| 16 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা অণুগল্প: খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে । শাশ্বতী বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

অশীতিপর পিতামহী গান শুনছেন তদগত হয়ে। হাত দুটি কোলের ওপর জড় করে রাখা। ছোট্ট একটি কাঠের পিঁড়ির ওপর তিনি বসে আছেন চোখ বুজে। পাশে একটি ছোট্ট টেবিলে দুটো গোল চাকতির টেপ রেকর্ডার চলছে – যেটি গত পুজোতে জার্মানি থেকে উপহার হিসেবে এসেছে নাতির কাছ থেকে। যন্ত্রটিতে তাঁর পছন্দমত গান বাজে রোজ সকালে। আজ সকাল থেকেই বেজে যাচ্ছে ভক্তিগীতি। নজরুলের পরে রজনীকান্ত তারপর রামপ্রসাদ অতুলপ্রসাদ। একের পর এক ।বালিকা আমি পাশে বসে চুপটি করে। সুরের জগতে আমিও ভেসে বেড়াচ্ছি। শরতের সকালের নরম রোদে এখনো কনকচাঁপা রঙ লেগে আছে।

আজ লক্ষ্মীপূজোকোজাগরী। সকাল থেকে চলছে এ বাড়িতে তার তোড়জোড়আয়োজন। বড়ঘরে আমাদের পূজো হবে। সে ঘর আমাদের এই সাতপুরুষের ভিটে বাড়িতে প্রথম তৈরি হয়েছিল। এ ঘরেই লক্ষ্মীর আসন ও গৃহদেবতানক্সাকাটা বিশাল কাঠের সিন্দুকযেখানে অনায়াসে পাশাপাশি কয়েকজন শুয়ে থাকতে পারে পেতলের তামার রুপোর বাসন-কোসন। পূজো, পার্বণ উৎসবের। এ ঘরের মেঝে এখনো মাটির। পিতৃপুরুষের নির্মাণকে সম্মান জানিয়ে এখনো সেই প্রথম অবস্থাতেই রাখা হয়েছে।

সেই মাটির মেঝের মাঝখানটা নিকিয়ে তকতকে করে রাখা হয়েছে । ঠিক মধ্যি খানে অনেকটা জায়গা খালি রাখা। মা কাকিমা চালের গুঁড়ো পাথরের বাটিতে গুলছেন। পুরনো নরম সাদা পরিস্কার সুতির কাপড়ের টুকরো খানিকটা নিয়ে সেই চালের গোলাতে ডুবিয়ে আঙুল দিয়ে আঁকা শুরু হোল আলপনা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেঝেতে ফুটে উঠলো এক অসাধারণ আলপনা– বেলপাতাশঙ্খলতা,পদ্মকুঁড়িকলার ছড়া দিয়ে গোল করে ঘুরে ঘুরে পূর্ণ পরিণতি পেয়েছে পদ্মপাপড়ি আর তাঁর পরাগ রেণু দিয়ে এক অনবদ্য শিল্পকলা। তাঁর চারদিকে চারটি কোণস্বরূপ নকশাকাটা কলকে। যেন পূর্ণতার শীর্ষবিন্দু।

কী এটা কাকিমা ?বালিকার সাগ্রহ প্রশ্ন

বউছত্র । মা লক্ষ্মীর আসন। উনি এসে এখানে বসবেন।

সত্যি যেন এক পদ্মপাপড়ি মেলে আসন পেতে রয়েছে মা লক্ষ্মী বসবেন বলে। পূজো তখনো শুরু হয় নি। কিন্তু ওই আলপনা দেখেই আমি আনন্দে শিহরিত হয়েছিলাম। আজও আমার কাছে লক্ষ্মীপূজো মানেই সেই পদ্ম পাপড়ি মেলা আলপনার আসন খানি।

এরপরে বহুদিন চলে গেছে। এই মুহূর্তে বসে আছি ইস্তাম্বুলের এক রেস্তোরাঁতে। ইস্তাম্বুল দর্শনে বেরিয়েছি কর্তার কাজে ঠাসা দিন গুলোর এক ফাঁকে। খাবার বলে দেওয়া হয়েছে। এখনো আসেনি। কানে আসছে মেহফিল-ই- সামা বা সুফি ধর্ম সঙ্গীতের আসরের গান। বসেছে কাছেই কোথাও। চলছে সুফিয়ানা কালাম বা সুফি সঙ্গীত। বড় করুণ সে গান। এ গানে আছে ঈশ্বরের সাথে মিলনের এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এক সুফি দরবেশ সাদা ফেযটুপিকুচি দেওয়া সাদা কুর্তা আর চুড়িদার পরে একভাবে ঘুরে ঘুরে বিভোর হয়ে নাচেন। ধীরে ধীরে ইহ সংসার যেন তাঁর সামনে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঘূর্ণায়মান এই নাচের ঘোরে। গত সাতদিন ধরে এখানে আছি। এই সুর রাস্তা ঘাটে প্রায়ই শুনি। মনের মধ্যে গেঁথে গেছে এ গানের সুর। রেস্তোরার ঠিক বাইরেদেওয়াল জোড়া কাঁচের জানলার বাইরেই কাছেই কোথাও এই মেহফিল-ই-সামা চলছে।

কী মনে হতে পায়ে পায়ে সেই জানালার দিকে এগোলাম। জানালার বাইরেই বস্পরাস প্রনালীর অতল নীল জলরাশি দুই মহাদেশের সীমানা ঘুচিয়ে বয়ে চলেছে মোহনায় । জানালার দুই পাশে সাদা দেওয়াল। সেখানে চোখ পড়তেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম। দুপাশের দেওয়ালেই দুটো বউছত্র – তাঁর চারপাশে সেই কোণবিন্দু স্বরূপ নকশাকাটা কলকে ।হুবহু এক। সেই বেলপাতাসেই শঙ্খলতা সেই পদ্মপাপড়িসেই পরাগরেণু। অবশ হয়ে গেলাম। কানে বাজছে মেহফিলসামার সুর। মুহূর্তে ফিরে এলো রজনীকান্ত রামপ্রসাদের সুরে ভেসে যাওয়া বহুদিন আগের সেই লক্ষ্মী পূজোর দিনটি। শুনতে পাছি কোন সুরনজরুলরজনীকান্ত না সুফিআলাদা করতে পারছি না ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত