| 25 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: সুন্দরের স্বপ্নে নীললোহিত । নন্দিনী সেনগুপ্ত 

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

কেমন আছে নীললোহিত? সে কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অলটার ইগো’! কোথাও কি তাদের একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়?  কখনো কি তারা একইরকম ভাবনাচিন্তা করে? নাকি একদম বিপরীত মেরুতে তাদের চলাফেরা? তবে সুনীল অনেকসময় হিসেবী, তাকে সমালোচকদের, কিম্বা পাঠকদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। নীললোহিতের সেসব বালাই নেই। যে কথা সুনীল সহজে বলতে পারেন না জনসমক্ষে, সে কথা নীললোহিত বলে ফেলে অনায়াসে।    

নীললোহিত কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়? সাঁওতাল পরগণা, বেলপাহাড়ি, চাইবাসা— নানা পাণ্ডববর্জিত জায়গায় যৎসামান্য পাথেয় নিয়ে ঘুরে আসতে পারে সে। পকেটে মানিব্যাগ থাকেনা তার। সিগারেট, দেশলাই, পাথেয়, সব থাকে শার্টের বুকপকেটে। ঝোলায় থাকে যথাসর্বস্ব। এক-আধবেলা খাবার না জুটলেও তার বিশেষ কষ্ট হয়না। তবে আবার ঘুরে ফিরে চলে আসে কলকাতায়। কলকাতা দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত সে। সব লেখায় থাকে কলকাতার কথা। পটভূমিকা কিম্বা মূল চরিত্র হিসেবে অনেক জায়গায় কলকাতা থাকবেই। কলকাতা কি তার কাছে মায়ের মত? নাকি প্রেমিকার মত? কতখানি টান তার কলকাতার প্রতি, যে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং অতুল বৈভবের হাতছানি ছেড়ে, আমেরিকার আইওয়া থেকে চলে আসতে পারে সে? মার্গারিটের বিশুদ্ধ প্রেমও তাকে আটকে রাখতে পারেনা। নাকি সে প্রেমের থেকেই পালিয়ে বেড়ায়? পাছে সে প্রেম সংসারে আবদ্ধ হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, হয়তো সেই ভয়ে সে নারীর কাছে গেলেও জড়ায় না কোনও চুক্তিতে। দয়িতাকে জড়িয়ে থাকে হাল্কা উত্তরীয়ের মত শর্তবিহীন প্রেমে। জোর করে অধিকার করবার চেষ্টা করে না কোনো নারীকে। বরঞ্চ পূজার বেদির মত এক উচ্চতায় বসিয়ে রাখে নারীদের, যাদের পায়ের নিচে কখনো কাদা লাগে না।    


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


    

কলকাতায় আছে নীললোহিতের মা, দাদারা, বউদিরা। গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার যেমন হয়, তারও পরিবার সেরকম। যে সময়ে নীললোহিত কলকাতায় থাকতে শুরু করেছিল, সে সময়ে সেখানে ‘নিউক্লিয়ার পরিবার’ খুব বেশি দেখা যেত না। বর্তমান সময়ের নিরিখে নীললোহিতের মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটি অনেকটাই অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে পাঠকের; কারণ সেইসময়ে খাবার পাতে একেকটা ছুটির দিনে একেক ভাইয়ের পাতে বড় মাছের মুড়ো খাওয়ার পালা আসতো। স্বাচ্ছল্য ততটা নেই, কিন্তু অবশ্যই পারিবারিক বন্ধন আছে তার। হয়তো সেই টানেই পুরোপুরি বাউন্ডুলে জীবন যাপন করা হয়ে ওঠে না নীললোহিতের। নীলু কি একেবারেই চাকরি পায়না? নাহ, পায় তো। সে শিক্ষিত ছেলে, তাছাড়া তার চেনাজানা আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব কি কলকাতা শহরে একেবারেই নেই, যে বলে কয়ে নীলুকে একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে পারবেনা! ফলে, নীলু চাকরি পায়। তবে, বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনা। বসের মুখের উপরে দুমদাম কথা বললে কি কোনো যুগেই কারো চাকরি বেশিদিন বজায় থাকে? নীলুরও তাই হয়। শুধু কি চাকরি? আমেরিকায় আইওয়া থেকে অত ভাল স্কলারশিপ ছেড়ে চলে আসা, এ কি শুধুই কলকাতার প্রতি আকর্ষণের জন্য! আসলে তার স্বাধীনচেতা মন তাকে দিয়ে এসব করিয়ে নেয়। বেশিদিন একইরকম স্থিতিশীল অবস্থা সে সইতে পারেনা।      

নীললোহিত সেভাবে থিতু হতে না চাইলেও, একটা জিনিস অদ্ভুতভাবে থেমে আছে তার জীবনে। সেটা হল তার বয়স। সে একেবারেই সময়ের দাস নয়, সে ঘড়ি পরেনা কোনোদিন এবং তার বয়স কখনই সাতাশ পেরোয় না। দেশভাগের পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে প্রায় ষাট বছর ধরে কলকাতার নানা বদল ঘটেছে। সব ঘটনাই সে দেখছে এক যুবকের দৃষ্টিকোণ থেকে। দেশভাগের সময়ে শিয়ালদহ স্টেশনে উপচে পড়া উদ্বাস্তুর ভিড় থেকে শুরু করে কন্ট্রোলের লাইনে দাঁড়ানো মধ্যবিত্তের বিপন্ন দশা, সব কিছুই সে হেঁটে হেঁটে দেখে। সে নিজেও এই মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিভূ, তবুও কোথায় যেন একটু নির্মোহ দৃষ্টি তার। সেভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে না সে সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। রেশনে আলো চাল না পাওয়া গেলে ঠাকুমা না খেয়ে মরবেন, এরকম ভাবনায় ভাবিত হয়ে সে পুরোহিতের কাছে বিধান চাইতে যায়। ফিরে আসে বিফলমনোরথ হয়ে। কিন্তু পুরোহিতের মুখের উপরে কোনোভাবেই বলে উঠতে পারেনা যে বৈধব্যপালনের নিয়ম সম্পূর্ণ অন্তসারশূন্য। তবে মাঝেমধ্যে উচিত কথা বলে সে; কলেরার টিকা না নেওয়া প্রান্তিক মানুষদের উপরে ধর্মের ছটা ঘুরিয়ে যাওয়া মানুষের ভণ্ডামি ধরে ফেলে। কলেরার মহামারী দেখতে পেয়েছিল সে। আজ এই অতিমারী অধ্যুষিত পৃথিবীকে সে কেমন চোখে দেখতো, সে কথা জানতে বড় ইচ্ছে করে। মানুষের লোভ, মানুষের ভণ্ডামি যে অনেকখানি দায়ী বর্তমান পরিস্থিতির জন্য, একথা সে কেমনভাবে প্রকাশ করতো, সেকথা জানতে কার না কৌতূহল হবে? 


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


   

একটা বিরাট সময়কালের ক্যানভাসে মানুষের জীবনযাপন, মানুষের কথা বলেছে নীললোহিত। মধ্যবিত্ত জীবনের বিপন্নতার সঙ্গে বিড়ালছানাদের জীবন যাপনের একটা মিল খুঁজে পেয়েছে সে। সে নিজেই অনেকসময় বিড়ালছানাদের অন্য কোথাও পার করে আসে। তারপর একটা অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তবে  মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ বলেই হয়ত সে অনায়াসে মিশে যেতে পারে সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমাহলের কর্মী এক গরিব আত্মীয়ের বাড়ি সে যেমন যায়, তেমনি সান্ধ্যভোজে চলে যেতে পারে সেই সিনেমাহলের মালিকের ড্রয়িংরুমে। এমনকি একবার এক পকেটমারের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও নীলুর নিজস্ব একটা বন্ধুবৃত্ত আছে। তাদের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। শ্মশানে গিয়ে মানুষের শেষ যাত্রা দেখতে ভালবাসে সে। নিজেকে সেভাবে জাহির না করলেও তার একটা সুন্দর সপ্রতিভ স্বভাব আছে। এগিয়ে গিয়ে সে কথা বলে কলকাতা শহরে ঘুরতে আসা সাহেব-মেম টুরিস্টের সঙ্গে; শহরের দৈন্যদশা দেখিয়ে তাদের ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তু জোগান দিতেও লজ্জা করেনা তার। তার মতে, এসব কিছু শহরের দগদগে ঘায়ের  মত হলেও, তা চরম সত্য। তবে সবসময় সত্য নিয়ে সে ভাবিত নয়। টুকটাক নানা নির্দোষ মিথ্যে সে বলেই  থাকে। যেমন পূজার ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাবে, সেটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে একেক সময় একেক রকম বলে। আসলে তার প্রবল ইচ্ছে বেড়াতে যাওয়ার, অথচ পাথেয় নেই। সেইজন্য অমন বলে আনন্দ পায় সে। সে মানসপথিক। কোথাও না কোথাও মনে মনে সে ঘুরে আসে প্রতি মুহূর্তে।   

বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে সে সবসময়ে একপায়ে খাড়া। মাঝেমাঝে মনে হয় হয়তো সাদামাটা মধ্যবিত্ত জীবনের রুঢ় বাস্তব থেকে পিঠ ফিরিয়ে থাকবার জন্যই ভ্রমণে তার এত আগ্রহ। আসলে তো শুধু দেশভাগ নয়, কলকাতা শহরে যুদ্ধের ব্ল্যাকআউট থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলনের অস্থিরতা, নানা ঘটনা, নানা জটিলতার সাক্ষী সে। ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়া শহরের রাতে উপচে পড়া জ্যোৎস্নার আলো দেখে সে বিমুঢ় বোধ করেছে। নকশাল আমলে জন্মানো শিশুর মুখে আধো আধো স্বরে কবিতা, গানের সুরের বদলে বোমাবন্দুকের আওয়াজের খেলা দেখে সে শঙ্কিত হলেও আশা চিরকাল জেগে ছিল তার মধ্যে। সেইজন্য তার প্রতিটি লেখায় শেষে আশাবাদের কথা থাকে। মানুষ যে দিনের শেষে আশাকে জিতিয়ে দিতে চায়, সত্যি করে দিতে চায় রূপকথাকে, এই কথা তার থেকে কে ভাল জানে! এই যে আশাবাদের জয়গান, এও এক মধ্যবিত্ত মানসিকতারই প্রতিফলন। নীললোহিতের প্রথম দিকের লেখাগুলিতে সেইসময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের নানা খুঁটিনাটি ধরা পড়েছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


             

প্রশ্ন উঠতে পারে যে পুরনো সময়ের লেখা যা নীললোহিতের চোখে দেখা, সেসব এখন কেন পড়বো?  আসলে পড়তে গিয়ে দেখতে পাই যে অনেক জায়গায় পরিপ্রেক্ষিত একই আছে বর্তমান সময়ের সঙ্গে। রাজনীতি কোনো ভাবেই সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না, এই উপলব্ধি নীলুর বহু আগেই ঘটেছিল। কলকাতা শহরে শিক্ষকরা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য মিছিল করেন, নীলু দেখেছিল। আমরাও এখন দেখি। অনেক বেশি নিরাবেগ হয়েই দেখি। সাম্প্রদায়িক চোরা টেনশনের স্রোত ছড়িয়ে ছিল প্রতিদিনের জীবনে, একথা নীলু বুঝেছিল। আমরাও এখন বুঝি, তবে আরও নির্মমভাবে। শহর খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল নীলুর চোখের সামনে। এতটাই বদলে যায় যে পুরনো মানুষজনকে এক দু বছর পরে শহরের বাইরে থেকে এসে কেউ খুঁজে পায় না। শহরের রাজপথে ল্যান্ডো গাড়ির ঘোড়াকে মরতে দেখে তার মনে হয় শহরের বুকে একটা যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরকম নানা বদল হয়তো আমরাও প্রতিদিন দেখি আমাদের চোখের সামনে, কিন্তু মনেই হয়না যে ধাপে ধাপে একটু একটু করে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। যেমন, নীললোহিতের লেখায় যেটা ভীষণভাবে উপস্থিত, সেটা হল মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধের জন্য কোনো বেকার যুবক চাকরি পেয়েও লজ্জিত থাকে, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ বেকার যুবসমাজের থেকে, তার চেনাজানা বন্ধুদের বৃত্ত থেকে সে ছিটকে গেল। এরকম অনুভুতি বর্তমান সময়ের স্বার্থপর সমাজে খুঁজে পাইনা আমরা কোথাও এবং তখনি আমরা বুঝতে পারি যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভীষণরকম বদলে গেছে।  

নীললোহিত ঘুরে বেড়াতে গিয়ে অনেক রকম মানুষের সঙ্গে আলাপ জমায়। নানারকম মানুষের কথা থাকে তার লেখায়। ভদ্রকে প্রবাসী বাঙালি কবি নীলমাধব সিংহকে খুঁজে পেয়ে তার মনে হয়, যদি বিভূতিভূষণ দেখতে পেতেন এমন একজন মানুষকে, তাহলে হয়তো অন্যরকম মায়া দিয়ে লিখতেন তার কথা। বিভূতিভূষণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একথা বলা চলে, নীললোহিতের কলমের জাদুও নেহাত কম নয়। বীরপুরের লেভেল ক্রসিংএ সে দেখতে পায় গেটকিপার রামখেলাওন সিংকে, যে মধ্যরাতে এক সুন্দরী প্রেতিণীকে দেখবার জন্য জাগে। নীলু বোঝে যে লোকটা পাগল, তবুও তার জন্য মায়া ঝরে তার কলম থেকে। বাড়ির কাজের লোক শিবুর মায়ের জীবনের ট্র্যাজেডি সে নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে গেলেও, ঘটনার শেষে এসে এক মরমী স্পর্শ বুঝিয়ে দেয় যে নীলু মানুষের ইচ্ছাপূরণের গল্পগুলো এক অন্যরকম আলোয় যাচাই করে। কাশ্মীরে গিয়ে দেখা পায় জেদি মহিলা শুভ্রার, যে একা নিজের ছোট মেয়েকে সঙ্গে করে খুঁজতে এসেছে হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে। নিরুদ্দেশ মানুষের খোঁজ মেলেনা, কিন্তু চরিত্রগুলির এক অন্যরকম উত্তরণ ঘটে ‘স্বর্গের খুব কাছে’ উপন্যাসের শেষে। আবার উস্তাদ আমির খানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে নীললোহিতের কলম থেকে উৎসারিত হয় ‘তোমার তুলনা তুমি’ উপন্যাসটি। সেখানে সুরের ধারায় লেখকের সঙ্গে পাঠকরাও স্নান করেন। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত মারু বেহাগের গমকে ভেসে যাই আমরা। বিচিত্র ঘটনার কেন্দ্রে আমরা নীললোহিতকে আবিষ্কার করি নানা মাত্রায়।   


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


    

নীললোহিতের প্রথম দিকের লেখাগুলির মধ্যে দিকশূন্যপুরের কোনো উল্লেখ পাইনা। তাহলে কি লেখকের ইচ্ছাপূরণের রূপকথার রাজধানী সুপ্ত ছিল কলকাতার অলিগলি কিম্বা কাছাকাছি কোথাও? হয়ত শহরের কোনো পার্কে তখন মাস্তানদের ঔদ্ধত্য সায়েস্তা করবার জন্য একটা বাচ্চা মেয়ের পোষা অ্যালসেশিয়ানের উপস্থিতিতেই নেমে আসতো কোনো এক অলীক বিকেল। হয়তো শহরতলির কোনো রেলস্টেশনে শীতের রাতে গরিব মানুষদের খোলা জায়গা থেকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াতেন উষ্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ স্বভাবের এক স্টেশনমাস্টার। গ্রামের স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু মানুষরাই হয়তো পথে বৃষ্টিতে আটকে পড়া পথিকদের রেঁধেবেড়ে খাইয়ে যত্নে বিছানা পেতে দিতেন। বিশ্বাস করে রাস্তা থেকে অচেনা, নিরাশ্রয় মেয়েকে কাজ এবং আশ্রয় দেবার জন্য নিয়ে যেত সাধারণ কোনো গৃহবধূ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নীললোহিতের বয়স না বাড়লেও শহর এবং চারপাশের মানুষের বয়স বাড়ে। সেভাবে আর রূপকথার বিকেল, অলীক জ্যোৎস্নার রাত, উষ্ণতার ভরসার ভোর কিম্বা আশ্রয়ের দিন নেমে আসেনা কলকাতায় কিম্বা তার আশেপাশে কোথাও। কিন্তু নীললোহিতের আশাবাদ যে অদম্য। তাই সে দিকশূন্যপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সব ভাল আর সুন্দর মানুষেরা থাকে। সেখানে কোনো অন্যায় কাজ হয় না। রূপকথাগুলো সত্যি হয়ে যায় খুব সহজে। নীললোহিতের সৃষ্টিকে সাহিত্য বলতে নারাজ অনেক সমালোচক। কিন্তু আশাবাদী গল্পের আন্তরিক সহজ ভঙ্গিমা সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। পাঠক নীললোহিতের উত্তম পুরুষে লেখা কাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সহজে। প্রতিটি পাঠকের অন্তরের স্বাধীনচেতা সত্তা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তখন নীলুর প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথে নামে।             

নীললোহিতের বয়স বাড়েনা। শহর এবং পরিবেশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় তার প্রেমিকা কিম্বা বান্ধবীদের সময়কাল। নীরা তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য সবাইকে লুকিয়ে ক্লাস শেষ হলে একা বেরিয়ে আসতো সায়েন্স কলেজের গেট দিয়ে। শহরের ফুটপাথ ধরে পাশাপাশি হেঁটে যেত হাত না ছুঁয়ে এক আনমনা বিকেলে। কোনো বন্ধু তাদের একসঙ্গে দেখলে পালিয়ে দূরে সরে যেত। কিন্তু মুমু আবার প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও তার মুখে কিছুই আটকায় না। একদঙ্গল বন্ধুর সামনেও দুমদাম যা খুশি বিপজ্জনক প্রেমের কথা বলে ফেলতে পারে সে, সেইজন্য নীললোহিত মুমুকে নিয়ে সদা শঙ্কিত। সে ‘নীলু’ বলে ডাকে না তাকে। তার সম্বোধন ‘ব্লু’। নীললোহিত প্রেমের ব্যাপারে স্পর্শকাতর। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীর প্রেমে পড়ে সে, কিন্তু সম্পর্ক কখনই পরিণতি পায়না। কখনো আবার তার প্রেম সম্পূর্ণ একতরফা। তার প্রেমে অদ্ভুত এক সারল্য, পবিত্রতা, যা বাস্তব পৃথিবীতে অলীক। মনে হয় যে নীলু আসলে তার প্রেমিকাকে নয়, তার প্রেমটাকেই ভালবেসে লালন করে। সেরকম প্রেমের খোঁজ মানুষ সহজে পায় না। ঠিক যেভাবে ইচ্ছে থাকলেও, যে কেউ যেতে পারেনা দিকশূন্যপুরে। এখানেই মনে একটা প্রশ্ন জাগে। দিকশূন্যপুর কি শুধুই নীললোহিতের অলীক কল্পনা? নাকি দেশবিদেশের বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে যা কিছু ভাল, যা কিছু সুন্দর দেখেছে সে, সেখানেই দিকশূন্যপুর। দ্বীপের মত একটুকরো স্বর্গ খুঁজে পেয়েছে সে  সেখানে। তারপর শহরের বয়স বাড়লে, শহরের বদল ঘটায়, সেই সব দ্বীপের জমি জুড়ে নিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছে অন্য ঠিকানায়। যেভাবে আমরা আত্মার অন্তস্থলের সব পবিত্রতা একত্র করে মন্দিরে সাজিয়ে রাখি ঈশ্বরের আসন, ঠিক সেভাবেই সেজে উঠেছে দিকশূন্যপুর। নীললোহিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনি কোনোকালে। সে মানুষের উপরে বিশ্বাস রেখেছে। তাই তার বেশিরভাগ লেখায় মানুষ এবং তার বিশ্বাস জিতে যায়। মানুষের যাত্রাপথের শেষ মাইলস্টোনে লেখা হয় দিকশূন্যপুরের নাম। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত