উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: প্রমিত বাঙলা এগিয়েছে এতিমের মতো একাকী
বিশ শতকে দেশ বিভাগের পর বছর, মানে ১৯৪৮ সালে মহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার কার্জন হলে উচ্চকন্ঠে ঘোষণা দিয়ে ছিলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা (Urdu and urdu shall be the state language of Pakistan)। তখন আমরা নাদান। বুঝতেই পারিনি কথাটার গুরুত্ব কতোটা। সেই সময়ের ছাত্র জনাব আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন) হলের একপ্রান্ত থেকে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন ‘নো নো নো’। সেই একটা ‘না’ জ্বালিয়েছিলো পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের সহস্র দীপাবলী। সেই দীপাবলী জ্বালাতে গিয়ে দেশের অনেক হীরক সন্তান শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা কি জেনেছিলেন, এই ‘না-প্রদীপের’ আলো কতোদুর যাবে? আজ আর কেউ নেই এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো। যদি বা কেউ থেকেও থাকেন, তাঁরা সাজানো কথা বলবেন বলে মনে করি।
আমাদের তখন জানা ছিলো না, ভাষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানে কি? ভাষার দাবি তুলে জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে কতোটা গনতন্ত্র পাওয়া যায়? ইউরোপে তখন কেবল বিকশিত হচ্ছিলো ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক বিদ্যাটা।ভাষাবিজ্ঞানের সেই বিভাষী চর্চাকারিদের কাছ থেকে জেনেছি, ভাষা আর মানুষ সমার্থক সত্বা। ভাষাই মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়। দেশগতো পরিচয়। পূর্নাঙ্গ মানবিক বিকাশের মাধ্যম। আমরা শুধু জানতাম, বৃটিশরা আমাদের ওপর তাদের ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দিয়ে এতিম তথা ব্রাত্যভাষা বানাতে চেয়েছিলো বাঙলাকে। আবার দ্বিতীয় দফায় উর্দু ভাষা এসে বাংলাকে এতিম বানাবে। এ কেমন অন্যায় কথা?
উনিশ শতকে প্রমথ চৌধুরী একবার বলেছিলেন, বাঙলা হলো হিন্দুদিগের ভাষা। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, জল জঙ্গলে নাব্য এই দেশের সমস্ত মানুষ যেনো হিন্দু। আর কোনো ধর্মের মানুষ কখনও ছিলো না বাঙলাদেশে। থাকলেও তাঁরা বাঙলায় কথা বলতেন না। অতি শিক্ষিত বিলেত ফেরত একজন আলোকিত মানুষের মুখে এহেনো সাম্প্রদায়িক কথা এসেছিলো কেমন করে তা জানিনা। অথচ বাঙলা হলো দেশটার ভূমিজ ভাষা। দেশের প্রকৃত জনের ভাষা। এই দেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই বাঙলা বলে এসেছেন। বাঙলার ওপর আঘাত তাই সবাইকেই বিদ্ধ করেছিলো। তবে ভাষাকে সাম্প্রদায়িকিরনের প্রতিবাদে স্মরণ করতে চাই সেইসব বৌদ্ধ তান্ত্রিক সন্যাসীদের, যাঁরা প্রবল প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও প্রাকৃত বাঙলায় চর্যাপদগুলো লিখেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন বাঙলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক রুপ। সেই বিচারে হিন্দুরা নয়, বৌদ্ধরাই বাঙলা ভাষার আদি কারুপিতা। এই ঐতিহাসিক তথ্যটা হয়তো প্রমথ বাবুর মনেই ছিলো না। তবে কথাটার প্রচারও নেই একেবারে।
ইংরেজদের তাঁবেদারি শেষ হতে না হতেই এবং দেশে ইংরেজি ভাষার শিক্ষাব্যাবস্থা বহাল থাকতেই শোনা গেলো উর্দু ভাষাকে ঘাড়ে চাপানোর হুংকার। সদ্যসৃষ্ট পাকিস্থানের খোদ রাষ্ট্র প্রধানের মুখ থেকে। জনাব জিন্নাহ এই বক্ত্রিতাটা দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। তিনি নিজে উর্দুভাষী ছিলেন না। তাই ইংরেজিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দুর পক্ষে হুকুম জারি করেছিলেন। এখন ভাবি, তিনি কি উর্দু জানতেন না? নাকি পছন্দ করতেন না? তবে অবিভক্ত ভারতে এলিটদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ইংরেজি ছিলো মাতৃভাষার মতো। ব্রিটিশদের সাথে চলা ফেরা, কথা বলা এবং আন্দোলনে দর কষাকষির সময় তাঁদেরকে ইংরেজিতেই কথা বলতে হতো। উর্দুও নয় হিন্দিও নয়। তাদের রুজি রোজগারের মাধ্যমও ছিলো ইংরেজি। ফলে মাতৃভাষার প্রতি তাদের টানটা হয়তো ছিলো শিথিল। তাই কি বুঝতে পারেননি হঠাৎ করে একটা নতুন ভাষা চাপিয়ে দিলে অন্যভাষীর জীবনে তার কি কি কুফল হতে পারে? আসলে কেমন দাপুটে ছিলো যেনো তখনকার নেতৃত্ব। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পরে এখন যা বুঝতে পারি, তখন তা পারিনি।
দিন তো বসে থাকে না। পুর্ব-বাঙলা তথা পুর্ব পাকিস্তান প্রদেশে বাঙলা ভাষাকে কেন্দ্রকরে একটা আবেগ জেগে উঠেছিলো খুব তাড়াতাড়ি। মাতৃভাষার প্রতি সহজাত টানেই সেটা হয়েছিলো। সেই আবেগে ছাত্র জনতার অংশ ছিলো বেশ বড়ো। এই বৃহত জনগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেই আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ১৯৫৬ সালে। কারণ ঐ বছরেই বাঙলাকে পাকিস্তানের অন্যতমো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ভাষা আন্দোলন থামেনি। কারণ ভাষা আন্দোলন মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের বীজ বুনেছিলো। অধিকার আদায়ের দাবি জানাতে শিখিয়েছিলো। ইংরেজের কাছে তো দাবির কথা বলা যেতো না। তাদের সাথে ছিলো প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক। কিন্তু এক পাকিস্তানে, পশ্চিম আর পুবে, প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক হবে কেনো? তাই রাষ্ট্রভাষার দাবিটা ছিলো রাষ্ট্রের কাছেই বাঙলা-ভাষিদের প্রথম গণদাবির গণচাওয়া। দাবি জানিয়ে চাইতে শেখা।
এই দাবি সম্প্রসারিত হয়েছিলো ক্রমে শিক্ষার মাধ্যম এবং জীবনের সর্বস্তরে বাঙলাভাষার দাবি হিসেবে। তখনই খুব প্রয়োজন ছিলো একটা ভাষা পরিকল্পনার। প্রয়োজন ছিলো একগুচ্ছ নিবেদিত প্রাণ গবেষকের প্রাণান্ত শ্রমের। সেটা হয়নি। ভাষা প্রেমী এবং ভাষা সৈনিকদের কেউ বিষয়টা বোঝেনইনি। তাই হয়নি আজো কাজটা। কিন্তু প্রয়োজনটা তো যায়নি। আজও আমরা একটা সুষ্ঠ ভাষা পরিকল্পনার অভাবে ধুঁকছি। এই কথাটা এখনও কেউ জোর দিয়ে বলছেন না।
অন্যদিকে পঞ্চাশের দশকে ততকালীন বুদ্ধজীবিদের একটা খুদ্র অংশ গড়ে তুলেছিলেন ‘সহজ বাঙলা’ আন্দোলন। খুব কমজোর ছিলো সেই
আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবিরা হয়তো রাজনৈতিক ভাবেও ছিলেন সচেতন। কিন্তু ভাষা সচেতনতার দিকটাতে তেমন পোক্ত ছিলেন বলে মানা যায় না। নতুন দেশ, নতুন ভৌগলিক পরিচয়, নতুন নাগরিকত্বের প্রতি আনুগত্য, ভালোবেসে বাঙলা ভাষার জন্য কিছু করতে চাওয়া, সবই ছিলো ভালো। কিন্তু ভাষা মানে তো শুধু মানচিত্রগত পরিচয়মাত্র নয়, কথা বলা মাত্র নয়। কোটি কোটি মানুষের নিজস্ব কথা কোথায় কেমন করে কিভাবে বলতে হবে, সামাজিক সম্পর্কের মানুষদের কিভাবে ডাকতে বা সম্বোধন করতে হবে, শিক্ষাজীবনে বাঙলা ভাষাকে কেমন করে ব্যবহার করতে হবে, কোন ভাষিক আচরনকে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে কাজে লাগাতে হবে, কেমন করে প্রমিত বাঙলা বানান লেখতে হবে, এসব নিয়ে কেউ মাথাই ঘামালেন না। এখনও না।
বলা হলো, বাঙলা হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা। বাঙলাভাষীর জন্মগতো অধিকার আছে এই ভাষার ওপর। যে যেমন করে পারবে, তেমন করেই ব্যবহার করবে বাঙলাভাষা। আমজনতা করলোও তাই। মায়ের সাথে বস্তিবাসীর মতো তুই তোকারির আদলে অশালীন ভাষার ব্যবহার, কেমন এক কদর্য ভাষিক আচরন আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে দিলো। যাঁরা শিষ্ট ভাষা ব্যবহার করতেন, আমজনতার এলেবেলে ভাষিক জীবনাচার তাঁদেরকে ঠেলে দিতে থাকলো একাকীত্বের দিকে। এলেবেলে ভাষিক আচরনের উচ্ছৃংখলতা বাঙলা ভাষার শাস্ত্রীয় চর্চাকেও দিলো না এগোতে।
সেই পঞ্চাশের দশকে কতিপয় গবেষক বুদ্ধিজীবি বানান সংস্কার সম্বন্ধে কিছু না বলেই হঠাত ‘সহজ’ বানান ‘শহজ’ লেখেছিলেন। বাঙলায় স/শ-কে আপোস বদল ধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করি আমরা। সেটা যে বিজ্ঞানসম্মত নয়, সে কথাটাও পাড়েননি তাঁরা। যদি তখনই ‘স’ এবং ‘শ’
ধ্বনির যথার্থ ব্যবহার নিয়ে গবেষনা হতো, তাহলে তিন ‘স/ শ/ ষ’ নিয়ে আজ আমাদের এমন লেজে গোবরে মাখামাখি হয়ে থাকতে হতো না। কয়েকটা যুক্তাক্ষরের উচ্চারণ ছাড়া আমাদের মুখে ‘স’ সব সময় ‘শ’-ই হয়। তাই শিখেছি, বলেছি, লেখেছি। ভুল শিক্ষার এমনই গুন যে, এখন বানান সংস্কারকে কেউ আর মেনে নিতেই চান না। হাস্যকর!
সেই কতিপয় শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবি ‘য’-কে আরবি ‘য’ হিসেবে লেখার সিদ্ধান্ত দিলেন। যেমন, ‘নামায, রোযা, আযান’, এমন লেখতে হবে। কিন্তু আমরা জানি, ‘য’ কোনোদিন ‘জ’ ছিলো না ততসম শব্দে। ততসম শব্দে ‘য’-এর উচ্চারণ ‘ইয়’। বাঙলায় এসে এই ‘য’ আমাদের মুখে ‘জ’ হয়ে গেছে সেই কোন কালেই। সে কথাটাও বললেননা কেউ। তাছাড়া আরবি শব্দ লেখার জন্য এই ‘য’-কে ‘দন্ত-জ’ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কিনা, এই একটা ‘য’ আরবি চার পাঁচটা ‘জ’-এর কাজ চালাতে পারবে কিনা, এইসব কোনো আলোচনাও হলো না। ‘য’-কে দন্ত-জ বললেই যে হয়ে যাবে না, তার জন্য নতুন একটা বর্ণ আমদানি করা আবশ্যিক কি না, সে প্রসঙ্গই এলো না।
অন্যদিকে ‘য’-কে আমরা ফলা হিসেবে ব্যবহার করি বর্ণকে দ্বিত্ব করার জন্য। তারই বা কি হবে? তার কোনো আলোচনা ছিলো না। বাঙলায় বর্ণকে দিত্ব করার পক্রিয়াও একরকম নয়। দিত্ব নির্মানের দায়িত্ব থেকে তাহলে ‘য’-কে রেহাই দেয়া হবে কিনা, সে কথাও ওঠেনি। কেমন এক জগা খিঁচুড়ি হয়েই থাকলো সবটুকু। এবং এখনও এই সব কাজের কথা বলাই যাচ্ছে না। কেউ শুনতে চায় না। বলতেও দেয় না। ভাবতেও অসম্ভব লাগে। তবু বলেই যাচ্ছি।
বানান তো ভাষার সাজ এবং সৌন্দর্য। সেখানেও রীতি সিদ্ধতার কথা আছে। আমরা লেখি একরকম, উচ্চারণ করি অন্যরকম। এরও কারন আছে। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাই না আমরা। ইংরেজিতে ‘t’ দিয়ে ‘ত,’ট’, থ, শ, চ’ ধ্বনি হতে পারে। বাঙলায় এই নৈরাজ্য সম্ভব না। বাঙলায় ‘ত’ দিয়ে অন্যকোনো ধ্বনি উচ্চারণ করা যাবে না। এটাই বাঙলা ভাষার বৈশিষ্ট। এটাই ছাঁচ। তবু বাঙলায় ব্যবহৃত ততসম শব্দের বানান থেকে চেনা বাহুল্যগুলো আমরা বাদ দিতে চাই না। যেমন, ‘সান্ত্বনা, শ্মশান, বৈশিষ্ট্য’, ইত্যাদি শব্দের বানানকে বাঙলা বানান বলাই যায় না। তবু বলতে হয়। অনেকে ঐতিহ্যের জিকির তুলে বলেন, বানান বদলানো যাবে না। যেমন আছে তেমন থাকবে। শোভা হয়ে থাকবে। বুঝেই পাই না, ব্যাখ্যাতীত বানানের আবার ঐতিহ্য কিংবা শোভা কি?
এমন ঐতিহ্যমুখিনতা লালন করছেন আমাদের বুদ্ধিজীবিরা। তাদের মত হলো, যা আঁছে, যেমন আছে, তাই নিয়ে থাকা। নতুন কোনো বিজ্ঞান লগ্ন কথা শুনতেই চাইলেন না আলোকিত বাঙলাভাষী। বাঙলা ভাষার বাঙলা বানান সম্বন্ধে নিজেরা কিছু ভাবলেন না, অন্যকেও ভাবার সুজোগ দিলেন না। বাঙলার ধনিবিদ্রোহী বানানকে ঐতিহ্য মনে করে গদ্গদ হয়ে থাকছেন। অবাক হই ভেবে, জীবনের ঐতিহ্য কালে কালে বদলে গেলে ভাষাও বদলে যাবে, এই কথাটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? এই পৃথিবীতে কিছুই অনড় নয়। স্থায়ী ঐতিহ্য বলে কিছু নেই এ জগতে।
নতুনেরা ঐতিহ্যের দোহাই শুনবে কেনো? মাটির গন্ধ ফেলে প্রজন্ম যখন শহরের গন্ধে এসে পড়ে, তখন চাল চলন খাওয়া দাওয়া কথা বার্তা সবই যায় বদলে। ঐতিহ্য যায় পালিয়ে। লুঙ্গি না পরে তখন প্যান্ট পরতেই ভালো লাগে তরুনদের। আটপৌরে রীতিতে না পরে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতেই ভালো লাগে মেয়েদের। গ্রামের বসন ঐতিহ্য ফেলে শহুরে ধাঁচ তুলে নেয় শরীরে। শুধু কি এই? সকালের নাশতায় পান্তা, মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ের বদলে রুটি পরোটা, ডিম, চা খেতে ভাল লাগে। সাবান কাঁচা কাপড়ের বদলে ইস্ত্রি করা কাপড় পরতে হয়। আঞ্চলিক ভাষার বদলে প্রমিত বাঙলা বলার চেষ্টা চলে। জীবনাচারে বেশ একটা সপ্রতিভ ভাব চলে আসে। ঐতিহ্য বদলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই তো এগুলো। চাইলেই তাই ঐতিহ্য আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। উন্নত জীবনযাপনের আকাঙ্খায় অনেক কিছুই ফেলে ছেড়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হয় মানুষকে। এটাই বাস্তবতা। গার্মেন্টসের শ্রমিক মেয়েদের সাজগোজ মেক আপ চলন বলন ঋজুতা দেখেও ঐতিহ্যের টান কাকে বলে, তা বুঝতে চাই না।
এই আমরাই দেখেছি, গ্রামীন জিবনের খোলস ফেলে শহরমুখী মানুষ যখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের বৃত্ত গড়ে তুলতে শুরু করলো, তখন প্রজন্মের প্রয়োজন ছিলো উন্নত নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য পরিশীলিত বাঙলা ভাষা চর্চার। তখন বাঙলা শেখাবার জন্য কোনোও আয়োজন ছিলো না। কেউ এগিয়েও আসেননি। না স্কুল, না সমাজ, না বুদ্ধিজীবি, না ভাষা সচেতন আলোকিত মানুষ। এলিটেরা আভিজাত্য নিয়ে দুরে দুরে থেকেছেন। নতুন উঠে আসা প্রজন্মকে মনে করেছেন আগাছার মতো। ভাবখানা এমন, এরা আবার শহুরে জীবনের আওতায় এলো কেনো? এ কোন জ্বালা!
প্রজন্মকে একা একাই শহুরে তথা নাগরিক জীবনের পথে এগোতে হয়েছে ভিতু এতিমের মতো। আঁচড় পাঁচড় করে এগোনো যাকে বলে। চাল চলনের শোভনতার পাশাপাশি প্রমিত বাঙলাটাও শেখার চেষ্টা করেছে একা একাই, শুনে শুনে, হোঁচট খেতে খেতে। ভুল ভালই হোক আর আঞ্চলিক-প্রমিত মিশ্রিতই হোক, তারা এগোতে শিখলো। তখনও তাদের বাঙলা ভাষা চর্চার জন্য কোনো দিক নির্দেশনা, গবেষণা, প্রমিত বাঙলা ভাষা শিক্ষা আন্দোলনের ব্যাবস্থা না করে শুধু সমালোচনা করেছেন তথাকথিত অভিজাত মানুষেরা। এখনও তাই করছেন। কিন্তু আমজনতার মুখে এবং জীবনাচারে বাঙলা ভাষার চর্চা কি থেমে আছে? তা এগিয়েই যাচ্ছে বহতা নদীর মতো কোনো কিছুর পরোয়া না করে। চোখের সামনেই দেখেছি এই চিত্র।
জনজীবনে যখন বিরাট একটা পরিবর্তন আসে, তা সে যেটাই হোক, তখন সমাজের মাথাদের একত্রে বসতে হয়। ভাষা আন্দোলন সেই রকম একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো আমাদের জীবনে। সমাজের বুদ্ধিজীবি এবং আলোকিত মানুষেরা শিক্ষালগ্ন তরুন প্রজন্মকে নিয়ে ছক কেটে গড়ে তুলেছিলেন সেই আন্দোলন। এমনি এমনি হয়নি কিছু। এমনি এমনি ভাষা আন্দোলন থেকে একটা দেশের জন্ম হয়নি। এখনও তেমন আন্দোলন দরকার বলে মনে করি। যে আন্দোলনের ফলে আমরা পাবো একটা জাতীয় বাঙলা ভাষা নীতি। পাবো প্রমিত বাঙলা চর্চার ব্যাপক দিকরেখা।
বাঙলা ভাষা বলতে আমরা বুঝেছি সাহিত্যকে। সবাই দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। যেনো রবীন্দ্রনাথই স্বয়ং বাঙলাভাষা। আর বুঝেছি, আবৃত্তি, নাটক, সিনেমা এবং গানকে। তো সেই রাবীন্দ্রিক বাঙলাই কি এখন চলছে? বিপুল পরিবর্তন হয়েছে সেখানেও। প্রজন্ম এখন যে বাঙলা বলে, লেখে, চর্চা করে, তা রাবীন্দ্রিক ভাষা নয়। এটা আধুনিক তথা প্রমিত বাঙলা ভাষা। আরও শক্তিশালী, শাণিত, ঋজু এবং লাগসই। আরও আপনার এবং আমজনতার আরাধ্য ভাষা। প্রতিদিন ভেঙে গড়ে, বলতে গেলে নিজে নিজেই শিখছে প্রজন্ম। দেখে বুঝেও আমরা কিছু করতে পারি না।
একটা বিষয় আমাদের বুঝতে হবে, সাহিত্য আর ভাষা এক জিনিস নয়।সাহিত্য চর্চা আর ভাষা চর্চা এক কথা নয়। সাহিত্য প্রাণের বিষয়। ভাষা বিজ্ঞানের বিষয়। ভাষার ছোট্ট একটা ধ্বনির বিবর্তনেও শতাব্দীর ইতিহাস থাকে। একটা ধ্বনির পরিবির্তনে শুধু শব্দ নয় একটা আস্ত বাক্যের অর্থও বদলে যেতে পারে। মানুষে মানুষে ভালোবাসার সম্পর্ক শত্রুতায় পরিণত হতে পারে। আনন্দের আবহে বিষাদ আসতে পারে। পারস্পরিক লেন দেনে ঘাটতি সৃষ্টি হয়তে পারে। সে এক বিশ্রি ব্যাপার। এই কথাগুলো কে কবে কোনদিন বলেছেন প্রজন্মদের সামনে? শুধু ভাষার ঐতিহ্য বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন বুদ্ধিজীবিরা? এখনই বা কেনো বুঝিয়ে বলতে চান না এইসব কথা? আমরা তো জানতে চাই।
বাঙলিশ কথাবার্তা শুনলে, ‘বাঙলা গেলো বাঙলা গেলো’ বলে যাঁরা বিলাপ করেন, তাঁরা কি করেছেন যখন আরজে’ রেডিও থেকে বিকট বিকৃত বাঙলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়েছে? মনে আছে, ১৯৬০-এর দশকে রেডিও প্রোগ্রামে একটা উচ্চারণে ভুল হলে তিন মাস আর তাকে প্রোগ্রাম দেয়া হতো না। সেই সাত্বিকতা কেমন করে যেনো একেবারে শিথিল হয়ে গেলো স্বাধীন বাঙলাদেশ পেয়ে। ভাষা সৈনিক, ভাষা প্রেমী, সচেতন ভাষী, এঁরা তখন কি করেছেন? পত্র পত্রিকায় লিখিত প্রতিবাদ, বা সমালোচনা সভা, সরকারিভাবে ব্যাবস্থা নেয়ার আর্জি পেশ করা, এমন কিছু? অথবা ‘আরজে-র’ ভাষা দলনের প্রতিবাদে কোনো মিছিল, মৌন অবস্থান, অনশন ধর্মঘট, আলোচনা সভা, ধারাবাহিক লিখিত প্রতিবাদ করা, তেমন কিছু করেছেন কি তাঁরা? ভাষার নিয়ম শৃংখলার কথা বলেছেন কি তাঁরা? বরং বলতে গেলে আপোসে ছাড় দেয়াই হয়েছে।
প্রমিত বাঙলা চর্চার কথা বলি আমরা। প্রজন্মের জীবনচারিতায় কেমন করে এই বিজ্ঞানমন্ত শ্রীমন্ডিত আধুনিক বাঙলা শিক্ষার ব্যাবস্থা করা যায়, সে ব্যাপারে আমাদের কোনোই পরিকল্পনা নেই। আয়োজন নেই। সেজন্য প্রজন্ম বসে থাকবে? কিছু চৌকষ প্রজন্ম শহরে নগরে নানাপ্রকার দোকান খুলে ‘বাঙলা বানিজ্য’ চালাচ্ছে। চোখে দেখেই বা কি করছি আমরা? জীবনের দাবি আমি একেই বলতে চেয়েছি। প্রবাদ আছে, ‘ প্রয়োজন কোনো বাধা মানে না’। শুধু ধিক্কারে নিন্দা মন্দে ওরা ফিরবে না। কারণ জীবন তো পেছনে না, সব সময় সামনে ডাকে।
স্বাধীন বাঙলাদেশে টেকস্ট বুক বোর্ড ছিলো হিমালয় সমান। বোর্ড বাঙলা বানানের একটা পুস্তিকাও প্রনয়ন করে। সেটা কোলকাতা বানান সংস্কারেরই এপিঠ ওপিঠ বলতে গেলে। নতুন কোনো দিক নির্দেশনা তাতে ছিলো না। এরপর বাঙলা একাডেমি নব্বই-এর দশকে প্রমিত বাঙলা বানান পুস্তিকা প্রনয়ন করে। সেটাও কোলকাতার বানান সংস্কারের চর্বিত চর্বন। আবার ২০১২ সালে পুস্তিকাটির সংশোধিত সংস্করন প্রকাশ করে বাঙলা একাডেমি। সেটা আরও দুর্বোধ্য। বানানের শুদ্ধাশুদ্ধির প্রশ্নে প্রজন্ম এখনও দিশেহারা। আমরাও। তা বলে বসে নেই ওরা। জীবনের রথে বসে কি থেমে থাকা যায়? যেমন পারে তেমন করে কাজ চালায়। হাবুডুবু খায়, দুই ‘ণ’, তিন ‘স’, দুই ‘জ’, ইত্যাদি নিয়ে।
প্রাণের ধর্মে প্রজন্ম এগিয়ে যায় ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে। তাদের পরিচালনায় কিছু উচ্চারণ প্রশিক্ষন কেন্দ্র আছে শহরে নগরে। সেখানে মূলত আবৃত্তি শেখানো হয়। ভাষা সৈনিকেরা সেগুলোর খবর জানেন না। ওরাও তাঁদের ডাকেনা। অভিনয় প্রশিক্ষনের ব্যাপারেও কিছু উচ্চারণ শেখার আয়োজন থাকে। সে আর কতোটুকু? তবু চাকরি, রেডিও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, মঞ্চে ঘোষণা, সঞ্চালনা, আবৃত্তি এইসব দিকে যাওয়ার একটা কোনোরকম ব্যাবস্থা হবে মনে করে তারা ছোটে সেদিকেই। কেন্দ্র পরিচালকেরা মাঝে মাঝে পন্ডিত ব্যক্তি ডেকে আনে, পারিশ্রমিকও দেয়। কিছু কেন্দ্র দেখেছি, উতসুক আগ্রহী ছেলেমেয়েরা আকুপাকু করে কিছু শেখার জন্য। ওদের অপ্রাপ্তি দেখে মায়া লাগে।
দেশে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তারা প্রমিত বাঙলা শেখাবে কি, হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা বিষয়ই নেই। তাহলে ছেলে মেয়েরা প্রমিত বাঙলা ভাষার উচ্চারণ বানান ব্যাকরণ শিখবে কোথায়? তবু ওরাই বাহন বাঙলা ভাষার। ওরা বসে নেই। থেমে নেই। তাই বলেছি, ওদের মুখে মুখেই প্রমিত বাঙলা এগিয়েছে এতিমের মতো একাকী।

বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাষাবিদ; জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহীতে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা করেছেন। যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে। সাহিত্য চর্চা সহ বাংলা ভাষা গবেষণার জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার।