসব কথা আর ভাবতে পারি না। মনে হচ্ছে, কোথায় দু-একটা পাখী ওরকম চিকপিক করে ডেকে উঠছে, গিয়ে গলা টিপে দিযে আসি, কেননা, ঠাট্টার মতন লাগছে। আসলে আবার শিখাকে পাবার ইচ্ছাই মনের মধ্যে জাগছে, কারণ নিজের এই কষ্টটা তা নইলে যেতে চায় না, এই যে দিশেহারা একটা ভাব—তার চেয়ে যাই, কোথাও গিয়ে কষে খানিকটা মাল টানি। সেই চেয়ারটার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, একটু নড়তে পর্যন্ত ভুলে গেছি। বেলা যে বেড়েছে, বোঝা যাচ্ছে, ঘরের আলোটা বেড়েছে, তবে ঘরটার আশেপাশে এত গাছ আছে, যেন তাদের ছায়াও দেওয়ালের কোথাও কোথাও পড়েছে। যেখানে প্রজাপতিটা মার খেয়ে পড়েছিল, সেইদিকে একবার তাকিয়ে, আমি দরজার দিকে পা বাড়ালাম। তখনই, দরজায় শিখাকে আবার দেখা গেল, আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, ওর হাতে এক কাপ চা। ও আমার দিকে তাকালো না, সোজা এল, টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রাখলো, কিন্তু চলে গেল না, টেবিলের কাছেই মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। ওকে দেখে এখন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, অন্ততঃ জামা-কাপড়ে যে, ওকে একটু আগেই কীরকম চেয়ারে ফেলে চটকানো হয়েছে। তেমনি চুল খোলা, শিকের গরাদ আলগা আলগা জামা, গোলাপী গোলাপী আঁচলটা পিছনে ফেলা। কেবল, এইটুকু বোঝা যাচ্ছে, ওর রাগ হয়েছে, কথা বলবে না, গম্ভীর আর ভার।
কিন্তু ও আমার জন্যে চা করে নিয়ে এসেছে এই দেখে, এই মনে হতেই, আমার একটা কষ্ট আর আনন্দ দুই-ই হল—জানি না, কষ্ট আনন্দ, দুই-ই এক সঙ্গে কী করে হয়—অথচ এর মধ্যে একটা অন্যরকম খচখচানিও আছে, কেন ও সব ব্যাপারটাকে এত সহজ করেই বা ফেলতে চায়।

আমি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, পিঠে হাত রাখলাম, ও মুখটা একটু ফিরিয়ে ওর বড় বড় চোখে আমাকে একবার দেখল, রাগ আর দুঃখ মেলানো থাকলে যেরকম হয় অনেকটা সেইরকম চাউনি। আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘চা।’

আমি দু’ হাত দিয়ে ওকে আমার দিকে ফিরিয়ে নিলাম,আর আলতো করে ঠোঁটে একটা চুমো খেলাম, ও আবার বললো, ‘চা খেয়ে নাও।’ আমি আরো বেশী করে জড়িয়ে ধরে, ওর ঠোঁটের দিকে তাকালাম, যেখানে একটু আগেই রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল। এখন আর একটুও রক্ত নেই, নিশ্চয় ধুয়ে এসেছে, বললাম, ‘আমাকে একটু চুমু খাবে?’

‘না।’

‘খাও না, প্লীজ!’

ও একবার আমার চোখের দিকে তাকালো, তারপরে মুখটা তুলে আমার নিচের ঠোঁটে চুমো খেল, তখন ওর ওপরের ঠোঁটটা আমার মুখের মধ্যে। একটু পরেই, ঠোঁট খুলে নিয়ে আবার বললো, ‘চা খেয়ে নাও, ঠাণ্ডা হচ্ছে।’

কিন্তু এখন আর আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে না, ওকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু পাছে ও আবার চলে যায়, তাই প্রায় এক ঢোকে চা খেয়ে নিলাম। নিয়ে কাপটা রেখে ওকে যখনই ফিরে ধরতে যাব, এমন কি মনে মনে দরজাটা বন্ধ করে দেবার কথাও ভেবেছি, তখনই ও বলে উঠলো, ‘তুমি একটা সর্বনাশ না করে ছাড়বে না, না?’

জবাব দেবার আগেই, আমি ভাবতে আরম্ভ করি, এ কথা বলছে কেন, আর ও এভাবে কথা বললেই এমন একটা ভাব করবে, যেন ও আর শিখা নেই। আমি ভুরু কুঁচকে তাকাতে ও নিজেই বললো, ‘তুমি তোমার ওই শুটকা বাঁদরটাকে বলেছ, কেশবদা এক জায়গায় দুশো কুইন্টল চাল আর একশো পাউন্ডের মত বেবী ফুড লুকিয়ে রেখেছে?’

আবার সেই কেশব পূর্ণেন্দু। বললাম, ‘কেন, মিথ্যা কথা বলেছি নাকি?’

‘সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, তোমার এসব কথা বলবার দরকার কী। তোমাকে আমি কতদিন বলেছি, তুমি এসবের মধ্যে থাকবে না। লোকে তোমাকে আগে খারাপ বলবে, ওদের বিচার পরে করবে, লোকদের তুমি জান না?’

তার মানে, আমি তো গুণ্ডা, তাই একথা শিখা বলছে, আর কথাটা মিথ্যাও বলেনি, কারণ আমার ওদের মত রাজনীতির দল নেই, আমি নেতা না। কিন্তু একথা ভাবলেই, আমার মাথায় রক্ত উঠতে থাকে। আমি বললাম, ‘ওসব আমি মানি না। জানি, তাই বলেছি। আমার পেছনে ওরা লাগতে আসে কেন।’

শিখা মাথা নাড়তে নাড়তে, কেমন একরকম কষ্ট লাগার মত গলায় বললো, ‘না না, এসব করো না, মানতে তোমাকে হবেই। তোমাকে এত করে বলছি তুমি এসবের মধ্যে যেও না। তুমি শুটকাকে বলেছ, শুটকা আবার সে-সব পূর্ণেন্দুদাদের দলের কাকে বলেছে, কেশবদ একেবারে ঝড়ের মত আমার কাছে ছুটে এসেছে। কাল রাত্রে বলে গেল, টুকুকে সাবধান করে দিও, ও সাপের গায়ে পা দিতে যাচ্ছে, ভাই বলে পার পাবে না।’

আমি শিখার দিকে চেয়ে বললাম, ‘তোমাকে বলতে এল কেন?’

শিখা ভুরুটা তুললো এমনভাবে, আর চোখ দুটো একটু বড় করলো, যেন খুবই অবাক হয়েছে। বললো, ‘তোমার নামে সব নালিশ তো আমাকেই শুনতে হয়। কেশবদা, পূর্ণেন্দুদা সব নালিশ তো আমাকেই করে, নতুন নাকি?’

আমি জানি তা, তবু আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ভাবি, কেন, ওরা দু’জনে দু দলের হয়েও কেন শিখার কাছেই ছুটে ছুটে আসে। অবিশি, জানি, আমার কথা শিখাকে বললে, ঠিক আমার কানে আসবে, হয়তো সেই জন্যেই বলে, কিন্তু যারা নিজেরা দলাদলি করে, তারা কেন এই একটা মেয়ের কাছেই আসে। এ সময়ে শিখার একটা কথা আমার মনে পড়ে যায়, ‘পুরুষেরা সবাই এক, মেয়েদের কাছে ওদের চাইবার আর কিছু নেই। অবিশ্যি জানি না, চাইবার কী থাকতে পারে, পুরুষদের কাছেই বা মেয়েদের কী চাইবার থাকতে পারে, একখানি জিনিস ছাড়া; তবু আমার মনের মধ্যে গোলমাল হতে থাকে।

শিখাও আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল, আর তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, কাছে—আমার খুব কাছে এসে বললো, ‘কী, ওরকম তাকিয়ে রইলে যে? সবাই ভাবে, আমি তোমাকে সব কথা বলতে পারব, তুমি আমার কথা শুনবে, তাই আমাকে সব বলে।’

আচ্ছা, শিখা কি বেশ্যা নাকি, যেরকম থাকে না, অনেক পুরুষের সঙ্গেই লেনদেন, কিন্তু নিজের একটা আলাদা পেয়ারের লোক থাকে, কী যেন একটা বলে তাকে—আমি কি সেইরকম নাকি। কিন্তু তা ভাবতেও আমার ইচ্ছা করে না, কেননা, ভাবভঙ্গি তো সেরকম না, অথচ নাহ, সারা জীবনে বোধহয় এর জবাব পাওয়া যাবে না। আমি বললাম, শুটকা যে বলেছে, কেশবকে সে কথা কে বললো। আমি তো শুটকাকে বলতে বারণ করেছিলাম।’

‘তা আমি কী করে জানব, কেশবদ শুনে এসে, আমাকে বলতে এসেছিল। দেখলাম, চোখমুখ লাল; বলেই চলে গেল।’

‘ওহ্‌, তাই বড়বাবু কাল সারা রাত বাড়ি ফেরেনি, ভোর রাত্রে ফিরেছে, তার মানে চোরাই মাল আর বেবীফুড আবার অন্য জায়গায় পাচার করে দিয়েছে।’

বলতে বলতে স্‌সাহ্‌, দারুণ হাসি পেতে লাগলো, কিন্তু শুটকা, শুটকা হারামজাদা তো গোলমাল আরম্ভ করেছে। আমি বললাম, ‘শুটকা শুয়োরের বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না। ও স্‌লা মেজদাদের দলের সঙ্গে হব্‌নব্‌স্‌ আরম্ভ করেছে।’

শিখা বললো, ‘ঠিকই করেছে, শুটকা কাজ গোছাচ্ছে, যে কোন একটা দলে তো যেতেই হবে, তাই পূর্ণেন্দুদাদের দলে চলে যাচ্ছে। তোমার মত বোকা নাকি কেউ, তোমাকেও একটা দলে চলে যেতে হবে; তা নইলে টিকতে পারবে না। তা না, তুমি আবার পূর্ণেন্দুদার নামে কী সব বলেছ, কোম্পানীর টাকায় কেনা জমির টাকা মেরেছে, না কী করেছে।’

‘তা তো মেরেছেই, তোমার দাদা তো সবই জানে, ওর হাত দিয়েই হয়েছে।’

‘হোক, সে কথা তোমার বলার দরকার কী।’

‘না, আমি বলছি, ও এত হাজার হাজার টাকা মাইনে পায়, গায়ে আঁচড়টি লাগে না, ও কেন গরীবদের নিয়ে রাজনীতি করে।’

‘ওসব পুরনো কথা, তোমার মুখে অনেক শুনেছি, কিন্তু পূর্ণেন্দুদা একজন নেতা, সে ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারে, শুধু তা না, তুমি ওদের দলের রমেশকে নিয়েও নাকি যা-তা বলেছ।’

‘কে রমেশ?’

‘কেন, যে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে আছে, কেরানী—’

‘ও, সেই মোটা কাচের চশমা, সব সময় কাটি দিয়ে দাঁত খোঁটে, আর শকুনের মতন এদিক ওদিক তাকায়?’

‘সে সব আমি জানি না, তুমি রমেশের নামে বলেছ, “এই সাব-ডিভিশনের প্রাথমিক শিক্ষকদের কত হাজার টাকা গভর্নমেন্টের কাছে পাওয়ানা ছিল, সেই টাকা থেকে সে টাকা মেরেছে। আবার এ সব লোকেরা মিছিলে বেরোয় কী করে জানি না।” বলেছ তুমি?’

‘হ্যাঁ, বলেছি তো, প্রমাণ করে দিতে পারি, আমাদের এখানকার প্রাইমারী ইস্কুলের হেডমাস্টার নিরাপদবাবুই বলবে, আট মাস শুধু শুধু দেরী করেছে টাকাটা দিতে। অথচ সব রেডি হয়ে পড়েছিল, তারপরে যখন আড়াই হাজার টাকা মাস্টাররা ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছে, তখন চেক পাস হয়েছে।’

‘প্রমাণ আবার করবে কী করে, লেখাপড়া আছে নাকি কিছু।’

‘কেন, নিরাপদবাবু বলেছেন; উনি কোনদিন মিথ্যা বলেন না।’

‘ওটা বুঝি প্রমাণ হল, কী যে ছাই বল না। নিরাপদবাবুই বা কীরকম লোক, ওঁরা ছাড়লেন কেন?’

‘পেটে যে ইঁদুরে ডন মারছিল ওদিকে।’

শিখা হেসে ফেললো, হঠাৎ আর কথা যোগালো না মুখে। আমি আবার বললাম, ‘ওরা আমাকে তো গুণ্ডা বলছে, ওরা কী? ওরা কি সত্যি সত্যি গরীবের দল করে? সেই সব আসল গীরবেরা কোথায়, কোনদিন দেখেছ? সব তো ওরাই।’

‘না, সবাই তো আর পূর্ণেন্দুদা বা রমেশ না।’

‘সে তোমার, লোম বাছতে কম্বল ফাঁকা হয়ে যাবে।’

শিখা প্রায় ভুরু কোঁচকাতে যাচ্ছিল, আমি একটা খিস্তি করতে যাচ্ছি ভেবে। আমি আবার বললাম, ‘আরে গুণ্ডা বলে তো কানা না, দেখগে, গরীবেরা নিজেদের মতই আছে, এরা ফাটাফাটি করে যাচ্ছে।’

শিখা ওর খোলা চুলে ঝাপটা মেরে মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘করুক, তুমি কিছু বলতে পারবে না। তুমি বলার কে?’

তার মানে, এটা ওর রাগ না, মাথা ঝাপটানো মানে ঝগড়া না, ও আমাকে বকছে, মানে, আছে না একরকম, ভাব থাকলে যেমন জোর করে বলা যায়, সেইরকম যে কারণে, এখন ওর চোখ দুটোর চাউনিও কীরকম হয়ে গেছে, একটু বাঁকা বাঁকা। বললাম, ‘ওরা আমাকে যা-তা বলে কেন। বলবেই তো,তুমি তো যা-তাই-ই,তুমি ভাল নাকি। আর তা নইলে,তুমি ওদের কারুর একজনের দলে চলে যাও।’

কথাটা বলে, একটু একটু হাসতে থাকে শিখা৷ আমি বললাম, ‘গেলে কী হবে?’

‘তবু তোমার একটা দল থাকবে। তোমাকে একটা দল বাঁচাবে।’

বলতে বলতে শিখার মুখটা কীরকম হয়ে গেল। আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে, ও অন্যদিকে কীরকম আনমনাভাবে তাকিয়ে রইল, আঙুল দিয়ে আমার বুকের বোতামের কাছে একবার ছুঁয়ে দিল, আমার কোমরের বেল্ট একবার ছুঁয়ে দিল, বললো, ‘না সুখেনদা, শোনো, তুমি সব ব্যাপারগুলোকে এভাবে নিও না, প্লীজ, তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ না, দিন দিন কী রকম অবস্থা হয়ে উঠছে, তুমি সবাইকে শত্রু করে ফেলছ, দু’দলই তোমার ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে, আমার ভাল লাগছে না।’

ওর এ কথাগুলো শুনে আমার যেন ভিতরে কীরকম একটা হতে থাকে, ঠিক কী, তা বুঝতে পারি না, কেবল মনে হয় ঘাড়ের কাছে কোথায় যেন একটা শিউরোনি শিউরোনি ভাব লাগে। ওরা আমার কী করতে পারে, তা জানি না, তবে হ্যাঁ, ওদের দল বড়, আমার কেউ নেই, কিন্তু ওরা কী করতে পারে আমার! মারলে, খুন করবে—কেননা, শিখা যেভাবে বলছে, এটা ঠিক ও বোধহয় সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন যাব ওদের দলে। আমার থেকে কেশব পূর্ণেন্দু কিসে ভাল, আমি বুঝতে পারি না, অথচ দল আছে বলে, ওদের তবে থাকতে হবে, কেন—ওরা কি আকাশ নাকি, মাটি নাকি, যার তলায়, যার ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। যেমন বলে, ঈশ্বরের বিধান মেনে নিতে হবে, সেইরকম নাকি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কোন দলে?’

শিখা অবাক হয়ে বললো, ‘আমি কোন দলে? আমি কোন দলে নেই, একটা সাধারণ মেয়ে, শিখা মজুমদার!’

‘আমিও তো একটা ছেলে, সুখেন্দু—।’

‘না, তুমি তা নও, তুমি কি সাধারণ নাকি। তোমাকে নিয়ে লোকের মাথাব্যথা, তোমাকে সবাই অন্য লোক বলে চেনে।’

তা ঠিক; আমি হলাম এ শহরের একটা গুণ্ডা, বড় মাস্তান, আমার অনেক রোয়াব, অনেকেই আমাকে মানে। আমাকে ওদের দলের লোকেরা মানে না ঠিকই, কিন্তু অনেকেই মানে। আমাকেও অনেকের দরকার হয়, যেমন কারখানায় বড়দা, মেজদার দু দল থাকলেও চোপরা আমাকে আলাদা ডেকে, বিশেষ বিশেষ লোকের কথা বলে, কেননা, চোপরা পৃথিবীর কাউকেই বিশ্বাস করে না। দরকার হলে কারখানার যে কোন লোককেই শায়েস্তা করতে যাই আমি। তবে আমার হল মাস্তান দল, আমার রাজনীতি নেই। শিখা ঠিকই বলেছে, আমি একটা ছেলে মাত্র না। ও যেমন বললো, ও একটা সাধারণ মেয়ে, কোন দলে নেই, আমি ঠিক তা না। আচ্ছা, আমি যদি একটা সাধারণ ছেলে হয়ে যাই, কোন দলেই যাব না—ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল আমার, আর হাসতে হাসতেই বললাম, ‘তা হলে আমিও তোমার মত সাধারণ একটা ছেলে হয়ে যাই, কোন দলেই যাব না।’

শিখা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন অবাক না, হাসি না, কেমন একটা আনমনা আনমনা ভাবে। যেন কথাটা বুঝতেই পারেনি। বললো, ‘কী করে হবে?’

‘তা কী জানি।’

‘আমি জানি।’

‘বল।’

‘চাকরিবাকরি করবে—!’

‘সে তো মেজদাও করে।’

‘মেজদার মত না, শোন-না আমার কথা, তুমি সাধারণ লোক দেখনি? চাকরিবাকরি করে, খায়-দায়, বিয়ে করে, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।’

অবিশ্যি ভাবতেই পারছি না তা, কী করে ওরকম হওয়া যায়। তারপরে হয়তো শিখা বলবে, ঘাড়ে গদানে পাউডার দিয়ে, পান চিবুতে চিবুতে, রোববারে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। দুপুরে তাশ পাশা খেলা, সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরেই খাটুনির কেলান্তিতে কেলিয়ে পড়ে থাকা। ছেলেমেয়ের চ্যাঁ ভাঁ নিয়ে হাড় কালি করা, উহ্রে স্‌সাহ্‌, গা ঘিনঘিনিয়ে উঠছে। তবে হ্যাঁ, ওদের দলে না গিয়ে এটাও ভাল—জেনেশুনে ওসব করতে পারব না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তখন ওদের খারাপ ব্যাপারগুলো বলতে পারব তো?’

শিখা বললো, ‘না। তা বলতে পারবে না।‘

‘বাহ, তা হলে সাধারণ লোক হয়েই বা লাভ কী?’

শিখা ভুরু বাঁকিয়ে তাকালো, বললো, ‘না, তোমার দ্বারা ওসব হবে না। আর তুমি যদি সব ছেড়েও দাও, তা হলেও ওরা তোমাকে কোনদিন বিশ্বাস করবে না, শহরে কিছু একটা ঘটলেই, তোমার কথা ওদের একবার মনে হবেই। কিন্তু তুমি কেন একটা সাধারণ ছেলে হলে না।‘

এমনভাবে শিখা বলছে, যেন আমি সুখেন্দু না হয়ে কেন নিরাপদবাবু হলাম না। এমনভাবে হাত ঝাঁকানি দিয়ে মুখটা এমন ভাব করে বললো, যেন তাতে ওর কষ্ট হচ্ছে। অথচ আমার ভীষণ হাসি পেয়ে গেল, আমি ওকে দু হাতে জড়িয়ে কাছে নিলাম, আর পায়রার মত ওর বুকটা ফুলে উঠলো, যেন ওরই চিবুকটা প্রায় বুকে ঠেকবে। ঠোঁট দিয়ে ওর একটা কানে ছুঁইয়ে দিলাম। ও কিন্তু মাথা নেড়ে আবার বললো, ‘না না, তুমি জান না, আমার এ সব কিছুই ভাল লাগছে না, আচ্ছা, সত্যি তুমি কি—।

আমি ওর ঠোঁটে আস্তে চুমো খেলাম, ও আবার বললো, ‘সত্যি, তুমি কি সব ছেড়ে ছুড়ে একটা সাধারণ ছেলে—।‘

‘চেষ্টা করব।’ বলে, এবার অনেকক্ষণ ধরে খেলাম, আর ভাবলাম ওকে যে তখন রেগে গিয়ে এত কষ্ট দিলাম, সে বিষয়ে ও একটা কথাও বললো না। খালি এসব কথাই বললো। আর এখন যেন ও কী রকম নরম তুলতুলে হয়ে উঠেছে। আমি ওকে মেঝে থেকে তুলে ফেললাম গায়ের ওপরে, কোণের চৌকিটার কাছে নিয়ে গেলাম। শোয়াতে চাইলাম, কিন্তু ও জোর করে বসে বললো, ‘না, দিদি এসে পড়তে পারে, অনেক বেলা হয়েছে।’

‘দরজাটা দিয়ে আসি।‘

‘না, এখন না, তুমি একটা কী?’

বলে, চোখের দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন কী একটা কথা বলছে, আর তখনই আমার মনে পড়ে গেল, হুম, অসুবিধা আছে। তাই উঠে পড়ে ডান হাতের কব্জিতে ঘড়ি দেখে নিজেই চমকে উঠে বললাম, ‘উহ্‌রে, বারোটা বেজে গেছে। চলি, ওবেলা আসব।‘

বলে দরজার দিকে যেতে যেতে শুনলাম, শিখা আবার বলছে, ‘আমার কথাগুলো একটু মনে রেখো।’

আমি কোন জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম। বারান্দা দিয়ে ওদের বাড়ির বেড়ার কাছে গিয়ে যা ভেবেছিলাম তা-ই, মোটরবাইকটার ওপরে রোদ পড়েছে। যখন রেখেছিলাম, তখন ছায়া ছিল। হ্যাণ্ডেলে হাত দিতে গিয়েই একবার থমকে গেলাম, একটা প্রজাপতি উড়ে গেল হ্যাণ্ডেলের ওপর থেকে। কী জানি, আমার হ্যাণ্ডেলে বসে কী করছিল ওটা—দেখছি, শিখাদের পাড়ায় মেলাই প্রজাপতি। হাত বাড়িয়ে একবার ধরবার চেষ্টা করলাম, পালিয়ে গেল। এটা একটু হলদে হলদে মতন। মোটরবাইকটা ঠেলে, কেরিয়ার থেকে নামিয়ে, টিনের ঝাপের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে গেলাম, আর পা ঠুকে স্টাট দিতেই গোটা পাড়াটা যেন চমকে উঠলো। লোকেরা নিশ্চয় বলাবলি করছে, ‘গুণ্ডাটা যাচ্ছে।‘

শহরের ঘিঞ্জিতে এসে প্রথমেই গেলাম পেট্রল পাম্পে, পাঁচ লিটার তেল দিতে বললাম। পাম্পের মালিক মণ্ডলকে দেখা গেল, ঘরের ভিতর কাচের মধ্য দিয়ে আমাকে দেখছে। তেল ভরতে ভরতেই, লোকটা খালি গায়ে, খালি পায়ে, গাবদা শরীরটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এল। আসবে জানতাম—মেলাই টাকা আমার কাছে পাওয়ানা হয়েছে কি না। আশ্চর্য, লোকটা হিসাব কেন রাখে বুঝতে পারি না—চুরি করার এত ফন্দি জানিস, তবু আমাদের কাছে তাগাদা! এসেই গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘সাড়ে তিনশো টাকার ওপর হয়ে গেল কিন্তু।‘

আমি ট্যাংকের মুখ বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘তাতে কী হয়েছে, সেদিন যে আপনার সেই খচ্চর ভাড়াটেটাকে পেছনে লেগে উঠিয়ে দিলাম, সাত বছর ধরে তো পারছিলেন না, আমাকেই তো ডেকে নিয়ে গেছলেন।‘

‘তা ঠিক, তা ঠিক, তোমরা না হলে কি ওসব লোক সজুত হয়, তবে— ‘

‘তবে আবার কী, লোকটা ছিল সত্তর টাকায়, এবার তো দেড়শো টাকায় ভাড়া দিয়েছেন—ডবল যাকে বলে।‘

বলে আমি স্টার্ট দিলাম, মণ্ডল বললে, ‘তা ঠিক—তবে—।‘

‘ইচ্ছে হয় তেল দেবেন, না হয় দেবেন না।‘

স্‌সাহ্‌, মুখটা আমার পাথরের মত হয়ে যাচ্ছে, আমি চলতে আরম্ভ করলাম, আর পিছনে শুনতে পেলাম, ‘ন না, তা বলছি না…’

কী বলছ তুমিই জান স্‌লা। ই কি মাইরি, একটা কৃতজ্ঞতা বলে কথা নেই। একটা নিরীহ লোককে বিপদে ফেললাম ওর জন্যে—অবিশ্যি নিরীহ কি না জানি না, তবু এই মণ্ডলের থেকে ভাল। বাড়ি ভাড়া কোনদিন বাকী ফেলেনি লোকটা, পাড়ার লোকেরা খারাপ বলেনি। কোনরকম এদিক ওদিক ছিল না—এক-একজনের যেমন থাকে, পাড়ার মধ্যে একটু গেরামভারি চাল, একটু হিড়িক মেরে চলা, সেরকম কিছু না। এমনও না যে, লোকটার দু’ চারটে বড়সড় মেয়ে আছে, যাদের জন্যে পাড়ার ছোঁড়ারা দিন-রাত্রি হিড়িক দিচ্ছে, রক আর আশপাশ ছেড়ে নড়ছে না, যাতে মেয়েগুলোকে ঢলানে বলে, বাপকে তাড়ানো যায়। তবু লোকটার পিছনে লেগে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি, কেননা, মণ্ডলের আরো মোটা টাকার ভাড়া চাই। আর বেইমানটা বলে কিনা, পেট্রলের অনেক টাকা বাকী পড়ে গিয়েছে। বাকী পড়ল কী করে চাঁদ, এতদিন কাজ বাগাবার মতলবে ছিলে, তাই টাকার কথাটা মনে করিয়ে দিতে চাওনি। এখন হাসিল, এখন তাগাদা–দিচ্ছি তোমাকে টাকা। এই শহরে করে খেতে হলে আমাকে তেল না দিয়ে তোমার উপায় নেই, তোমার চোরাই পথের ঠিকানা আমার জানা আছে। যাক গে এসব কথা, তেল ওর বাবা দেবে—কিন্তু—আচ্ছা আমি ভাবছি, সত্যি, আর দশটা সাধারণ লোকের মত আমি না-ই বা হব কেন, হওয়াটা কি খুবই কঠিন। এই চাকরিবাকরি করলাম, একটা বিয়ে—কিন্তু শিখাকে ছাড়া তা হবে না, বিয়ে করতে হলে ওকেই চাই। বেশ, ওকেই বিয়ে করলাম….দেখ দেখ স্‌সাহ্‌, গরুর গাড়িটা কীভাবে আসছে, আর একটু হলেই ওই কাঠের চাকায় ধাক্কা লাগতো, আর একেবারে উল্টে গিয়ে নর্দমায় পড়তাম। আমি একটা চিৎকার করলাম, ‘হে-ই স্‌সাহ্‌ বয়েলগাড়ি!’…

বললে কী হবে, গাড়ি টানছে বলদে, চালাচ্ছেও বলদেই, তা নইলে এই বেলা বারোটায় কেউ গান গাইতে গাইতে যায়। তার ওপরে যেমন রাস্তার ছিরি, ঠিক চোট্টা চেয়ারম্যানটার মতই খুবলানো গা, সেটা আবার কেশবের দলের লোক। এইসব মফস্বল শহরের মিউনিসিপালিটির কোন চেয়ারম্যান সম্পর্কে আজ অবধি আমি ভাল কথা শুনিনি। আর দু একটা ভাল লোক, যাদের কথা শুনেছি, যেমন ডাক্তার গঙ্গাপদ রায়, বিচ্ছিরি সোজা আর সাচ্চা লোক, একটু ন্যালাখ্যাবলা মত আছে। ছারপোকার মত ডাক্তার না যে, খালি রুগীর ট্যাকের দিকে নজর, বরং লোকটাকে জগ দেয় অনেকেই, তাকে একবার সবাই মিলে চেয়ারম্যান করেছিল, আর গঙ্গাপদ ডাক্তার ছ’ মাসের মধ্যেই কাছা খুলে পালিয়ে এসেছিল, যেন জীবনে এমন ভয় সে আর কখনো পায়নি। বলেছিল, ‘মাথা খারাপ, ও সব কাজ করতে গেলে যে পাঁচ-পয়জার জানা থাকা দরকার, সে এলেম আমার নেই। আমি চুরি করতে পারব না, করতে দিতেও পারব না, তার চেয়ে বাবা তাঁতীর তাঁত বুনে খাওয়াই ভাল। তার মানে, গঙ্গাপদ ডাক্তারকে নিরীহ লোক ভেবে, তাকে সামনে রেখে, যে যার গোছাবার তালে ছিল। ব্যাপার দেখে, ডাক্তার দে দৌড়, বোধহয় চোর ধরিয়ে দিতেও পারবে না, অথচ নিজেকেও দলে থেকে যেতে হবে, এই সব দেখেশুনে, কেটে এসেছে। আচ্ছা, কেন এরকম হবে, আমি বুঝতে পারি না, মিউনিসিপালিটির টাকায় গড়বড় হবেই, চেয়ারম্যানের নিজের পাড়ার রাস্তা ভাল হবেই, দশটার জায়গায় কুড়িটা লাইট পোস্ট হবেই, আর বাদবাকী সব গোল্লায় যাক, যেন বাপের জমিদারিতে এসে বসলেন উনি। দেখ দেকিনি শহরের রাস্তার ছিবি—যেখানে হাত দেবে চোরের উৎপাত—তবে কি না, লোকগুলো ভদ্দরলোক, আমার ইয়ে। শুটকা হারামজাদাটা এখন কোথায় আছে কে জানে, ওকে আমার চাই—এই যে, থানার বড়বাবু, ভ্যানের মধ্যে, ড্রাইভারের পাশেই বসে আছে, ‘হ্যাল্লো স্যা—! আমি হাত তুললাম, লোকটা কোনরকমে একবার হাতটা নাড়লো মাত্র, ভুরুটা তুললো একবার, যেন হাতে কুষ্ঠ হয়েছে, ঠুটো জগন্নাথ, ওর বেশী তোলা যায় না! তা না, আসলে শহরের রাস্তায় দশজনের সামনে গুণ্ডাটাকে বেশী খাতির দেখানোটা ঠিক হবে না, তা-ই। আমার বয়েই গেল, যাক গে, ওটাও ভদ্দরলোকের চুক্তির মধ্যেই পড়ে, কেউ কাউকে ঘাঁটাবে না, ডিসটর্ব করবে না ….এটা আবার কী হচ্ছে, বেলা বারোটার পর। মোড়ের মাথাতেই, গাড়ি ঘোড়া থামিয়ে কাদের মিটিং হচ্ছে এটা। আর দেখতে হবে না, পূর্ণেন্দু—মানে মেজদাদের দল, রমেশ বক্তৃতা দিচ্ছে; ভাই, বন্ধুগণ, মহকুমা শাসকের এই জুলুমের জবাবে আমরা আগামীকাল আমাদের সমস্ত মহকুমাব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছি। আপনারা.। রাস্তাটা এমনভাবে জুড়ে দাঁড়িয়েছে সব, যাবার পথ রাখেনি একটু। দেখছি যশোদাবাবুর দলও আছে, কত দল যে আছে, যাক, তার মানে কাল হরতাল—কাল কী বার যেন—হ্যাঁ, বেস্পতিবার। আমি মেশিনটা বন্ধ না করে দাঁড়ালাম, শব্দে অনেকেই পিছন ফিরে তাকালো, আমি রমেশের দিকে তাকিয়েছিলাম—আর কেন জানি না, হঠাৎ কিছু লোক সরে পড়তে লাগলো। আমি রাস্তার পাশে, কয়েকটা দোকানের সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম, আর রমেশ তখন গলা আরো তুলে বলে উঠলো, ‘আমি জানি বন্ধুগণ, শহরের অসামাজিক লোকেরা গুণ্ডা এবং দালালেরা নানাভাবে আমাদের…।‘ তার মানে, আমাকে দেখেই আমার সম্পর্কেই বলছে, আমি রমেশের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতেই মেশিন বন্ধ করলাম, আর তখন একদল লোক আমার দিকেই বারে বারে তাকাতে লাগলো—যেন আমি একটা সঙের পেরু—কিন্তু আজ বুধবার এত বেলায় এ লোকগুলো কারা, যারা ভিড় করে আছে। তারপরেই দেখি, নিরাপদবাবু একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন, ওঁর মোটা কাঁচের চশমাটা প্রায় নাকের ডগায়, তাই রমেশকে দেখবার জন্যে মুখটা তুলেছেন প্রায় আকাশের দিকে, আর মুখটা কুঁচকে হাঁ-মুখটা এতখানি খুলে রেখেছেন, আর জিভটা বেরিয়ে পড়েছে, জিভটা নড়ছে এমনভাবে যেন উনিও কথাগুলো বলছেন, না কি ওভাবে গিলছেন, কে জানে। এমন সময়ে, কে যেন আমাকে ডাকলো, ‘সুখেনদা। পাশ ফিরে দেখলাম, একটা জুয়েলারির দোকানের ছোকরা আমাকে ডাকছে, বললো, ‘মোটর-সাইকেলটা রেখে দোকানে এসে বসুন না।‘ তার মানে, এ শুধু গুণ্ডার খাতির না, মেজদাদের দলের উপর রাগ আছে নিশ্চয় কোন কারণে, আর বুঝতে পারছে তো, রমেশ আমাকেই গালাগাল দিচ্ছে, তা-ই একটু দেখিয়ে দেওয়া। স্‌সাহ্‌ চোরাই সোনার কারবার করছে, আর খদ্দেরের মালে যত খুশি পান দিচ্ছে। আমি ঘাড় নেড়ে বলি, ‘না ভাই, এখন যাব।‘

বলে আমি আবার স্টার্ট দিই। ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে, একটু যেন কেমন ছানা কেটে যাওয়াই, আমি আবার রমেশের দিকে তাকালাম। ও কি নিরাপদবাবুকে দেখতে পাচ্ছে, আর নিরাপদবাবু কী ভাবছেন, আমার একটু জানতে ইচ্ছা করছে। এই রমেশই তো প্রাথমিক শিক্ষকদের পাওয়ানা টাকার থেকে টাকা মেরেছিল। অবিশ্যি জানি নাওদের অফিসারও সেই টাকা থেকে টাকা খেয়েছিল কি না। না খেয়ে কি আর সই করেছিল, ছাহেব কি আর তাঁর কেরানী বাবুদের ছেনেন না, তাও কি কখনো হয়। এমন কি অফিসের বেয়ারাটাও নিশ্চয় সে টাকার ভাগ থেকে বাদ যায়নি। ফাইল-টাইল সব তো আবার ওদের হাতেই থাকে, কোথায় কোনটা আছে, খোঁজ-খবর ওরাই ঠিক রাখে। আসল প্রস্তাবটা তো বেয়ারার মারফতই এসেছিল, নিরাপদবাবু তো সেভাবেই বলেছিলেন, ‘সেদিনও আশা ছেড়ে দিয়ে চলেই আসছিলাম, ভিখিরির মত মনে হচ্ছিল নিজেদের। হঠাৎ বেয়ারাটা বাইরে এসে বললে, “মাস্টেরবাবু, এতগুলো সরকারি টাকা কি আর এমনি এমনি বেরয়? আপনারা দাবী করলেন, বলতে গেলে মুফতেই তো পেয়ে গেলেন। কিছু যদি ছাড়েন-টাড়েন—মানে খুশি হয়ে একটু খাওয়ানো-টাওয়ানো আর কি, বোঝেনই তো কোন দেবতার কী পুজো, শুধু শুধু কেন এতগুলো টাকার চেক পড়ে থাকবে, রাজী থাকেন তো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” প্রথমটা ভাবলাম, লোকটা বদমাইসি করছে, এ কি কখনো হয়, যেখানে রমেশ রয়েছে, আমাদের আন্দোলন সমর্থন করছে, যে-আন্দোলনের জন্যে টাকাটা পাচ্ছি, সেই টাকার ভাগ দিতে গেলে রমেশই তো ক্ষেপে যাবে। বেয়ারার বেয়াদপিতে আমি গিয়ে রমেশকে সব বলে দিলাম, রমেশ আমনি অফিসারের নামে গালাগাল দিতে লাগল, তারপরে বললে, “তবে ও ব্যাটা যখন একবার তাল করেছে, তখন না ঝেড়ে সই করবে না। তা নইলে আরো দশ মাস ফেলে রাখবে।” “আরো দশ মাস ” “হ্যাঁ, একেই তো বলে লাল ফিতের ফাঁস, জানেন না? আঠারো মাসে বছর কি আর এমনি বলে। বেশি বললে দেখবেন চবিবশ মাসে বছর হয়ে যাবে, হেঃ হেঃ হেঃ….। তাই বলছিলাম, ও ব্যাটাকে যা দেবার দিয়েই দিন, নইলে ছাড়বে না, তারপরে দেখুন না, ওর বিরুদ্ধে তো শীগগিরই আমরা লড়াইয়ে নামছি, ওর অত্যাচার আমরা মুখ বুজে সইব না…. ” কিন্তু রমেশ একটা দলের লোক হয়ে যে টাকাটা দিতে বলবে, ভাবতে পারিনি। আর আমাদের তো জান, এদিকে আনতে ওদিকে কুলোয় না, আমরা মাস্টাররা সবাই মিলে ঠিক করে ফেললাম, নিয়েই নিই, নিয়েও নিলাম। কী জানি, বাবা, শেষে মূলে হা-ভাত হবে। সব দেখেশুনে কেমন যেন লাগে, ভিরমি যাকে বলে, কিছুই বুঝি না।‘…

মাস্টারমশাই এখনো যেভাবে রমেশকে দেখছেন আর ওর বক্তৃতা শুনছেন, তাতেও বোধহয় ভিরমিই খাচ্ছেন। দেখলাম, রমেশ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, ও বোধহয় একটা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখগুলো ধকধক জ্বলছে, ওর আশেপাশে আরো কয়েকটা চোখও ঠিক সেইরকম জ্বলছে, যেন আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। হঠাৎ আমার ঘাড়ের কাছে কী রকম শিউরে উঠলো—কীরকম একটা অস্বস্তি অস্বস্তি ভাবের। আমি এগিয়ে চলে গেলাম, রমেশ চিৎকার করে চলেছে—শিখার মুখটা আমার মনে পড়ে গেল, আর ওর কথাগুলো, কিন্তু—হ্যাঁ, আমি যদি একটা সাধারণ মানুষই হই—নিরাপদবাবুর মতন। আমরা তো ছেলেবেলার নিরাপদবাবুর কাছে পড়েছি, অনেকবার ওঁর বাড়িতে গেছি, তখন মাস্টারমশাই অন্যরকম ছিলেন, ওঁর গোঁফ ছিল, আর গোঁফের রঙ কালো ছিল, আর ওঁর বউ দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন। একটা ছোট বাড়ি, দু তিনটে ছোট ছোট ঘর, উঠোন জুড়ে গাদা কেষ্টকলির ঝাড়, তিনটে নারকেল গাছ—এখনো সেই বাড়িতেই আছেন—ওটা ওঁর বাবার বাড়ি। এখনকার নিরাপদবাবুকে দেখলে, সেই মাস্টারমশাইকে ভাবাই যায় না। ওঁর বউ খুব মিষ্টি মিষ্টি হাসতেন,সব সময়েই—অথচ মাস্টারমশাই কিন্তু বেশীর ভাগ সময় মুখটা ভার করেই রাখতেন, যেন রাগ রাগ ভাব, যে কারণে আমরা ভাবতাম, উনি খুব রাগী, আমাদের মত উনি নিশ্চয়ই বউকে খুব বকেন। কিন্তু ছেলেবেলায় একদিন দেখেছিলাম, মাস্টারমশাইয়ের চোখ থেকে ওঁর বউ কাপড়ের আঁচল দিয়ে পিচুটি মুছিয়ে দিচ্ছেন—মাস্টারমশাইয়ের অসুখ করেছিল, তাই। শুধু তাই না, মাস্টারমশাইয়ের চোখ মুখ মুছিয়ে, একটা ন্যাকড়া দিয়ে সিকনি অবধি ঝাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওঁর বউ, আবার বলেছিলেন, ‘আর একটু জোরে ঝাড়ো। মাস্টারমশাই হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলেন, ‘পারছি না যে! ঠিক যেন ছেলেমানুষ, আর ওঁর বউ নাকটা ভাল করে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, যেন, যেমন মায়েরা দেয় না মুছিয়ে-মাছিয়ে, সেইরকম, অথচ মুখে হাসি হাসি ভাবটাও ছিল। ওঁদের তিনটে ছেলেমেয়ে তখন এদিকে ওদিকেই খেলে বেড়াচ্ছিল। সেই কালো গোঁফওয়ালা ভয়ংকর মাস্টারমশাইকে কীরকম আদুরে আর ছেলেমানুষের মত লাগছিল, আমি হাঁ করে দেখেছিলাম, যেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তখন মাস্টারমশাইকে ভয় করছিল না। তারপর থেকে, কোন কারণে উনি রেগে গিয়ে বকলে, আমার এই ব্যাপারটা মনে পড়তো, মনে হত, রাগী লোকটা যেন আসল লোক না, সেই লোকটাই আসল। এখন যেমন মনে হয়, সেই ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন একটা প্রেম প্রেম-ভালবাসাবাসি জড়িয়ে আছে, যেটা আমরা ভাবতেই পারি না—মানে, আমরা তো অন্যরকম ভাবি, আর বুঝি, আমাদের যেমন প্রেম করার রকম-সকম একেবারে অন্য রকম, তার জেল্লাই আলাদা, ছবির মতন। বয়স কাঁচা না হলে আবার ভালবাসা কী, যেন ওটা আমাদের হয়, যে জন্যে এক-এক সময় আমার মনে হয়, প্রেম করাটাও একটা ফুটানি করার মতই।… আচ্ছা, আমি যদি নিরাপদবাবুর মতই একটা সাধারণ মানুষ হই—শিখা হয়তো আমার পিচুটি সিকনি মুছিয়ে দেবে না—না না, তা অবিশ্যি জোর করে বলা যায় না, ওর মধ্যে আবার একটা কীরকম আছে, হয়তো দিতে পারে, মাস্টারমশাইয়ের বউয়ের মতই হয়তো আমাকে ভালবাসবে। লোকে হয়তো বলবে, শহরের একটা এঁটো মেয়েকে, নিজের দাদাদের এঁটো মেয়েটাকে—নাহ, কী বিচ্ছিরি একটা ভাব লাগে এসব ভাবলে, ইচ্ছা করে বাইকটা নিয়ে লাফ দিয়ে উঁচুতে উঠি, আর ঠাস করে রাস্তায় পড়ে, ছেতরে ছরকুটে মরি। কিন্তু আমি—আমিই বা কী একেবারে নৈবেদ্যের আস্ত কলাটি। লোকেরা কী না বলে, বলুক গে, আমি তো জানি, লোকেঁদের বলার থেকে শিখা অনেক বেশী, অনেক বড়—কারণ ও যদি আমাকে মাস্টারমশাইয়ের বউয়ের মতন ভালবাসে—যেখানে কোন লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই, ভয় নেই, আর আমি চাকরি করি—আমাদের কয়েকটা ছেলেমেয়ে—আমি একটা সাধারণ মানুষ—কী রকম সেই অনশনের দিনের মত মনে হচ্ছে, খবরদার আমাকে কেউ ছুঁতেও পারবে না—কাজ করি, খাই, বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকি….। কিন্তু রমেশ আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিল কেন; ও কি আমার থেকে ভাল!

এখন আমার মনে পড়ছে, মেজদা একদিন আমাকে বলেছিল, গুণ্ডামি না করে খেটে খা, খেটে খা। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাতে তোর কী সুবিধা ‘ ও বলছিল, “যেদিন খেটে খাবি, সেদিন আমাদের দলের মর্ম বুঝবি। আমি বলেছিলাম, ‘কেন, তোরা কি খেটে খাওয়া মানুষদের দল করিস নাকি। নিশ্চয়ই। ‘ওসব, শালুককে গিয়ে গোপাল ঠাকুর চেনাস। তুই ঘরে বসে স্যাণ্ডউইচ প্যাঁদাবি, এদিকে ওদিকে মাল মেরে বেড়াবি, আর আমি খেটে শুকনো বাসো রুটি চিবুবো, আর তোকে নেতাগিরি করতে দেব, তা মোটেই ভাবিস না ‘ ও যেন বেশ মজা পেয়ে হাসছিল, বলেছিল, কী করবি? ‘কেন, খেটে খাওয়া মানুষদেব কী ভাবিস তোরা, তোদের চ্যাঙ নাকি যে, তোরা নেতাগিরি না করলে তাদের চলবে না। তাদের নেতা তারাই হবে।’ ও বলেছিল, ‘গাধা, বুলি তো শিখেছিস মেলাই, আমরাও তো তাই চাই। আমার একেবারে ফ্যাক করে থুথু ফেলতে ইচ্ছা করছিল, বলেছিলাম, ‘চাস নাকি, মাইরি, ছত্যি! তোর এই কাঠামোয়? যা পানসি চালাচ্ছিস চালা, ওসব বলতে আসিস না। মনে করেছিস, এই করেই চালিয়ে যাবি, আর বাকীরা চোখে ঠুলি এঁটে থাকবে।’ বলে অ্যায়সা শরীরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলাম না, জাদুর চোখে একেবারে আগুন জ্বলে উঠেছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, ‘নোঙর, ইতর। আর তুই একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা, ভারী সসভ্য। ওর যে আর কিছু বলার ছিল না, তা জানতাম, তাই গালাগালি দিয়েই সরে গিয়েছিল। সে কথা আমার এখন মনে পড়ছে—হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ, মানে খেটে খাওয়া মানুষ আমি যদি হই, তখনো ওদের কারুর মোড়লি মানতে আমি রাজী না। খেটে খাওয়া গরীবদের সবাই রাজা করে দিচ্ছে। যাত্রার দলের সঙের মত, খালি তলোয়ার ঘোরাচ্ছে আর তড়পাচ্ছে—কিন্তু দেখ ময়দানে সে নেই। যেন খালি পার্ট বলে হাততালি নেবার তাল, মুখে বুলি মেরে যাচ্ছে, শুনলে মনে হবে, কালকেই গরীবদের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেবে। যেন চিরদিনই কিছু না করে হাততালি পেয়ে যাবে, আর খেটে খাওয়া গরীবেরাও চিরদিন ওদের কথায় আশায়-আশায় কাটিয়ে দেবে। গরীব লোকেরা সব বোকা, তোমাদের চেনে না, না? দিব্যি রসেবশে চালিয়ে যাচ্ছে, দূর থেকে ফতোয়া দিচ্ছে, গরীবেরা উদ্ধার হয়ে যাচ্ছে। যেন গরীবেরা জানে না, তাদের জন্যে পূর্ণেন্দু রমেশের মত লোকেরা লড়ে দেবে না, নিজেদের জন্যে তারা নিজেরাই লড়বে। নিজের পেটের ক্ষুধা, অন্যের খাওয়া দিয়ে ভরে না। স্‌সাহ্‌ খচ্চর! কিন্তু শুটকা হারামজাদা গেল কোথায়, আশেপাশের একটা দোকানেও তো দেখতে পাচ্ছি না, ওদের ওই সভার মধ্যেই ছিল নাকি ….কিন্তু এ আবার কোথায় চলে এলাম, হঠাৎ এদিকে চলেছি কেন। আজ তো বাজারের দিকে বা বাজারের মহাজনদের কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবিনি, তবু দেখছি, সেই রাস্তাতে চলে এসেছি। এ রাস্তায় আসতে আমার ঘেন্না করে, এমন জঘন্য রাস্তা-ভিড় আর ধারে ধারে রাস্তা জুড়ে যমপেষ দোকান, যেন গোটা রাস্তাটাই গিলে বসে আছে। বাজারের এই রাস্তাটা দেখলে মনে হয়, লোকেরা কেবল খেয়ে পরে বাঁচবার জন্যেই হন্যে হয়ে আছে, খালি কিনছে—জামাকাপড়,খাবার, যেন কোন অভাবই নেই, পয়সা টগবগাচ্ছে, আর ঘরে গিয়ে দেখ, হাঁড়িতে ইদুরের ডন। তা করুক গে, কিন্তু লোকজন চলাফেরা করবে তো, রাস্তাটা তো আর বাজার না যে, মেয়ের মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে খিকখিক করে হাসবে আর ছিট কাপড় দেখবে, খাবার গিলবে, আর ছোঁড়ারা এপাশে ওপাশে ভিড় জমিয়ে হিড়িক দেবে। কোন কোন মহাজনের কাছে যাবার জন্যে, এ রাস্তায় আমাকে আসতে হয়—মালকড়ির জন্যেই আসতে হয়, কারণ শহরের যে-সব কাঁচাখেকো দেবতাদের ঠাণ্ডা রেখে, মহাজনদের স্বাধীন ব্যবসা চলে—চুরির স্বাধীনতা যাকে বলে, খুশি খুশি দর, নেবে তো নাও, নইলে কাটো, ওসব আইনকানুন দেখিও না, ওসব আমার ট্যাঁকে বাঁধা, এরকম রোয়াবে ব্যবসা চালাতে হলে যাদের পুজো দিতে হয়,আমি তাদেরই একজন। ওই সেই ভদ্দরলোকের চুক্তি যাকে বলে আর কি, এরকম চুক্তি না থাকলে কি ভদ্দরলোকদের চলে!

কিন্তু আমার তো আজ সেরকম কোন মহাজনের কাছে আসবার কথা ছিল না। তবু কেন যে এ রাস্তাটায় ঢুকে পড়লাম জানি না। নাহ, মাথার কোন ঠিক নেই, শিখার মুখটা খালি মনে পড়ছে, আর অন্য সব কথা—তা-ই ঠিক জানি নাকি কী সব কথা। এলোমেলো সব কথা, যেমন শিখার সেই কথাটা, আমার কী রকম ভয় হয় অথবা আমি তো একটা সাধারণ বাঙালী মেয়ে ‘ মোটর বাইকের চিৎকারে অনেকে ফিরে তাকাচ্ছে, রাস্তা করে দিচ্ছে, কিন্তু যেন সেই রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের মত, গা নেই, তবু উঠতেই হয়, আর ভিতরে ভিতরে দাঁতে দাঁত পেষে, মনে মনে গালাগাল যা দেয়, চেহারা আর জামাকাপড় দেখলে তা বিশ্বাসই করা যায় না, এত খারাপ। তবে, সেই কী বলে, ‘মার্জিত রুচিবান মানুষ তো সব, তাদের বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। তবে, আমার কাঁচকলাটা, এঞ্জিনের আওয়াজটা আমি আরো বাড়িয়ে দিই, যাতে ভয় পেয়ে সরে যায়। তবে, এর মধ্যেই কেউ কেউ ডাকাডাকি করছে, ‘সুখেন, “সুখেনদা’–না, বসবার জন্যে না, জানান দেবার জন্যে, তারা আমাকে দেখেছে, বেশীর ভাগই দোকানদার, আমি হাত তুলে তাদের জবাব দিয়ে, এগিয়ে চলেছি—কিন্তু আচ্ছা, আমি কেন এরকম হলাম—মানে এইরকম একটা লোফার গুণ্ডা—সবাই ভয় পায় আর ঘেন্না করে—একমাত্র একজন ছাড়া। আমি বুঝতে পারি, আমাকে সবাই তা-ই করে, ভয় আর ঘেন্না, যেন তারা সবাই ভাল, ভাল ভাল কথা ভাবে, চিন্তা করে, ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানে না, রাজ্যের যত খারাপ কাজ, সব আমি একলা করছি, আর ওরা সব দেশটার মঙ্গলস্‌সাধন করছে। তবু যদি গোপালঠাকুরগুলোকে না চিনতাম, কিন্তু সে যাক গে, আমি কেন এরকম হলাম, আমি কেন একটা সাধারণ বাঙালী ছেলে হলাম না, শিখা যেরকম…

ডানদিকের রাস্তায় বেঁকে গেলাম, তবু যা হোক একটু ফাঁকা—কিন্তু এ কী রে স্‌সাহ্‌, আমি কি মালের ঘোরে আছি নাকি, তা না হলে, ন কড়ি হালদার, দেশটা অধঃপাতে গেল, চারদিকে অসততা, ছেলেমেয়েরা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে এইসব বলে বলে সব সময় এগলি ওগলির মোড় গরম করে রাখে, ‘গভর্নমেণ্টের উচিত—মাইরি, কেন যে লোকটা লাট বা মন্ত্রী হয়নি, কে জানে। সবাইকে সব শিখিয়ে দিতে পারে; সে-ই লোক কি না আমার দিকে চেয়ে চেয়ে গলে যাওয়া ভাবে হাসছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, আবার হাত তুলে থামতে ইশারা করছে! এ যে বাবা ইতিহা—স্! যে-লোক কোনদিন আমার সঙ্গে একটা কথা বলেনি, ছুচিবেয়ে বিধবাদের মত এড়িয়ে এড়িয়ে চলে, যেন আমি স্‌সাহ্‌ রাস্তার পেয়াজের খোসা, মাছের কাঁটা, ডিমের খোলা; যে-লোক সব সময় সততা আর কী যেন—হ্যাঁ, ‘বিহিত করতে হবে বলে, সে কি না আমার দিকে চেয়ে হাসছে, উহ্রে বাবা, হাসিটিতে যেন আবার একটু স্তেহও গলে পড়ছে, হে হে হে, দাঁড়াতেই হয়। হালদারের কাছে গিয়ে, রাস্তার ধারে মোটরবাইক থামিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছেন। ওহরে বাবা, আরো গলে পড়ছে যে হাসিতে। কী হতে পারে, কেউ পিছনে লেগেছে নাকি ন’ কড়ি হালদারের, না কী রাত্রে বাড়িতে ঢিলটিল ছুড়ছে কেউ, ভয় দেখাবার জন্যে বা মেয়েদের জন্যে—বড় মেয়েও তো দু-একটা আছে, সে-ই একটাকে তো চিনি, প্রায় আমাদের সমবয়সী, বীণা না কী যেন নাম। শহরে খুব নামডাক অবিশ্যি সেই মেয়েটার, হিড়িঙ্কি মেয়ে যাদের বলে। রাস্তা-মজানো।

হেঁ হেঁ, কোথায় চললে, বাড়িতে নাকি?

নাদুসনুদুস চেহারায়, মোটা জামা গায়ে দিয়ে, ফরসা লোক ময়লা দাঁতে হেসে এভাবে কথা বললে কী বিচ্ছিরি যে লাগে। তার ওপরে সে লোক যদি গলির মোড়ের লেকচারবাজ হয়, আবার এভাবে হাসতেও পারে, তখন কেমন যেন চোরা চোরা খচ্চর বলে মনে হয়। বললাম, ‘এই ফিরব এবার আস্তে আস্তে। কিছু বলছিলেন নাকি?’

আবার সেই গলে পড়া হাসি, আর তার মধ্যেই ফোলা ফোলা মাংসের মধ্যে ঢাকা চোখ দিয়ে চারপাশে একবার দেখে নিল। কী মতলব রে বাবা, লোকটা আমাকে দিয়ে কাউকে খুন করাতে চায় নাকি, সেই কথাই বলবে নাকি, যে-ভাবে ফাঁকা রাস্তায় আশেপাশে তাকাচ্ছে, যেন প্রাইভেট কথা কিছু বলবে। বলল, “কাল রাত্তির থেকেই তোমাকে খুঁজছি, একটু বিশেষ দরকার, বুঝলে না? সকালে তোমাদের বাড়িতেও গেছলাম, শুনলাম বেরিয়ে গেছ—বিশেষ দরকার, মানে—।‘

আর মানে করতে হবে না, যথেষ্ট পেয়াজি হয়েছে, এবার বাত ছাড় তো বাবা, আসলে কী বলতে চাইছ। কিন্তু আবার সেই মানে দিয়েই বলতে থাকল, ‘মানে, সব কাজ তো সবাইকে দিয়ে হয় না, হেঁ হেঁ হেঁ, দেশটা একেবারে রসাতলে চলে গেছে, সব জায়গায় দেখবে জোচ্চোরি, সে তোমার ক্যালিবার থাকুক না থাকুক, টাকা বের করলে, দিনকে রাত করতে পার…।‘

মরেছে, স্‌সাহ্‌ ন’ কড়ি হালদার যে আমাকেই বুঝাতে আরম্ভ করল সব—দেশ রসাতলে, টাকাই ক্যালিবার, কিন্তু ঝেড়ে কাশো না বাবা!—“তা কী আর বলব বাবা, কথাটা যখন কানে এসেছে—আমাকে কাল রাত্তিরে শশধর বোস বললে, সে বাজে কথা বলবার নয় জানো তো বাবা, খবরটাও সে নিয়ে এসেছে, সে-ই তোমার কথা বললে, বললে যে, সুখেনকে দিয়ে কাজটা হতে পারে। তাই তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি—মানে, ও সব হেঁজিপেজি মেনীমুখো ছেলে দিয়ে এসব কাজ হয় না। আমার ছেলেগুলো যেমন হয়েছে। আর আমার তো বুঝতেই পারছ, হেঁ হেঁ, শরীরে পোষাবে না, তবে বীণাটার জন্যে, আমার মেয়ের কথা বলছি….। ওহ রে স্‌সাহ্‌, মেয়ের কথা বলছে যে, তার আবার কী হল, কারুর সঙ্গে সটকে পড়েছে, তা-ই আমাকে খুঁজে দিতে হবে নাকি! মেয়ের নাম করে, থেমে আবার চারপাশে যে-ভাবে দেখে নিচ্ছে, আবার আমার মুখটাও দেখছে—মানে আমি কী ভাবছি, কেমুন কেমুন যান লাগে, বাগিয়ে বসে নেই তো, এখন খসাবার তাল, অথচ নিজে কোন ডাক্তারের কাছে প্রকাশ করতে পারছে না, তাই আমাকে দরকার, কারণ জানে, আমার হাতে ডাক্তার আছে—আছে মানে, আমি বললে ডাক্তার না বলতে পারবে না, টাকার বেলাতেও একটু কমসম হবে। সেই যেমন হয়েছিল, শিবু—শিবের বোন মঞ্জরীর বেলা, ওর প্রথমবার এ্যাবরসনের ব্যবস্থাও তো আমিই করে দিয়েছিলাম, যার জন্যে ডাক্তার ভেবেছিল, ওটা আমারই কর্ম, অথচ তখনো মঞ্জরীর গায়ে কোনদিন হাতই লাগাইনি, এখন যেমন গেলেই লাগাই। তারপরে অবিশ্যি আরো দু বার না তিন বার খালাস করতে হয়েছে, আর ডাক্তারও সেই একই—সেই ডাক্তার, অনশনের সময় যে আমাদের দেখাশোনা করেছিল। তবে মঞ্জরটা একটা বলের মত, দেখলে কিছু বোঝা যায় না, কোন রকমেই না। মঞ্জরী ছাড়াও কয়েকজনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, যে জন্যে ডাক্তার আমাকে খুব পেয়ার করে, আর সেই কথাটা হয়তো ন’ কড়ি হালদার শুনেছে, তাই এখন বীণার জন্যে—‘বে-থা তো আজ অবধি দিতে পারলাম না, যা দিনকাল পড়েছে, এদিকে ছেলেদের মেলাই বক্তিমে শুনবে, সব মুখেন মারিতং জগৎ, পণ ছাড়া বে করতে বল, অমনি গুটি গুটি সরে পড়বে, তার ওপরে আবার মেয়ের রূপ চাই, গুণ চাই, নিদেন ইস্কুল ফাইনাল পাশ না হলে তো, সে মেয়ে জাতেই উঠল না। তা আমার তো আর পণ দিয়ে বে দেবার ক্ষমতা নেই, কোনরকমে একবার যদি ইস্কুল ফাইনালটা পাশ করাতে পারি, হেঁ হেঁ হেঁ ….’ হেঁ হেঁ হেঁ, তো আমি কী করব! কী খিস্তি যে করতে ইচ্ছা করছে না, অথচ লোকটা কোনদিন ডেকে কথা বলে না, তাই কাঁচকলা দেখিয়ে কেটে পড়তেও পারছি না, তা ছাড়া মালটিকে একটু বোঝাও দরকার, কিন্তু আমি তো আর ইস্কুল ফাইনাল পাশ করিয়ে দিতে পারব না। লোকটা কী আমাকে পড়াতে বলবে নাকি, মরেছে স্‌সাহ্‌, বীণার মুখটা এখন আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, ড্যাবরা ড্যাবরা চোখ, ছোট মত একটা নাক—হ্যাঁ, ওর নাকটা বোঁচা বোঁচা, অথচ ছোট ছোট মনে হয়, পাতলা পাতলা ঠোঁট আর লম্বা চিবুক, ঠিক বাঙলা পাঁচ-এর মত লাগে মুখটা, দেখলেই মনে হয়, ইস্কুল ফাইনাল তো অনেক দূরের কথা, ওর দ্বারা প্রেম করাও হবে না, কেমন যেন ভিখিরিদের মত লাগে ওকে, একটা কেমন দুঃখী দুঃখী ভাব, যেন ও একটা দুঃখিনী মেয়ে, দেখলে কষ্ট হয় …. আর অনেক বছর তো হয়ে গেল ঘষতে ঘষতে, বয়সকালের একটা ইয়ে আছে তো, এদিকে দেখতে তো ক্রমেই বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, কোনদিন কী একটা করে-টরে বসবে, একেবারে মাথা কাটা যাবে, সেই জন্যেই বুঝলে তো বাবা, ছেলেমেয়েদের সব সময়ে একটা কিছুতে লাগিয়ে রাখতে হয়। আমিও তাই রেখেছি, কিন্তু, তুমি বাবা এ মওকাটা আমাকে ধরিয়ে দাও, মানে তুমিই পারবে! ন’ কড়ি হালদারের গলা আরো চেপে এল, আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এল, বললো, ‘আমি খবর পেয়েছি, ইস্কুল ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কলকাতায় লুকিয়ে বিক্রী হচ্ছে, একশো টাকায় সব পেপার, বুঝলে তো। আজকের মধ্যে না হলে আর পাওয়া যাবে না, ফুরিয়ে যাবে। এখন মুশকিল হয়েছে, ওসব লোকজন ঘাতঘোত আমি তো জানি না, শুনলাম, তোমার দাদা কেশব সব জানে—আর সে তো জানবেই, ওদের দলের ক্ষ্যামতা বেশী, ওপরের সব বড় বড় ব্যাপারে ওদের হাত আছে, মানে প্রশ্নপত্র বের করতে হলে, ওদের হাত না থাকলে হয় না, ওদের দয়াতেই তো সব…।‘

যত শুনছি, আমারই ভিরমি খাবার যোগাড়। মোড়ের লেকচারবাজ ন’ কড়ি হালদার, স্‌লা মহাস্‌সত্যবাদী, একটি অন্যায় বা খারাপ কথা বলেছ তো তোমার বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে, এমন গরম গরম বাত ছাড়বে, সে কিনা চোরাই প্রশ্নপত্র কিনে এনে দিতে বলে মেয়ের জন্যে। ধুকড়ির মধ্যে খাসা চাল, এই লোক কিনা ছুঁচিবেয়ে বিধবাদের মত, আমাকে পেঁয়াজের খোসার মত ডিঙিয়ে চলে। আমি বললাম, তা হলে কেশবকেই বলুন না, ও-ই তো এনে দিতে পারবে।

‘হেঁ হেঁ হেঁ, সেটা বাবা একটু ইয়ে লাগছে, মানে, আমি আবার বলতে যাব, এই আর কী। তোমার হাত দিয়েই যদি হয়ে যায়, মানে, আবার কলকাতায় যাওয়া-টাওয়া, তার চেয়ে তুমিই যদি খবরটবর নিয়ে একটু এনে দাও। তুমি ঠিক পারবে। তোমার ওপর ভরসা করা যায়, বুঝলে না। যেমন করে হোক, এই মওকাটা …।’

বুয়েছি বাওয়া, তুমি ডুবে ডুবে জল খাবে, শিবের বাবাও টের পাবে না, যে কারণে আমাকেই বেছে নিয়েছ। কেশব নেতা, ক্ষমতাবান, ভদ্রলোক, তার কাছে গিয়ে নাক কাটার চেয়ে গুণ্ডাটাকে কাজে লাগানোই ভাল। কোনদিন যদি কথাটা ফাঁসও হয়, তখন অস্বীকার করলেও চলবে, “আরে দূর, গুণ্ড বদমাইসের কথায় কেউ কান দেয় এই রকম বলবে, শহরে নকড়ি হালদার যে ভদ্রলোক সেই ভোদরলোকই থাকবে। হুম, ওদিকে মোটা জামাটার পকেটে টাকার করুকর শব্দও শোনা যাচ্ছে, টাকা বের করছে। বললো, সব টাকাটাই তোমাকে দিয়ে দিলাম, একশো টাকা, আজকের মধ্যেই এটা তোমাকে করে দিতে হবে।’

লোকটার কোন তন জ্ঞান নেই দেখছি। আমি যে আমি, তাও ভাবছি টাকাটা নেব কিনা, আব লোকটা জীবনে আমার সঙ্গে কোনদিন কথা বলেনি। আজ একশোটা টাকাই হাতে তুলে দিচ্ছে, একে কী বলে, বুঝতে পাবি না। একেই বোধহয়, সেই কী বলে, লোভীর মরণ, না কী জানি, না কি প্রাণের দাযে আর দিগবিদিক জ্ঞান নেই—তো দে স্‌সাহ্‌। আমি কী করব, আসছে যখন নিয়ে নিই, তারপরে দেখা যাবে, কাকে বল প্রশ্নপত্র, কোথায় তা পাওয়া যাচ্ছে। দেখছি, পুরো একশো টাকার একটা নোট—মুখটা আমাকে একটু ইয়ে করতেই হয়, মানে খুবই সীরিয়াস ভাব, এত বড় একটা কাজ, বীণা ইস্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেবে, চোরাই প্রশ্নপত্র থেকে আগেই সব দেখে রাখবে, তারপরে কে ঠেকায় পাশ, একেবারে সস্বামীর ঘরে চলে যাবে। টাকাটা নিয়ে, পকেটে গুজতে গুজতেই মোটরবাইক স্টার্ট দিই আমি, একবার শব্দ করি, “আচ্ছা”, কিন্তু ন কড়ি হালদার যে কী বললো, ইঞ্জিনের হাকাড়ে তা ডুবে গেল, আমি এগিয়ে চলে গেলাম। উস, কী রাস্তা পাড়ার মধ্যে, প্রায় নাচতে নাচতে চলেছি, কিন্তু আশ্চর্য, অন্ধকারের মধ্যে যেমন মেঘ করলে, অনেক দূরে—অনেক দূরের আকাশে চিরিক চিরিক করে বিদ্যুৎ চমকায়, আমার ভিতরে যেন সেই রকম হচ্ছে। তার মানে, ওই সেই কথাটাই, আমি আর যেন ঠিক থাকতে পারছি না, কোথায় একটা গোলমাল লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার চারপাশে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে, ছায়া ছায়া মত, অথচ চোখে দেখতেই পাচ্ছি, কেউ নেই, তবু মদ খাওয়ার খোয়ারির মত একটা ব্যাপার যেন। শিখার মুখটাই আবার আমার মনে পড়লো, আর ওর কথাগুলো, কিন্তু কেন তুমি একটা সাধারণ ছেলে হলে না’, অথচ, তাই যদি আমি হতে পারি, তবু দাদাদের কারুর বিষয় কিছু বলতে পারব না। কেন, এটা আবার কী রকম ব্যাপার যে, গুণ্ডা না, বদমাইস না, একটা অর্ডিনারি লোক। কোন দলের লোকেরা কী কী শয়তানি করছে, তা বলতে পারবে না, যেন তারা সব গরু ভেড়া। কারুর মন্দ ব্যাপারে কিছু বলত পারবে না। তার মানে, একমাত্র দল থাকলে, কোন দলের লোক হলে, অন্য দলের লোকদের গালাগালি দিতে পারে। যেমন পূর্ণেন্দু দেয়. কেশবকে বা এ ওকে, কিন্তু তুমি চুপ করে থাক। তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। ব্যাপারটা কি এরকম নাকি, শিখা কি তা-ই বলছিল। ওর কথা থেকে, ঠিক তা তো মনে হয় না, বরং ওর কথা থেকে এই মনে হয়, ব্যাপারটা যেন খুব কঠিন। আর সত্যি, কঠিন তো বটেই, কারণ আমি তো ঠিক জানিই না, কী করে একটা সাধারণ মানুষ হওয়া যায়, কারণ, সাধারণ মানুষ মানে, সব ছেড়েছুড়ে টাটের ঠাকুর হয়ে বসে থাকা না। যেমন কি না, শিখার বাবাকে যদি কেউ সাধারণ মানুষ বলে—অসম্ভব, ওরকম একটি ফেরেববাজ রাম খচ্চর লোক তা হতেই পারে না, কিন্তু লোকটাকে তো সাধারণ বলেই মনে হয়। আসলে, আমি যাদের দেখছি, যাদের কথা ভাবছি, তারা কেউ শিখার সেই সাধারণ লোক না। যেমন নিরাপদবাবু, অনেকটা সাধারণ মানুষ বলেই মনে হয়। একটা লোক, সারা জীবন মাস্টারি করলেন, চুরি জোচ্চোরি বা ইস্কুলের পয়সা চুরি, কারুর পিছনে লাগা, মাস্টারি করতে করতে অন্য কোনরকম ব্যবসা করা, যা অনেকেই করে—বই বিক্রী করা থেকে সুদ খাটানো,কিছুই না,যেটা ভাবাই যায় না, এরকম একটা লোক থাকতে পারে। অন্ততঃ কিছু না হোক, অন্য মাস্টারদের হিংসে করা, ছাত্রদের বাপ মাকে বা ইস্কুল কমিটির কাছে কোন মাস্টারের নামে লাগানো, যে-সব আখচারই ঘটছে, সে সবও ওঁর সম্পর্কে কেউ শোনেনি। জামাকাপড় চিরদিন একরকমই দেখলাম, কোনদিন যে একটু সাজগোজ করেছেন, তাও দেখিনি,সিগারেটবিড়ি খান না,অন্য কোন নেশা তো অনেক দূরের কথা, এক বউ ছাড়া কোন মেয়েমানুষের কথা ওঁর ব্যাপারে ভাবাই যায় না, কেউ কোনদিন শোনেনি। এই সমস্ত ব্যাপারটাই তো আমার কাছে ইম্পসিবল বলে মনে হচ্ছে। অসম্ভব, একটা মানুষ কী করে এরকম হতে পারে, সারা জীবন কাটাতে পারে, আমি ভাবতেই পারি না। আমাকে ওরকম হতে হলে, আমি মরেই যাব। কী করে ওরকম হওয়া যায় জানি না। মাস্টারমশাই অনেকটা শিখার ‘সাধারণ মানুষের মত। কেননা, রমেশ যখন মাস্টারদের টাকাটা মেরে দিল, তখনো উনি কিছুই বললেন না। হয়তো মনে মনে খুব রাগ করেছিলেন, কষ্ট পেয়েছিলেন, কারণ আমাকে যখন চুপি চুপি ব্যাপারটা বলেছিলেন, তখন ওঁকে কী রকম কাঁদো-কাঁদো লাগছিল। রাগের থেকেও অনেক সময় ওরকম হয়। কিন্তু শিখা যে বলেছিল, ‘নিরাপদবাবুরাই বা কী রকম লোক, ওঁরা ছাড়লেন কেন, যে-কথা থেকে মনে হয়, সাধারণ মানুষেরা তা ছাড়ে না, একটা সাধারণ মেয়ে হিসাবে শিখা হলেও ছাড়তো না। তার মানে, সাধারণ মানুষ—কিন্তু, একি, কারখানার রাস্তায় কখন চলে এলাম আবার। আমি তো এখন এ রাস্তায় আসবার কথা ভাবিনি বা কারখানায় কারুর সঙ্গে দেখা করবার চিন্তাও করিনি—ওহ বাবা, কেশববাবুদের দল যে পোস্টার সাঁটছে দেখছি দেওয়ালে। গাড়িটা থামালাম, পোস্টারটা পড়লাম। আগামীকাল প্রকাশ্য অধিবেশন, দলে দলে যোগ দিন ‘.হুম, তার মানে আগামীকাল শহরটি গরম। ওদিকে হরতাল, এদিকে প্রকাশ্য অধিবেশন, একেবারে জমজমাট ব্যাপার। যে দুজন পোস্টার লাগাচ্ছিল, দুটোকেই চিনি, বড়বাবুর চেলা, আর একটা সেই কিষেণ, যেটাকে জুয়ার আড্ডায় একদিন পেদিয়েছিলাম। এসব কাজের জন্যে, কেশবের এরাই চেলা—কিন্তু বড়বাবুটি গেলেন কোথায়, এখনো চোরাই মাল সামলাতে ব্যস্ত নাকি। কাল রাত থেকে তো মাথার ঠিক নেই—কিন্তু শুটকাটা গেল কোথায়—ওকে তো আমি বলতে বারণ করেছিলাম, কারণ আমার কী কাঁচকলা যায় আসে, কারুর চোরাইমাল আছে না আছে। আমার পেছনে লাগতে এলে আমি বলব।

গাড়ির মেশিনটা চালু থাকায়, শব্দ পেয়ে কিষেণরা তাকালো, আর তাকাতেই ওদের দুজনের চোখ দুটো ঠিক রমেশদার মতই জ্বলে উঠলো, যেন আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আবার দুজনে বিড়বিড় করে কী যেন বলাবলি করছে, স্‌সা, চোরের দালালি করছে, তার আবার কুলোপনা চক্কর ৷ ‘ হেই কিষেণ, কিসের পোস্টার লাগাচ্ছিস রে’ ডেকে জিজ্ঞেস করলাম।

বেশ তেরিয়ান হয়ে, ঝেজে জবাব দিল, ‘চোখ থাকে দেখে নাও।

আচ্ছা, খুব রোয়াব দেখছি, আবার চোখ পাকিয়ে দেখছে, স্‌লা—কিন্তু আমার ঘাড়ের কাছটা এরকম শিউরে উঠছে কেন, আবার, আর যেন শিরদাঁড়ার কোথায় একটা চিক চিক করে কেপে গেল। কেন, এরকম হচ্ছে কেন, শিখার মুখটা আমার মনে পড়ছে, আর ওর সেই কথাটা, ‘আমার কী রকম ভয় হয়। একটা কীরকম অস্বস্তি হচ্ছে, তবু আমি মাটি থেকে পা তুলে নিতে নিতে বললাম, ‘খুব বেড়েছিস মনে হচ্ছে ‘ বলে চলে যেতে শুনলাম, ‘তুমিও বেড়েছ, তোমারও বেশী দিন নেই আর ‘ আচ্ছা, হবে, জবাব পরে হবে, কিন্তু আমি দেখছি সেই কারখানাতেই এলাম, গেলাম একেবারে সোজা অফিসের কাছে।

মোটরবাইক রেখে চোপরার চেম্বারে গলাম, ঠাণ্ডা ঘর, বেশীক্ষণ থাকলে শীত করে। আমাকে তো আটকাবার কেউ নেই, দারোয়ান না, বেয়ারা না, চোপরার হুকুম, আমার অবাধ গতি। লোকটা বাঙলা বলে মন্দ না। এমনিতে দেখলে মনে হয়, বেশ ঝকঝকে চোখা মানুষ, কিন্তু ওর আমি ক্ষ্যাপা বাঘের চেহারাও দেখেছি, চাকরি রাখতে সব করতে পারে। এখনো সাহেবের লাঞ্চ টাইম হয়নি দেখছি। বাড়িতে তো যায় না, খানা চোপরা-বউদি এখানেই পাঠিয়ে দেয়—তবে একটাই যা রেয়াত, চেম্বারে বসে মাল খায় না, ওটা ছুটির পরে—সন্ধ্যাবেলায়। আমাকে দেখেই বলে উঠলো, ‘হ্যালো সুখেন, এথোন কী মনে কোরে, বস বস।‘

‘এই—এদিক দিয়ে যেতে যেতে একবার এসে পড়লাম।

‘হালচাল?’

‘খারাপ, কাল তো হরতাল।’

‘সে তো জানি।‘

‘চালাবেন নাকি!’

‘ইচ্ছে তো আছে, তবে তোমরা কোন মদদ দেবে না তো কী কোরে হোবে। তোমার বড়দার দলের সঙ্গে মেজদাদারা লড়ছে, আমরা মার খাচ্ছি।‘

খচ্চর। এ ছাড়া কিছু মনে আসে না আমার, তোমরা সব সাধু, তাই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছ। চালিয়ে যাও, যদিন এই দুই দাদারা আছে; চিরদিন এই চার হাজার টাকা মাইনে, আরো অনেক আমদানি, মেলাই র‍্যালা রপোট চলবে না। তবে আমার এসব কথা আজ ভাল লাগছে না, বললাম, ‘আমাকে একটা চাকরি দেবেন?’

চোপরা হেসে উঠলো, ‘ইউ আর আসকিং সামথিং নিউ, উম?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, ভাবছি একটা চাকরিবাকরি করব।’

‘কেনো, তোমার টাকার কম হচ্ছে নাকি?’

‘না, তার জন্যে না, আর এসব ভাল লাগে না।‘

চোপরা বোম্বাই হিরোর মতন হেসে উঠলো, বললে, ‘সচ? ক্যায়া বাত বোলা তুম নে। তোমার বাবা এতো বড়লোক, তোমার দাদারা এতো বড় লীডর—‘

আমি বলে উঠলাম, ‘তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তো গুণ্ডা।‘

চোপরা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবার মত শব্দ করলো, ‘উম?’ তারপরে যেন অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি গুণ্ডা আছে? না না না, আজ তোমার মেজাজ খারাপ আছে, তা-ই ও বাত বলছে। তোমাকে লোকে কতো রেসপেক্ট কোরে, ভয় পায়।‘

শুয়োরের বাচ্চা, এই কথাই আমার মনে হচ্ছে, তবু আমি বললাম, ‘কিন্তু এসব আর আমার ভাল লাগছে না।‘

‘কেনো, আমাদের তোমাকে ভাল লাগে। আমরা তোমাকে মদদ দেব সব সময়।’

কথা বলছে না, যেন ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচাচ্ছে, আর ঘাড় নাড়ছে।

আমি বললাম, ‘সেইজনেই তো আপনাদের কাছেই একটা চাকরি চাইছি।‘

চোপরা হাসতেই লাগলো, আর আমার দিকে বারে বারে তাকাতে লাগলো—যে তাকানোটা আমার একটুও ভাল লাগছে না, কারণ মনে হল, সেখানে হাসির হা-ও নেই, একটা অন্যরকমের চাউনি, যে চাউনি দেখে আমার আবার যেন ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠলো, সেই রকম শিউরোনি ভাব। চোপড়া আবার বললো, ‘তোমার মেজাজটা কেনো খারাপ আছে?’

‘কিছু ভাল লাগছে না।’

‘আমাদের ক্লাবে যাও না একবার।‘

মাল খেতে যেতে বলছে। মন্দ হয় না একবার গেলে, ওর অ্যাকাউন্টেই প্রচুর গিলে আসা যায়, আর আমি গেলে, এই অসময়েও বেয়ারা ঠিক খুলে দেবে, কিন্তু আমার যেন কেমন, কিছুই ঠিক ভাল লাগছে না। বললাম, ‘এখন যাব না।’

‘রিয়ালি, ইউ আর আসকিং ফর এ সার্ভিস?’

‘সত্যি। ‘

‘হুম্‌।’

চোপরা হঠাৎ গম্ভীর হল, চোয়াল দুটো শক্ত করলো, যেন সত্যি ভাবলো কিছু, কিন্তু কিছুই বললো না, কেবল একটা ফাইল দেখতে লাগলো চুপচাপ। এরকম একটা ভাব—একেবারে নতুন লাগছে আমার কাছে, এরকম, আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে, চুপচাপ ফাইল দেখে যাওয়া, স্‌সাহ্‌ যেন আমি ওকে চিনি না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, ‘এখন চলি তা হলে।’

‘হুম, পরে কোথা হবে?’

স্‌লা, মুখই তুললো না। আমি চেম্বারের দরজাটা টেনে ধরে, আবার ওর দিকে ফিরলাম, আর তৎক্ষণাৎ, দেখলাম, চোখ দুটো কুঁচকে, খুঁচিয়ে আমাকেই দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই বললো, ‘কী?’

আমি বললাম, ‘ওবেলা আসব আমি।’

‘ঠিক আছে ঠিক আছে।‘

যেন তাড়াবার জন্যে ব্যস্ত, অথচ আমি এলে, কত কথা জিজ্ঞেস করে, উঠতে চাইলে খালি বস বস করে, হঠাৎ যেন গিদধড়টার কী হয়ে গেল। চাকরি করতে চাই শুনে যেন লোকটা বিগড়ে গেল—তার মানে, আমার আবার চাকরিবাকরি, এ সব কী, আমি তো একটা গুণ্ডা, ওটাই আমার চাকরি। বাইরে বেরিয়ে আমি মোটরবাইক স্টার্ট দিয়ে কারখানার ভিতর থেকে রাস্তায় এসে পড়ি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত