Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Proshanto Mridha 50 birth day wish

ইরাবতী প্রবন্ধ: যে খোঁজে আপন ঘরে । প্রশান্ত মৃধা

Reading Time: 5 minutes

পঞ্চাশের মগ্নতায় লেখক প্রশান্ত মৃধা । লেখকের জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবারের অসংখ্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। লেখকের জন্মতিথিতে লেখকের লেখা একটি প্রবন্ধ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


 

আজীবন সংগ্রামী লেখক সমরেশ বসু। সাহিত্য সৃষ্টিকেই জীবনের একমাত্র কাজ হিসেবে স্বেচ্ছায় নির্বাচন করেছিলেন অল্প বয়সে। তাঁর সামনে তখন উদাহরণ ছিলেন দুজন—তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত শতকের পাঁচ দশকের গোড়ায় সদ্যঃস্বাধীন ভারতে এ বড় কঠিন সিদ্ধান্ত। কিছুদিন আগে দেশভাগ হয়েছে। সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক হিসেবে জীবনযুদ্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন প্রায় পরাজিতই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সে তুলনায় অনেক সফল। এমন বাস্তবতায় শুধু সাহিত্য করে বেঁচে থাকার সংকল্প নেওয়া কষ্টকল্পনা বটে। সমরেশ বসু তা-ই করেছিলেন।

যদি বাঙালি লেখকদের অবস্থা ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকা কিংবা উত্তর আমেরিকা বা জাপানি ভাষার লেখকদের মতো হতো, একটা বই ভালো বলে নাম করলে সেই বইয়ের বিক্রির টাকায় আরেকটা বই লেখার আগে পর্যন্ত অথবা তার পর পর্যন্ত নিশ্চিন্তে বেঁচেবর্তে থাকতে পারতেন, তাহলে চিন্তা ছিল না। বিপর্যস্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন এ কথা। একটা তো বটেই, ভালো বলে নাম হওয়া অন্তত দুইটা বই মাত্র ২৬ বছর বয়সের ভেতরে তিনি লিখেছিলেন (‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’; ‘জননী’ বা ‘দিবারাত্রির কাব্য’ অনুল্লেখ্য থাক), কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ঘরেতে বাড়ন্ত চাল—এ কথা মাথায় রেখে পরের লেখায় হাত দিতে হয়েছে তাঁকে। সেই প্রাণঘাতী পরিশ্রমেই আমৃত্যু সঙ্গী হয়েছে মৃগী রোগ। এ কথা জানতেন সমরেশ, রুগ্ণ মানিক তখন অসুস্থ, ক্লান্তি তাঁকে তখন প্রায় আত্মঘাতী আয়ুর সীমানায় নিয়ে পৌঁছেছে।

এমন উদাহরণ সামনে থাকায় আগামী দিনে কী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হতে পারে তা বুঝতে পেরেছেন সমরেশ বসু। এর আগে বেঁচেছেন বিচিত্র সব জীবিকায়। তবে প্রথম দিকের রচনা থেকেই বড় হাউসের আনুকূল্য জুটেছে তাঁর। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ (১৯৫৪) লিখেছেন দেশ পত্রিকায় কালকূট ছদ্মনামে। প্রকাশমাত্রই পাঠকপ্রিয় এ বই। কাছাকাছি সময়ে লিখেছেন ‘গঙ্গা’, ‘বাঘিনী’ ও ‘সওদাগর’-এর মতো উপন্যাস। প্রতিটিই পাঠকের নজর কাড়ে। একই সঙ্গে চলচ্চিত্রেও রূপান্তরিত হয় কিছুদিনের ভেতর। ফলে ধীরে ধীরে সমরেশ বসু আর্থিক সচ্ছলতাও পান। লেখাটা এ জন্য তাঁর কাছে কখনো সহজ হয়নি, আবার সব সময়ই তা যেন বেশ সহজ ছিল! যদিও প্রচলিত অর্থে জনপ্রিয় লেখক বলতে যা বোঝায়, তা তিনি কখনোই ছিলেন না।

এই কথাগুলো যত দ্রুত আর প্রায় খসখস করে লিখে ফেলা গেল, একজন লেখকের পক্ষে নিশ্চয়ই প্রথম পর্বে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অত সোজা কথা নয়। বিষয়ে বৈচিত্র্য থাকতে হয়। সমরেশ বসুর তা ছিল। ‘বিটি রোডের ধারে’ কি ‘উত্তরঙ্গ’, ‘নয়নপুরের মাটি’র মতো একেবারে প্রথম পর্বের লেখা থেকে হঠাৎ ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র মতো বিষয়কে নির্বাচন—লেখক হিসেবে তাঁর বিচিত্রগামিতার প্রথম সোপান। একে ছদ্মনাম, তারপর উত্তম পুরুষের কাহিনি আর এক পরিব্রাজকের কলমে রচিত আখ্যান। সমরেশ বসুর সমালোচক বা সুহৃদদের কেউ কেউ যতই কালকূট স্বাক্ষরে লেখাগুলোকে ভ্রমণকাহিনি হিসেবে আখ্যা দিন অথবা লেখকও তা-ই মনে করতেন বলে জানা যায়; এগুলোয় বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল থাকত আর একই সঙ্গে নিজের ভেতর দিয়ে অপরকে দেখা আবার অপরের ভেতরেও নিজেকে খোঁজা। এক নিরন্তর সন্ধান। কালকূট নামের একটি লেখা আছে, ‘যে খোঁজে আপন ঘরে’। খুবই ছোট আকৃতির উপন্যাস। এই কাহিনির শিরোনামকে একই সঙ্গে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়; সেখানের লছমি নামের মেয়েটি যেন নিজের গৃহ খুঁজে পায়, যার ভেতর দিয়ে চিরপরিব্রাজক কালকূটও নিজ গৃহের সন্ধানে ব্রতী। অন্যদিকে এই শিরোনামা সমরেশ বসু নামের লেখকেরও ‘সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা’, নিরুদ্দিষ্টের দিশা, তাঁর অভীষ্ট। ‘নয়নপুরের মাটি’ থেকে ‘দেখি নাই ফিরে’ পর্যন্ত প্রতিটি লেখায় নিরন্তর স্বদেশই সন্ধান করেছেন তিনি। এই সন্ধান আত্মজিজ্ঞাসারই অন্য নাম, নিজেকে জানার জন্য। একেবারেই স্বাধীন ভারতের সমকালীন লেখক সমরেশ বসু। তাই আত্মজিজ্ঞাসার ব্যক্তিগত প্রকল্পটি একদিক থেকে ভেবে নেওয়া যায় এভাবে : কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, পার্টি নিষিদ্ধ হলে জেলে যাওয়া, জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে বের হওয়া, তারপর পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন (আবার পার্টি থেকেও তাঁকে ভুল বোঝা), এদিকে ২৩-২৪ বছরের ভেতরে চারটি সন্তানের পিতা, গৌরী বসুর ত্যাগ! এসবের ভেতরে যে পার্টি স্বাধীন ভারতে প্রথম আওয়াজ তোলে ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’, সেই ঝুটা আজাদিতে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে যে ভারতবর্ষ ইংরেজরা রেখে যায়, সেই ভারতকে বাংলাকে খুঁজে দেখার এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা। দুইভাবে, এক. নিজের কল্পকাহিনি অর্থাৎ গল্প-উপন্যাসে বাংলাকে খোঁজা; আর দুই. কালকূট নামে নিজেই উপস্থিত হয়ে খুঁজে ফেরা।

তাই গঙ্গা-সওদাগর-বাঘিনী পর্বের পরে ‘বিবর-প্রজাপতি’ পর্ব, এরপর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’ (বিক্রমপুরের পটভূমিতে), ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘যুগ যুগ জীয়ে’, ‘তিন পুরুষ’সহ অন্যান্য লেখাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে নেওয়া যায়। কালকূটেরও পর্বান্তর আছে, আছে বিবিধ অভিযাত্রা। আছে ফেলে আসা স্বদেশ, বাংলাদেশ। ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে’ কিংবা ‘কোথায় পাবো তারে’তে পুরান ঢাকার কথা ঘুরেফিরে এসেছে। সেই পরিব্রাজক-কলম কুম্ভমেলা থেকে পশ্চিম বাংলার বন-বনানী, আরব সাগরের তীর কি দাজির্লিং আর ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দির, শাম্ব বা পৃথায় ঘুরে আসেন প্রাচীন ভারত—সর্বত্র বিচরণগামী। এই দুইমুখী বিচরণ অথবা একমুখী বিচরণেরই দুটি দিক; দুটি মিলেই এক সমরেশ বসু। আসক্ত ও উদাসীর ভেতরে সন্ন্যাসী, আবার সংসারী, কখনো দ্রোহী কখনো হতাশ হত্যোদম, কখনো বাউল কখনো গৃহী।

তবে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ জীবনের বিচিত্রমুখিতাকে উন্মোচন। এক জায়গায় আটকে না থাকা। যদিও তাঁকে প্রচুর লিখতে হয়েছে। প্রচুর লিখলে লেখায় ক্লান্তি ভর করা খুব স্বাভাবিক। তাঁর কলমেও ক্লান্তি ভর করেছে। যে কাহিনির স্বাভাবিক অন্য পরিণতি হতে পারে, কখনো তাড়াহুড়া, কখনো সেখান থেকে নতুন আরেকটি উপন্যাস শুরু করার তাগাদায় কাহিনি ছেড়ে দেওয়া—এসব ঘটেছে। যেমন—‘মিটে নাই তৃষ্ণা’ কিংবা ‘বনের সঙ্গে খেলা’র মতো প্রায় অপ্রয়োজনীয় লেখাও তাঁকে লিখতে হয়েছে। আবার, একেবারে শেষ দিকে ‘দেখি নাই ফিরে’ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। অনেক দিন ধরে এই উপন্যাসের রসদ সংগ্রহ করেছেন, কিছুই প্রায় বাদ দেননি রামকিঙ্কর সম্পর্কে জানতে। শুরু করেও আবার থেমেছেন, আবার শুরু করেছেন। তাঁর মতো সর্বভারতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের এই নিষ্ঠা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু এই রামকিঙ্কর থেকে উল্টো দিকে গেলে ‘নয়নপুরের মাটি’ পর্যন্ত সমরেশ বসু নিজেকে বারবার বদলেছেন। কলকাতায় বাস করতেন জীবনের শেষ ভাগে আর এর উপান্তে নৈহাটিতে ছিলেন দীর্ঘকাল, এই দুটি জায়গাকে কেন্দ্রে রেখে তিনি চাইলে লিখে যেতে পারতেন অসংখ্য কাহিনি। তবে তাতে সমরেশ বসু একের পর এক উন্মোচনের ভেতর দিয়ে যে আত্ম-আবিষ্কার করে চলেন, সে জায়গায় কোনোভাবেই পৌঁছানো হতো না। না পাঠকের, না লেখকের।

সমরেশ বসুর ধাতটাই একটু ভিন্ন। সাহিত্যকে জীবনধারণের বস্তু করে যে নিশ্চিত কাহিনি বয়ান করতে হয়, তা তিনি করেননি। যেমন—বিমল মিত্র, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত। এঁরা তাঁর সমকালীন। ঢাউস সাইজের লিখতে হয়, নাগরিক প্রেমকাহিনি লিখতে হয় অথবা গোয়েন্দা গল্প লিখতে হয়—এই কাজটি করেননি। ছোটগল্প প্রায় লিখতেই হয় না। ও স্রেফ অপচয়। তারপর পাঠকের চাহিদা মোতাবেক সংযোগও রক্ষা করতে হয়। এসব তাঁর ক্ষেত্রে প্রায় ঘটেনি। প্রায় এ জন্য ‘বিবর’ লেখার পরে ‘প্রজাপতি পাতক’ অপ্রয়োজনীয়ই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেছেন একটানে। এক জায়গায় আর থাকেননি। এই যে নানা-থাকার সাহস, এই যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, এই কাজটিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মিল। আর অসংখ্যক ছোটগল্প রচনা করেছেন, যার অনেকই চাইলে ছোট উপন্যাস বা নভেলায় পরিণত করতে পারতেন। যেমন—‘অকাল বসন্ত’, ‘কমিলস’, ‘উড়াতীয়া’, ‘পাড়ি’র মতো ছোটগল্প-বিষয়ের দিক থেকে বাংলা ভাষায় কম লেখা হয়েছে। সেখানে ছোটগল্প লেখকের সংযমও রক্ষিত হয়েছে। সমরেশ বসু চাইলে ‘মানুষ রতন’, ‘উড়াতীয়া’ কিংবা ‘পাড়ি’কে সহজেই উপন্যাসে পরিণত করতে পারতেন। এই সংযম তিনি সব সময়ই রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই গল্পগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়, অতি সহজে লেখা এ গল্প। কিন্তু রেলের সিগন্যালম্যান তাঁর বন্ধু ও এক নারীর কিংবা শুয়োরকে নদী পার করা দুই ছিন্নমূল নারী-পুরুষ কিংবা আধ অবাঙালি বস্তিতে যে ছেলেটি সমাজতন্ত্রী আর তার ‘কমিলস’-বিরোধী বাপ—এদের গল্পকে চাইলেই লেখা যায় না। শুধু লেখকের চোখের গভীরতলের জন্য এই কাহিনিগুলো বড় সহজ, একেবারে চেনা চৌহদ্দির মনে হয়, কিন্তু এই মানুষজনকে চেনা আসলেই অত সহজ নয়! এই চেনা তো উপরিতলে শুধু চোখে দেখে চেনা নয়, ভেতরে একে খুব নিবিড়ভাবে দেখা। ফলে যেখানে যত সহজ করে তিনি তুলেছেন বলে মনে হয়, লেখা আসলে তাঁর কাছে অত সহজ ছিল না। নিরন্তর মানুষের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া ছিল তাঁর কাজ। সেই কাজটি অক্লান্ত করে গেছেন। একেবারে নিয়ম করে। প্রতিদিন সকালে লিখতে বসতেন, উঠতেন বিকেলে, পাশ্চাত্যের লেখকদের মতো। কোনো বিশেষ অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো বিষয় তাঁর ছিল না। লেখকের প্রাত্যহিকতাই তাঁর জীবিকা ও অন্ন! সেই জীবনে নিজেকে জানার জন্যই নিরন্তর খুঁজে গেছেন মানুষরতন!

তাই লেখা কখনোই তাঁর কাছে সহজ হয়নি, নিরন্তর আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় তা সহজ হয়, কিন্তু প্রেম কখনোই সহজ নয়; আবার নিমজ্জনে প্রতিমুহূর্তে প্রেমও সহজই, তাই লেখাটা সমরেশ বসুর হাতে সহজও ছিল। বাংলা ভাষার এক প্রধান গদ্যলেখক হিসেবে তিনি মানুষের প্রতি সেই ভালোবাসাকেও সহজ করেই তুলেছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমে!

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>