Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 articel rupayan ghosh

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: ছায়া ও কায়া: কবির অতিসত্তা । রূপায়ণ ঘোষ 

Reading Time: 4 minutes
রাত্রি গভীর হলে স্টেশন ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে আসে। মফস্সলের অন্ধকার এখানে মানুষের কণ্ঠস্বরের চেয়ে অধিক গাঢ়। অনেক রাত্রিতে ঘুমের কলরব শুরু হলে প্যাঁচার ডানা খসখস আর গাছেদের পাতা পড়ার শব্দ ব্যতীত যখন কোনো আওয়াজ নেই, ঠিক তখন ঘুমের আবেশ ভেঙে ছায়া জেগে ওঠে। এই ছায়া ঠিক আমারই মতো কিন্তু বাধ্য নয়, আমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে। তার হাঁটার ভঙ্গি দৃপ্ত আবার সংকোচিতও। 
দৃপ্ত, কারণ, সে অনিয়ন্ত্রিত, মুক্ত, স্বাধীন। আর সংকোচিত, কেন-না সে শরীরবিহীন, আশ্রয়শূন্য! নির্জন স্টেশনের একটা সামান্য প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে অপর প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে যেতে সে পদে পদে আকার বদলায়। ছোটো ছোটো কুচি পাথর, সমান্তরাল রেললাইন! রেললাইনের অসীম বিস্তারের পাশে শুয়ে সে লক্ষ করছে আমার মুখাবয়ব; তাতে কোথাও সমান্তরাল ঘটনা, দৃশ্য এমনকী অভিব্যক্তিও নেই। এই না থাকা আসলে তারও না থাকা, এই এবড়ো-খেবড়ো উপত্যকা আদতে তাঁরও ভ্রমণ-প্রান্তর। সুতরাং সমান্তরাল পথ ত্যাগ করে সে উঠে যায়, যেভাবে আমার কবিতার বাক্  থেকে সমানুপাতিক সমস্ত বর্ণ হারাতে হারাতে দুর্বোধ্য প্রলাপের সৃষ্টি হয়। প্রলাপ লিখতে শুরু করি, ছায়া সেই অপলাপ ধারণ করে। 
প্ল্যাটফর্মের জ্যোৎস্নাহীন শেডের নীচে যে আধপাগলি মেয়েটা পোড়া রুটি থেকে একটু একটু করে জীবন শুষে নিচ্ছে— ছায়া সেই রুটির টুকরো হয়ে ঢুকে যাচ্ছে তাঁর হাঁ-এর অন্তরালে। বোধহীন এক জীবনের ভিতর এত অন্ধকার যে, সেখানে কোনো বর্ণ নেই, অক্ষর নেই। খাঁ-খাঁ শূন্যতায় ভাসতে-ভাসতে ছায়ারা কবিতার রসদহীন ভাণ্ডার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় অথচ বেরোতে পারে না। সকল উন্মাদের ভিতর সৃষ্টির অনাদি শব্দ খেলা করে— ছায়া সেই নাদ ধরে নিতে চায়, সে বিশ্বাস করে প্রতিটি শব্দের শরীরে কবিতার মিথুনগন্ধ রয়েছে। শব্দের মৈথুন, বর্ণের, অক্ষরের, পঙক্তির মৈথুন থেকে কবিতার সহস্র জন্ম হয়। তারপর? সেই জন্মের গন্তব্য কী? কবিতারা, কবিতার প্রতিচ্ছায়ারা, আভাসেরা ভেসে বেড়ায়? রক্ত-বিক্রেতা কোন গরিব সেই জন্মের স্বাদ পেয়ে ওঠে? 
না, কারণ, সে দেখতে পায় গভীর রাত্রে হাসপাতালের প্রধান ফটক হাট করে খোলা। মুহূর্তে তাঁর আনন্দিত চোখগুলি সিক্ত হয়ে উঠলে রক্তিম পঙক্তিরা তাঁর হেঁটে যাওয়াকে কাব্যিক যাত্রাপথ বানিয়ে তোলে। প্রতিটি মানুষ অপর মানুষের দিকে সংশয় নিয়ে তাকায়, প্রতিটি মানুষের ছায়া অন্য মানুষের ছায়া থেকে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে চায়। ছায়া ও কায়ার মধ্যে মিল নেই অথচ তাদের রহস্যের ভিতরে আশ্চর্য মিল। আমি ছায়া ও কায়ার বিষয়ে লিখি কিন্তু সম্পূর্ণ লিখতে পারি না। পৃথিবীর তামাম দেহ অথবা সমস্ত অবয়ব আমার পরিচিত নয়। ফুল-বিক্রেতা, সবজিওয়ালা, মাছ-বিক্রেতা এদের সকলকে এক অদ্ভুত নিত্যতায় চিনে নিয়েছি অথচ তাঁদের কারোরই ছায়াকে জানি না। এই না-জানা আমার প্রজ্ঞানেত্র খুলছে না, এই পরিচয়হীনতা আমার আনন্দময় সত্তা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। ছায়াও কি সেই ‘আত্মন্’-কে ত্যাগ করেছে যা তার গহন তমিস্রার মধ্যে থেকে ধ্বনির সঞ্চার করেছিল। সেই শব্দ, সেই ধ্বনি উৎসারের গভীরে কী ছিল- অশ্রু, রক্ত নাকি প্রতীক্ষা? 
আমার কবিতা, আমার বিম্বসত্তা ক্রম বিস্মিত হয়ে উঠছে; এই তিন অবস্থা— সবই প্রাণসংযুক্ত, সঞ্চারণশীল প্রবহমান এক অনন্তের অভিমুখে নির্দেশিত। 
“প্রাণইতি স ব্রহ্ম ত্যৎ ইত্যাচক্ষতে।”— প্রাণ, ব্রহ্ম এবং তথ্য পৃথক অথচ যেন একই সংজ্ঞাভুক্ত, কারণ, এর উৎসই তো হৃদয়। নিজস্ব অতিসত্তার দিকে চেয়ে স্তব্ধ হচ্ছি। হৃদয়ের ক্ষরণেই তো অশ্রু ও রক্তের অনুভব,  তাদের বেদনা অথবা মায়ার উৎসমুখ। প্রতীক্ষার দিকে তাকিয়ে দেখছি সে নিরবয়ব অথচ মানুষের আকুল চোখে প্রাণীর অনন্য সহজাত প্রাথমিকতায় তার বদলে যাওয়া রূপ-লাবণ্য যেন দূর থেকে দূরগামী। দিগন্তজুড়ে জোনাকির মতো তার অবিরত জ্বলা-নেভার কারুকার্য;  আমার ছায়াসত্তা সেদিকে ছুটে যায়। আলোর পিছনে ধাবিত হতে হতে তার হাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে পড়ে; সেখানে অরণ্যের আদিম অন্ধকারেও প্রাণ থাকে। জীবনের আলো-আঁধারের মধ্যে শুরু হয়ে যায় সংগ্রামপ্রথা। জোনাকির আলো, ঝিঁ-ঝিঁর নিশীথবর্ণ ডাক— আমরা পর্যায়ক্রমে দেখতে থাকি মানুষ অথবা বিহঙ্গের মতো! 
এই দৃষ্টি না মানুষের, না পাখির। ছন্দহীন ঘুমের দিকে ঝুঁকতে থাকা রাত আমাদের দেখার আকাঙ্ক্ষা কেড়ে নেয়, যুদ্ধ শেষ হয় কিংবা হয় না। এই আকাঙ্ক্ষা অন্তর্নিহিত শক্তির বিমুক্ত এক চিত্ত যা নিজেকে সর্বব্যাপী বিরাটের মধ্যে দেখার জন্য ব্যাকুল। 
“তদেব বহুভবনং প্রয়োজনং নাদ্যাপি নির্বৃত্তম্।”— একই শরীর, একই চেতনা অথচ তার অভ্যন্তরে ‘বহু’ হয়ে ওঠার দুর্বার সাধ— যা মেটেনি, যা মিটছে না। অপ্রতিহত সৃষ্টির বেগে সে বদলে যায় নতুন, আরও নতুন আকারে-প্রকারে, উল্লাসে-বেদনায়। কবির সৃষ্টির এই বেগ কি অনুভব করতে পারে তার প্রতিসত্তা? 
কাব্যের শরীর ভাঙে— ছেনি, হাতুড়ি, তুলির ব্যবহারে ব্যবহারে এই অপরিসীম জড়তা ভাঙতে ভাঙতে বেদনার নিরন্তর প্রবাহ জেগে থাকে। কেমন করে সে তার স্বগত আড়ষ্টতা দূর করে আকৃতির অথবা আকাঙ্ক্ষিত অভিব্যক্তির পূর্ণ সরল ও স্বচ্ছতম উপাদান হয়ে উঠবে, সেজন্যই কবির বিরামহীন প্রয়াস। যেভাবে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না বৃক্ষের সবুজ শাখা চুইয়ে চুইয়ে ময়ূরের পেখমে ঝরে পড়ে; এই প্রয়াস সেই জ্যোৎস্নার মতোই অবিরাম। এই ময়ূর— তার অনন্য প্রতিবিম্ব ছড়িয়ে রয়েছে বহুদূর, তার শরীর ছাড়িয়ে সেই বিস্তার। তবে কি মনুষ্যেতর প্রাণীর ছায়াও এই ক্রীড়ামগ্ন গতির বাহক? এ-প্রশ্ন উঠতে উঠতে পঙক্তিরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়। তারা জিজ্ঞাসা রাখে সেলফ্ [Self] আর সোল্ [Soul] কি আত্মার পরিপূরক? 
এই ময়ূর ও কবি? তারাও কি পারস্পরিক নির্ভরতায় সংযুক্ত! প্রকৃতপক্ষে এই ‘আত্মা’, ‘আমি’ ও ‘অহং’-এর অপকৃষ্টার্থকে সজোরে নিক্ষেপ করে প্রজাতিগত হয়েও একান্তভাবে বিশেষ [Particular] তথা অনন্য [Unique]। 
“অহংসর্বস্বহন্তঃ প্রতিস্বরানন্তং সর্বব্যাপী নির্বৃত্তম্।” – এই ‘প্রতিস্ব’ সেই সক্ষমতার সংগীতবৈভব যা বিবর্তনের ফলে মনুষ্যেতর থেকে মানুষের ক্রীড়াক্ষেত্রে সমৃদ্ধতর ব্যক্তিতায় (Prosperous Individuality) পরিণত হয়। এতসব প্রশ্নের জটিল আবর্তে চাঁদের আলো এসে পড়ে না, শীতল হয়ে ওঠে না অফুরান অনুসন্ধান। কেবল আমার বিম্বিত উপলব্ধি সকল তাদের সৃজনধর্মিতা আঁকড়ে রূপ সৃষ্টির বিলীয়মান শিল্পের কথকতা গেয়ে চলে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি কথাও গাওয়া যায়! বাতাসের হিল্লোলে যে শব্দ, বৃক্ষের সঙ্গে তার তো কথকতারই সম্পর্ক। সেই শব্দমালার গহনে যে সুর রয়েছে কবি তো তাকে সংগীত ব্যতীত অন্য কিছু ভাবতে সক্ষম নন। আসলে তার ভেতরের দ্বিতীয় সত্তা [Alter Ego] সমস্ত চরাচর জুড়ে হয়ে ওঠা গতিসমূহের শরীর ভাঙে, চূর্ণ করে। দ্যাখে গদ্যের অবিরল ধারা— সে ক্ষুন্ন হয়, তীক্ষ্ণ হয়, ক্রোধান্বিত হয়। ছন্দের ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে পৃথিবীর তামাম সত্তার ভিতরে কুঁদে দিতে চায় কাব্যিক উদাসীনতা, ভাব ও রূপের প্রকাশ অথবা অপ্রকাশ। গড়ে দিতে চায় প্রমূর্ত আঁধার, অমূর্ত আলো। কেননা তমসা বিস্তৃত অনন্ত আদতে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেছে, আলো সেখানে বন্দিনী চাহনির কাছে উপস্থিত করে সেই আধ-পাগলি নারী, দরিদ্র রক্ত-বিক্রেতা, মৃত্যুর কোলাহল অথবা জীবনের উল্লাস।  
দেখতে দেখতে দৃষ্টি নিরপেক্ষ এক অবস্থানে এসে পড়ে, তুলাদণ্ডের মতো তার শির— দু-পাশে দোদুল্যমান আলো-অন্ধকার, কায়া ও ছায়া, ব্যক্তি ও কবি! তবে কি কবি ঈশ্বর আর ব্যক্তি মেফিস্টোফেলিস? নাকি কবিই একইসঙ্গে ঈশ্বর আর শয়তান? 
ভাবতে ভাবতে বহির্ভাগের কলরব স্তিমিত হয়ে আসে। ছান্দোগ্য ইন্দ্রজালে চরাচর বশীভূতকারী কবি আদতে সেই মেফিস্টোফেলিস যে ভ্রাম্যমাণ পণ্ডিতের ছদ্মবেশে আমাদের অনন্ত কুহেলিবৃত্তে প্রবেশ করে এল। রাত্রির জনশূন্য স্টেশন সজাগ হয়, পোড়া রুটি, অর্ধোন্মাদ গর্ভবতী নারী, রক্ত-বিক্রেতা, ফুটপাতের ধারে শুয়ে থাকা অর্ধজাগ্রত কুকুর, জোনাকি, ময়ূর সকলেই সচকিত হয়। কবির কলম থেকে নির্গত হচ্ছে অপদেবতার সমবেত সংগীত। পোশাক খুলতে খুলতে সেই গান গেয়ে যাচ্ছে চন্দ্রাহত নারী! তবে কি সে ‘মার্গারেট’? কবির ভিতরের লোলুপ সাপ জাগ্রত হচ্ছে। ছায়া ও কায়া মুখোমুখি, মুখোমুখি ঈশ্বর ও শয়তান। সেই অর্ধোন্মাদ নারী প্রাণ প্রসব করতে করতে মৃত্যু ছুঁয়ে ফেলছে;  পাথরের মতো হয়ে উঠেছে কবির কলম। জীবন ও মৃত্যুর দু-দিকে দাঁড়িয়ে ঈশ্বর ও মেফিস্টোফেলিস। কী চায় তাঁরা, যোনি সম্ভোগ? নাকি যোনির সৃষ্টি-আরাধনা?
কবি ভেবে চলেছে; সময় বহমান কিন্তু অন্ধকার শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কবি নিজস্ব সত্তার দিকে চেয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। সে জানে অন্ধকার শেষ হয় না, কেবল সঞ্চারিত হয়। 

One thought on “উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: ছায়া ও কায়া: কবির অতিসত্তা । রূপায়ণ ঘোষ 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>