উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: গোগোলের ওভারকোট এবং আজকের সমাজ
পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা একই। সেইজন্য হোমেন বরগোহাঞির হালধীয়া চরাই বাওধান খায়’ উপন্যাসের রসেশ্বর চরিত্রের মধ্যে এবং সুদূর রাশিয়ার গোগোলের ‘ওভারকোট’গল্পের আকাকি বাশমাচকিন চরিত্রের মাধ্যমে আমরা একটি আশ্চর্য ধরনের মিল দেখতে পাই। ১৮০৯ সনে রাশিয়ার ইউক্রেনে নিকোলাই ভাসিলিইভিচ গোগোলের জন্ম হয়, মৃত্যু ১৮৫২ সনে। ইউরোপের অনেক বিখ্যাত সমালোচকের মতে ইউরোপের অনেক প্রখ্যাত গল্পকারের জন্ম গোগোলের ওভারকোটের পকেট থেকে হয়েছে। ওভারকোট গল্পের কাহিনির সময়কাল ১৮৩৫। তখন জারের শাসনকাল ছিল। মানবতার চরম অপমান ছিল অত্যাচারী জারের শাসনকালের প্রতিদিনের ঘটনা। তখন সমস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় পচন ধরেছিল। সাধারণ পাহারাওয়ালা থেকে আরম্ভ করে দেশের শাসন ব্যবস্থার উচ্চ পদের চিফ সেক্রেটারি পর্যন্ত প্রত্যেকেই এই অপশাসনকে কোনো ধরনের বাধা না দিয়ে মেনে নিয়েছিল। নিকোলাই গোগোল এক আশ্চর্য ধরনের সহানুভূতির দৃষ্টিতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়া এই অরাজকতার ছবি আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন।
আকাকি বাশমাচকিন সরকারি অফিসের উনিশ নাম্বার সেকশনের একজন সাধারণ কেরানি।অন্যান্য কেরানিরা আকাকিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে থাকে। আকাকির সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অফিসে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কেউ প্রমোশন পেয়েছে, কেউ পেনশন নিয়েছে কিন্তু আকাকি বাশমাচকিনের জীবনে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে নি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একটার পরে একটি দলিল নকল করে যায়। এটাই আকাকি বাশমাচকিনের কাজ। তার জীবনে তাসের আড্ডা, জুয়া খেলা অথবা বন্ধুর সঙ্গে গল্পগুজব করার কোনো অবকাশ নেই। এভাবেই চলছিল আকাকির প্রাণহীন নিস্তরঙ্গ জীবন। পিটাসবার্গ শহরে সেই বছর বড় ঠান্ডা পড়েছে। এত ঠাণ্ডা,মনে হয় যেন দেহের চামড়া ভেদ করে হাড়ের ভেতরে ঢুকে যাবে। অভিজাত শ্রেণির মানুষগুলি বলাবলি করে যে চারপাশে যে বরফ পড়ছে তা নাকি স্বাস্থ্যের জন্য বড় ভালো। আকাকির মনে হয় তার মতো দুঃখী কেরানির জন্য এর চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। সেইজন্য ঠাণ্ডার অজুহাত নিয়ে আকাকি কখনও অফিস যাওয়া বন্ধ করে না। বরফের মধ্যেও আকাকি সবসময় সময়মতো অফিসে হাজির হয়েছে। অফিসে আসার পরে ও ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকে, হাতের আঙুলগুলি বাঁকা হয়ে যায়। কলার খসে যাওয়া ইঁদুরে কাটা শতচ্ছিন্ন আকাকির ওভারকোটটা নিয়ে অফিসের সমস্ত সহকর্মী ব্যংগবিদ্রূপ করে থাকে।এমনকি দরজি পেট্রোভিচও শতচ্ছিন্ন আকাকির ওভারকোটটা নিয়ে বিদ্রূপ করে, ওভারকোটটা আর সেলাই না করে পায়ের পট্টি বানিয়ে নিতে উপদেশ দেয়। অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে আকাকি আশি রুবল দিয়ে একটি ওভারকোট বানাতে দেয়।আকাকি স্বপ্ন দেখে তাঁর আর কোনো কষ্ট নেই, বাতাস আর ছুরির মতো পিঠে বিঁধবে না, ঘাড়ের মাংসে দাঁত বসাবে না।
আকাকির নতুন ওভারকোটের সন্মানে হেডক্লার্কের ঘরে পার্টির আয়োজন করা হয়। প্রত্যেকেই ওভারকোটের দীর্ঘ জীবন কামনা করে। এরকম একটা দিন আকাকির জীবনে আগে কখনও আসেনি। পার্টির শেষে বাড়ি ফিরে আসার সময় পথের মানুষ, দোকানের সারি, ভাড়া করা শ্লেজগাড়ি এক নতুন সৌন্দর্য নিয়ে আকাকির দুই চোখে ধরা দেয়। ঠিক তখনই দুটি গুণ্ডার আক্রমণে আকাকিকে কোটটা হারাতে হয়।একটু দূরে পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। গুণ্ডাগুলি বহু দূরে চলে গিয়েছে বলে যগন বুঝতে পারল তখনই পুলিশ আকাকির দিকে এগিয়ে এল। গুণ্ডা দুটিকে অনুসরণ করে গ্রেপ্তার না করে পুলিশ আকাকিকে জেলে ঢুকিয়ে দেবার ভয় দেখায়। থানায় নালিশ জানাতে গেলে দারোগা আকাকিকে নানা ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করে।এরকম মনে হয় যেন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার চেয়ে সাধারণ মানুষকে কিছু একটা অজুহাতে মানসিক অত্যাচার করাটাই পুলিশ এবং দারোগার প্রধান কাজ। তার মধ্যেই সেই থানার অফিসাররা এক ধরনের বিকৃ্ত আনন্দ লাভ করে। এইক্ষেত্রে সেই সময়ের রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান স্বৈরাচারী অবস্থার এক আশ্চর্য ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়।আকাকি পুলিশের বড় অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ভাবে।অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডক্লার্ক আকাকিকে উৎসাহ দিয়ে বলে, বড় অফিসার আদেশ দিলে দারোগা কাজটা করে দিতে পারে, ওভারকোটটাও খুঁজে দিতে পারে, কিন্তু সেই কোটটা যে আকাকির তা প্রমাণ করাটা আকাকির পক্ষে বড় কঠিন হবে। সাক্ষী লাগবে, রসিদ লাগবে, উকিল, মোক্তার, জামিন আরও কত কিছুর প্রয়োজন হবে। একা সেই নয়, এইধরনের ওভারকোট যে একমাত্র আকাকিরই আছে তা না হতেও পারে। পিটাসবুর্গের অন্য অনেকেরও সেই একই ধরনের অভারকোট থাকতে পারে। অবশেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডক্লার্কের পরামর্শ অনুসরণ করে আকাকি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবে। কাজটা এত সহজ নয়। নিয়ম অনুসরণ করে প্রথমে পেসকারের হাতে দরখাস্ত জমা দিতে হয়,পেসকার সেটা ডেপুটি সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে দেয়, সেখান থেকে ফাইল যায় চিফ সেক্রেটারির কাছে ,আর চিফ সেক্রেটারি নিজে ফাইল কমিশনারের সেখানে দিয়ে আসে।বহু চেষ্টা চরিত্র করে আকাকি কমিচশনারের দেখা পায়। বেচারা আকাকি। সে জানত না যে সমগ্র রুশ সাম্রাজ্যে যেখানে বড় বড় সমস্যা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হৈ রয়েছে সেখানে তার মতো একজন সাধারণ কেরানির ওভারকোট নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় থাকতে পারে না। তাই অপমান করে আকাকিকে কমিশনারের দপ্তর থেকে বের করে দেওয়া হয়।
দীর্ঘ চাকরি জীবনে আকাকিকে একসঙ্গে চারদিন অফিসে অনুপস্থিত দেখে সবাই আশ্চর্য হয়। এর আগে ঝড়-তুফান, বৃষ্টি,অথবা অন্য কোনো সমস্যার জন্যই আকাকি অফিসে একদিনের জন্য ও অনুপস্থিত থাকেনি ।সেদিনই ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে জানতে পারা যায় যে প্রচণ্ড জ্বরের জন্য সেদিনই আকাকির মৃত্যু হয়েছে।
আকাকি কি কেবল পিটাসবুর্গের একজন সাধারণ কেরানি? তাহলে আকাকিকে কেন আমাদের এত পরিচিত বলে মনে হয়? কেন আমাদের মনে হয় সরকারি অফিসগুলিতে খুঁজে বেড়ালে। এই ধরনের অজস্র আকাকির দেখা পাওয়া যাবে।পাহারাওয়ালা থেকে আরম্ভ করে পুলিশের দারোগা এমনকি পুলিশ কমিশনারের মতো মানুষগুলিই তো আজ আমাদের দেশ শাসন করছে। সেই জন্য আজ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। বিশ্বকবির ‘দুই বিঘা জমির’উপেনের সমস্ত হারানোর যে অপরিসীম বেদনা তা আমাদের আকাকি বাশমাচকিনৰ কথা মনে পড়িয়ে দেয় না কি?
হোমেন বরগোহাঞির ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়’ উপন্যাসটি ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত হয়।উপন্যাসটিতে সমাজ বাস্তবতার একটি করুণ ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।আমাদের সমাজে মানুষের মানবীয় সত্তা ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। তার ফলে প্রাণহীন নীতি কিছু জন্মলাভ করেছে। আমরা যাকে নীতি বলি, তা প্রকৃতপক্ষে মানবতা-বিরোধী এবং সাধারণ মানুষের দুখ-দুর্দশার প্রতি উদাসীন। এই উদাসীনতা এক ধরনের শূন্যতার জন্মদান করেছে। উপন্যাসের সনাতন মহাজন এই শূন্যতার প্রতিভূ যারকপট আচরণ প্রান্তবাসী গরিব রসেশ্বরের জীবনে দুঃখ দুর্দশাকে ডেকে এনেছে। নিজের একটুকরো মাটি নিয়ে রসেশ্বর স্বপ্ন দেখেছিল।সেই স্বপ্ন নিজের পরিবারের সঙ্গে সন্তান সন্ততি নিয় সুখে দিন যাপন করার স্বপ্ন। যে মাটিটুকু নিয়ে রসেশ্বর স্বপ্ন দেখিছিল, সেই মাটিটুকুকে ছলে-বলে-কৌশলে ডাহা মিথ্যা কথা বলে সনাতন কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্র করে। সনাতনের এই কার্যে বিচারক থেকে আরম্ভ করে আমলা-মুহুরি -পিয়ন সবাই সাহায্য করেছে,রসেশ্বরের মতো দরিদ্র, কৃপার পাত্র অসহায় একজন মানুষকে এরা প্রতিটি মানুষই প্রবঞ্চনা করেছে। রসেশ্বর ন্যায় বিচার চেয়ে আদালতের কাছে বাকি থাকা ঘরের ভিটা, হালের গরু সমস্ত হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে।অথচ নিজের স্বার্থের খাতিরে সনাতন যখন একগুচ্ছ মিথ্যা কথা বলে এবং দুটো টাকা নিয়ে রসেশ্বরের কাছে এসে দাঁড়ায় তখন রসেশ্বর সমস্ত ভুলে সনাতনের হয়ে ইলেকশনের পোস্টার লাগিয়ে বেড়ায়। সনাতন শর্মা,ডিম্বেশ্বর মণ্ডল আদির মতো শোষক শ্রেণির হাতে সাধারণ মানুষের জীবন কত অসহায় তা লেখক উপন্যাসটিতে অত্যন্ত মমতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। রসেশ্বরের অবস্থা -ওভারকোট গল্পের আকাকি বাশমাচকিনের তুলনায় কোনো ক্ষেত্রেই কম করুণ নয়। উভয় কাহিনিরই মূল উপজীব্য আমলাতন্ত্রের স্বৈরাচার।সমাজে মানবতার মৃত্যু ঘটেছে।অ’ভারকোট গল্পের পাহারাওয়ালা দারোগা, হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায় উপন্যাসের ডিম্বেশ্বর মণ্ডল, সনাতন শর্মা, পিয়ন, কেরানি আর হাকিম ভুলে গেছেন যে আকাকি বাশমাচকিন এবং রসেশ্বরও ওদের মতোই মানুষ।মানবতার প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধের সঙ্গে তীব্র সমাজ সচেতনতা আকাকি বাশমাচকিন এবং রসেশ্বকে জীবন্ত করে তুলেছে।
অনুবাদক