| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মলগ্ন 

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট


১.

১৯৫৯ সনে প্রভাবশালী অস্ট্রিয়ান দার্শনিক কার্ল পপারের ইংরেজী বই The Logic of Scientific Discovery বের হল। এটি ছিল তাঁর ১৯৩৪ সনের মূল জার্মান বইটির বর্ধিত সংস্করণ। পপার বললেন, বিজ্ঞানের দর্শনে ভ্রান্তিকরণের (falsifiability) ধারণা থাকতে হবে, অর্থাৎ একটি অনুকল্পকে (hypothesis) তখনই বৈজ্ঞানিক বলা যাবে যদি সেটিকে মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো সুযোগ থাকে। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল “সব রাজহাঁস সাদা”। এটি একটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প কারণ রাজহাঁসকে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন কিছু নয়, এবং এর মধ্যে একটি রাজহাঁসকে যদি কালো বা অন্য রঙের দেখতে পাওয়া যায় তাহলে অনুকল্পটি মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রমাণ হবে এবং “সব রাজহাঁস সাদা” বাক্যটি একটি তত্ত্বে পরিণত হবে না। বিজ্ঞানে তত্ত্ব হল এমন একটা জিনিস যা সমস্ত পর্যবেক্ষণ উত্তীর্ণ হয়েছে, যেমন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব।

অন্যদিকে “এই ঘরটি এমন বিশেষ অদৃশ্য কণা দিয়ে ভর্তি যা কিনা কোনো পর্যবেক্ষণ দ্বারাই দৃশ্যমান হবে না” বৈজ্ঞানিক অনুকল্প নয় কারণ এই প্রস্তাবটি প্রথমেই বলে দিয়েছে যে, কোনো পর্যবেক্ষণ দিয়েই সেই কণা দেখা যাবে না, অর্থাৎ এই প্রস্তাবটিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো উপায়ই নেই। এর মানে এই নয় যে, ওই ঘরে ‘বিশেষ অদৃশ্য কণা’ নেই, কিন্তু ভ্রান্তিকরণের কোনো সুযোগ না দেবার জন্য অনুকল্পটি বিজ্ঞানের আওতায় পড়বে না।

ওপরের কথাগুলির ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির যে প্রক্রিয়াগুলি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা একমত হলেন তা হল (১) একটি অনুকল্পের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ভাবীকথন (prediction) করবেন, (২) তারপর হয়ত একটি এক্সপেরিমেন্ট প্রস্তুত করবেন যার ফলাফল সেই ভাবীকথনকে সত্য বা মিথ্যা (অথবা এদের কোনো মিশ্রিত রূপ) প্রমাণ করবে এবং (৩) সেই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অনুকল্পটির পরিমার্জন করে আবার নতুন এক্সপেরিমেন্ট করা হবে। যেখানে এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব নয় (যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, ভূবিদ্যা ইত্যাদি) সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অনুকল্পটিকে প্রতিষ্ঠা বা পরিত্যাগ করা সম্ভব। অবশেষে সমস্ত ভাবীকথন উত্তীর্ণ হলে অনুকল্পটি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পরিণত হবে।     

ইদানিংকালে কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ‘ভ্রান্তিকরণ’ ধারণাটিকে উন্নত তত্ত্বের গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে দাবি করছেন। আমাদের মহাবিশ্বর বাইরে অন্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ধারণাটি – যাকে বহুমহাবিশ্ব (multiverse) অনুকল্প বলা হয় – নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন কিন্তু এই ধারণাটিকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার কোনো হাতিয়ার তাঁরা দিতে পারছেন না, এই সমালোচনার মুখে পড়ে তাঁরা বলছেন ‘ভ্রান্তিকরণ’ নীতিটির পরিবর্তন দরকার। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায়ও বহুবিশ্ব বা Many Worlds নামে একটি তত্ত্ব অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর প্রিয়, সমস্যা হল এটির সত্যতা যৌক্তিক অনুমানের ভিত্তিতে নির্ধারিত করতে হবে, ‘ভ্রান্তিকরণ’ নীতি দিয়ে নয়। যেহেতু এই ধরণের প্রস্তাব বৃহত্তর বিজ্ঞানী মহলে এখনো গৃহীত হয়নি, তাই আমরা অনুকল্প, ভাবীকথন, এক্সপেরিমেন্ট বা পর্যবেক্ষণ, উপসংহার – এই ক্রমটিকেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে গ্রহণ করছি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ফ্রান্সিস ব্যাকন (১৫৬১ – ১৬২৬)

ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস ব্যাকন (১৫৬১ – ১৬২৬) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এই ক্রমটিকে লিপিবদ্ধ করেন। ব্যাকনকে অভিজ্ঞতাবাদের (empiricism) স্রষ্টাও বলা হয়। পরীক্ষা, সরাসরি পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানার্জন অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে পড়ে। ব্যাকনের সমসাময়িক ইতালীয় গ্যালিলেও গ্যালিলেইকে (১৫৬৪ – ১৬৪২) আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদের প্রথম বিজ্ঞানী বলা হয়। গ্যালিলিওর কথা বাংলায় (বা ভারতে) পৌঁছাতে দু শ বছর মত লেগেছিল, ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১) ইংরেজী বইসমূহের ওপর ভিত্তি করে লিখলেন (১৮৪৯ সনে) কয়েকজনের জীবনী, তাদের মধ্যে ছিলেন কোপের্নকাস, গ্যালিলেও, নিউটন ও হার্শেল (ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কর্তা) প্রমুখ। গ্যালিলিও প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন –

“অজ্ঞ লোকেরা বোধ করিয়া থাকে, বস্তুর গুরুত্ব অর্থাৎ ভার আছে বলিয়া উহা ভূতলে পতিত হয়। আর যাহার গুরুত্ব যত অধিক তাহা তত শীঘ্র পতিত হয়। পূর্ব কালে অরিস্টোটল প্রভৃতি অতি প্রধান ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা এই মত প্রতিপন্ন করিয়া গিয়াছিলেন, এবং আমাদের দেশের নৈয়ায়িকদেরও এই মত। কিন্তু ইহা ভ্রান্তিমূলক, প্রকৃতির নিয়মানুগ নহে। … পরীক্ষা দ্বারা স্থিরীকৃত হইয়াছে, নির্বাত স্থানে গুরু ও লঘু বস্তু, যুগপৎ পরিত্যক্ত হইলে, যুগপৎ ভূতলে পতিত হয়।”

আমি নিশ্চিত নই এখানে বিদ্যাসাগর কোন ভারতীয় নৈয়ায়িকদের কথা বলেছেন, যদিও আর্যভট্ট (৪৭৬ – ৫৫০) এবং ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮ – ৬৬৮) পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে বস্তুর পতন হয় সেরকম ধারণা দিয়েছিলেন এবং অ্যারিস্টোটলের মত তাঁরাও ধারণা করতে পারেন যে, ভারি বস্তু আগে পড়বে। গ্যালিলেওর আকাশ পর্যবেক্ষণ নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন –

“গ্যালিলেয় [ঈশ্বরচন্দ্রর বানান], এই দৃষ্টিপোষক নলাকার নূতন যন্ত্র নভোমণ্ডলে প্রয়োগ করিয়া, দেখিতে পাইলেন, চন্দ্রমণ্ডলের উপরিভাগ অত্যন্ত বন্ধুর; সূর্যমণ্ডল সময় সময়ে কলঙ্কিত লক্ষ্য হয়; ছায়াপথ সূক্ষ্মতারকাস্তবকমাত্র; বৃহস্পতি পারিপার্শ্বিকচতুষ্টয়ে পরিবেষ্টিত; শুক্রগ্রহের চন্দ্রের ন্যায়, হ্রাস বৃদ্ধি আছে; শনৈশ্চরের উভয় পার্শ্বে পক্ষাকার কোনো পদার্থ আছে। ওই পক্ষ এক্ষণে অঙ্গুরীয় বলিয়া সিদ্ধান্তিত হইয়াছে।”

একটি বাক্যে জ্যোতির্বিদ্যায় গ্যালিলেওর সমস্ত আবিষ্কারের কথাই উল্লেখ করা হল। কোপেরনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাজগতের কথা প্রচার করে গ্যালিলেও চার্চের রোষানলে পড়লেন, ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষায় “যাজকেরা তাঁহার নামে ধর্মবিপ্লাবক বলিয়া উপস্থিত করাতে, ১৬১৫ খৃঃ অব্দে, তাঁহাকে রোমনগরীর ধর্মসভার সম্মুখে উপস্থিত হইতে হইল।” গ্যালিলেওর এই ভাগ্যকে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের সঙ্গে তুলনা করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর বিধবা বিবাহ প্রচলন ও বহু বিবাহ রোধের প্রস্তাবনা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কাছ থেকে যে প্রতিরোধ পেয়েছিল সেটিকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমে ইউরোপে ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ১৬৩৩ সনে গ্যালিলিওকে যখন আবার রোমে ডাকা হল তাঁর বিজ্ঞান ধারণাকে পরিত্যাগ করার জন্য, যাজক বিচারকরা গ্যালিলিওকে বললেন (ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষায়)  –

“তোমাকে আমাদের সম্মুখে আঁঠু পাড়িয়া ও বায়বল [বাইবেল] স্পর্শ করিয়া কহিতে হইবেক, আমি পৃথিবীর গতি প্রকৃতি যাহা যাহা প্রতিপন্ন করিয়াছি সে সমুদায় অস্বর্গ্য, অশ্রদ্ধেয়, ধর্মবিদ্বিষ্ট ও ভ্রান্তিমূলক। গ্যালিলেয়, সেই বিষম সময়ে মনের দৃঢ়তা রক্ষা করিতে না পারিয়া, যথোক্ত প্রকারে পূর্বনির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করিলেন। কিন্তু গাত্রোত্থান করিবামাত্র, আন্তরিক দৃঢ় প্রত্যয়ের বিপরীত কর্ম করিলাম, এই ভাবিয়া মনোমধ্যে ঘৃণারোষসহকৃত যৎপরনাস্তি অনুতাপ উপস্থিত হওয়াতে, তিনি পৃথিবীকে পদাঘাত করিয়া উচ্চৈস্বরে কহিলেন, ইহা এখনো চলিতেছে।”

গালিলেও গ্যালিলেই (১৫৬৪ – ১৬৪২) 

‘ইহা এখনো চলিতেছে’ (ইংরেজীতে And yet it moves, ইতালীয় ভাষায় E pur si muove) মানুষের বিজ্ঞান চেতনা ও শত প্রতিরোধের মুখে সত্য প্রকাশের এক বলিষ্ঠ বাণী। শত প্রতিরোধ ও বিপদের সম্মুখীণ হয়েও গ্যালিলেও বলতে চাইলেন, তোমরা যাই বল, পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে এবং সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সে স্থির নয়, এই হল সত্য। এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অথবা ঠিক কবে এবং কোন জায়গায় গ্যালিলেও কথাটি বলেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু আমরা জানি এই বিচারের পরে গ্যালিলওকে বৃদ্ধ বয়সে আবার নির্বাসন ভোগ করতে হল। এটা ভাবা বোধহয় অযৌক্তিক হবে না যে, বিদ্যাসাগর গ্যালিলিওর সঙ্গে সহমর্মিতা বোধ করতেন। যদিও তাঁদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন ছিল, কিন্তু আমি বলব তৎকালীন সমাজের জড়বুদ্ধির আঁধার কাটাতে তাদের সেই কর্মের চরিত্র একই ছিল। গ্যালিলেও যে ব্যাকনীয় পন্থায় (অভিজ্ঞতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে) সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মপদ্ধতিকে অনেকটা সেই আলোকে দেখা যেতে পারে। শেষের বাক্যটি আমার একটি অনুকল্প মাত্র, সেটিকে প্রমাণ করা অবশ্য বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য নয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১) 

ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বহু বছর কাজ করেছেন। ১৮০০ সনে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা করে মূলত ব্রিটিশদের বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা শিক্ষা দেবার জন্য। ১৭৮৪ সনে ভাষাবিদ উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬ – ১৭৯৪) কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির (Asiatic Society) পত্তন করেন, এর উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার অন্তর্গত অঞ্চলের ঐতিহাসিকভাবে সঞ্চিত জ্ঞানের সন্ধান করা। ওই সময়ে জোনস ফোর্ট উইলিয়ামে বিচারকের ভূমিকা পালন করছিলেন, প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ছিল প্রবল উৎসাহ। উইলিয়াম জোনস প্রস্তাব করেছিলেন সংস্কৃত, গ্রীক ও ল্যাটিনের উৎস একই, সেই উৎস হল কোনো একটি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। তবে জোনসের আগে অনেকেই এই সংযোগের কথাটি বলেছিলেন। প্রথম দিকে শুধুমাত্র ইউরোপীয়রা এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হতে পারলেও ১৮২৯ থেকে ভারতীয়রা এর সদস্য হবার সুযোগ পেলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নাল ঐ সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ওপর গবেষণা ছাপায়। এর মধ্যে, ১৮৩৫ সনে, কলকাতা মেডিকাল স্কুল স্থাপন করা হয় এবং বেশ কিছু মেডিকাল জার্নাল প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময়কার বিলেতি বা ভারতীয় উভয় গবেষকদের বেশিরভাগ কাজ হয় উদ্ভিদ নয় চিকিৎসাবিদ্যায় নিবদ্ধ ছিল। প্রশ্ন হল আমরা যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম সেই পদ্ধতির প্রায়োগিক দিকগুলি এশিয়াটিক সোসাইটি বা মেডিকাল জার্নালগুলোর লেখায় পাওয়া যায় কিনা।

এর উত্তর দিতে হলে আমাদের মানসে বাংলাদেশ দু শ বছর আগে কেমন ছিল সেটিকে মূর্ত করতে হবে। মধ্যযুগে ইসলামের বিজ্ঞানের যে স্বর্ণসময় বলা হয় তখন আল বেরুনির (৯৭৩ – ১০৪৮) ব্যক্তিনিরপেক্ষ বস্তুগত (objective) পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বা আলোকবিজ্ঞানের পিতা বলে খ্যাত হাসান ইবনুল হায়সামের (৯৬৫ – ১০৪০) এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে অনুকল্পের প্রমাণ/অপ্রমাণ ইত্যাদি পদ্ধতিকে ব্যাকনের অভিজ্ঞতাবাদের কাছাকাছি বলা যেতে পারে। ভারতে প্রায় আট শ বছরের সুলতানি, মোগল বা নবাবি শাসন সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কোনো কিছুই আমদানি বা আত্মস্থ করতে পারে নি। নিঃসন্দেহে সেই সময়ে ধাতুবিদ্যা, সমরবিদ্যা বা স্থাপত্যে অনেক কুশীলব ছিলেন, কিন্তু মহাবিশ্বের প্রকৃতির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা বা সেই সম্বন্ধীয় কোনো পর্যবেক্ষণের ছক স্থাপন করার মত কোনো বড় ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে না। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনামলে ইতালিতে গ্যালিলেও বৃহস্পতির চাঁদ আবিষ্কার করছিলেন, বিলেতে ফ্রান্সিস ব্যাকন লিখছিলেন The Advancement of Learning। জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের সময় ইউরোপের সঙ্গে ভারতের পূর্ণ যোগাযোগ ছিল এবং বাণিজ্য ছাড়াও আর্টের ক্ষেত্রে কিছু পারস্পরিক প্রভাব পাওয়া যায়, কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁর বৈজ্ঞানিক প্রভাব ভারত পর্যন্ত পৌঁছাল না।


বিখ্যাত ওলন্দাজ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্টের আঁকা “শাহজাহান ও দারা শিকোহ” (১৬৬০)

এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করত হল ঊণবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। ১৮২৩ সনে রামমোহন রায় তৎকালীন গভর্নর জেনেরাল উইলিয়াম অ্যামহার্স্টকে লিখলেন, যার ভাবটি হল মোটামুটি এরকম – সরকার থেকে একটি নতুন সংস্কৃত কলেজ খোলার কথা শুনে আমরা যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এখানে ইউরোপীয় শিক্ষকেরা আমাদের গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়ন, শারীরবিদ্যা এবং আরো দরকারি বিষয়াদি শেখাবে, কিন্তু যখন শুনলাম এখানে হিন্দু পণ্ডিত নিয়োগ করা হবে – যারা দু হাজার বছর পুরানো আধ্যাত্মবাদ, যা কিনা বলে আমার যা দেখি তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই, তাই পড়াবেন – সেটা শুনে হতাশ হলাম। এতে আমাদের তরুণেরা কোনো শিক্ষাই লাভ করবে না, আমাদের দরকার উদার ও আলোকিত শিক্ষা  

ইতিমধ্যে, ১৮১৭ সনে, রামমোহন ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫ – ১৮৪২) সহ অন্যান্য কয়েক জনের সাহায্যে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন যা এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে নামে খ্যাত। ডেভিড হেয়ার ২৫ বছর বয়সে স্কটল্যান্ড থেকে ঘড়িনির্মাতা ও ব্যবসায়ী হিসেবে কলকাতা আসেন, কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলায় আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান অনেক। ১৮১৭ সনে School Book Societyর প্রতিষ্ঠায় তিনি অন্যতম ভূমিকা রাখেন, এই প্রতিষ্ঠান ইংরেজী ও বাংলায় টেক্সট বই ছাপিয়ে শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করে। অনেকের মতে বাংলায় রেনেসাঁর সূত্রপাত ১৮১৭ সনে থেকেই। পুরো ঊণবিংশ শতাব্দী জুড়ে হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি দূর করতে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকার কথা আমাদের জানা, তাঁর মধ্যে সমাজে বিজ্ঞানবোধ বিকাশে অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০ – ১৮৮৬) ও তাঁর সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।         

                     
এবার আমরা আবার ফিরে যাই ঊণবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর ব্যাপারে। প্রথম দিকে সেগুলোতে শুধুমাত্র ইউরোপীয় গবেষকদের লেখাই ছিল, দেশীয় বিশেষজ্ঞর প্রথম লেখা বের হয় কলকাতা মেডিকাল ও ফিজিকাল সোসাইটির পত্রিকায় ১৮২৯ সনে, রামকমল সেন লিখলেন বেল গাছের বর্ণনা ও বৈশিষ্ট্য। বিদেশের জার্নালে প্রথম বাঙালীর লেখা বের হয় ১৮৭৪ সনে, গ্লাসগোর মেডিকাল জার্নালে। লিখলেন গোপাল চন্দ্র রায়, পেঁপের রসের ওপর। তবে গোপাল রায় ওই সময়ে কুষ্ঠ রোগ থেকে আরম্ভ করে শল্য চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় মেডিকাল জার্নালে প্রচুর পেপার লিখেছেন। ঊণবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বাংলা মানসে প্রবেশ করল। ১৮৮০ সন থেকে প্রমথনাথ বসু ভূতত্ত্ববিদ্যার ওপর দেশে এবং বিদেশের জার্নালে লিখতে থাকলেন আর ওই বছরই (১৮৮০) আশুতোষ মুখার্জি (১৮৬৪–১৯২৪) ইউক্লিডের ২৫তম প্রস্তাবনার একটি নতুন গাণিতিক প্রমাণ দিলেন, এই কাজটি কেম্ব্রিজের Messenger of Mathematics পত্রিকায় ছাপা হল। আশুতোষ মুখার্জির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৬। পরবর্তী ১০/১২ বছর তাঁর ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক প্রবন্ধ লেখেন যেগুলোর বেশিরভাগই এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে বের হয়। আশুতোষ মুখার্জি সম্পর্কে পরে আবার লিখছি।

১৮৯৫ সনে জগদীশ বসু লিখলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Electrician জার্নালে। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল On Polarisation of Electric Rays by Double-Refracting Crystals। এখানে Electric Rays বলতে বেতার তরঙ্গই বোঝানো হয়েছে, জগদীশ বসু দেখালেন দৃশ্যমান আলোকে বিভিন্ন কেলাস দিয়ে যেভাবে পোলারাইজ করা যায়, বেতার তরঙ্গকেও সেরকম করা সম্ভব, পোলারাইজ করা অর্থ হল তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের তড়িৎ অংশটির দিক পরিবর্তন। জগদীশ বসু ছিলেন একজন ভাল এক্সপেরিমেন্টালিস্ট সেটি তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়লে বোঝা যায়, অন্যদিকে তাঁর এক্সপেরিমেন্টের তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলি তাঁর প্রবন্ধে সেরকমভাবে পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হল যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কথা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল জগদীশ বসুর কাজে সেটি প্রতিফলিত হয়েছে কিনা। পোলারাইজেশন নিয়ে প্রবন্ধটি তিনি এই অনুকল্প দিয়ে শুরু করেছেন যে, যদি দৃশ্যমান আলো ও বেতারতরঙ্গ একই ধরণের জিনিস হয় (অর্থাৎ দুটিই যদি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ হয়) তবে দৃশ্যমান আলোকে যেভাবে পোলারাইজ করা সম্ভব বেতার তরঙ্গকেও সেভাবে সম্ভব। তাঁর এক্সপেরিমেন্ট সেটি প্রমাণ করল। এই অর্থে জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন বাংলা তথা ভারতের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী। পরবর্তী পাঁচ বছরে বেতার তরঙ্গ নিয়ে লিখলেন প্রায় ২০টি প্রবন্ধ। ১৮৯৭ সন থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রসায়নে প্রচুর গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করলেন। বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবে এই চারজন মানুষের – আশুতোষ মুখার্জি, জগদীশ বসু, প্রফুল্ল রায় ও প্রমথনাথ বসুর – হাত ধরে।

জগদীশ চন্দ্র বসু লন্ডনের Royal Institution-এ তাঁর এক্সপেরিমেন্ট দেখাচ্ছেন (১৮৯৭)

২.
বিংশ শতাব্দীর প্রথমে পদার্থবিদ্যায় বিল্পব হল, এল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এই ধারায় অবদান রাখলেন এবার সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা। নতুন বিজ্ঞান সম্বন্ধে জানতে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন বাংলায় নিবাসী এক জার্মান ভদ্রলোক। সেই কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনিটি সংক্ষেপে বর্ণনা করে এই প্রবন্ধের ইতি টানব।

প্রথমে বলি মহেন্দ্রলাল সরকারের (১৮৩৩–১৯০৪) কথা। মহেন্দ্রলালের স্বপ্ন ছিল বিলেতের রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের মত ভারতে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যা কিনা বিজ্ঞান চর্চায় মৌলিক অবদান রাখবে। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৭৬ সনে কলকাতায় গঠিত হয় Indian Association for the Cultivation of Science। এই প্রতিষ্ঠানেই ১৯০৭ সন থেকে চন্দ্রশেখর রামান আলোর বর্ণালীর ওপর তাঁর নোবেল বিজয়ী গবেষণা করেন। এখানেই আশুতোষ মুখার্জি গাণিতিক পদার্থবিদ্যার ওপর লেকচার দিতেন। ১৮৮৬ সনে বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জনের পরে আশুতোষ মুখার্জি ভেবেছিলেন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শিক্ষকের পদ পাবেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় ওই পদটির জন্য ফান্ডিং জোগাড় করতে পারলেন না, হতাশ হয়ে আশুতোষ আইনে বিশেষজ্ঞ হলেন এবং ১৯০৪ সনে কলকাতা উচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলেন। আশুতোষ মুখার্জি আবার ১৯০৬ থেকে ১৯১৪, আবার ১৯২১ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন এবং তাঁর উদ্যোগেই ১৯১৬ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে University College of Science প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনিই মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু ও চন্দ্রশেখর রামানের মত প্রতিভাবান মানুষদের বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আশুতোষ মুখার্জিকে যদি প্রথমেই গণিতের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হত তিনি গণিতে বিশ্বমানের অবদান রাখতে পারতেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
আশুতোষ মুখার্জি (১৮৬৪ – ১৯২৪)

সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ এনারা সবাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন, তাঁরা ১৯১৭ সনে পাশ করে বের হলে আশুতোষ মুখার্জির কাছে গেলেন পদার্থবিদ্যার নতুন শাখাগুলোর ওপর বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করার আর্জি নিয়ে। সত্যেন বসু লিখছেন, “খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পাশে লাইব্রেরীঘরে স্যার আশুতোষের খাস-কামরায় হাজির হলাম আমি মেঘনাদ, শৈলেন – অবশ্য ভয়ে ভক্তিতে সকলেই বিনীত নম্র – একেবারে গোবেচারী ভাব। … জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা কি পড়াতে পারবি? ‘আজ্ঞে যা বলবেন, তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।’ আশুতোষ হাসলেন, তখন পদার্থবিজ্ঞানে নানা নতুন আবিষ্কার হয়েছে। আমরা মাত্র নাম শুনেছি। বেশির ভাগ জার্মানিতে…প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন, বোর – তখন শুধু নাম শুনেছে বাঙালী। জানতে গেলে পড়তে হবে জার্মান কেতাব, বা অনুসন্ধান–পত্রিকা নানা ভাষায়। যুদ্ধের মধ্যে সেসব বেশির ভাগ ভারতে আসে না।”

সত্যেন ও মেঘনাদকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিজ্ঞান বিভাগ University College of Science-এর প্রভাষক করা হল, কিন্তু নতুন বিজ্ঞান পড়াতে হলে নতুন বই চাই। কোথায় পাওয়া যাবে? আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ওপর বই ছিল (মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু মূল জার্মান থেকে আইনস্টাইন অনুবাদ করছিলেন), কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব কোথায় পাওয়া যাবে – পড়তে হবে বোলটজমান, কারশফ, প্ল্যাঙ্ক! এখানে মনে রাখতে হবে তখনও হাইজেনবার্গ, শ্রোডিনজারের মত দিকপালের আবির্ভাব হয়নি। তখন তাঁরা খোঁজ পেলেন ব্রুহল (Paul Johannes Bruhl) নামে এক জার্মান ভদ্রলোকের যিনি কিনা কলকাতার অদূরে শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সবই পড়াতেন – পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূবিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, কৃষি।

ব্রুহলের জন্ম বর্তমান জার্মানির পূর্ব প্রান্তে, ওয়েফা গ্রামে ১৮৫৫ সনে। তাঁর ছোট বয়সেই যক্ষ্মা ধরা পড়ল, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ভারতের গরম আবহাওয়ায় পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, তো বের হয়ে পড়লেন পায়ে হেঁটে সেই সুদূর যাত্রায় ১৮৭৮ সনে ২৩ বছর বয়সে। জার্মানি থেকে দানিয়ুব নদীর তীর ধরে তুরস্ক, তারপর আরমেনিয়া ও পারস্য হয়ে পৌঁছেছিলেন করাচিতে ১৮৮১ সনে। পথে ইস্তাম্বুলে কিছুদিন পড়ালেন, আর সংগ্রহ করলেন প্রচুর উদ্ভিদের নমুনা। করাচি থেকে  জলপথে এলেন কলকাতা। ১৯৮২ সনে তাঁকে Provincial Education Service-এ অন্তর্গত করা হল (Indian Education Service এর থেকে অবশ্য একটু বেশি মর্যাদাপূর্ণ ছিল। তারপর বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজে পড়ালেন এক বছর। ১৯৮৩ সনে বিয়ে করলেন ইংরেজ নারী Annie Betts Fox-কে। কোথায় এবং কীভাবে Annie Betts-এর সাথে ব্রুহলের পরিচয় হল সে সম্পর্কে আমি কিছু জানতে পারি নি।

পল ব্রুহল (১৮৫৫ – ১৯৩৫)

এসময়ে ভাগ্যক্রমে ব্রুহলের সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ কিং-এর সাথে, কিং সেইসময় শিবপুরে বোটানিকাল উদ্যানের প্রধান ছিলেন এবং ব্রুহলের উদ্ভিদজ্ঞানে চমৎকৃত হয়ে তাঁকে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে নিয়ে এলেন। ১৮৮৭ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত পঁচিশ বছর ব্রুহল পড়ালেন শিবপুর কলেজে। এখানে জর্জ কিং সম্পর্কে দু-একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জর্জ কিং-এর অন্যতম অবদান হল তিনি দক্ষিণ আমারিকার সিনকোনা নামে একটি উদ্ভিদের চাষকে ভারতবর্ষে প্রবর্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই উদ্ভিদ থেকে কুইনাইন হয় এবং সেই সময়ে এটাই ছিল ম্যালেরিয়ার একমাত্র ওষুধ। জর্জ কিং প্যাকেটে করে এই কুইনাইন ডাক মারফৎ প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন, প্যাকেটের মূল্য ছিল এক পয়সা, এক পয়সার নিচে কোনো মুদ্রা ছিল না। জর্জ কিং ১৮৭৬ সনে কলকাতায় চিড়িয়াখানা পত্তনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। জর্জ কিং-এর সঙ্গে পল ব্রুহল A Century of New and Rare Indian Plants নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। 

পল ব্রুহলের কাছে ছিল দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ। সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা তাঁর কাছ থেকে ধার করে আনলেন – প্ল্যাঙ্ক, বোলটজমান ও ভিয়েন (Wien) – জার্মান ভাষায় লেখা পদার্থবিদ্যার বই। ব্রুহল যখন ইউরোপ ছেড়েছিলেন তখন সবেমাত্র ‘কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ সমস্যা’ নিয়ে নতুন পদার্থবিদ্যার ভিত্তিভূমি সবে রচিত হচ্ছে, কেমন করে কলকাতায় বসে ব্রুহল এরকম নতুন গবেষণার বই সংগ্রহ করলেন সেটা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। ব্রুহলের কাছ থেকে বই জোগাড় করবার চার বছর পরে, ১৯২১ সনে, সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রীডার হিসেবে যোগ দিলেন।

পল ব্রুহল ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারার ছিলেন, এই পদটির কাজ তাঁর একদম পছন্দের ছিল না এবং ১৯১৪ সনে বিলেতের বিখ্যাত কিউ বোটানিক্যাল গার্ডেনে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু এর মধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তাঁর আর বিলেত যাওয়া হয় না। সুখের বিষয় তাঁকে ১৯১৮ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় যে পদটিতে তিনি দশ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে পল ব্রহলের নামে এশিয়াটিক সোসাইটি তিন বছর অন্তর উদ্ভিদবিদ্যায় একটি পুরস্কার দেয়।    

এই লেখাটিতে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করা হয় নি, উদাহরণস্বরূপ উণবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী মুসলিম সমাজ আধুনিক বিজ্ঞান চিন্তাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে তা নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি, ইউরোপ থেকে আগত নতুন চিন্তা গ্রহণে সেখানে অনেক দ্বিধা ছিল। ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের নেতিবাচকতা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই, কিন্তু সেই সময়ে বহু কৌতূহলদ্দীপক ইংরেজ, স্কটিশ ও ইউরোপীয় মানুষ বাংলায় জড়ো হয়েছিল যাদের প্রভাব ছিল ইতিবাচক। পল ব্রুহল ছিলেন এরকম একজন, ছিলেন জর্জ কিং, উইলিয়াম জোনস। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে গিয়ে আলেক্সান্ডার পেডলারের (১৮৪৯ – ১৯১৮) রসায়ন লেকচারে সম্মোহিত হয়ে রসায়নবিদ হবার সিদ্ধান্ত নেন। পেডলার মহেন্দ্রলাল সরকারকে ১৮৭৬ Indian Association for the Cultivation of Science প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। এর আগে ডেভিড হেয়ারের কথা উল্লেখ করেছি, বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাংলার তরুণদের মধ্যে, বিশেষত রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তা প্রসারে তরুণ হেনরি ডিরোজিওর (১৮০৯ – ১৮৩১) কথা আমরা জানি। ডিরোজিও নিজেকে ভারতীয় ভাবতেন, মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু না হলে বাংলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবির্ভাব হয়তো আরো আগেই হত। তবু শেষ পর্যন্ত হয়তো বাংলার বৈজ্ঞানিক রেনেসাঁ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, আজ বাঙালীর মন-মানসিকতা দু শ বছর আগে যে যুক্তির পথে উৎসাহী হয়েছিল তার থেকে বোধহয় অনেক দূরে সরে এসেছে। ডেভিড হেয়ারের ১৮১৭ সনে School Book Society প্রতিষ্ঠার পরে দু শ বছর পার হয়ে গেল, সেই সময় থেকে পরবর্তী এক শ বছর বাংলা চিন্তায় ও চেতনায় যে বিকাশের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল তার অবসান বহুদিন হল হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজে বিজ্ঞানের কথা, যুক্তির কথা অনেক সময়ই অকপটে বলা যায় না যে অবস্থাটা একশ বছর আগে ছিল না। আমার আশা বাঙালী তার রেনেসাঁর ইতিহাস আবিষ্কার করে পূর্বতন উত্তরোণের পথ ফিরে যাবে।
   

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত